কোলকাতার গহনা বাড়ি চেনেন??

বামাচরণ ভড় ঠাকুরবাড়ি গয়না বাড়ি হিসেবে পরিচিত।উত্তর কলকাতার নীলমণি সরকার লেনে বামাচরণ ভড়ের বসতবাড়িকে ব্রজকিশোর ঠাকুরবাড়ি বলে চেনে । সরু গলি, বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই, কী অপূর্ব স্থাপত্য কারুকার্য অপেক্ষা করছে এই বাড়ির ভেতরে।
ইংরেজ আমলে বামাচরণ ভড় এক সফল ব্যবসায়ী। বামাচরণের জন্ম ১৮৫১ সালে। তিনি কলকাতার বাসিন্দা ছিলেন না। ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতা তখন উদীয়মান নগরী, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের পীঠস্থান হয়ে যখন ওঠেছে। তখন এ শহরে বামাচরণ এসে ছিলেন এক ভাগ্যান্বেষী হিসেবে। দরিদ্র পরিবারের সন্তান, পেটের দায়ে এসেছিলেন কোলকাতায়। কলকাতায়, আর দশজন শ্রমিকের মতো তিনি কাজ শুরু করেছিলেন।
কলকাতায় এসে প্রথমে বামাচরণ এক পোশাক তৈরির কারখানায় শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন । এই সংস্থা মূলত ইওরোপীয় পোশাক তৈরি করত। অসম্ভব বুদ্ধিমান ও পরিশ্রমী বামাচরণ ছিলেন। তিনি ব্যবসার যাবতীয় বিষয় করায়ত্ত করলেন। পরে তিনি কলকাতার এক পোশাক প্রস্তুতকারক ইংরেজ কোম্পানির অংশীদার হয়ে বসলেন। আর এই কোম্পানীর মালিক বিলেতে ফিরে গেলেন, পুরো ব্যবসা মালিক হয়ে বসেন বামাচরণ।
দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে ইংরেজদের বোয়েরের প্রথম যুদ্ধ চলেছিল,২০শে ডিসেম্বর ১৮৮০ থেকে ২৩শে মার্চ ১৮৮১ পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় যুদ্ধ চলেছিল,১১ই অক্টোবর ১৮৯৯ থেকে ৩১শে মে ১৯০২ পর্যন্ত।এই যুদ্ধে জড়িয়ে গেল এক বাঙালির ব্যবসায়ী বামাচরণ ভড় নাম।বোয়েরের যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী ইংরেজ সৈন্যদের সামরিক পোশাক সাপ্লাই করেছিলেন তিনি।
তৎকালীন ঔপনিবেশিক কলকাতায় মতিলাল শীল,গোকুল মিত্র, নরসিংহ দাঁ-এর মতো কৃতি বাঙালি ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছিলেন,বামাচরণ ভড়। তিনি সামরিক পোশাকের ব্যাবসা নাম,যশ,খ্যাতি করেছিলেন।ব্যাবসা যখন মধ্যগগনে, বামাচরণ ভড় তার নীলমনি সরকার লেনের বসতবাড়িতে স্থাপন করলেন গৃহদেবতা রাধা মাধবের মন্দির। তাঁর মতে কৃপায় আজ এই তার এই বিশাল প্রতিপত্তি,তাঁকে তিনি কিভাবে অস্বীকার করেন।

যাইহোক ১৮৬৫ সালে তৈরি লাল ইটের বাড়িটি দোতলা। তৎকালীন প্রচলিত জমিদার রীতিতে ইট, কড়িবরগা, চুন-সুরকি নির্মিত বাড়িটি দেড়শ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় অবিকল।
দেড়শো বছর অতিক্রান্ত লাল রঙা বাড়িটার ভিতরে প্রবেশ করলেই বিস্মিত হতে হয় আজকে ও।বাইরে থেকে বিশেষত্বহীন বহিরঙ্গের বাড়িটির অন্দরের শোভা বর্ধন করেছে গথিক আর মুঘল স্থাপত্যরীতির সংমিশ্রণে তৈরি একাধিক আর্চ। বিম আর কলাম ধরে রেখেছে বাহারি পেনডেন্টিভ। খড়খড়িযুক্ত বারান্দা, তাতে লোহার রেলিং আর মাথায় আর্চ ছাদের পাঁচিলের কারুকার্যও অনবদ্য। ছাদের আর্চগুলিতে দেখা যায় আংটায় আটকানো পর্দার ঝালরের প্যাটার্ন। প্রাচীনত্বের স্পর্শ এখনো ধরে রেখেছে কাঠের রেলিং-যুক্ত মার্বেল পাথরের সিঁড়ি।।এক অসাধারণ স্থাপনা মুগ্ধ হতে বাধ্য করবে সবাইকে ।
এই বাড়ির বাহারি নাম গয়নাবাড়ি।সেই কোন কালে হয়তো বাড়ির দেওয়ালে,খোদিত নক্সার প্রাচুর্যতার কারণেই এহেন নাম ভালোবেসে রেখেছিল মানুষরা ।লোকমুখে গয়না বাড়ি নামটি পরিচিত হয় পরে।
