মাকাল ঠাকুর সাধারনত সুন্দর বন অঞলের মৎস্যজীবি ও জেলে সম্প্রদায়ের পূজিত দেবতা। আবার হাওড়া জেলায় গ্রামাঞ্চলের মৎস্যজীবীরা মাকাল ঠাকুরকে মাকালচণ্ডী নামে পূজা করেন। অতি প্রাচীন কাল থেকেই পুকুরে মাছ চাষ করতে যাওয়ার আগে মাকাল ঠাকুরের পুজো দেওয়ার রীতি আছে । প্রচলিত পালাগানের শিবের চাষ পালায় , দেখা যায় মহাদেব ও গৌরী দেবীকে তারা ধানক্ষেতের জমা জলে মাছ ধরছেন, এবং সেই মাছ মাথায় করে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করছেন। অনুমান করা যায়, মৎসজীবি সম্প্রদায় হরগৌরীকে জেলেদের দেব-দেবী রূপে কল্পনা করে পুজো করেন।
মাকাল ঠাকুরের কোনও মানুষের মতো মূর্তি করা হয় না। একটি অথবা একসঙ্গে দুটি ছোট মাটির স্তূপের করে পুজো করা হয়। পুকুর থেকে আঠালো পাঁকমাটি অল্প নিয়ে ছয় ইঞ্চি লম্বা ও দু তিন ইঞ্চি ব্যাস যুক্ত স্তূপ তৈরি করা হয়। তারপর আঙ্গুলের চাপ দিয়ে নাক, চোখ, মুখ তৈরি করে পূজার বেদীতে বসানো হয়। যেখানে জোড়া প্রতীকে পুজো করা হয় সেখানে কিন্তু দু’টি প্রতীকের মধ্যে স্ত্রী দেবতা-পুরুষ দেবতা ভেদভেদা করা হয় না দুটি প্রতীককেই দেবতার মূর্তি মনে করা হয় ।তবে সুন্দরবন অঞ্চলের মৎস্যজীবীরা বিশালাক্ষী ও খাল-কুমারী সহ কয়েকজন দেবীরও পূজা করেন। খাল শব্দ থেকে ও মাখাল শব্দ আসতে পারে।
মৎস্যজীবীরা যে জলাশয়ে মাছ ধরতে সেই জলাশয়ের তীরে এঁর পূজা করেন। সেখানে কয়েক গজ পরিমাণ জমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে সমতল করে নেওয়া হয়। সেখানে মাটি দিয়ে তিনটি থাকযুক্ত ছোটো বেদি বা স্থণ্ডিল তৈরি করা হয়। বেদির মধ্যে মাটি স্তূপ বসানো হয়। এই বেদির চার কোণে চারটি তিরকাঠি পুতে , লাল সুতো দিয়ে বেদির একটি আবরণ বা বেড়া তৈরি করা হয়। প্রতীকের উপর লাল রঙের চাঁদোয়াও টাঙানো হয়। এ পূজায় ব্রাহ্মণ পুরোহিতের , কোনও মন্ত্র প্রয়োজন নেই। মৎস্যজীবীদের দলের সর্দার নিজ ভক্তিতে পূজা করেন। কখনো কখনো দেয়াসি শ্রেণির ব্রাহ্মণকে পূজা করতে দেখা যায়। এঁরা পূজার সময় তিনবার "গুরু সত্য" কথাটি উচ্চারণ করে। প্রতীকের উপরের অংশে সিঁদুর লেপে তার উপর ফুল ও তুলসীপাতা বা বেলপাতা রাখে। একটি ঘটও পাতা হয়। প্রদীপ জ্বালা হয়। পূজার আয়োজনও সামান্য।
খেটে খাওয়া মানুষের উপাস্য মাকাল ঠাকুর খুব অল্পতেই সন্তুষ্ট। কলাপাতায় বা থালায় মাকাল ঠাকুরের বেদীর সামনে অর্ঘ্য দেওয়া হয়।একটি মাটির থালা বা সানকিতে বা কলাপাতায় করে কিছুটা আতপ চাল, একছড়া পাকা কলা ও কয়েকটি বাতাসা মাত্র দিয়ে নৈবেদ্য রাখা হয়। একটি থালায় শিশুদের চুষিকাঠি, লাট্টু, ঘুনসি, ধান, দূর্বা ও তুলসীপাতা রাখা হয়। একটি কলকে ও কিছুটা গাঁজা রাখা হয়। পূজার শেষে "ফুল চাপানো" হয় বেদিতে। লোকবিশ্বাস প্রতীকের উপরের অংশে রাখা ফুলটি যদি আপনা থেকে মাটিতে পড়ে যায়, তাহলে অনেক মাছ জালে উঠবে। এই পূজাতে কোনও বাজনা বা বলিদানের প্রথা নেই। ধুপ, প্রদীপ জ্বেলে আরাধনা হয়। সন্ধ্যেবেলা মাকাল ঠাকুরের কাছে যারা মাছ ধরতে যায়, তারা নিজেরাই খড় জ্বালিয়ে এই পুজো করে থাকেন।
মাকাল ঠাকুরের যুগ্ম মূর্তিটির বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, কাদামাটি দিয়ে তৈরি মাকাল ঠাকুরের যুগ্ম কাল্পনিক মূর্তি দেবদেবী সম্পর্কিত নিরাকার রূপে ধরা হয়, যা খ্রিস্টপূর্ব যুগ কিছু আগের ধারণা। সহজ কথায় ইসলামি সংস্কৃতির প্রভাব।
মাকাল ঠাকুরের পূজার কোনও মন্দির বা নিদৃষ্ট স্থান বা থান কালও নেই। তবে মাকাল ঠাকুর পূজার নির্দিষ্ট "থান" না থাকলেও । কখনো কখনো গ্রামবাংলার অন্য কোনও লৌকিক দেবতার সহচররূপে বিভিন্ন থানে মাকাল ঠাকুরের পূজার্চনা করা হয়। যেমন, বেলেঘাটা খালের পূর্ব তীরে নওয়াবাদ-গোলাবাড়ির একটি থানে দক্ষিণরায়, পঞ্চানন্দ, সঙ্গে মাকাল ঠাকুর পূজা পান স্থানীয় কৃষক ও মৎস্যজীবীদের দ্বারা।