Wednesday, 14 September 2016

ভুমি

আজ সিঙ্গুরে মঞ্চের কাছের ভিড়ের দমবন্ধ পরিবেশ থেকে একটু হালকা হতে আমি, Amalendu Sarkar, আর Sriman Chakraborty উল্টোদিকে হাঁটা শুরু করেছিলাম, কাতারে কাতারে লোক, তাদের উল্টোমুখে। আমাদের মতো অনেকেই তাই। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে খানিকটা যেতে একজায়গায় দেখলাম, টাটাদের পাঁচিলের ভাঙা অংশ দিয়ে পিল পিল করে লোক ঢুকে পড়ছে ওই হাজার একর জমিতে। আমরাও ঢুকে পড়লাম। :D
ঘুরে দেখলাম -- বাতিল কারখানা। কারখানার শেড। বছর দশেক আগেও যে চাষজমি ছিল এগুলো, না বলে দিলে কেউ বুঝবে না। আগাছা। আর কাশ ফুল। জলাশয়। দুটো তিনটে বুলডোজার আগাছা তুলছে। আর বুলডোজারগুলোকে তাড়া করেছে বকের দল। গত আট বছর প্রায় মনুষ্য বর্জিত এলাকা। প্রায়, কারণ গরু ছাগল চড়াতে আসত কেউ কেউ। এখনও আসছে।
কাটোয়া, গুড়াপ, বর্ধমান, অম্বিকা কালনা -- সব জায়গার থেকে চাষিরা যারা এসেছে সিঙ্গুর সমাবেশে, তাদের মূল আকর্ষণ এই টাটার পাঁচিলের ভেতরের জমিটা। কারখানার শেড। "এখানে আর চাষ করা সম্ভব" কি না। এমনকি "আহারে কারখানাটা" বলার লোকও কিছু। সবাই চাষি। একজন বলল, 'এখানে শিল্পও করা যেত, টাটার বদলে অন্য কাউকে দিত'। আর একজন বলল, 'দিদি বলুক, সারা বাংলা থেকে ১০০ দিনের কাজের লোক এনে এই জায়গা আগের মতো করে দিক।'
মঞ্চের কাছাকাছি এলাকায় তেল চুকচুকে প্রমোটার মার্কা চেহারার লোকের ভিড়ভাট্টা দেখে খারাপ লাগছিল। দম আটকে আসছিল। মন ভরে গেল পাঁচিল টপকাতে পেরে। আর এখানেও এত লোক দেখে। দুপুর গড়িয়ে গেল। লোক আরও বেড়ে গেল পাঁচিলের মধ্যে। বৃষ্টি এল। কয়েক কিলোমিটার দূরে মঞ্চে মমতার ভাষণ শুরু হল, বোঝা গেল। কিন্তু কথা শোনা যাচ্ছিল না। এখানে অবশ্য অন্য আকর্ষণ। অতি উৎসাহী কেউ কেউ টাটার কারখানার শেড-এ ইঁটও মারছিল, আর চরাচর কাঁপিয়ে শব্দ তার।
ন'বছর আগে আমাদের চোখের সামনে পাঁচিল না দেওয়া একটা জায়গা পাঁচিল দেওয়া নিষিদ্ধ এলাকা হয়ে গিয়েছিল। কাগজ, ম্যাগাজিন, প্যাম্পলেট-এর এম্পিরিক্যাল কাজ করার সময় নিজের অনুভূতি জানানোর জায়গা বড়ো একটা থাকে না। এলাকার ক্ষেতমজুর কী বলল, ভাগ চাষি কী বলল, প্রান্তিক চাষি কী বলল, মধ্য চাষি কী বলল, মা কী বলল, ছেলে কী বলল, মেয়ে কী বলল, ঘোষ কী বলল, দাস কী বলল, রুইদাস কী বলল, মালিক কী বলল, মৈতি কী বলল -- সে সব কথা লিখেছি তখন। ঠিক করেছি। করাই দরকার।
ন'বছর আগে আমার খুবই খারাপ লেগেছিল টাটার পাঁচিল উঠে যাওয়ায়। কেউ বাধা না দেওয়ায়। কারণ অনেক আছে, কারণের কথা থাক।
আজ সেই পাঁচিলের ভেতর অবাধে দলে দলে ঘুরে বেড়াতে পেরে, টাটার কারখানার বাতিল শেড আর লন দেখে মারাত্মক ভালো লেগেছে।
সাআলা!

Thursday, 1 September 2016

সিঙ্গুর

সুপ্রিম কোর্ট ও মমতা ছাড়াও সিঙ্গুরের জয় আরো অনেক কিছুর। সিঙ্গুরের জয় অধিকার আন্দোলনের। সিঙ্গুরের জয় চাষবাসের। সিঙ্গুরের জয় গর্বিত, গোঁয়ার, গাঙ্গেয় বাংলার চাষির। সিঙ্গুরের জয় ধৈর্য্যের। সিঙ্গুরের জয় গ্রামবাংলা ও শহরবাংলার কৃষিপ্রেমের। সিঙ্গুরের জয় সংসদীয় পন্থার। সিঙ্গুরের জয় প্রয়োজনীয়, কারণ সিঙ্গুরে হার কর্পোরেটের।
ব্যস্‌ এটুকুই।
কারণ সিঙ্গুরের জয় একটি ফয়সালা হয়ে যাওয়া লড়াই-এর। এবং সেই ফয়সালা সিঙ্গুর একা করেনি। করার কথাও নয়। সেই ফয়সালা করেছে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, পস্কো, রায়গড়, শালবনী (লালগড়), হরিপুর ......। জমি অধিগ্রহণ আইনটাই বাতিল করে দিয়েছে নীতিনির্ধারক মুষ্টিমেয়রা। বদলে এসেছে জমি কেনা। আর ছুটছাট কিছু পড়ে থাকলে সেটুকু অধিগ্রহণ। নয়া কায়দা, যা অনেক বেশি বাজার-সম্মত। ক্ষতিপূরণের বদলে দরদাম করা বিক্রয়মূল্য। আধিপত্য-সম্মতির সূক্ষতর রূপ।
মানুষের আরো ভালোভাবে বেঁচে থাকার লড়াই তো খেলা বা ভোট নয়। এমনকি আন্দোলনও নয়। তাই এর জয় পরাজয় হয় না। ফয়সালা হয়। এক দশক আগের চাষাবাদ করে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকা মানুষের লড়াই সাথি হিসেবে পেয়েছে প্রায় এক দশক ধরে চলতে থাকা এবং চলতেই থাকা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা-কে। প্রকল্পগুলির গুটিয়ে যাওয়ার পেছনে জনপ্রতিরোধ একটা কারণ। আরেকটা কারণ এই মন্দা।
কিন্তু চাষাবাদের বিপদটি গভীর হয়েছে, অথবা গভীরতর বিপদটা ওপরে উঠে এসেছে। সার, বিষ, জল বহুল চাষ আর একেবারেই লাভজনক থাকছে না। চাষার ছেলে সত্যিই আর চাষা থাকতে ডরাচ্ছে। চাষ-লেবার সরে যাচ্ছে অন্যত্র, যেখানে রোজগার বেশি। পড়ে থাকছে জমি। পশ্চিম ভারতে শিক্ষা চাকরিতে সংরক্ষণের সুবিধা চাইছে উচ্চবর্ণ চাষি।
তাই সিঙ্গুরের জয় সুখস্মৃতি নিশ্চয়ই। ছেলেমেয়েদের শোনানোর মতো আখ্যান। কিন্তু পাথেয় নয়। কারণ লড়াইটা বদলে গেছে।