Sunday, 12 June 2022

মাকাল ঠাকুর

লোক দেবতা কখনো পুরান সমর্থিত নয়। কিন্তু আজকাল বিভিন্ন জায়গায় নতুন নতুন বুদ্ধিজীবি হঠাৎ করেই লোকসংস্কৃতিকে মুলধর্মের ধারা সাথে মিলাতে চাইছে  সেটা খুব ভুল বলে আমি মনে করি।দক্ষিণবঙ্গের নিম্ন গাঙ্গেয় ও জঙ্গল অধ্যুষিত অঞ্চলের মানুষের কাছে মহাদেব পূজিত হন মাকাল রূপে একথা বোধহয় ভুল। কিছু ঐতিহাসিকদের বলেছেন মাকাল শব্দটি মহাকালের অপভ্রংশ। অর্থাৎ কিছু মানুষ মনে করেন ‘মহাকাল’ শব্দটির ধ্বনি লোপ পেয়ে ‘মাকাল’ শব্দেটি এসেছে। কিন্তু সুন্দর বন অঞলে  মৎস্যজীবীদের মধ্যে "মাকাল" পদবি দেখা যায়। তাছাড়া দুই ২৪ পরগনায় জেলায় "মাকাল" নামযুক্ত একাধিক গ্রামও রয়েছে, যেমন মাকালপুর, মাকালতলা ইত্যাদি।

মাকাল ঠাকুর সাধারনত সুন্দর বন অঞলের মৎস্যজীবি ও জেলে সম্প্রদায়ের পূজিত দেবতা। আবার হাওড়া জেলায় গ্রামাঞ্চলের মৎস্যজীবীরা মাকাল ঠাকুরকে মাকালচণ্ডী নামে পূজা করেন। অতি প্রাচীন কাল থেকেই পুকুরে মাছ চাষ করতে যাওয়ার আগে মাকাল ঠাকুরের পুজো দেওয়ার রীতি আছে  ।  প্রচলিত পালাগানের শিবের চাষ পালায় , দেখা যায় মহাদেব ও গৌরী দেবীকে  তারা ধানক্ষেতের জমা জলে মাছ ধরছেন, এবং  সেই মাছ মাথায় করে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করছেন। অনুমান করা যায়, মৎসজীবি সম্প্রদায় হরগৌরীকে জেলেদের দেব-দেবী রূপে কল্পনা করে পুজো করেন।

মাকাল ঠাকুরের কোনও মানুষের মতো মূর্তি করা হয় না।  একটি অথবা একসঙ্গে দুটি ছোট মাটির স্তূপের করে পুজো করা হয়। পুকুর থেকে আঠালো পাঁকমাটি অল্প নিয়ে  ছয় ইঞ্চি লম্বা ও দু তিন ইঞ্চি ব্যাস যুক্ত স্তূপ তৈরি করা হয়। তারপর  আঙ্গুলের চাপ দিয়ে নাক, চোখ, মুখ তৈরি করে পূজার বেদীতে বসানো হয়। যেখানে জোড়া প্রতীকে পুজো করা হয় সেখানে কিন্তু দু’টি প্রতীকের মধ্যে স্ত্রী দেবতা-পুরুষ দেবতা ভেদভেদা করা হয় না দুটি প্রতীককেই দেবতার মূর্তি মনে করা হয় ।তবে সুন্দরবন অঞ্চলের মৎস্যজীবীরা  বিশালাক্ষী  ও খাল-কুমারী সহ কয়েকজন দেবীরও পূজা করেন। খাল শব্দ থেকে ও মাখাল শব্দ আসতে পারে।

মৎস্যজীবীরা যে জলাশয়ে মাছ ধরতে  সেই জলাশয়ের তীরে এঁর পূজা করেন। সেখানে কয়েক গজ পরিমাণ জমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে সমতল করে নেওয়া হয়। সেখানে মাটি দিয়ে তিনটি থাকযুক্ত  ছোটো বেদি বা স্থণ্ডিল তৈরি করা হয়। বেদির মধ্যে মাটি স্তূপ বসানো হয়। এই বেদির চার কোণে চারটি তিরকাঠি পুতে , লাল সুতো দিয়ে  বেদির একটি আবরণ বা বেড়া তৈরি করা হয়। প্রতীকের উপর লাল রঙের চাঁদোয়াও টাঙানো হয়। এ পূজায় ব্রাহ্মণ পুরোহিতের , কোনও মন্ত্র প্রয়োজন নেই। মৎস্যজীবীদের দলের সর্দার নিজ ভক্তিতে  পূজা করেন। কখনো কখনো দেয়াসি শ্রেণির ব্রাহ্মণকে পূজা করতে দেখা যায়। এঁরা পূজার সময় তিনবার "গুরু সত্য" কথাটি উচ্চারণ করে। প্রতীকের উপরের অংশে সিঁদুর লেপে তার উপর ফুল ও তুলসীপাতা বা বেলপাতা রাখে। একটি ঘটও পাতা হয়। প্রদীপ জ্বালা হয়। পূজার আয়োজনও সামান্য।
খেটে খাওয়া মানুষের উপাস্য মাকাল ঠাকুর খুব অল্পতেই সন্তুষ্ট।  কলাপাতায় বা থালায় মাকাল ঠাকুরের বেদীর সামনে অর্ঘ্য দেওয়া হয়।একটি মাটির থালা বা সানকিতে বা কলাপাতায় করে কিছুটা আতপ চাল, একছড়া পাকা কলা ও কয়েকটি বাতাসা মাত্র দিয়ে নৈবেদ্য রাখা হয়। একটি থালায় শিশুদের চুষিকাঠি, লাট্টু, ঘুনসি, ধান, দূর্বা ও তুলসীপাতা রাখা হয়।  একটি  কলকে ও কিছুটা গাঁজা রাখা হয়। পূজার শেষে "ফুল চাপানো" হয় বেদিতে। লোকবিশ্বাস প্রতীকের উপরের অংশে রাখা ফুলটি যদি আপনা থেকে মাটিতে পড়ে যায়, তাহলে অনেক মাছ জালে উঠবে। এই পূজাতে কোনও বাজনা বা বলিদানের প্রথা নেই। ধুপ, প্রদীপ জ্বেলে আরাধনা হয়। সন্ধ্যেবেলা মাকাল ঠাকুরের কাছে যারা মাছ ধরতে যায়, তারা নিজেরাই খড় জ্বালিয়ে এই পুজো করে থাকেন।

 মাকাল ঠাকুরের যুগ্ম মূর্তিটির বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, কাদামাটি দিয়ে তৈরি মাকাল ঠাকুরের যুগ্ম কাল্পনিক মূর্তি দেবদেবী সম্পর্কিত নিরাকার রূপে ধরা হয়, যা খ্রিস্টপূর্ব যুগ কিছু আগের ধারণা। সহজ কথায় ইসলামি সংস্কৃতির প্রভাব।
মাকাল ঠাকুরের পূজার কোনও মন্দির বা নিদৃষ্ট  স্থান বা থান কালও নেই। তবে মাকাল ঠাকুর পূজার নির্দিষ্ট "থান" না থাকলেও । কখনো কখনো গ্রামবাংলার অন্য কোনও লৌকিক দেবতার সহচররূপে বিভিন্ন থানে  মাকাল ঠাকুরের পূজার্চনা করা হয়। যেমন, বেলেঘাটা খালের পূর্ব তীরে নওয়াবাদ-গোলাবাড়ির একটি থানে দক্ষিণরায়, পঞ্চানন্দ, সঙ্গে মাকাল ঠাকুর  পূজা  পান স্থানীয় কৃষক ও মৎস্যজীবীদের দ্বারা।

Thursday, 9 June 2022

রাঢ়ের দশোহরা

রূঢ় বাংলায় দশোহরার ভোরবেলায় সব বাড়িতেই সারা হয়ে যায় পুজো। আগে মনসা গাছের তলায় এই পুজো করা হত বলে মনে করা হয় এটি মনসা পুজো। কিন্তু আসলে জৈষ্ঠ্যমাসে শুক্লা দশমী তিথিতে মা গঙ্গা মর্ত্যে প্রথম প্রকট হয়েছিলেন বলে পৌরাণিক কাহিনীতে বলা আছে । এ বলা আছে এই বিশেষ তিথিতে বা দিনে  গঙ্গাস্নান করলে দশ প্রকার পাপ থেকে মুক্ত হওয়া যায় তাই দশ প্রকার পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যই এর নাম দশোহরা।
তবে নানা মুনির নানা মত , কেউ একে দেবী মনসার পুজো বলে মনে সাপেদের জন্য রাখে  দুধ-কলা। লোকজন বিশ্বাস করেন মনসা দেবীকে সন্তুষ্ট করতে পারলে সর্পদংশন থেকে রেহাই পাওয়া যাবে এবং দেবী পীতবর্ণা হওয়ায়, দেবী লক্ষ্মীর সহরূপা হিসাবে ধরা হয় তাঁকে, তাই উনি সন্তুষ্ট হলে নাগ-নাগিনীরা আশীর্বাদ স্বরূপ দেবীর শরণাগতকে সর্বসম্পদ দান করেন। 
ভালো করে লক্ষ্য করুন লক্ষীর বাহন পেঁচা আর মনসা সাপেদের দেবী। বাংলার শষ্য ক্ষেত্রের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো ইঁদুর এবং এই ইঁদুরের হাত থেকে রক্ষা কর্তা হলো পঁচা এবং সাপ। হিন্দু সংস্কৃতি আসলে সেই সমাজ বিজ্ঞান দিয়ে গঠিত যেখানে কৃষি সংস্কৃতিকে সমর্থন করে। আমাদের বাস্তুতন্ত্রকে সন্মান করতে শেখে। দিনে পাঁচ বার মাথা ঠুকে মৃত্যু পরে ৭২ হুরের সাথে সহবাসের ইচ্ছে তাদের নেই। তাঁরা কর্ম সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী।

যাইহোক সে কথা কথিত আছে, এইদিনে গঙ্গাস্নান পর দশটি ফুল,দশটি ফল,দশটি প্রদীপ দিয়ে পুজোর পূজা করলে মঙ্গল হয় আপানার। বা অনেকের মতে দশোহরা দশ প্রকার  বিনাশ করে। অর্থাৎ  আপনাকে এই পাপ করা থেকে বিরত হবার নির্দেশ দেয়। তাই দিনটি নাম হয়েছে দশোহরা।
রাঢ় অঞ্চলে দশোহরা "দশর "নামে  পরিচিত।রাঢ় অঞ্চলের মানুষেরা সূর্য ওঠার আগে তাদের ঘরবাড়িগুলোতে গোবরগোলা জলের বেড়ি দিয়ে ঘিরে দেন। হিন্দুধর্মে গরু মা ভগবতীর অবতার।  গরুর গোবরের তাই তাৎপর্য আছে । তাছাড়া গোবরের জীবাণুনাশক ক্ষমতা রোগজীবাণু ধ্বংস করে বিশ্বাস আছে । এই বেড়ি সাপ এবং বিভিন্ন রকম ক্ষতিকর কীটপতঙ্গকে ঘর ঢুকতে দেয় না বলে বিশ্বাস করে সবাই ।তাই দশরের  দিন  বা দশোহরার দিন ।  গোবরজলের বেড়ি দিয়ে ঘরকে সুরক্ষিত করা হয় । লোকবিশ্বাস হলো মানুষের হিংস্র প্রবৃত্তিগুলির  সাপের বিষের মতোই  তাই নিজেদের ভেতরের সেই হিংস্র প্রবৃত্তিগুলিকে দমন করতে আর নিজেদের শরীরকে জীবাণুমুক্ত করার জন্য মনসা পুজোতে  তার প্রসাদে  হিসাবে  একটি তেতো ফল ব্যবহার করে। স্থানীয়  মানুষের কেল্যাকড়া বলে। লোক বিশ্বাস মানুষের মনের খারাপ  চিন্তা গুলো ত্যাগ করে । এইদিন মরসুমি ফল আম খাওয়ার চল আছে। এই পুজো করা হয় পারিবারিক সুখ-শান্তি বজায় রাখতে ও মা মনসার কৃপায় ঐশ্বর্য্যলাভ করতে।  দশরের মাহাত্ম্য রাঢ় অঞ্চলে  বেশ  গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয়।এইদিন ঘুড়ি উৎসব পালন করা হয় জাঁকজম করে।

Wednesday, 8 June 2022

জলভরা সন্দেহ

জামাই ঠকিয়ে জামাইষষ্ঠী
ভাবছেন জামাইষষ্ঠীরও আবার ইতিহাস!না না, ইতিহাসটা ঠিক জামাইষষ্ঠীর না,তবে একে জড়িয়ে সৃষ্টি হওয়া এক অতি জনপ্রিয় জিনিসের।
শাশুড়িদের কাছে জামাই মাত্রই আদর যত্ন করার পাত্র,সে ঘোমটা ঢেকে বাতাস করা শাশুড়িই হোক বা আধুনিক শাশুড়িই হোক।জামাই এলে এমনি দিনেও চলে বিশেষ আয়োজন তবে জামাইষষ্ঠীর দিন সেই আয়োজন হয় বেহিসাবী। 
সন ১২৯০ বঙ্গাব্দ, ভদ্রেশ্বরের তেলেনীপাড়ার ব্যানার্জী জমিদার গিন্নির সখ হয়েছিল নতুন জামাইকে তিনি নতুন কোনো মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করবেন।সেই সখ জমিদার মশায়ের কানে পৌঁছতেই এক্ষেত্রে হলো গিন্নির ইচ্ছায় কর্ম।জমিদার বাড়িতে ডাক পড়লো এলাকার প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন বিক্রেতা সূর্যকুমার মোদকের,তাকে হুকুম করা হলো এমন অভিনব মিষ্টি বানাতে হবে তাকে যাতে মিষ্টি দিয়ে হবে জামাই ঠকানো।সূর্যমোদক তো বেজায় চিন্তায় পড়লেন,কি হবে উপায়!জমিদারের আদেশ বলে কথা।অনেক ভেবে সূর্যমোদক তালশাস আকৃতির একটি সন্দেশ তৈরি করলেন,যার ভিতরে ভরে দিলেন সুগন্ধী গোলাপ মেশানো দোলোর রস(সেকালে গুড়কে পাক দিয়ে যে চিনি তৈরি হতো তাকে দোলো বলা হতো)। আর সন্দেশের আকারও ছিল তেমন বড়ো,হাতের তালুর সমান প্রায়।নতুন মিষ্টি তৈরি হয়ে বিশেষ দিনে পাঠানো হলো জমিদারবাড়ির অন্দরে।জামাইয়ের সামনে পঞ্চব্যাঞ্জনের শেষ পাতে রাখা হলো সেই মিষ্টি।নব জামাতা যেই না কামড় দিলেন অমনি সন্দেশের ভিতরের রস ছিটকে তার গরদের পাঞ্জাবী দিল ভিজিয়ে।ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল জামাই,তবে সন্দেশের স্বাদ মন ভরিয়ে দিল।জমিদার গিন্নি বেজায় খুশি এমনটাই তো  তিনি চেয়েছিলেন ।মিষ্টিমুখে জামাই ঠকানো।জমিদার বাড়ির মহিলামহলে হাসির ফোয়ারা ছুটলো।দিকে দিকে এই ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লো।বাংলার মিষ্টি জগতে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল জলভরা তালশাস সন্দেশ।
বিখ্যাত সূর্য মোদকের জলভরা সন্দেশের এই ছিল জন্ম বৃত্তান্ত।যাত্রা শুরু হলো জলভরার।
এখন যদিও হরেক রকম জিনিস ভরা তালশাস পাওয়া যায়,গোলাপ জল তো ছিলই,শীতকালে নলেন গুড়,স্ট্রবেরী, ক্যাডবেরি,গরম কালে আমের জলভরাও পাওয়া যায়।
তাইতো বলে,"চন্দননগরের জলভরা,জামাই ঠকিয়ে আজও সেরা"