Thursday, 4 August 2016

জন্ম দিন

‘জন্মদিন’
শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, ভারতের মানচিত্রেরও একেবারে প্রান্তিক একটি গ্রামের হাইস্কুলে শিক্ষকতার কাজে বহাল হয়েছিলাম আজ থেকে দশবছর আগে। অর্থনীতির সাম্প্রতিক মানদণ্ডে যাদের ‘ধনী’ বলা যায়, সেরকম কোনও পরিবার সেই গ্রামে সেদিনও ছিল না, আজও নেই। এদেশে ‘ধনী’-রা (যাঁরা নিজেদের আহ্লাদ করে মধ্যবিত্ত বলে থাকেন) গ্রামে থাকেন না। গ্রামে অবিশ্যি তাদের ‘দেশের বাড়ি’ থাকে, যেখানে তাঁরা কালেভদ্রে যান। গ্রামের দিকে সচরাচর দশটি পরিবারের মধ্যে সাতটিই হয় ‘দরিদ্র’, বাকি তিনটিকে বড়জোর ‘সচ্ছ্বল’ বলা চলে।
তা সেরকমই একটা ‘হঠাৎ সচ্ছ্বল হয়ে ওঠা’ পরিবারের শিশুর জন্মদিনের অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ পেয়েছিলাম চাকরি-জীবনের সেই প্রথম পর্বে। পরিবারের কর্তার হঠাৎ পাওয়া একটি ছোটখাটো সরকারি চাকরি তাঁর মাটির বাড়িটিকে সদ্য পাকা করেছে। সেই ‘দালানেরই’ ছাদে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল ‘বার্থডে পার্টি’। ইতিপূর্বে কখনো সেই শিশুটির জন্মদিন ওভাবে ‘সেলিব্রেট’ করা হয়নি। করার সামর্থ্য ছিল না তাদের।
‘উন্নয়ণ’ বলতে আমরা, তৃতীয় বিশ্বের লোকজন যা বুঝি, তা কিন্তু প্রথম বিশ্বের উন্নয়ণের উচ্ছিষ্ট ছাড়া কিছুই নয়। ব্যাপারটা আবার ভারতের গ্রাম-শহর সম্পর্কেও একইভাবে প্রযোজ্য। ঠিক যেমন আমাদের দেশের কোনো বড় শহরে অ্যাম্বুলেন্সের আগে পৌঁছয় পিৎসার ডেলিভারি বয়, তেমনি গ্রামগুলোতে পরিশ্রুত পানীয় জলের অনেক আগেই পৌঁছে যায় পেপসির ক্রেট, প্রাথমিক শিক্ষার আগে পৌঁছয় ডিশ টিভি। উন্নয়ণের সেই ‘উচ্ছিষ্ট’-ই সেদিন পৌঁছে গিয়েছিল গ্রামের সেই দালানকোঠার ছাদে -- একটা ঢাউস ‘বার্থডে কেক’-এর আকারে। রাতারাতি ধনী হয়ে যাওয়া পরিবারের শিশুটি সেই কেক কাটছিল। আর আমি দেখছিলাম হ্যাজাকের আলোর সেই বৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা কালোকুলো চেহারার বাচ্চাকে। জুলজুলে চোখে ওরা তখন তাকিয়ে ছিল সেই বাহারি কেক-টার দিকে, ধারালো চকচকে ছুরিটার দিকে...। দুবেলা পেটপুরে খেতে না পাওয়া, অপুষ্টিতে ভোগা, সচ্ছ্বলতার আশীর্বাদ-বঞ্চিত সেই বাচ্চাগুলো সেদিন ওই বাড়িতে নিমন্ত্রিত ছিল, শিশুটির বন্ধু হিসেবে। ওদের সেই লোভী জুলজুলে চোখগুলো আমাকে প্রায় তিরিশ বছর আগের এক স্মৃতির দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।
তিরিশ বছর আগে, আজকের এই কলমচি যখন নেহাৎ-ই পাঁচ-ছ বছরের বালক, তখন পাড়ার এক রীতিমত ধনী পরিবারে ‘জন্মদিনের নেমতন্ন’ জুটেছিল তার। অর্থনৈতিক শ্রেণিবৈষম্য ব্যাপারটা শিশুদের মগজে সহজে ঢোকে না। তাই হয়তো সেই পরিবারের শিশুটির আবদারে বাধ্য হয়ে তার বাবা-মা তার এমন কয়েকটি ‘বন্ধুকে’ নিমন্ত্রণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, যাদের সঙ্গে তাঁদের ‘ঠিক মেলে না’। সেই ‘দায়ে পড়ে আমন্ত্রিত’ শিশুর দলের একজন হয়ে সেদিন সন্ধ্যা-নাগাদ মহানন্দে হাজির হয়েছিলাম বন্ধুর জন্মদিনের উৎসবে। সেখান থেকে অবশ্য আমাদের খানিকটা লুচি-মাংস আর দুটো মিষ্টি খাইয়ে এবং ‘কেক কাটতে দেরি হবে’ জানিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিদায় করে দেওয়া হয়েছিল। পরদিন সেই বাড়ির বাইরের আস্তাকুঁড়ে রকমারি সুখাদ্যের উচ্ছিষ্ট দেখে বুঝতে পেরেছিলাম, একটা জন্মদিনের আড়ালে আরও কতরকমের জন্মদিন লুকিয়ে থাকতে পারে।
আমার একমাত্র সন্তানটির আজ প্রথম জন্মদিন। তাই, এটা তার বাবা-মায়ের একান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত যে, তার জন্মদিন উপলক্ষ্যে কোনোদিন কোনো ‘বার্থডে পার্টি’ হবে না। কেউ নিমন্ত্রিত হবেন না। একান্ত-আত্মীয় ব্যতীত কারো কাছ থেকে কোনো উপহারও গৃহিত হবে না। এ নিয়ে যদি কোনোদিন আপন সন্তানেরই অভিমানী প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, সেদিন না হয় তাকে বুঝিয়ে বলা যাবে যে -- শুধুমাত্র জন্মগ্রহণ করার মধ্যে এমন কোনো কৃতিত্ব নেই যার জন্য লোকজন ডেকে ভূরিভোজ করাতে হবে (বা দলবল জুটিয়ে মদ্যপান করতে হবে)। জন্মদিন ব্যাপারটা একান্তই ব্যক্তিগত (বড়জোর পারিবারিক) খুশির দিন, বৈভব প্রদর্শন করে অপরের মুখ ম্লান করে দেবার দিন নয়।
ওকে এও বলা যেতে পারে যে, শুধু দীর্ঘজীবি হয়ে পৃথিবীর বোঝা বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই। যদি পারো নিজেকে সেই যোগ্যতায় উত্তীর্ণ কোরো, যাতে তুমি নও, লোকে তোমার জন্মদিন পালন করে। পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষেরই জন্মের একটা দিন আছে, কিন্তু জেনে রেখো, ‘জন্মদিন’-টা অর্জন করতে হয়।

No comments:

Post a Comment