অষ্টক গান সম্পর্ক জানেন কি? লোক সংস্কৃতি এই ধারা কি সত্যি লুপ্তপ্রায়??
নীল ষষ্ঠী' বা নীল পুজো' বাংলার হিন্দুসমাজের
এক লৌকিক উৎসব, যেখানে শিবের বিয়ে দেওয়া হয়। চৈত্রসংক্রান্তির
চড়ক উৎসবের আগের দিন অনুষ্ঠিত হয় নীল ষষ্ঠী পুজো।
মহাদেব শিবের এক নীলকণ্ঠ । সেই নীল
বা শিবের সঙ্গে চণ্ডিকা
বিয়ে উপলক্ষ্যে লৌকিক আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয় এই পূজায়। পৌরাণিক কাহিনি অনুসায়ী দক্ষযজ্ঞে সতীর দেহত্যাগের পর সতী পুনরায় নীলধ্বজ রাজার বিল্ববনে সুন্দরী কন্যারূপে আবির্ভূত হন। রাজা তাঁকে নিজ
কন্যারূপে লালন-পালন করে শিবের সঙ্গে বিয়ে দেন। নীলপূজা শিব ও নীলাবতীরই বিবাহ-অনুষ্ঠানের
স্মারক।
নীল পুজোতে শিবকে নিয়ে ,নীলসন্ন্যাসীরা ও শিব-দুর্গার সঙেরা গান করতে করতে বাড়ি বাড়ি ঘােরান এবং ভিক্ষা সংগ্রহ করেন। এ সময় তাদের মুখে শােনা যায় যে বিশেষ ধরনের গান
তা ‘নীলের গান' বলেই লোক মুখে পরিচিত। তবে এই নীলের গান হল-অষ্টক গান'।
চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন সারাদিন উপােস করে সন্তানবতী হিন্দু মেয়েরা । বিকেলে তারা শিবের মাথায় জল ঢালেন । নীলের ব্রত’ শুনে সন্তানের
কল্যাণার্থে প্রদীপ জ্বালিয়ে শিবপুজো করে
উপবাস ভাঙ্গে তারা। তবে নিম বা বেল কাঠ দিয়
শিবের মূর্তি তৈরি হয়। চৈত্র সংক্রান্তির বেশ আগেই
নীল বা শিবকে মণ্ডপ থেকে নীচে নামানাে হয়। নীলপূজার আগের দিন অধিবাস; গভীর রাতে হয় হাজরা পূজা।হাজরা পূজায় শিবের চেলা বা ভূত-প্রেতের দেবতাকে পােড়া শােল মাছের ভােগ দেওয়া হয়। বিয়ে উপলক্ষে সকল দেবতাকে আমন্ত্রণ করা হয়।পরেরদিন
নীলপূজার সময় শিবকে গঙ্গাজলে স্নান করিয়ে নতুন
লালশালু কাপড় পরিয়ে অন্ততপক্ষে সাতটি বাড়িতে ঘােরাতে হয়।নীলসন্ন্যাসীরাও লাল কাপড় পরে পাগড়ি
মাথায়, গলায় রুদ্রাক্ষমালা ও হাতে ত্রিশূল নিয়ে
শিবের সঙ্গে করে এই মিছিল করে। এই মিছিলের
দলপতিকে ' নীল পাগোল' বা "বালা" বলা হয়। এদের সাথে থাকে ঢাক-ঢোল, বাঁশী বাজনদারের দল । সঙেরা শিব-দুর্গার সাজে । মহিলারা ঘরের উঠানে আল্পনা দিয়ে নীলকে আহ্বান করে বরাসনে বসিয়ে তার মাথায় তেলসিঁদুর পরিয়ে দেন। এরপর নীলের গান শুরু হয়:
যেমন
"শুন সবে মন দিয়ে হইবে শিবের বিয়ে
কৈলাসেতে হবে অধিবাস।
(ও) তাতে নারদ করে আনাগোনা কৈলাসে বিয়ার ঘটনা
বাজে কাঁসী বাঁশী, মোহন বাঁশরী।"
"(ও) নারদ চলল গিরি রাজের গৃহেতে।
আর একদিনেতে শূলপাণি, নারদকে বলেন বাণী
শুনো নারদ শুনো আমার সাধ,
আমি দুই পাশে দুই বালিশ দিয়ে, মধ্যিখানে থাকি শুয়ে
উশিপুসি করে কাটাই রাত।।
(ও) নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।
আর ওই শিব কয় কৈলাসে যেয়ে, দেখে এসেছি মেয়ে
শীঘ্র করো বিয়ের আয়োজন,
(ও) নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।
চলিলেন নারদ মুনি, চলিলেন নারদ ধনি
উপনীত গিরি পুরে যেয়ে।
কইলেন মেনকা রানী, আইলেন নারদ মুনি
দেখা পেয়ে এল মুনির ঠাঁই।।
(ও) নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।
শোনো ওগো গিরি রাজা, হইবা আমার আজা
জামাই তোমার হবে দিগম্বর।।"
বিয়ের ঘটক ভাগিনেয় নারদ মুনির কাছে শিব আর্তি জানান,
"ভাইগনা যদি উপকারী হও।
তবে বিয়া দিয়া আমার প্রাণ বাঁচাও।।"
বিয়ের পর নীলের গানে থাকে সংসারী হর-পার্বতীর কথা, শিবের কৃষিকাজ, গৌরীর শাঁখা পরা প্রভৃতি এবং ভিখারি শিবের সঙ্গে অন্নপূর্ণা শিবানীর দ্বান্দ্বিক সহাবস্থানের কাহিনি। গানের প্রথম অংশ দলপতি বালারা এবং পরবর্তী অংশ অন্য নীলসন্ন্যাসীরা গেয়ে থাকেন।
গানের শেষে সন্ন্যাসীদের চাল-পয়সা, ফল প্রভৃতি ভিক্ষা দিয়ে থাকেন বাড়ির মেয়েরা।।
বাংলার লোক সংস্কৃতির জনপ্রিয় এই অষ্টক গান হারিয়ে যাচ্ছে । না হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্রত গুলো সাথে এই সংস্কৃতি হয়তো এখন গুরুত্ব হারিয়েছে কিন্তু এখনো হারিয়ে যায় নি। একে সঠিক লালন পালন করার প্রয়োজন।
অষ্টক গান মূলত গ্রাম বাংলাতে চৈত্র সংক্রান্তি ও গাজনের সময় বিশেষ করে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এমনটা কি? মূলত নৃত্য ও গীত এর মাধ্যমে রচিত হয় অষ্টক গানে অনেক সময় ভগবান শ্রী কৃষ্ণ ও রাধারাণীর লীলা তুলে ধরা হয়।শিল্পীরা কেউ শ্রীকৃষ্ণ, রাধারানী,নিমাই, অষ্টসখী, মাতা যশোদা,সেজে তাদের নৃত্য ও গীতের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেন অষ্টক গান।
এই অষ্টক গানে নৌকাবিলাস, নিমাই সন্ন্যাস, কৃষ্ণ বেহুলা লখিন্দর ইত্যাদি পালা গুলি দেখানো হয় নৃত গীত সহকারে।
অষ্টক গীত শব্দটা এসেছে বোধহয় শ্রী কৃষ্ণের অষ্টপ্রহর এর লীলা থেকে । অথবা প্রতি দলে আট জন মিলে নৃত্য গীত করে বলে। কিংবা শ্রী কৃষ্ণে অষ্ট সখী নিয়ে লীলা করতেন সেই অনুযায়ী এই নৃত গীত পালা অষ্টক গান বলা হয়।
অষ্টক গান লোকসংস্কৃতি অঙ্গ তাই নৃত খুব সাদামাটা জৌলুস বিহীন । কিন্তু খুব আবেগপ্রবণ, মন মুগ্ধকর যা হৃদয় স্পর্শ করে যায়।অষ্টক গীত নৃত্যে ঢোল, করতাল, ঘুঙুর, হারমোনিয়াম,বাঁশি, ইত্যাদি ব্যাবহৃত হয়।