Sunday, 23 October 2022

কালিঘাট

কলকাতা নামকরনের ইতিহাসের সাথে  মা কালীর নামের যোগ আছে।  মুম্বাই এর নামকরন যেমন মুম্বাদেবী থেকে হয়েছে, মনে করা হয় কালীক্ষেত্র কালিঘাট  থেকেই  এসেছে কলিকাতা নামটি।কলকাতা নগর তৈরি অনেক আগে থেকেই এই স্থানের অস্তিত্ব ছিলো বিভিন্ন বিদেশী পর্যটক বিবরণ এবং মঙ্গলকাব্য এর উল্লেখ পাই  এই কালিঘাটে তাতে কমপক্ষে ২০০০ বছরের পুরনো এই তীর্থস্থান। কারণ গ্রীক দার্শনিক টলেমির নিজের ভারতের বর্ণনায় যে কালীগ্রামের উল্লেখ করেছেন ২০০০ বছর আগের  তা  আজকের কালীঘাট। ১১০০ খ্রীষ্টাব্দে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তার চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে লিখেছেন সপ্ত ডীঙায় চরে ধনপতি সওদাগর তার পুত্র শ্রীমন্তকে নিয়ে আদিগঙ্গা মানে আজকের টালির নালা দিয়ে যাবার সময় এই কালীমন্দিরে পূজা দিয়েছিলেন।
আবার দেখা যায় ১১৫৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১১৭৯ খ্রিষ্টাব্দ অবধি বল্লাল সেনের রাজত্বকালে এই জায়গাটি  প্রসিদ্ধি লাভ করে কালীক্ষেত্র নামে। সেই সময়ে বহু তীর্থযাত্রী গঙ্গাতীরে অবস্থিত কালীক্ষেত্রে স্নান করতে আসতেন এমন বর্ণনা পাওয়া যায়।
তবে আজ  কালীঘাটের যে কালীমন্দিরটি আমরা দর্শন করি সেটি ১৮০৯ সালে তৈরী।  কথিত আছে এই সতীপীঠ বহুযুগ ধরে জঙ্গলে গুপ্তছিলো। কোন একসময়  গঙ্গাতীরে সন্ধ্যাবেলার আহ্নিক সেরে ফেরার সময়ে এক ব্রাহ্মণ একটি রহস্যময় জ্যোতি উৎস দেখে সেটি অনুসরণ করে এগিয়ে গিয়ে কালীকুণ্ড নামে পুকুরের পাশে দেবীর মুখায়বের মতন একটি পাথরের টুকরো এবং একটি প্রস্তরীভূত পায়ের আঙুল দেখতে পান। এবং এরপর দেবী তাকে দৈববাণী দেন প্রতিষ্ঠার। যদিও এই ঘটনার সাল-তারিখ  নথি খুঁজে পাওয়া যায়নি।

বল্লাল সেনের রাজত্বকালে এই জায়গাটি সেই সময় কালীক্ষেত্রের বিস্তৃতি ছিল বহুলা মানে আজকের বেহালা থেকে দক্ষিণেশ্বর পর্যন্ত প্রায় ২৬ কিলোমিটার জায়গা। তারমধ্যে আবার  মাঝেখানে ৩ কিলোমিটার তিনকোনা জায়গাকে অতি পবিত্র দেবীর স্থান বলে ধরা হতো । কারন বিশ্বাস করা হতো এই তিন কোনা স্থানের তিনটি কোণে অধিষ্ঠিত ছিল ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের মন্দির। এই ত্রিভুজাকৃতি অঞ্চলের মধ্যে কোন এক জায়গায়  পৌরাণিক কাহিনীতে অনুযায়ী নারায়ণের সুদর্শন চক্রে ছিন্ন হয়ে সতীদেহের পায়ের বাম  পরে ছিলো।

তাই  কালীঘাটের কালীমন্দির হল একান্নটি সতীপীঠ বা শক্তিপীঠের মধ্যে অন্যতম এক সতীপীঠ। অর্থাৎ একান্নপীঠের এক পীঠ। পুরাণ অনুযায়ী, এখানে দেবী সতীর ৫১টি দেহখণ্ডের মধ্যে ডান পায়ের কনিষ্ঠা আঙুলটি পড়েছিল। এটি একচল্লিশতম সতীপীঠ। এখানে দেবীর কনিষ্ঠ আঙ্গুল পড়েছিল।সেই জন্য এখানেও দেবীমূর্তি হিসেবে কালি  সাথে সাথে একটি ভৈরব মূর্তিকে প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ভৈরবের নাম নকুলেশ্বর।

মনে করা হয় এই অঞ্চলে তখন বাস ছিল মূলত জেলে, দুলে, বাগদী প্রভৃতি আদিবাসীদের। কিছু তান্ত্রিক ও ব্রাহ্মণ তীর্থ যাত্রী মাঝে মাঝে এখানে আসতেন গোপন সাধানা করতেন।তারাই এই অঞ্চলকে গুপ্ত করে রাখার চেষ্টা করতেন।

বর্তমানে, মা কালি এতোটা জনপ্রিয় যে দেবীমূর্তির তিনটি বিশালাকৃতি চোখ, একটি দীর্ঘ প্রসারিত জিহ্বা এবং চারটি হাত যা সোনার দিয়ে তৈরি করে দিয়েছেন ভক্তরা। বরিশাল এর সাবর্ণ জমিদার শিবদাস চৌধুরী ও তার ছেলে  রামলাল এবং ভাতুষ্পুত্র লক্ষ্মীকান্তর উদ্যোগে এখনকার মন্দিরটি তৈরি হয়েছে। আদি গঙ্গার তীরে ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয়েছে নতুন  মন্দিরটি যার উচ্চতা প্রায় ৯০ ফুট। প্রায় আট বছর এটি সম্পূর্ণ হতে সময় লেগেছিল । আয় ব্যায় হয়েছিল ৩০ হাজার টাকা। জমির পরিমাণ ১বিঘা ১১ কাঠা ৩ ছটাক। । সেই জন্য সেখানে এক দেবীমূর্তি ও একটি ভৈরব মূর্তিকে প্রতিষ্ঠা হয়। ভৈরবের নাম নকুলেশ্বর আর দেবী হচ্ছেন কালী।

এই অঞ্চলে তখন বাস ছিল মূলত জেলে, দুলে, বাগদী প্রভৃতি আদিবাসীদের। কিছু তান্ত্রিক ও ব্রাহ্মণ তীর্থ যাত্রী মাঝে মাঝে এখানে আসতেন। তারপর ৩০০ বছর কালীঘাট বা গঙ্গার কোন ইতিহাসের উল্লেখ মেলে না।

বর্তমানে, প্রতিষ্ঠিত দেবীমূর্তির তিনটি বিশালাকৃতি চোখ, একটি দীর্ঘ প্রসারিত জিহ্বা এবং চারটি হাত যা সোনার নির্মীত। এখনকার মন্দিরটি বরিশাল এর সাবর্ণ জমিদার শিবদাস চৌধুরী ও তার ছেলে  রামলাল এবং ভাতুষ্পুত্র লক্ষ্মীকান্তর উদ্যোগে, আদি গঙ্গার তীরে ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয়। এই মন্দিরটির উচ্চতা ৯০ ফুট। এটি সম্পূর্ণ হতে সময় লেগেছিল প্রায় আট বছর। সেই সময় ব্যায় হয়েছিল ৩০ হাজার টাকা।  ১বিঘা ১১ কাঠা ৩ ছটাক জমির জুড়ে তৈরি হয়েছিল মন্দিরটি।

Friday, 14 October 2022

গারসি’ বা ‘গাস্বী ব্রত’ বা ‘গারুসংক্রান্তির ব্রত’

গারসি’ বা ‘গাস্বী ব্রত’ বা ‘গারুসংক্রান্তির ব্রত’ পুজো আশ্বিন সংক্রান্তিতে পালন করা হয়। গ্রাম বাংলার মেয়ে-বউরা কৃষিকাজ ও আরোগ্য লাভ ও সুস্থতার কামনায় এই ব্রত পালন করে। ব্রতের উদ্দেশ্য হেমন্তের অফলা রুক্ষ্মতাকে দূরে সরিয়ে লক্ষ্মীর আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গে মশা-মাছি, কীটপতঙ্গের হাত থেকে পরিবারকে রক্ষা।
তবে একসময় বাংলায় এই দিন রাতে কিশোর যুবকেরা ভূত-প্রেত তাড়াতে মধ্য রাতে টায়ার আর মশাল জ্বালিয়ে পাড়াময় ঘুরে বেড়াত। শহর এবং গ্রাম সবজায়গায় এই উৎসব পালিত হতো মহা আনন্দে।
গারসী সংক্রান্তি’ দিন থেকে কার্তিক পূজার দিন থেকে পর্যন্ত একমাস আগে গ্রাম বাংলায় প্রতি বাড়িতে ‘আকাশ প্রদীপ’দেওয়া হতো। সাধারণত উঠানের কোণে উঁচু বাঁশ পোঁতা হতো। তাতে কপিকল দিয়ে এই বাঁশের মাথায় তুলে দেওয়া হতো ‘আকাশবাতি’ পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্য।

তবে এই ব্রত কে অরন্ধন উৎসব বলা যেতে পারে। আশ্বিন মাসের শেষ দিনের সকাল বাড়ির উঠোনের তুলসীতলা নিকোন করা মধ্যে দিয়ে শুরু হয় এই ব্রত। তুলসী হল এই ব্রতের আচার মূল জায়গা। কাকভোরে 'গারুর' বা 'গারসি'-র ডাল রান্না করা মধ্য দিয়েই এই ব্রতের মূল কাজ। ব্রতের শেষে এই ডালই বাড়ির মেয়ে বউরা খেয়ে থাকেন। খেসারির ডালে বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি মিলিয়ে এই ডাল তৈরি করা হয়। ঝিঙে, আলু, পটল, লাউ, গাঁটি, মুলো, কুমড়ো ডাটা, কুমড়ো ইত্যাদি সব সব্জির দেওয়া হয় এতে। কারণ দেবীকে প্রার্থনা করা হয় যেন বারোমাস এই শাক-সবজি পাওয়া যায় তাদের বাগানে । তবে সবজির কচু শাক প্রধান।বাংলার মাঠ ঘাটে পাওয়া যাওয়া মানকচু, দুধকচু, কৃষ্ণকচু - যত ধরনের কচু সব দেওয়ার রীতি আছে এতে । কারণ লোক বিশ্বাস কচুতে থাকা জৈব উপাদান রোগজীবাণুর হাত থেকে রক্ষা করে।
 এই রান্নাকে আসমবারি বলা হয়। এই রান্নায় হলুদ তেল ব্যবহার হবে না। আসমবারির সব কিছুকেই সেদ্ধ করতে হয় ডালের সঙ্গে। বিজ্ঞান সম্মত ভাবে একদম স্বাস্থ্যকর খাবার।
স্নানের আগে কাটা সবজি টুকরো দাঁত দিয়ে কেটে পিছনের না তাকিয়ে ফেলে ছুড়ে ফেলে দেয় মেয়েরা। তারপর মনে মনে বলে ‘অলক্ষ্মী দূরে যা লক্ষ্মী ঘরে আয়'। স্নানের পর পবিত্র হয়ে ব্রতীরা জরো হয় তুলসী মণ্ডপে ব্রত কথা শুনতে। এক ঘটি জল আর বিজোড় সংখ্যার আম্রপল্লব রাখে সবাই। স্বস্তিক চিহ্নআঁকা হয় কুলোর মধ্যে নুন দিয়ে । দেবীর ভোগ ঐ খেসারির ডাল, নারকেল কলা , বিভিন্ন ফল আর ঘরে বানানো মিষ্টি। দূর্বা ও ফুল হাতে নিয়এ বাড়ির সকল মেয়ে-বউরা শোনে ব্রতের কথা। ব্রতের শেষে উলু ও শঙ্খ বাজিয়ে সবাই বলে উঠল 'বুরা গিয়া ভালা আ, আপদ বলাই দূরে যা, মশা-মাছি দূরে যা' ।
এই ব্রত থেকে ই বোধহয় বোঝা যায় বাংলাদেশের মা বোনদের চাহিদা ছিলো খুব সাধারণ। নিজের পরিবারের খাদ্য যোগান আর আরোগ্য কামনা তাদের এক মাত্র প্রার্থনা।

লক্ষ্মী কতখানি পৌরাণিক দেবী??

লক্ষ্মী কি লৌকিক দেবী ?  এই প্রশ্নের উত্তর আপনি প্রথমেই বলবেন না, কারণ পুরানে এর উল্লেখ আছে কিন্তু আপনি আমার আগের লেখাতেই দেখেছেন প্যেঁচা এর বাহন । কিন্তু এর বাহন কিন্তু আগে প্যেঁচা ছিলো না। কখনো ময়ুর কখনো কচ্ছপ কখনো হরিনকে এর বাহন হিসেবে পেয়েছি। সুতরাং লোক বিশ্বাস জন্য এই দেবীর রূপ পরিবর্তন হয়েছে আমরা খুব সহজেই দেখতে পাই।


ইতিহাসের পাতায় গেলে দেখতে পাবেন

কুনিন্দরাজ অমোঘভূতির মুদ্রায় লক্ষ্মীর সামনে হরিণ আছে । কুমারগুপ্তের মুদ্রায় আবার লক্ষ্মীদেবী একটি ময়ূরকে খাদ‍্য দিচ্ছেন আবার অন‍্য একটি মুদ্রায় দেবী পদ্মহাতে,  ময়ূরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।


প্রথম ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ও কুমারগুপ্তের স্বর্ণমুদ্রায় দেবীর বাহন সিংহ। বৃহৎ স্তোত্ররত্নাকরে মাধব ব‍্যাস আথর্বণ রহস‍্য থেকে যে লক্ষ্মীমন্ত্র উদ্ধার করেছেন তাতে লক্ষ্মীকে সিংহবাহিনীরূপে দেখাযায়। নেপালে প্রাপ্ত পটে অংকিত অর্ধ-লক্ষ্মী নারায়ণ মূর্তীতে বিষ্ণুর অর্ধদেহের পদতলে গরুড় ও লক্ষ্মীর অর্ধদেহের পদতলে কচ্ছপ।গুপ্তোত্তর যুগে শশাঙ্কের স্বর্ণমুদ্রায় দণ্ডায়মানা লক্ষ্মীদেবীর প্রসারিত দক্ষিণহস্তে পদ্ম, পিছনে পদ্মলতা ও পায়ে তলায়  একটি হাঁস।.
ড. জিতেন্দ্রনাথ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের ব্যাখায় কুনিন্দ মুদ্রায় দেবীর মানবমূর্তী ও পশুমূর্তী অঙ্কিত হয়েছে কারন লক্ষ্মীদেবী চঞ্চলা, হরিণও চঞ্চল ।  কচ্ছপ বা কূর্মও অঞ্চল বিশেষে দেবীর বাহন হয়েছ। কূর্ম বিষ্ণু দ্বিতীয় অবতারও। সূর্য-বিষ্ণুর শক্তি লক্ষ্মীর বাহন বিষ্ণুরূপী কূর্ম হওয়ার সম্ভবনা আছে। আদিতে লক্ষ্মীর আদি বাহন ছিল হরিণ। পরে সরস্বতীর কাছ থেকে নিলেন সিংহ ও ময়ূর। সরস্বতীর হাঁসটিকে তিনি অধিকার করার চেষ্টা করেছিলেন খ্রীষ্টিয় ষষ্ঠ শতাব্দী পরে । এই বাহনগুলির কোনটিকেই লক্ষ্মী  থাকলো না । সরস্বতী হাঁস , দুর্গাদেবী সিংহের হল , ময়ূর গেল কার্তিকের দখলে, কূর্ম বিষ্ণুর অবতার হয়ে রইলো। অগত‍্যা লক্ষ্মীদেবী আশ্রয় বাহন হলো প্যেঁচা। তাই লোকবিশ্বাস এই দেবী তৈরি হয়েছেন বলে আমার বিশ্বাস।


আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই পূজাতে আলপনা দেওয়া রিতী।কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল আলপনা। এ বাংলায় বিভিন্ন ভাবে লক্ষী পূজা করা হয়। কখনও মাটির পট কখনো কলাগাছ কখনও  মাটির চিত্রাঙ্কিত সরা, কখনো ধানের ছড়ায় দেবীকে কল্পনা করে বাঙালীরা পুজো করেন।  লক্ষ্মী হিসেবে করে পুজো করা হত, মূর্তির প্রচলন হতেই সেগুলি আলপনার বিষয় বস্তুতে পরিণত হয়েছে। লক্ষ্মী পুজোতে প্যাঁচা, ধানের ছড়া, শঙ্খ, পদ্ম, পদচিহ্ন ইত্যাদি আলপনা আঁকা হয়।


এগুলি সবই সমৃদ্ধি-সম্পদের প্রতীক। ধানের ছড়া, কলা গাছ কৃষিজ সমৃদ্ধির প্রতীক,  আজও কোজাগরী পূর্ণিমায় নৌকা পুজো করা হয়, যা বাণিজ্যের প্রতীক। আমরা মঙ্গলকাব্য তে প্রমান পাই  জলপথেই বাণিজ্য  করতো একসময় বাঙালিরা। পরে আলপনায় ঢুকে গিয়েছে এই সব ছবি গুলো।


আদীপন থেকে আলীপন হয়ে আলপনা শব্দের জন্ম। আসলে  আলপনা হল কামনার প্রতিচ্ছবি। ইহজাগতিক বাসনা,  সম্পদ সমৃদ্ধি প্রার্থনা, সুস্থ নীরোগ জীবন কামনা, সাংসারিক শ্রীবৃদ্ধির আকাঙ্খা ইত্যাদি  আলপনার মধ্যে।


লক্ষ্মীর পদ যুগল একসময়ে  লক্ষ্মী রূপেই পূজিত হত। লক্ষ্মী একসময় মনসার মতো  লৌকিক দেবীই ছিলেন । আদিমাতা ও পৃথ্বীমাতার রূপে পূজিত দেবী।জৈনসাহিত্যে  গন্ধর্ব কিন্নর প্রমুখ ব্যন্তর দেবতা বা মধ্যবর্তী দেবতাদের শ্রেণিতেই লক্ষ্মীকে অন্তর্ভুক্ত করা আছে। খুব ভালো করে দেখলে।দ্বাদশ শতকের আগে কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষ্মী পুজোর চলছিলো না বাংলায়  । বাংলার  অন্যান্য লৌকিক দেব-দেবী, মনসা ,মসান ঠাকুর,সিনি দেবী , ক্ষেত্রপাল   যেমন কোনও না কোনও প্রতীকেরা দ্বারাই পূজিত হন , তেমনই সংকেত বা অন্য কোনও প্রতীকের মধ্যে আরাধনা করা করা হয় আজ লক্ষীকে ।  এক সমুয় লক্ষ্মীও পূজিত হতেন পদ চিহ্নের মাধ্যমে। লক্ষ্মীর পদ চিহ্ন  কিছু  বছর আগে  পর্যন্ত সংকেত হিসেবেও ব্যবহৃত হতে দেখা যেতো বিয়ের নিমন্ত্রণের চিঠিতে।


তবে পদ চিহ্ন পুজোর রেওয়াজ দীর্ঘদিনের, তা আজও রয়েছে, দক্ষিনেশ্বর- তারাপিঠ- কালীঘাট  এর মতো  জায়গায় কালী পায়ের অবয়ব বিক্রি হতে দেখা যায় আজো । ভক্তরা তা কিনে নিয়ে গিয়ে পুজো করেন তা বাড়িতে গাড়িতে।নবদ্বীপে নিমাইয়ের পদ চিহ্নেকে  পুজো দেওয়া হয়।  মৃত মানুষের পায়ের ছাপ রেখে দেওয়াও আমাদের  রীতি আছে । আবার পদ চিহ্ন দেখেই জঙ্গলের প্রাণীদের শুমারি করা হয়।অর্থাৎ পদ চিহ্ন হল উপস্থিতি বা অস্তিত্ববাদের ধারক-বাহক।


দেখা যায় লক্ষ্মীর পদ চিহ্নের বদলে পরে দিকে  মূর্তি এল অন্যান্য প্রতীকে তাঁর আরাধনা শুরু হল,। মূর্তির  আর প্রতীকে পুজোর শুরু হওয়ায় । পদ চিহ্ন আশ্রয় নিলো  আলপনায়। আজও যে আসনে লক্ষ্মী মূর্তি স্থাপন করে পুজো করা হয় তার নীচেও পদ চিহ্ন আঁকা হয়। পিঁড়িতেও লক্ষ্মীর পা আঁকা হয়। সংকল্পের ঘটের নীচে অনেকে আঁকেন। এখানেই স্পষ্ট হয় মূর্তি এসে প্রতীকের জায়গা । হেঁটে এসে লক্ষ্মী প্রবেশ করার তত্ত্ব একেবারেই নতুন । কারণ জোড়া পায়ে  কেউ হাঁটতে পারে না।


লোকজন বলেন কোজাগরী শব্দের অর্থেও যে জেগে থাকবেন মা তার বাড়ি যাবেন। মানুষ  ধারণা জন্ম, ওই পদ চিহ্নের আলপনার অর্থ হল মা ওই পথ ধরেই মা ঘরে  আসেন। কিন্তু হেঁটে আসার ভঙ্গিমার সঙ্গে আলপনার আঁকা  মেলে না। আজ আবার দ্বিপদ স্টিকারের পা-ই এখন কোজাগরী পূর্ণিমার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ । এক্ষেত্রে পদ যুগল কিন্তু অক্ষত থাকে । তাই মনে এলো এই গল্পটি লক্ষীপূজা আলপনার পা কি সত্যিই লক্ষী ঠাকুরের আগমনের চিহ্ন বহন করে?

Saturday, 8 October 2022

পেঁচা কেন দেবী লক্ষীর বাহন?

উত্তর ভারতের বলা হয় । সব দেবদেবী   মতো বাহন পচ্ছন্দ করা সময় লক্ষী ঠাকুর বিপদে পড়েন কারণ তিনি খাদ্য এবং সমৃদ্ধির দেবী হওয়ায় , সবাই লক্ষীঠাকুরে বাহন হতে চায় । কিন্তু সেটাতো সম্ভব নয়। তাই তিনি শর্ত রাখলেন, কার্তিক মাসের আমবস্যায় তিনি যখন পৃথিবীতে আসবেন তখন তার কাছে যে প্রথম আসবে তাকে তিনি প্রথম বাহন করবেন। রাতের বেলায় অপেক্ষা করতে করতে বেশিরভাগ পুশুপাখিরা ঘুমিয়ে পরে।  পেঁচা শুধু নীলাচল নয়। সে রাতে দূরের জিনিসও ভালো দেখে। ফলে সে দেবীকে দূর থেকে দেখে প্রথম তার কাছে পৌঁছে যায়।
হিন্দি ভাষায় পেঁচাকে উল্লু বলে। যার অর্থ বোকা। কিন্তু হিন্দু শাস্ত্র সে কথা বলা হয়না। পেঁচা আধ্যাতিক জ্ঞানের প্রতিক। সে দিব্য চোখের অধিকারি বলেই অন্ধকারে দেখতে পায়।  অজ্ঞানতার অন্ধকারে ও সে জ্ঞানে আলো খুঁজে নেয়।রাতে প্যেঁচা ডাক আসলে জ্ঞান আহরণের আহ্বান। অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে আধ্যাতিক জ্ঞান জাগরনের আর্দশ সময় হলো রাত্রির। কারণ অন্ধকার এখানে গোপন করে আপনার সাধনাকে ।
তবে সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের। লক্ষ্মী  ফসল বা খাদ্য শস্যের  দেবী । এই খাদ্য শস্যের সবচেয়ে বড় শত্রু ইঁদুর এবং অন্যান্য কীটপতঙ্গের শিকার করে এই প্যেঁচা তাই সে লক্ষীর বাহন।
পেঁচাকে শুভশক্তির প্রতীক বলেছে শাস্ত্রেই । বলা হয়েছে, পূর্ব দিক থেকে পেঁচার ডাক ভেসে এলে সংসারের আর্থিক উন্নতির লক্ষন। যাত্রার সময়পেঁচার ডাক শোনা বা মাথার ওপর পেঁচা উড়লে   গেলে যাত্রা শুভ হয়ে থাকে। আধ্যাত্মিক জগতের কাছে পেঁচা হল জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বুদ্ধি, প্রতিভা, অন্তর্দৃষ্টি, স্বাধীনতা, শক্তি ও সুরক্ষার প্রতীক। শাস্ত্রে বলে রাতের বেলা যখন সাধারণ মানুষেরা ঘুমিয়ে পড়েন, তখন সাধকেরা জেগে ওঠেন । নিঃশব্দ ও অন্ধকার পৃথিবী থেকেই জ্ঞানের আলো  আহরণ করেন  তাঁরা। পৃথিবীর বুকে  ভোরের আলো ফুটে ওঠার সাথে সাথেই তাঁরা যোগনিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ঠিক একই কারণে, সাধকদের কাছে পেঁচা শুভ।
আবার অন্যদিকে বলা হয়লক্ষ্মীর অর্ধেক অংশ অলক্ষ্মী।  লক্ষ্মী, ব্রহ্মার মুখের উজ্জ্বল অংশ আর  তাঁর পিঠের অন্ধকার দিক থেকে আবির্ভূতা অলক্ষ্মী। লক্ষ্মীর পায়ের কাছে বসা  পেঁচা অলক্ষ্মী এবং তার অশুভ প্রকৃতির প্রতীক। তন্ত্র-মন্ত্র-মারণ উচাটন-বশীকরণ ইত্যাদি কালাজাদুর মতো ঘৃণ্য কুসংস্কারে আচ্ছন্ন যাঁরা, তাঁদের  দীপাবলির রাতে পেঁচাকে মেরে প্রাণীটির নখ ও হাড় সংগ্রহ করে। তাঁরা বিশ্বাস করেন পেঁচার শরীরের বিভিন্ন অংশে সঞ্চিত আছে অপরিমিত অশুভ শক্তি। পেঁচা হত্যা করে দেহাংশগুলি সংগ্রহ করে  তাঁরা ভূত, প্রেত, দৈত্য, দানব, পিশাচদের নিজেদের বশে আনতে পারবেন। শত্রদের বিনাশ করার কাজে ব্যবহার করতে পারবেন । এঁরাই পেঁচাকে অশুভ শক্তির বলেছেন।
জ্যোতিষশাস্ত্রের  লেখক মন্ত্রেশ্বরের কথায় পেঁচা  শনিগ্রহের প্রতীক। কিছু শাস্ত্রকার মতে  দিনেরবেলা ঘুমায় তাই পেঁচা জ্ঞানহীন, দিনের আলোয় চোখে  দেখতে পায় না,  সে আত্মিক দিক থেকে অন্ধ । দুঃখ ও একাকীত্ব পেঁচার চিরসঙ্গী।। নিশাচর পেঁচা বাস করে নির্জন স্থানে। নিঃশব্দে ওড়ে রাতের আকাশে। তার ডাক অশুভ।  কিন্তু লিঙ্গপুরাণ থেকে জানা যায়, নারদ মুনি বলেছিলেন মানস সরোবরের নিকটবর্তী স্থানে বাস করা পেঁচাদের কাছ থেকে সংগীত শেখা উচিত।
ঋগ্বেদে অনুযায়ী, পেঁচা আসলে যমের দূত। যম অর্থ সংযম, যম মানে ধর্ম। ধনোপার্জনের সাথে সাথে সংযমবুদ্ধি ও ধর্মীয় চেতনা জাগ্রত রাখার প্রতীক হল পেঁচা। যমদূত পেঁচা তাঁর  মৃত্যুচিন্তা ও আত্মচিন্তা জাগ্রত করে সাধকের মনে। 
অন্যদিকে পেঁচা দিনকানা অর্থাৎ সে অজ্ঞান কারণ সম্পদ শালী হলেই মানুষ আধ্যাতিক জ্ঞান অর্জন থেকে দূরে থাকে। পেঁচা তাঁর প্রতীক। আবার জ্ঞান অর্জন করতে হয় গোপনে তার প্রতীক এই পেঁচা।

ছবি  Soumen Nath  , Sayan Roy