বাঙালীর আর যাতেই দুর্ণাম থাকুক সে যুদ্ধবাজ নয়।কথায় আছে--- ভোজনে আগে রণে পিছে। তবেই জানবে বাঙ্গালী আছে।।দুর্গার মত বিশুদ্ধ রণংদেহি যুদ্ধদেবী বাঙালীর কাছে ঘরের মেয়ে অবলা উমা। মহিষমর্দিনী সিংহবাহিনী সোয়ামী সোহাগিনী।আদরিণি কন্যে। স্বামীর সংসারে দশভূজা। বারো মাস খেটে খুটে নিজেই যেন সংসারাসুরের বাণে বিদ্ধ।তারপর স্বামী গুলি ডান্ডা গাঁজা খোর। সংসার চালাবে কি! নিজেরই পেটই চালাতে পারেনা।সেটাও দেখভাল করতে হয়। উমাকে ।সোমবছর পতিগৃহে থেকে মা আমার এই তিন দিনের জন্য বাপের বাড়ি আসে।বাবা মার তখন আহলাদের সীমা নেই।মেয়ে যা খেতে ভালোবাসে তার আয়োজনেই তারা নিয়োজিত। এই কারণে অধিকাংশ বনেদি বাড়িতে দুর্গার ভোগ বিষয়টি লক্ষনীয়। এই ভোগের মধ্যে একদিকে যেমন রন্ধনশিল্পের পরম্পরাটি টিকে রয়েছে তেমনি তার দেবদেবী ভাবনার বিশেষ বৈশিষ্ট্যটি নজর কাড়ে।
কাটোয়ার হাড়ি বাড়ির দুর্গা ।ভোগের মধ্যে লাগে কাঁচা থোঁড়।এ নিয়ে অবশ্য নানা মুনির নানা মত।কেউ বলেন ঠাকুরের নৈবেদ্য যোগাড় করার ক্ষমতা ছিল না এই অন্ত্যজদের।অথচ হাড়ির ঝি চণ্ডী।সুতরং ওই সস্তার থোঁড় দিয়েই দেবীর ভোগ।পরে অনেক বনেদি বাড়ির পুজোয় দেখেছি যেমন কালনায় ভাতারের মাধপুরে দেবীর নৈবেদ্যর অন্যতম উপকরণ এই থোঁড়।এমনি কি দেবীর কাছে অনেক জায়গায় এই থোঁড় বলিও দেওয়া হয়।
রণরঙ্গিনী সিংহবাহিনী দুর্গার অন্যতম উপাসক ভট্টাচার্য পদবীর ব্রাহ্মণরা। ক্ষেত্রসমীক্ষায় দেখেছি অধিকাংশ ভট্টাচার্যদের বনেদি দুর্গা তান্ত্রিকমতে পুজো হয়।পশুবলি হয় আকছার ।এমনকি তাদের বিয়ে থা অন্নপ্রাশনে আনন্দকালী নামে কালীঠাকুর আসে।এদেরি পূজিত দুর্গা ঠাকুরে দেখেছি দেবীর ভোগে এক্কেবারে ঘরোয়া খাবার।কচুর তরকারী শাক আর কাঁচাতেঁতুলের টক।এর নাম সাবডা ভোগ।
দেবীর আবার পরম প্রিয় বউদের হাতে তৈরি ভাজা আর পোড়া।তেলাভাজা বাঙালীর অতিপ্রিয় খাবার। চপশিল্প নাকি আমাদের ভবিষত।সুতরাং ভাজাপোড়াই বা বাদ যাবে কেন?অনেক বনেদি বাড়ির দুর্গার আবার প্রিয় খাবার পুঁই দিয়ে ইলিশ মাছের চচ্চড়ি।বাড়ির কর্তাদের জিগাইলাম----
আপনারা কি বাঙ্গলাদ্যাশ হইতে আইস্যাছেন?
কত্তামশাই একগাল হাইস্যা কইলেন --ঠিক ধইর্যাছেন আমাগো দ্যাশ অইলো ছিহট্ট মানে ছিলেট। ইলসামাছ দেবীর খুবই প্রিয়।
ভাতারের পাশে মাহাতা গ্রামের দুগগা ঠাকরুণটি নেহাতই গাঁইয়া।ভিজেভাত আর চ্যাংমাছের ঝোল না হলে তিনি রেগে কাঁই । পূর্ববঙ্গের স্মৃতি বাহিত অনেক দুর্গাপুজোয় আবার কাঁচা আনাজই দিয়ে হয়।এতে আবার ঘটিরা যা খোঁচা মারে তা না বলাই ভালো। আর নিরামিষে মাংসটা নিয়ে একটু বলি।বিরোধাভাস ভাববেন না।পাঁঠার খাঁটি মাংস।গুপ্তকবি বেঁচে থাকলে গুণটি বর্ণনা করে দিতেন।পিঁয়াজ রসুন ছাড়া গব্যঘৃত সহযোগে আদা আর জিরের এমন কেরামতি কে জানত দেবীর এই পলান্নভোগ না খেলে।
এখন চোখ না মুদেও দেখতে পাই। বাসার সামনের খোলা মাঠ জুড়ে কুয়াশা। অামার ঘরের সাথে লাগানো ছোট জানালার পাশের গাছটি চুপ করে ভিজছে শরত শিশিরে। তখনো অালো ফোটেনি।
জয় মা ! জয় মা!!
এখন চোখ না মুদেও দেখতে পাই। বাসার সামনের খোলা মাঠ জুড়ে কুয়াশা। অামার ঘরের সাথে লাগানো ছোট জানালার পাশের গাছটি চুপ করে ভিজছে শরত শিশিরে। তখনো অালো ফোটেনি।
সবার অাগে মা জেগে গেছেন। মা না জাগলে অালো হবে কি করে? এই ভোরেও মা স্নান সেরে খুব সাধারণ শাড়ীতে তাঁর দশহাত খুলতে শুরু করেছেন। একহাতে মাটির প্রদীপ। এক হাতে ঘটি করে জল নিয়ে মুছে দিচ্ছেন মাটি। অার একহাতে মা পুজোর অাসন সাজিয়ে নিয়ে সবাইকে ডাকছেন, উঠতে হবে বলে।
বাবাও এসে বসেন খাটে। দিদি মায়ের পিছু পিছু। অামি অাধো ঘুমে হালকা চাদর জড়িয়ে চোখে মুখে জল দিতে দিতে শুনি, অাশ্বিনের শারদপ্রাতে দেবীর অমল কমল মুখখানি দিয়ে শুরু হয়ে গেছে মহালয়া। বাণী বাবু র কথা পঙ্কজ মল্লিকের সুর অার বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের অসাধারণ মিলনে মূর্ত হয়ে উঠছে সকাল। তিনি যখন জাগো জাগো মা বলে ডুকরে কেঁদে উঠতেন চোখ জলে ভিজে যেতো মার। তখন নাবুঝলেও এখন নিজের চোখের জল বলে দেয় কি এই অশ্রুর মানে।
মহালয়ার এই অাগমনী বুকের তলা সজল করে দিয়ে যায়। মহারাজ কর্ণ মৃত্যুর পর তাঁকে খেতে দেয়া সোনা জহরত হীরে দেখে বিস্মিত হয়ে ভগবানের কাছে নালিশ করেছিলেন এই বলে, এগুলো কি কেউ খায়? না খেয়ে বাঁচতে পারে? উত্তরে ঈশ্বর জানিয়েছিলেন যা তুমি মানুষ কে দিয়েছিলে তাইতো অামি তোমাকে ফেরত দেই বৎস। তুমিতো কাউকে খাদ্য দাওনি। তখন কর্ণ অাবেদন করেছিলেন তাঁকে একটি সপ্তাহ দেয়া হোক। ফিরে গিয়ে যেন মা বাবা সহ প্রয়াত বন্ধু স্বজন সকলের জন্য তিনি তা করতে পারেন। জীবদ্দশায় মাতৃ পরিচয়হীন তাঁকে সে সুযোগ দেয়ার ভেতর দিয়েই শুরু হয় মহালয়ার তর্পণ।
অাজ মা বাবা কেউ নেই অামার। দূরদেশে ছোট কুশিতে একফোঁটা জলে অামি তাঁদের তৃষ্ণা র নিবারণ করতে পারবোনা জেনেও বলি, এসো মা। সেই হিমহিম শরতের টিনের চালার ঘরে অাবার মৃদু অালোয় বেজে উঠুক,
বাজলো তোমার অালোর বেণু....
শুভ মহালয়া।
বাজলো তোমার অালোর বেণু....
শুভ মহালয়া।