শিব রাত্রির ব্রত করলে কি শিবের মতো বর লাভ হয়? শিবের মতো বর লাভের আকাঙ্খা কেন করে মেয়েরা?
মহাশিবরাত্রি...
"বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান।
শিব ঠাকুরের বিয়ে হবে তিন কন্যে দান"।
ছোটবেলা থেকেই আমরা কমবেশি সকলেই থেকেই শিব ঠাকুরকে নিয়ে এধরনের প্রচলিত ছড়া কিংবা প্রবাদ শুনেছি। পৌরাণিক মতে শিব কিন্তু মহাপ্রলয়ের দেবতা। যদিও পণ্ডিতরা প্রমান করেছেন, শিব প্রাগার্য অনার্য সংস্কৃতির দেবতা। তিনি আদিনাথ, সিন্ধু সভ্যতায় পাওয়া গেছে পশুপতির মূর্তি , এইটা শিবের আদি রূপ জীবকুলের উপাস্য 'পশুপতিনাথ'।
যদিও দেবাদিদেব মহাদেবকে নিয়ে ছড়িয়ে আছে, অনেক লৌকিক এবং পৌরাণিক উপাখ্যান। তবে লোককথায় শুনে এসেছি, ফাল্গুনের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথি শিব ও উমা বা পর্বতীর বিবাহের দিন। মহাশিবরাত্রি মাহাত্ম্য তাই অনেক। লোক বিশ্বাস এই দিনটি বছরের সবচেয়ে অন্ধকারতম দিন। বাংলা ছড়িয়ে আছে অনেক শৈবক্ষেত্র, এবং প্রতিটি মন্দির স্থাপনের পিছনেই আছে বিভিন্ন লোককথা ও । তবে এসব ছাড়িয়ে শিব বাংলা সংস্কৃতির সাথে মিশে গেছে, শিব আমরা নিজেদের বাংলা সংস্কৃতির সাথে মিশেই ফেলেছি। তাই দূর্গা আমাদের ঘরে মেয়ে, এবং মহাদেব সাদা মাটা বাঙালি হয়ে গেছে, যে কখন মাছ ধরে, চাষ করে।
যাইহোক মহা শিবরাত্রি ব্রতটি কিন্তু মেয়েলি আচার কৃত্যের মধ্যে অন্যতম হয়ে গেছে। যেহেতু এদিন মা দূর্গা ও শিবের বিবাহ সুসম্পন্ন হয়েছিল , সেইজন্য কুমারী মেয়ে কিংবা বিবাহিত মেয়েরা স্বামীর কল্যাণে শিবের প্রসন্নতা লাভের জন্য মহাশিবরাত্রি ব্রত করেন। শুধুমাত্র মেয়েরাই নয়, ছেলেরাও নিজের অভীষ্ট কামনা লাভে 'আশুতোষ মহাদেব এর স্মরণাপন্ন হন। অনেক পন্ডিত কথায় যদিও শিব পুরাণ, পদ্মপুরাণ, স্কন্দপুরাণ প্রভৃতি পুরাণে, মহাকাব্য কিংবা প্রাচীন সাহিত্যে শিব ও পার্বতীর গার্হস্থ্য জীবন বর্ণিত হয়েছে।যুগ যুগ ধরে ভারতীয় সংস্কৃতির দাম্পত্যের শ্রেষ্ঠ আদর্শ 'হরগৌরী'। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের দৌলতে বা লোক কথার দৌলতে শিব পার্বতী সংসার অশান্তির কথাই শুনতে পাই।কারণ শিব সাংসারিক জীবনের প্রতি উদাসিন এবং নেশাগ্রস্ত। তবে এই উদাসীনতা বোধহয় সৃষ্টিকর্তা হিসাবে নিজের সৃষ্টিকে ধংস করতে সাহায্য করে শিবকে। নেশা গ্রস্ত আসলে এটা প্রতীকি তিনি সকল প্রকার ক্ষতিগ্রস্ত বস্তুকে গ্রহণ করে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেন বোঝাতেই বলা হয়। আমাদের বুঝতে হবে তিনি সমুদ্র মন্থন সময় বিষ ধারন করেছিলেন। অর্থাৎ তিনি সংসার তিক্ত অভিজ্ঞতার বিষ সহজেই ধারণ করতে পারেন।
শিবের মতো বর প্রার্থনা করা-এটাই কামনা।কিন্তু সত্যি কি এটা কাম্য?
আজকের সমাজ কি শিবের মেনে নিতে পারবে? যাকে সে যুগে দক্ষ প্রজাপতি মেনে নিতে পারেননি? তথাকথিত আর্য-অনার্যের দ্বন্দ্বের মধ্যে যাকে টেনে আনছি না আমি আর। কিন্তু সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তিনি চিরকাল গর্জন করে উঠেছেন অসামাজিকদের দেবতা হয়ে। বৈদিক বা বেদোত্তর যুগের তিন শ্রেষ্ঠ দেবতা ব্রহ্মা-বিষ্ণু মহেশ্বর এর মধ্যে মহেশ্বর শ্রেষ্ঠ বলে মনে হয় , কারণ-ব্রহ্মা বা বিষ্ণুর চেয়ে বেশি বাঁধা পেতে হয়েছে, তাঁকে তাঁর নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। তাঁর পূজা, তাঁর আচার সবকিছুই সহজ থেকে সহজতম আবার জ্ঞান,পাণ্ডিত্য,মেধা,স্থূল বিদ্যা যাকে স্পর্শ করতে পারে না,কেবলমাত্র ভক্তের সরল আকুতিতেই তিনি সন্তুষ্ট। তাই ব্রাহ্মনের দ্বারা তাঁরা বেশি প্রচার পায়নি তিনি।
শিবের চরিত্র এক্কেবারে আলাদা-স্রোতের বিপরীতে একটি ব্যক্তিত্ব। যাঁর মধ্যে ত্যাগ তিতিক্ষা সংযম সন্ন্যাসের পরাকাষ্ঠা দেখা যায় আবার কখনো তার মধ্যে সতী কিংবা পার্বতীর প্রতি এক নিঃশব্দ প্রেমিক রূপে, রক্ষক রূপে রাজসিকতার বহিঃপ্রকাশও দেখা গেছে নিরন্তর।
সকলে প্রেমের প্রতীক কৃষ্ণকে ধরা হলেও। প্রেমিক -শিব,আরো বড়ো। সতীরদেহ ত্যাগ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে। তবে চিরকালই তিনি Instant Decision Maker অথবা মুহুর্তের মধ্যে নিজ গতিপথ পরিবর্তনকারী ব্যক্তিত্ব। তিনি একদিকে আবেগের প্রতিমূর্তি অপরদিকে কর্তব্য ও ধর্মরক্ষার সংস্থাপক। বাঙালী পল্লীকবির কাব্যে,পদাবলী কীর্তনের সুরে শিব তথাকথিত সাংসারিক নন,বোম ভোলা প্রকৃতির।নুন আনতে পান্তা ফুরায় গোছের কর্তব্য সম্পর্কে উদাসীন একটা ব্যক্তিত্ব,কারণ বাঙ্গালীরা আবেগপ্রবণ বেশি এবং দেবতাকে দেবত্বের থেকে বহুলাংশেই নিজের ঘরের মানুষ,আত্মীয় পরিজনের মত ব্যাখ্যা করতে অভ্যস্ত।
আজকের যুগের মেয়েরা কথা নয় যুগ যুগে মেয়েরা কি চান?
•Economically Secured Safe Life,
সব দিকটাকে ম্যানেজ করে চলতে পারা এরকম একজন পুরুষের ঘরণী হতে অর্থনৈতিকভাবে যাকে সমৃদ্ধ হতেই হবে। কৃষি নির্ভর বাঙালি সমাজে হয়তো হয়তো তাই শিবের মতো বর পেলে কোন সমস্যায় পরতো বাঙালি মেয়েরা।
কিন্তু শিব কি এরকম ছিলেন?
শিবের ব্যক্তিত্ব নিয়ে কিংবা চরিত্র অথবা ভালোবাসার প্রামাণ্যতা নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলা চলে না, জাগতিক প্রতিষ্ঠা,প্রাসাদোপম মহল-এসব তো তার কিছুই ছিল না, কিন্তু তিনিই সৃষ্টি কর্তা অথচো উদাসীন তিনি, নিজের ভোগ বিলাসে।শিব চিরকালই বঞ্চিত নিপীড়িতদের দেবতা,।সামান্য জল আর বেলপাতা দিয়ে শিবের কৃপা লাভ করতে পেরেছে।আমাদের মনে রাখতে হবে সমুদ্রমন্থন কালে ব্রহ্মা-বিষ্ণু এবং ইন্দ্রাদি সকল দেবতা অসুরগণ ছিলেন,সকলেই সমুদ্র মন্থন থেকে উদ্ভূত দ্রব্য সামগ্রীর লাভ,ভালো ভালো বিষয়গুলিকে গ্রহণ করেছেন কিন্তু হলাহল পান করলেন শুধু শিব। একজন আদর্শ পুরুষ।
আসলে শিব হলেন ভবিষ্যৎ।সৃষ্টি-স্থিতি আর প্রলয় অর্থাৎ সংহার,সেই সংহারের পর আবার সৃষ্টি আবার স্থিতি আবার প্রলয়।এই যে কালচক্র সেই কাল চক্রের মূল নিয়ন্ত্রক হলেন মহাকাল অতীতে যা ছিল বর্তমানে যা আছে, আগামীতে যে সে সব কোন কিছুই থাকবে না সেই যে না থাকা অবস্থা,কালাতীত-সেই অবস্থাটিই হলেন শিব,যার পরে আর কিছু নেই যিনি সবকিছুর আদি এবং অন্ত।