Monday, 20 February 2023

শিবের মতো বরং!!

শিব রাত্রির ব্রত করলে কি শিবের মতো বর লাভ হয়? শিবের মতো বর লাভের আকাঙ্খা কেন করে মেয়েরা?


মহাশিবরাত্রি...

"বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান।

শিব ঠাকুরের বিয়ে হবে তিন কন্যে দান"।

ছোটবেলা থেকেই আমরা কমবেশি সকলেই থেকেই শিব ঠাকুরকে নিয়ে এধরনের প্রচলিত ছড়া কিংবা প্রবাদ শুনেছি। পৌরাণিক মতে শিব কিন্তু মহাপ্রলয়ের দেবতা। যদিও পণ্ডিতরা প্রমান করেছেন, শিব প্রাগার্য অনার্য সংস্কৃতির দেবতা। তিনি আদিনাথ, সিন্ধু সভ্যতায় পাওয়া গেছে পশুপতির মূর্তি , এইটা শিবের আদি রূপ জীবকুলের উপাস্য 'পশুপতিনাথ'।

যদিও দেবাদিদেব মহাদেবকে নিয়ে ছড়িয়ে আছে, অনেক লৌকিক এবং পৌরাণিক উপাখ্যান। তবে লোককথায় শুনে এসেছি, ফাল্গুনের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথি শিব ও উমা বা পর্বতীর বিবাহের দিন। মহাশিবরাত্রি মাহাত্ম্য তাই অনেক। লোক বিশ্বাস এই দিনটি বছরের সবচেয়ে অন্ধকারতম দিন। বাংলা ছড়িয়ে আছে অনেক শৈবক্ষেত্র, এবং প্রতিটি মন্দির স্থাপনের পিছনেই আছে বিভিন্ন লোককথা ও । তবে এসব ছাড়িয়ে শিব বাংলা সংস্কৃতির সাথে মিশে গেছে, শিব আমরা নিজেদের বাংলা সংস্কৃতির সাথে মিশেই ফেলেছি। তাই দূর্গা আমাদের ঘরে মেয়ে, এবং মহাদেব সাদা মাটা বাঙালি হয়ে গেছে, যে কখন মাছ ধরে, চাষ করে।

যাইহোক মহা শিবরাত্রি ব্রতটি কিন্তু মেয়েলি আচার কৃত্যের মধ্যে অন্যতম হয়ে গেছে। যেহেতু এদিন মা দূর্গা ও শিবের বিবাহ সুসম্পন্ন হয়েছিল , সেইজন্য কুমারী মেয়ে কিংবা বিবাহিত মেয়েরা স্বামীর কল্যাণে শিবের প্রসন্নতা লাভের জন্য মহাশিবরাত্রি ব্রত করেন। শুধুমাত্র মেয়েরাই নয়, ছেলেরাও নিজের অভীষ্ট কামনা লাভে 'আশুতোষ মহাদেব এর স্মরণাপন্ন হন। অনেক পন্ডিত কথায় যদিও শিব পুরাণ, পদ্মপুরাণ, স্কন্দপুরাণ প্রভৃতি পুরাণে, মহাকাব্য কিংবা প্রাচীন সাহিত্যে শিব ও পার্বতীর গার্হস্থ্য জীবন বর্ণিত হয়েছে।যুগ যুগ ধরে ভারতীয় সংস্কৃতির দাম্পত্যের শ্রেষ্ঠ আদর্শ 'হরগৌরী'। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের দৌলতে বা লোক কথার দৌলতে শিব পার্বতী সংসার অশান্তির কথাই শুনতে পাই।কারণ শিব সাংসারিক জীবনের প্রতি উদাসিন এবং নেশাগ্রস্ত। তবে এই উদাসীনতা বোধহয় সৃষ্টিকর্তা হিসাবে নিজের সৃষ্টিকে ধংস করতে সাহায্য করে শিবকে। নেশা গ্রস্ত আসলে এটা প্রতীকি তিনি সকল প্রকার ক্ষতিগ্রস্ত বস্তুকে গ্রহণ করে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেন বোঝাতেই বলা হয়। আমাদের বুঝতে হবে তিনি সমুদ্র মন্থন সময় বিষ ধারন করেছিলেন। অর্থাৎ তিনি সংসার তিক্ত অভিজ্ঞতার বিষ সহজেই ধারণ করতে পারেন।


শিবের মতো বর প্রার্থনা করা-এটাই কামনা।কিন্তু সত্যি কি এটা কাম্য?

আজকের সমাজ কি শিবের মেনে নিতে পারবে? যাকে সে যুগে দক্ষ প্রজাপতি মেনে নিতে পারেননি? তথাকথিত আর্য-অনার্যের দ্বন্দ্বের মধ্যে যাকে টেনে আনছি না আমি আর। কিন্তু সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তিনি চিরকাল গর্জন করে উঠেছেন অসামাজিকদের দেবতা হয়ে। বৈদিক বা বেদোত্তর যুগের তিন শ্রেষ্ঠ দেবতা ব্রহ্মা-বিষ্ণু মহেশ্বর এর মধ্যে মহেশ্বর শ্রেষ্ঠ বলে মনে হয় , কারণ-ব্রহ্মা বা বিষ্ণুর চেয়ে বেশি বাঁধা পেতে হয়েছে, তাঁকে তাঁর নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। তাঁর পূজা, তাঁর আচার সবকিছুই সহজ থেকে সহজতম আবার জ্ঞান,পাণ্ডিত্য,মেধা,স্থূল বিদ্যা যাকে স্পর্শ করতে পারে না,কেবলমাত্র ভক্তের সরল আকুতিতেই তিনি সন্তুষ্ট। তাই ব্রাহ্মনের দ্বারা তাঁরা বেশি প্রচার পায়নি তিনি।

শিবের চরিত্র এক্কেবারে আলাদা-স্রোতের বিপরীতে একটি ব্যক্তিত্ব। যাঁর মধ্যে ত্যাগ তিতিক্ষা সংযম সন্ন্যাসের পরাকাষ্ঠা দেখা যায় আবার কখনো তার মধ্যে সতী কিংবা পার্বতীর প্রতি এক নিঃশব্দ প্রেমিক রূপে, রক্ষক রূপে রাজসিকতার বহিঃপ্রকাশও দেখা গেছে নিরন্তর।

সকলে প্রেমের প্রতীক কৃষ্ণকে ধরা হলেও। প্রেমিক -শিব,আরো বড়ো। সতীরদেহ ত্যাগ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে। তবে চিরকালই তিনি Instant Decision Maker অথবা মুহুর্তের মধ্যে নিজ গতিপথ পরিবর্তনকারী ব্যক্তিত্ব। তিনি একদিকে আবেগের প্রতিমূর্তি অপরদিকে কর্তব্য ও ধর্মরক্ষার সংস্থাপক। বাঙালী পল্লীকবির কাব্যে,পদাবলী কীর্তনের সুরে শিব তথাকথিত সাংসারিক নন,বোম ভোলা প্রকৃতির।নুন আনতে পান্তা ফুরায় গোছের কর্তব্য সম্পর্কে উদাসীন একটা ব্যক্তিত্ব,কারণ বাঙ্গালীরা আবেগপ্রবণ বেশি এবং দেবতাকে দেবত্বের থেকে বহুলাংশেই নিজের ঘরের মানুষ,আত্মীয় পরিজনের মত ব্যাখ্যা করতে অভ্যস্ত।

আজকের যুগের মেয়েরা কথা নয় যুগ যুগে মেয়েরা কি চান?

•Economically Secured Safe Life,

সব দিকটাকে ম্যানেজ করে চলতে পারা এরকম একজন পুরুষের ঘরণী হতে অর্থনৈতিকভাবে যাকে সমৃদ্ধ হতেই হবে। কৃষি নির্ভর বাঙালি সমাজে হয়তো হয়তো তাই শিবের মতো বর পেলে কোন সমস্যায় পরতো বাঙালি মেয়েরা।

কিন্তু শিব কি এরকম ছিলেন?

শিবের ব্যক্তিত্ব নিয়ে কিংবা চরিত্র অথবা ভালোবাসার প্রামাণ্যতা নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলা চলে না, জাগতিক প্রতিষ্ঠা,প্রাসাদোপম মহল-এসব তো তার কিছুই ছিল না, কিন্তু তিনিই সৃষ্টি কর্তা অথচো উদাসীন তিনি, নিজের ভোগ বিলাসে।শিব চিরকালই বঞ্চিত নিপীড়িতদের দেবতা,।সামান্য জল আর বেলপাতা দিয়ে শিবের কৃপা লাভ করতে পেরেছে।আমাদের মনে রাখতে হবে সমুদ্রমন্থন কালে ব্রহ্মা-বিষ্ণু এবং ইন্দ্রাদি সকল দেবতা অসুরগণ ছিলেন,সকলেই সমুদ্র মন্থন থেকে উদ্ভূত দ্রব্য সামগ্রীর লাভ,ভালো ভালো বিষয়গুলিকে গ্রহণ করেছেন কিন্তু হলাহল পান করলেন শুধু শিব। একজন আদর্শ পুরুষ।

আসলে শিব হলেন ভবিষ্যৎ।সৃষ্টি-স্থিতি আর প্রলয় অর্থাৎ সংহার,সেই সংহারের পর আবার সৃষ্টি আবার স্থিতি আবার প্রলয়।এই যে কালচক্র সেই কাল চক্রের মূল নিয়ন্ত্রক হলেন মহাকাল অতীতে যা ছিল বর্তমানে যা আছে, আগামীতে যে সে সব কোন কিছুই থাকবে না সেই যে না থাকা অবস্থা,কালাতীত-সেই অবস্থাটিই হলেন শিব,যার পরে আর কিছু নেই যিনি সবকিছুর আদি এবং অন্ত।


Friday, 17 February 2023

শিব রাত্রি ব্রত কি প্রমান করে?


শিব রাত ব্রত কাহিনী বিচার করলে , আমরা দেখতে পাই। এই শিব পৌরাণিক দেবতা হলেও , ব্রাহ্মণবাদকে সমর্থন সে করে না। অর্থাৎ ব্রাহ্মন বাতীত পূজা সে সন্তুষ্ট এবং সে আমার আদি খাদ্য সংগ্রহক সংস্কৃতিকে সম্মান করতে শেখাছে।

ব্রাহ্মন পূজা , যোগ্য করে তে ফল পান, তারচেয়ে বেশি ফল লাভ করছে সাধারণ মানুষ, খুব সাধারণ উপকরণ দিয়ে পূজা করে, যেখানে কোন মন্ত্র প্রয়োজন নেই, কিছুটা লৌকিক দেবদেবীদের মতোই সে যেনো অল্পতেই সন্তুষ্ট। এটা খুবই আকর্ষনীয় বিষয় কিন্তু কোথাও যেনো ব্রাত্যদের সংস্কৃতিকে গ্রহণ করছে, সাধারণ মানুষেরা।

বৈদিক যুগে আমরা যে 33 জন দেবতা পাই, তাঁরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো প্রাকৃতিক শক্তির দেবতাই ছিলেন, (ইন্দ্র, বরূণ, পবন, অগ্নি)। কিন্তু সৃষ্টি ,পালন, এবং ধংসের দেবতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন ব্রহ্মা , বিষ্ণু , মহেশ্বর।

বৈদিক যুগে অবসান ঘটিয়ে ত্রিদেবের আবির্ভাব আসলে আমার চোখ ঈশ্বরকে সার্বজনীন করা। কারণ বৈদিক যুগে হোমযোগ্য করা হতো যা বিলাস বহুল, অভিজাতদের ব্যাপার সেপার। সবচেয়ে বড় কথা সতীর কাহিনী দেখলেই বুঝতে পারবেন, শিব দরিদ্র হওয়ায়, তার শশউরআলয়ে যোগ্য আমন্ত্রণ পেলেন না। তাই সতী অপমানে দেহত্যাগ করেন। সুতরাং ত্রি দেবের আবির্ভাব সাধারণ মানুষকে ঈশ্বর সাধনার অধিকার দিলো।কৃষ্ণ, শিব , ব্রহ্মার আচরণ কিন্তু দেখা গেল মানুষের মতো।

শিব রাতের ব্রত কথা থেকে বুঝতে পারবেন, চরম উদাসীনতার প্রতীক সে, অল্পতেই তৃপ্তির পায় সে। আসলে এই উদাসীন কারণ সে ধংস কর্তা। তবে প্রশ্ন ধংসের দেবতা হিসেবে শিবের প্রয়োজন কেন? খুব সাধারণ আজ জনসংখ্যা বৃদ্ধি হলে রাষ্ট্র জন্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের করে। অতি প্রাচীন কালেই আমাদের পূর্বপুরুষদের চিন্তা করেছিলেন অতিরিক্ত কিছু হলে তার ধংসের প্রয়োজন তাই, শিবের আবির্ভাব। বোধহয় একটি বিতর্কিত চরিত্রে বৈপরীত্য ভরপুর । আসলে এইসব ঘটেছে মানবায়নে ফলে। রুদ্র রূপকে ভক্ত পরিনত করেছে শান্ত শিবে।

ব্রাহ্মনরা শিবকে কিন্তু অদ্ভুত ভাবে পশুপতি, ভুতবান নামে ডাকছেন।বলতে চাইছেন ঈশ্বর গোষ্ঠির রাগ থেকে সৃষ্ট এই শিব তাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ করতে পশুপতি হবার অধিকার চাইছেন। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে তিনি দেবতা হবার অধিকার অর্জন করলো অনেক পরে। প্রজাপতিকে শাস্তি দিতে তাঁর জন্ম।

তিনি আদি দেব কখনো ছিলেন না। মঙ্গলকাব্য যেমন আমরা দেখি জোর করে দেবতারা ভক্তদের পূজা পাচ্ছেন তেমন ব্রাহ্মনরা বর্ণনা করেছেন দেবতারা যখন মানুষের করা যোগ্যের ফল নিয়ে স্বর্গ সুখ উপভোগ করছেন, তখন তাঁর বাঁধা হয়ে শিব দেবতা হয়ে উঠেছেন প্রায় জোর করেই।

আসলে দক্ষ উপমা দেখুন শিবকে কন্যা দান তিনি শূদ্রকে বেদ পড়ানো সাথে তুলনা করছেন। সুতরাং শিবের দেবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া বোধহয় নিম্ন বর্ণের মানুষের কাছে একটি সুখবর।

আসলে কথায় ফিরে আসি ব্রতকথা দেখছি চন্ডালের বা ব্যাধের পূজায় তিনি তুষ্ট, সতীর কাহিনীতে দেখা যাচ্ছে দক্ষ শিবকে না নিমন্ত্রণ কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যা বলছেন তারা মানে কিন্তু দাঁড়ায় ব্রাহ্মন সমাজের বাইরে তিনি অসভ্য মানুষদের প্রতিনিধি তিনি। তাই শিব জনপ্রিয় দেবতা হয়ে ওঠা বোধহয় অসভ্য অনার্যদের সংস্কৃতির স্বীকৃতি।

শিব দেবতা হওয়া ব্রাহ্মনবাদ বা বৈদিক যুগের শেষ। কারণ বর্তমানে বলি প্রথা দেখা যায় ছাগল বলির প্রথা। আসলে এই ছাগল মুখ দক্ষের প্রতীক যিনি সেই ব্রাহ্মণদের প্রতিনিধি যারা শিবকে দেবতা হিসেবে মানতে চায় নি।

Thursday, 16 February 2023

সোঁদর ব্রত, পৌষ বুড়ি প্রসঙ্গে

 
সোঁদর ব্রত,পৌষ সংক্রান্তিতে সুন্দরবন অঞ্চলে মহিলাদের দ্বারা পালিত ব্রত।পৌষ সংক্রান্তি  বাংলার ঘরে ও বাইরে পালিত হয় মহা সমারোহে।এখন সোঁদর ব্রত তুলসী তলায় দেখা যায়। লক্ষ্মীর আটনের পাশে একটি ছোট্ট মাটির গর্ত করে তারমধ্যে একটি কুলেরডাল পুঁতা হয় ।।গোবরের সোঁদর প্রতীক হলুদ ছোপান কাপড়ে ঢাকা।তীর ধনুকের প্রতীক রাখা পিছনে আর কূল সহ ডাল শীকার ও সংরহ সমাজের ইঙ্গীতবাহী।সামনে আলপনা ঢেঁকি পার রত মানুষ , কূলো, ইত্যাদি চাষের সঙ্গে সম্পর্কিত সরঞ্জাম।
গোবরের তাল  তৈরি সোঁদর  বুড়ি বা গোবরবুড়ির গোবরের তাল সোঁদর মার বা সোঁদর বুড়ির  প্রতীক।  এটি মাতৃপূজার প্রতীক । সোঁদর বুড়ির মাথায় সিঁদূর টিপ দেওয়া হয় তা থেকে বোঝা যায় এটি নারী মূর্তির প্রতীক ।এর  পাশে তীর ধনুক  আর কূল সহ ডাল, হয়তো এক সময় আদি মানব সভ্যতার সুচনা প্রতীক, এটা প্রমান করে এক সময় মানুষ ফল মুল সংগ্রহ কারী ছিলো। এর  ঠিক সামনে একটি ছোট্ট গর্ত জলাশয়ের  প্রতীক যাকে যমপুকুর বলা হয়।   মা তারা সন্তানের মঙ্গল কামনা করে এই যম পুকুরে কড়ি বা পয়সা দেন। সোঁদর বুড়ির সামনে যমগর্তে পয়সা ফেলে ,  তালপাতা টুকরো নাড়তে নাড়তে মাহিলারা  বলেন, "সোদর যায় ভেসে, ওদোর আসে হেসে" আর এই গর্ত  থেকে আঙুলে করে  কাদা নিয়ে  মায়েরা টিপ লাগিয়ে দেন সন্তানদের কপালে মঙ্গলকামনায়। জল-জঙ্গলজীবী সুন্দরবনের বাঙালি জনজাতির এটি একটি প্রাচীন সংস্কার প্রমান।
পৌষপার্বণের বাংলার লৌকিক  এবং প্রাচীন পূজা এটি। এরকম অনেক ব্রত ছড়িয়ে আছে বাংলায় যেমন, পৌষবুড়ির শস্যের দেবী  । লৌকিক পুজো তাই কোন মন্ত্র তন্ত্র নেই। আনুষ্ঠানিক পুজোর বালাই নেই।ছেলেপুলেরা কাঁচা বয়সে অনেকই পৌষবুড়ির তৈরি করেছি, সোদরবুড়ির সঙ্গে এর অনেকটা মিল আছে।  সুন্দরবন অঞ্চলে পৌষ সংক্রান্তির দিন সোদর ব্রত পালন কারী মহিলারা  আগেই বলেছি ।বাংলার  কৃষিসংস্কৃতি আঞ্চলিকভাবে বৈচিত্র্য পূর্ণ। পৌষবুড়ির কথা বলতে হবে।অনেক জায়গায় পৌষসংক্রান্তির দিন সূর্য ওঠার  পাঁচটা মাটির ঢিপি বানিয়ে , সেই ঢিপিগুলির বিশেষ পুজো হয় মুলোর শিকড় বা সরষের ফুল দিয়ে।আর পয়লা মাঘ তিনটি মাটির ঢিপিকে পুজো করা। এদেরকে ফসলের রক্ষক হিসেবে ধরা হয়।
প্রসঙ্গত বলে রাখি পৌষবুড়ি কে  অলক্ষ্মী হিসাবে ই ধরা হয় ।  দীপান্বিতা লক্ষ্মীপূজার দিন  যে অলক্ষ্মীকে বিদায় করা হয়,  ভাঙাকুলো বাজিয়ে  বিদায় করা হয় , অবজ্ঞা করে। লক্ষ্মী বা শস্যদেবতা। মা-লক্ষ্মীকে পূজার আগে তাই অলক্ষ্মী বিদায় হয়।পৌষবুড়ি অলক্ষী তা বিতর্কিত হলেও।  পিঠে-পুলির লৌকিক দেবী কিন্তু এই পৌষ বুড়ি। পৌষবুড়ির প্রথম পিঠের ভাগ চাই তাঁর।  পিঠে না পেলে রেগে যান  তিনি।পৌষপার্বণের দিনে  পিঠে বানাবার আগে চালগুড়ি আর ময়দা দিয়ে চোর-চুন্নি নামে দুটি নর-নারীর মূর্তি বানা্ন  হয় ।চোর-চুন্নিকে নিয়ে গিয়ে পৌষবুড়িকে পিঠে খাইয়ে আসতে হয়। তার পর চোরপিঠে খায় সাধারণত  অবিবাহিত পুরুষ।লোকবিশ্বাস  ঐ পুরুষের তারাতারি বিয়ে হবে এই পিঠে খেলে।  চুন্নিপিঠে খান যে মেয়ে মা হতে চাইছে ।। পিঠেপুলির লোক উৎসবে পৌষবুড়ির  ট্রাজিক চরিত্র।পিঠে উৎসবের পরেরদিন এই পৌষবুড়িকে ছেলেরা পিটিয়ে পিটিয়ে ভেঙে দেয়। 
অলক্ষী বিদায়, পৌষ বুড়ির প্রসঙ্গ আনার কারণ একটাই। দেখুন দোলের  হোলিকাদাহনের বা নেড়া পড়া উৎসবকে লক্ষ্য করুন।  লোকইতিহাসের কোন  নিগূঢ় সংকেত খুঁজে পাবেন।মাতৃতান্ত্রিক সমাজ  পুরুষ শাসিত পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পরিণত হচ্ছে।অদিম সংস্কৃতি তথা দেব দেবী ভাবনাকে ক্রমশ বিদায় জানানো হয়েছে।বলতে পারেন লোক ধর্ম বিশ্বাসকে বিদায় দিয়ে শাস্ত্র পুরান সমর্থিত দেবদেবীরা জায়গা করে নিয়েছেন বাঙালির ঘরে।পৌষবুড়ির , অলক্ষী কিংবা  সোঁদর বুড়ির স্থান একসময় হয়তো ঘরে ভিতরেই ছিলো সেখান থেকে চলে গেছে দরজায় বাইরে। তার মুছে সাফ করে দেওয়া হয়েছে বলেই এই ভাঙনের বা বিদায়ের প্রথা।

  পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন একটা সুন্দর বনের  ছবি  বাজারে দেখতে পাবেন। সোঁদর ব্রত পালন করবেন মহিলারা   পৌষ সংক্রান্তিতে ঘরে ঘরে। তাই কেউ কেউ দোকান নিয়ে বসে সেখানে।কুল সহ কুলের ডাল,লাউ পাতা,ধানের শীষ,আম পাতা ও ধানের শীষ ৩, ৭ বা ১৭ পর্যন্ত বিজোর সংখ্যায় একসঙ্গে বেঁধে বাউনি।আতপ চালের গুঁড়ো,সিদ্ধ চালের গুঁড়ো যা প্রতীকী পিঠে করতে লাগবে সব আছে ।আছে নলেন গুড়,পিঠে সরা ঢাকা সহ। তবে সবার ঊপরে যেটা গুরুত্বপূর্ণ, তা হল নারকেল পাতার কাঠি যা ঝ্যাঁটা করতে লাগে তার খন্ড অংশ লাল সূতোয় বেঁধে ধনুক আর কাঠির  তীর।এর দাম ৫টাকা । শীকার ও সংগ্রহ যুগের প্রতীক যা আজও সুন্দরবনের মানুষের উৎস চিনিয়ে দিতে ব্যাবহার  হচ্ছে মহিলাদের ব্রততে।
পৌষ সংক্রান্তিতে সুন্দরবনের মহিলাদের দ্বারা পালিত এই ব্রতকে কেউ বলেন সোঁদর ব্রত কেউ বলেন বাউনি পূজা । তবে  নৃতাত্বিক ভাবে বিশ্লেষণ করলে ,  এই ব্রত মধ্য প্রস্তর যুগের শেষ ভাগ থেকে চলে আসছে যখন  সুন্দরবনের মানুষ শীকার ও সংগ্রহের জীবন যাপন করতো।
যদিও প্রত্নতত্ব, নৃতত্,লোকসংস্কৃতির প্রতিষ্ঠানের কাছে হেরিটেজ খোঁজ করে শুধু?হেরিটেজ মানে কি শুধু মাত্র ইংরেজ আমলে ১০০ থেকে ৩০০ বছরের তৈরী কিছু বিখ্যাত সৌধ বাড়ি ইত্যাদি বা রাজা রাজরাদের দ্বারা তৈরী মন্দির মসজিদ গীর্জা প্রাসাদ  সৌধ ইত্যাদি।  তাঁর বয়স হয়তো ১৫০০ -২০০০ , অনেক সময় ৪৫০০-৫০০০ হরপ্পা সংস্কৃতির  আর -৮০০০-৯০০০যদি মেহরগড়  প্রচীন হয় ।কিন্তু আমাদের চোখের সামনে আরো প্রাচীন বা আদিম  সংস্কৃতির নিদর্শন রয়েছে সাধারন মানুষ সেই ঐতিহ্য বহন করে নিয়ে চলেছেন বহু বছর ধরে     এই সব ব্রত পালনের মধ্য দিয়ে তা আলোচনার অগোচরে রেয়ে গেছে।
  আদিম কালের এই সংস্কৃতির শুরু এ নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই।তাই  অবিলম্বে সুন্দরবন সহ প্রান্তিক মানুষের বৈচিত্র্যপূর্ণ ও সমন্বয়ের সংস্কৃতি সংরক্ষ্ণণ প্রদর্শন আলোচনা চর্চার প্রয়োজন।



Monday, 13 February 2023

বাংলার ত্রিবেণী

বাংলার হুগলীর ত্রিবেণী কেন মুক্তবেনী ? এর গুরুত্ব কি?

কুম্ভ সংক্রান্তির কি?

সূর্য প্রতি মাসে তার রাশি পরিবর্তন করে ।সূর্য যে রাশিতে গমন করে তাকে সেই রাশির সংক্রান্তি বলা হয়। ফলে সারা বছরে বারো মাসে ১২টি সংক্রান্তি হয়ে থাকে। তবে মকর ও কর্কট সংক্রান্তি ৬ মাসের ব্যবধানে ঘটে থাকে। সূর্য তখন মকর রাশি ছেড়ে কুম্ভ রাশিতে প্রবেশ করে তখন একে বলা হয় কুম্ভ সংক্রান্তি।

কুম্ভ সংক্রান্তিতে নদীর সঙ্গমে কুম্ভ মেলার আয়োজন করা হয়, যা একটি বিশ্ব বিখ্যাত মেলা। ভারতীয়দের বিশ্বাস এই দিনে স্নান, দান ও সূর্যদেবের পুজোর গুরুত্ব অপরিসীম । ব্রহ্ম মুহুর্তে ঘুম থেকে ওঠার পরই মানুষ নদীতে স্নান করে।

জাফর খাঁ গাজী আজ থেকে ৭০৪ বছর আগে বাংলার ত্রিবেণীতে বিষ্ণু মন্দিরকে মসজিদে রূপান্তরিত করেছিলো। তখন থেকে কুম্ভস্নান ও মেলা বন্ধ হয়ে গিয়ে ছিলো। ১৩১৯ খ্রিষ্টাব্দের পর আবার কিছু বছর হলো ত্রিবেণীতে কুম্ভস্নান। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ত্রিবেণী ‘মুক্ত বেণী’ আর প্রয়াগ ‘যুক্ত বেণী’।

মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব ত্রিবেণীর ঘাটে পদার্পণ করেছিলেন কথিত আছে । ত্রিবেণীর কালীতলায় সনাতন ধর্মের দেবী মা কালীর একটি প্রাচীন মন্দির রয়েছে । লোককথা অনুযায়ী বিখ্যাত দুই ভাই রঘুনাথ সর্দার ও বিশ্বনাথ সর্দার (রঘু ওবিশে ডাকাত) যারা নীল বিদ্রোহে(১৮৫৯-১৮৬০) যোগ দিয়েছিলেন, তাঁরা এই এলাকার বাসিন্দা ছিলেন আর কালীমন্দিরে পূজা দিয়ে ডাকাতির করতে যেতেন ।

জেমস রেনেলে ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে বাংলার মানচিত্র প্রকাশ করেছিলেন "টেরবোনি" নামে ত্রিবেণী উল্লেখ রয়েছে। আসলে সপ্তগ্রামের দক্ষিণ-পশ্চিমে সরু নদীখাতে প্রবাহিত হত সরস্বতী নদী যা ছিল । তবে পরে এই নদীপথ ছেড়ে গঙ্গা নদী হুগলি বা ভাগীরথী নামে পরিচিত সবার কাছে। ত্রিবেণী ঘাটটি মহারাজা রুদ্রনারায়ণ রায়মুখুটি নির্মাণ করেছিলেন, এই ঘাটের কাছাকাছি ত্রিবেনীর মন্দিরগুলিতে গৌড়ীয় রীতির প্রভাব দেখা যায়। য়ামুনা, বা যমুনা হিসাবে উল্লিখিত, আগে নদীটি গঙ্গার (হুগলি নদী) শাখা হিসাবে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হতো কিন্তু বর্তমানে নদীটি গঙ্গা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

ব্যাণ্ডেল জংশন থেকে মাত্র ৫ মাইল দূরে ত্রিবেণীকে মুক্তবেণী কেন বলা হয় ? এলাহাবাদ বা প্রয়াগে গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী একধারায় মিলিত হয়েছে আর এখানে আসে আবার পৃথক ধারায় প্রবাহিত বলেই এই স্থানকে মুক্ত বেণী বলা হয়। ত্রিবেণীতে গঙ্গাস্নান হিন্দু মাত্রেরই কাম্য। এটি অনেক প্রাচীন স্থান। দ্বাদশ শতাবদীতে রচিত ধোয়ী কবির “পবন দূতম ” নামক কাব্যে এর উল্লেখ আমরা দেখতে পাই।

Sunday, 12 February 2023

তারকেশ্বরে মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা কে??

তারকেশ্বরে মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা আসলেকে?

ইতিহাস বলে রাজা ভরমল্ল তারকেশ্বরের কাছে জঙ্গলে একটি শিবলিঙ্গের স্বপ্নে দেখেন। এরপর তিনি এই স্বয়ম্ভু লিঙ্গটি খুঁজে বের করেন, মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।

কিন্তু কিছু মানুষের ধারনা উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা বিষ্ণুদাস নামের এক শিবভক্ত ,তারকেশ্বরে বাবা তারকনাথের মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা । খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে, জৌনপুরের ডোভি পরগণার গোমতী নদীর তীরস্থ হরিপুরের রাজা বিষ্ণুদাসের সাথে কাশীর রাজা বলবন্ত সিংহের সংঘর্ষ হলে, প্রায় ৫০০ অনুচর-সহ বিষ্ণুদাস হুগলি অঞ্চলে চলে আসেন এবং হুগলির জঙ্গলাকীর্ণ হরিপালের রামনগরে বসতি স্থাপন করেন। এই সময় বাংলার নবাব মুর্শিদকুলী খানের অনুমতি নিয়ে তিনি জমিদারির পত্তন করেন। মুর্শিদকুলী খান তাঁর জমিদারী জন্য প্রাথমিকভাবে পাঁচশত বিঘা জমি দান করেছিলেন। আসলে রাজা বিষ্ণুদাসের ভাই ভারমল্লা এই মন্দির স্থাপন করেছিলেন। অযোধ্যা প্রদেশের অন্তর্গত জেলা জৌনপুরের ডোভী পরগণার তারকেশ্বরের কাছে রামনগর গ্রামে তিনি কয়েকজন ব্রাহ্মণের সঙ্গে এসে বসবাস করছিলেন।

যাইহোক ১৭২৯ সালে মন্দিরটির সংস্কার করেন মল্ল রাজারা বলার কারণ।লোককথা অনুযায়ী বিষ্ণুদাসের ভাই দেখেছিলেন স্থানীয় একটি জঙ্গলে একটি কালো পাথরের ওপর গরুরা নিয়মিত দুধ দিয়ে আসে। এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখার পরেই তিনি তার দাদা বিষ্ণুদাসকে জানান পুরো ব্যাপারটা। তবে বিষ্ণুদাসও স্বপ্নাদেশ পেয়ে ওই পাথরটিকে শিবজ্ঞানে পুজো করা শুরু করেন ।যদিও তিনি এই লিঙ্গটি উত্তর প্রদেশে বা অন্য কোথাও নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের সব চেষ্টা ব্যার্থ হয়। কারণ সাধারণ ধারণা অনুযায়ী বাংলায় গঙ্গা সমভূমিতে এই রকম পাথর থাকা সম্ভব নয়। তাই এটি নিজে থেকে পাতাল থেকে উঠে এসেছে ধরে নেওয়া হয়।

সেই থেকে গড়ে ওঠে শিব মন্দির। শিবের তারকেশ্বর রূপ অনুসারে এই মন্দিরের এবং এই অঞ্চলের নাম হয় তারকেশ্বর। ১৭২৯ সালে মন্দিরটিকে মল্ল রাজারা নতুন করে সংস্কার করেন।বাবা তারাকনাথের বর্তমান আটচালা মন্দিরটি মল্লরাজাদেরই তৈরি বলে ধরে নেওয়া হয়।

কিন্তু সুধীর মিত্র তাঁর 'হুগলী জেলার ইতিহাস' (১৯৪৮, পৃষ্ঠা ৮১৪) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে,"১৭৭৯-১৭৮১ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত বঙ্গদেশের মানচিত্রে তারকেশ্বরের অস্তিত্ব নাই। তবে ১৮৩০-১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দে বাঙ্গালা সরকার বঙ্গদেশের যে জরীপ করাইয়াছিলেন, তাহাতে 'তারেশ্বরী' নামক একটি স্থানের উল্লেখ আছে দেখিতে পাওয়া যায়।" লোক কথা অনুযায়ী যাই বলা হোক এই মন্দিরটি প্রাচীনত্ব নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে আদি মন্দিরটি ভেঙে গেলে বর্ধমানের রাজা এর সংস্কার করেন। পরে পাতুল-সন্ধিপুর অঞ্চলের গোবর্ধন রক্ষিত এর পুনরায় সংস্কার করেন। ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে (১২০৮ বঙ্গাব্দ) বালিগড়ের রাজা চিন্তামণি দে এই মন্দিরে প্রার্থনা করে আরোগ্য লাভ করার পর, মন্দিরের সামনে নাটমন্দির তৈরি করে দেন।সে সময়ে এই মন্দিরে যাওয়ার জন্য তখন একমাত্র হাঁটা পথ ছিল। ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে (১২৯২ বঙ্গাব্দ) নীলকমল মিত্রের উদ্যোগে শেওড়াফুলি থেকে তারকেশ্বর পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মিত হয়।

কিন্তু তারকেশ্বর মন্দির নিয়ে নানা কিংবদন্তি থাকলেও এই মন্দিরটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেকখানি।স্বামী সচ্চিদানন্দ। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু , শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং চিত্তরঞ্জন দাশ সকালেই তারকেশ্বরের গিয়েছিলেন ।১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জুন (মঙ্গলবার ২৭শে জ্যৈষ্ঠ ১৩৩১ বঙ্গাব্দ) থেকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, আনুষ্ঠানিকভাবে তারেকেশ্বর সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন।

তবে এই শিব লিঙ্গ এখানে হঠাৎ করে কিভাবে এলো এ নিয়েও একটি কাহিনী আছে।ধরিত্রী মায়ের গর্ভে থাকাকালীন,শিশু ভোলানাথ এর ইচ্ছা হয়েছিল , পৃথিবীর স্বরূপ দর্শন করার, তাই তিনি ধরিত্রীর গর্ভ থেকে উঁকি দিয়েছিলেন। তখন তিনি দেখেছিলেন দুঃখে জর্জরিত বিশ্ববাসীকে। এতে তিনি শোকে পাথর হয়ে গেলেন। সেই সময় থেকেই তিনি তারকেশ্বরে ঐ পাথর রূপে অবস্থান করছেন।

বাবার মূল মন্দিরের বাঁ দিকে রয়েছে একটি পুকুর। এই পুকুরকে সকলে দুধপুকুর বলে চেনে। সেই দুধপুকুরকে নিয়েও প্রচলিত রয়েছে নানা লোককথা ও বিশ্বাস। এখনও হাজার হাজার মহিলা সন্তান কামনায় বা সন্তানের মঙ্গল কামনায় তারকেশ্বর মন্দিরে ছুটে আসেন। মনস্কামনার জন্য মন্দিরের বিভিন্ন দিকে মানুষ ঢিল বেঁধে আসেন। মন্দির লাগোয়া একটি কালী মন্দিরও রয়েছে।

ছবি সৌজন্যে :- google

Friday, 3 February 2023

আর্যরা কি বর্হিরাগত ?

আর্যরা কি বহিরাগত??? অনার্যরাই কি সত্যি কি অসুর?
'আর্যরা বহিরাগত' এই তত্ত্বটি ইউরোপীয় প্রচারিত। এরা ধর্ম এবং বানিজ্য প্রসারের জন্য প্রথমেই ভারতীয় ভাষা শেখে । এবং ভারতীয় পুঁথি, মহাকাব্য পড়ে ও এরা তাদের চেয়ে উন্নততর সমাজের খোঁজ পায়। ইসলাম ধর্মীয়দের দ্বারা আক্রান্ত এবং প্রভাবিত হলেও, প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার দর্শন, বিজ্ঞান, আয়ুর্বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, স্থাপত্য বিজ্ঞান অনেক উন্নত ছিল যে অষ্টাদশ শতাব্দীতেও ইউরোপীয় পণ্ডিতদের সেটা মেনে নিতে পারে নি। হিন্দু মুসলমান মধ্যে শুধু নয় তাঁরা ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যেও বিভাজন করতে আর্য অনার্য তত্ত্বের আমাদানি করলো। উত্তর ভারতকে আর্যদের বাসস্থান দক্ষিণ ভারতকে অনার্যদের বাসস্থান বলে উল্লেখ করে ভৌগলিক ভাবেও ভারতকে অনৈক্য করে তুলতে সচেষ্ট হলো।

উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতীয়দের মধ্যে অথচ কোনপার্থক্য নেই। কুমারাসামি থঙ্গরঞ্জন বিশ্বাস আর্য এবং দ্রাবিড় তত্ত্বের বিরোধীতা করেছেন। প্রাচীন ভারতীয়রা উত্তর ও দক্ষিণে বসতি স্থাপন হয়েছিল হাজার বছর আগে থেকেই। গবেষণায় ভারতের 13 টি রাজ্যের 25 টি ভিন্ন বর্ণ গোষ্ঠীর 132 জনের জিনে পাওয়া 500,000 জেনেটিক মার্কার বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ফিনল্যান্ডের এস্তোনিয়ার তার্টু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয়দের ডিএনএ ক্রোমোজোমের উপর একটি গবেষণা হয়েছিল। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড: কিউইসচাইল্ডের নির্দেশনায় এস্তোনিয়ার তার্টু বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্তোনিয়ান বায়োসেন্টারের গবেষক জ্ঞানেশ্বর চৌবে তাঁর গবেষণায় প্রমাণ করেছেন যে সমস্ত ভারতীয় জিনের ভিত্তিতে একই পূর্বপুরুষের সন্তান, অর্থাৎ ভিত্তিতে ক্রোমোজোমের ক্ষেত্রে, ক্রোমোজোমের ভিত্তিতে আর্য এবং দ্রাবিড়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।ভারতীয়দের মধ্যে যে জিনগত ক্রোমোজোম পাওয়া যায় তা পৃথিবীর অন্য কোন দেশে পাওয়া যায় না।তা শুধু ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং নেপালের জনসংখ্যার মধ্যে বিদ্যমান।

ডেকেন কলেজ উপাচার্য ড. বসন্ত আচার্য, লখনউয়ের বীরবল সাহানি ইনস্টিটিউটের গবেষক নীরজ রাই, হাভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষক ভিএম নরসিংহম, নাদিন রোল্যান্ড, ডেভেড রেক, নিক পিটারসনরা দলবদ্ধ হয়ে একটি গবেষণা চালিয়েছেন।
সাড়ে চার হাজার বছরের পুরনো এক মহিলার কঙ্কালের ডিএনএ পরীক্ষা করে জানা যায় আর্যদের অস্তিত্ব। ফলে আর্যদের আগমনের থিওরি নিয়ে প্রশ্ন উঠে পড়ে। এই পরীক্ষা থেকেই তাঁরা সিদ্ধান্ত উপনীত হন যে, বৈদিক যুগের মানুষ হরপ্পা জাতিরই অন্তর্গত।

আর্যরা যদি বহিরাগত হয়ে নয়, তাদের সাহিত্যে বেদমন্ত্রে জম্বুদ্বীপ মানে ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়া আর কোনও জায়গার উল্লেখ নেই । তাদের সপ্তসিন্ধু মানে পবিত্রতম নদীগুলি হল গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী, গোদাবরী, নর্মদা, কাবেরী ও সিন্ধু– সবকটিই ভারতের নদী।দেবাদিদেব মহাদেব, গিরিরাজ যক্ষ, ও অন্যান্য একাধিক দেবতা ও গন্ধর্বরা কৈলাস বা হিমালয়বাসী। স্বর্গের পথটাও তুষারাবৃত হিমালয়ের মধ্যে দিয়ে। গঙ্গার পৌরাণিক উৎস হিমালয় পর্বতেরই অংশ কৈলাসে স্থিত শিবের জটায়। এবং ভৌগোলিক উৎস গঙ্গোত্রী হিমবাহও হিন্দু তীর্থ। সত্যিকারের বহিরাগতদের হলে তীর্থস্থানগুলো মক্কা মদিনা জেরুজ়ালেম বেথলেহেম ইত্যাদি পশ্চিম এশীয় মরুদেশে বা ইউরোপে হতো। আর সতীর একান্নটি দেহাংশও পড়েছে এই ভারতীয় উপমহাদেশেই, যার মধ্যে রয়েছে বর্তমান রাজনৈতিক সীমানায় আবদ্ধ ভারতবর্ষ ছাড়াও পাকিস্তান, আফগানিস্তান, তিব্বত, নেপাল, মায়ানমার, চীনের অংশবিশেষ ও শ্রীলঙ্কা?


আবার অনার্য গায়ের রঙ কালো বলে বর্ণনা করেছেন অনেক। কিন্তু দেবদেবী দের মধ্যে কৃষ্ণ কালি শনি ও যম তাহলে কি অনার্য? আবার রাবণ অনার্য ছিলেন, কারণ তিনি দক্ষিণ ভারতের মূল বাসিন্দা। কিন্তু পুরাণ অনুযায়ী শশী বিশ্রবের পুত্র,স্বয়ং ব্রহ্মার নাতি। রাবণএকজন সারস্বত ব্রাহ্মণছিলেন, দলিত আদিবাসী নয় । ঋষি কশ্যপেরবংশধর, আবার ব্রাহ্মণ।প্রকৃতপক্ষে সমস্ত অসুররা জন্মসূত্রেসংস্কৃতভাষী ব্রাহ্মণ। অসুরেরা দেবতাদের মাসতুতো ভাই, আবার একই বাবার সন্তান।
মহিষাসুর ছিলেন ঋষি কশ্যপেরবংশধর, আবার ব্রাহ্মণ।প্রকৃতপক্ষে সমস্ত অসুররা জন্মসূত্রেসংস্কৃতভাষী ব্রাহ্মণ।
মহিষাসুরের পিতৃপরিচয় পাওয়া যায় দেবী ভাগবত, ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণ ও কালিকাপু্রাণে। ব্রহ্মার পুত্র মরীচি, মরীচির পুত্র কশ‍্যপ এক বিখ‍্যাত মুনি। এই কশ‍্যপমুনির পুত্র রম্ভ যার পুত্র অর্থাৎ কশ্যপের পৌত্র হল মহিষ। মহিষ শিবের পরম উপাসক। তবে সেও অনার্য নয়।

সাধারণত ক্ষত্রিয় রাজাদের আর্যপুত্র বলে সম্বোধন করা হতো। অনেকে আর্য মানে একটি উচ্চ পদকে বুঝিয়েছেন। ভারতের আদি নাম আর্যাবর্ত। এখনো হিন্দি ভাষায় এর নমুনা পাওয়া যায়।আর্য সম্বোধন অপভ্রংশ হয়ে হিন্দি তে আজা, আজি, আইয়া, আয়া শব্দ গুলো এসেছে।
ইরান থেকে বেহিস্তান শিলালিপি আবিষ্কৃত হওয়ার এ দাবি জোরালো হয় । যীশুর জন্মের প্রায় ৪৮৬ বছর আগে উৎকীর্ণ এই লেখতে পারস্য সম্রাট দারায়ুস নিজকে দাবী করেন-‘’ A Persian, a son of a Persian and an Aryan of Aryan Descent’’ হিসেবে।
ভাষার প্রসঙ্গে এরা সংস্কৃতের সাথে ইউরোপীয় ভাষার মিল খুঁজে বের করলেও এ ভাষা ভারতের বাইরের ভাষা নয়। ঋক বেদের বৈদিক সংস্কৃত থেকে পরিবর্তিত হয়ে আজকের সংস্কৃত তৈরি হয়েছে। ভারতের বাইরে এ ভাষার প্রচলন নেই। ইউরোপীয় ভাষার সাথে সামঞ্জস্য প্রমাণ করেলে দেখা যায় বেশি স্বর বর্ণ ও ব্যঞ্জন বর্ণের ব্যবহার সংস্কৃত ভাষায় দেখা যায়।

ভাষার প্রসঙ্গে থেকেই বলি ভাষাবিদ জোহানেস স্মিথ ‘Wave Theory’ বলেছেন পাথর ফেললে একটি কেন্দ্র বরাবর ঢেউ যেমন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে,তেমনই একটি আদিম ভাষা থেকে নতুন নতুন ভাষার উৎপত্তি হয়। কিন্তু আর্যদের উৎস বিশ্লেষণে ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতি দিয়ে বাসস্থান কোথায় ছিল,তা নির্ণয় করা যায় নি।সংস্কৃতের সাথে অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষার ব্যাপক সাদৃশ্যের প্রেক্ষিত্তে অনেকেই ভারতকে আর্যদের আদি বাসভূমি রূপে অভিহিত করতে বাধ্য হন।
ঋগ্বেদের অনুযায়ী যে নদীগুলির নামোল্লেখ রয়েছে সেগুলি পূর্ব থেকে পশ্চিমে অর্থাৎ গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী। তার অর্থ আর্যরা পূর্ব থেকে পশ্চিমে গমন করে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। আসলে হরপ্পা তে নদীর ছিল 4000 খ্রিস্টপূর্বাব্দের মাঝামাঝি সময়ে শুকিয়ে যেতে শুরু করে। অন্যান্য অনেক বড় আকারের ভৌগোলিক পরিবর্তন ঘটে এবং খ্রিস্টপূর্ব ২ হাজার সালে এই পরিবর্তনের কারণে উত্তর-পশ্চিমে প্রবাহিত নদীগুলির মধ্যে এটি বিলুপ্ত হয়ে যায়।ফলে বেদে আর্যদের বাসস্থানকে ‘সপ্তসিন্ধু’ সাথে আর্যসুক্তে (10/75) প্রবাহিত নদীর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তে গুলি কাবুল নদী, ক্রুগু (কুড়রম), গোমতী (গোমাল), সিন্ধু, পরুষনী (রবি), শুতুদ্রী (সুতলজ), বিতস্ত (ঝিলাম), সরস্বতী, যমুনা এবং গঙ্গা। আর্যরা এসব নদীর চারপাশে এবং করত।


এছাড়া ঋক বেদে যে গাছপালা নাম পাওয়া যায়, তা সব ভারতীয় উপমহাদেশের। আর ধর্ম প্রসঙ্গে বলা যায়।Wheeler উল্লেখ করেছিলেন সিন্ধু সভ্যতার ধর্ম ও আর্য সভ্যতার ধর্ম আলাদা ছিল । সিন্ধু সিভ্যতার মানুষ শৈব ছিলেন তাঁর প্রমাণ মেলে । গুজরাটের লোথাল, রাজস্থানের কালিবাঙ্গান অঞ্চলে বৈদিক শাস্ত্র অনুযায়ী ব্যবহৃত পূজা ও যজ্ঞের জিনিসপত্র পাওয়া গেছে।
এছাড়া হরপ্পা সভ্যতাতে অশ্বের নিদর্শন নেই।ফলে ভারত আর্যদের আদি বাসস্থান নয় এই তত্ত্বে সমর্থন যোগ্য নয়।আর্যরা ঘোড়ায় টানা রথে উত্তর পশ্চিম ভারতের দূর্গম পার্বত্য অঞ্চল পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। এ তথ্য ভুল। দূর্গম পার্বত্য অঞ্চল কোনভাবেই রথে করে অতিক্রম করা সম্ভব ছিল কি? পরবর্তী সময়ে খননকার্যে প্রমাণ পাওয়া যায় সিন্ধু সভ্যতা নয় তারও আগের সময়েও ভারতে ঘোড়ার ব্যবহার হত । সিন্ধু সভ্যতার একটি সীলমোহরে চাকার চিহ্ন আছে ফলে তারা চাকার ব্যবহারও জানতো ।

Wednesday, 1 February 2023

পুতুল কাকে বলে??

পুতুল কি? পুতুল কি শুধু ছেলে ভালোনোর উপকারণ ?


পাঁচ ভুতের কারবার এই পুতুল বানানো...'

না না এই ভুত সেই ভুত নয়! এক অ্যানাবেলে রক্ষে নেই আবার পাঁচ!! যারা মাটির পুতুল গড়েন তাদের কাছে এই পাঁচ ভুতই সৃষ্টির আধার - ক্ষিতি (মাটি), অপ (জল), তেজ (আগুন), মরুৎ (হাওয়া) ও ব্যোম (শূন্য)। মাটির তৈরী পুতুলে পৃথিবীর পঞ্চ ভুতের উপস্থিত ধর্মীয় ভাবে এর গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয় নিঃসন্দেহে। ভাবতে শেখায় পুতুল শুধু ছেলে ভোলানোর বিষয় নয়‌।

 সাদা বাংলায় আবার পুতুল , একটি বিশেষ্য পদ যার অর্থ মানুষ জন্তু ইত্যাদির প্রতিমূর্তি। দেবতার প্রতিমূর্তি হলে তাকে সাধারণত আমরা প্রতিমা বলি। কিন্তু ছলন পুতুল অর্থাৎ দেবতার মূর্তি অথচ পূজা পায় না তাকে আমরা ছলন বলে থাকি।


এবার ইতিহাস পাতায় যাই ,ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যাবে সভ্যতার প্রথম লগ্ন থেকেই পুতুল তৈরি করা হতো খেলা বা বাড়িঘর সাজানোর জন্য নয়, দেবতা এবং অশুভ শক্তির প্রতীক হিসেবেই । তাই পুতুল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টি ভঙ্গিতেও। 

 যাইহোক পুতুল শব্দটি বাংলা ভাষায় কি করে এলো।তৎসম বা সংস্কৃত পুত্রিকা, থেকে প্রাকৃত পুত্তলিআ ; অথবা তৎসম বা সংস্কৃত পুত্র থেকে প্রাকৃত পুতুল্ল হয়ে এসেছে পুতুল শব্দটি। এ হিসেবে ষষ্ঠী পূজার সময় পুত্র সন্তান আকাংক্ষা বা মঙ্গল কামনায় পুতুল তৈরি প্রচলন হয়েছে এটা ধরে নেওয়া যায়। তাছাড়া আজ বাংলার বিভিন্ন বিখ্যাত পুতুল গুলো সব প্রায় নারীদের আশা আকাঙ্খা প্রতীক হিসেবেই তৈরি। সে নয়াগ্রামের পঁচা হতে পারে , হতে পারে মেদিনীপুরের জো পুতুল, পুতুল তৈরি পিছনের গল্প বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে পুতুল গুলো তৈরি হয়েছে কোন ব্রত কথা অথবা লোক উৎসবের উপলক্ষে।


বাংলা গঙ্গা রিডি সভ্যতা পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতা গুলোর মধ্যে একটি। তবুও ইউরোপ যা বলবে তাই আমাদের কাছে এখনো সম্পদ বাদবাকি বাদের খাতায়। তাই ইউরোপীয় দৃষ্টি ভঙ্গিতে পুতুল কি বোঝার চেষ্টা করি একবার।

 ল্যাটিন শব্দ Pupa (Pupa / Doll) থেকে Puppet শব্দেটি পেয়েছি আমরা। পাপেট বা পুতুল হলো একটি সুস্পষ্ট অঙ্গবিশিষ্ট পুতুল, তবে একে বাহ্যিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যা মানুষ বা জীবজন্তুর আদলে গড়া। পুতুলগুলো জড়বস্তু বা বিমূর্ত কোনো ভাবনার প্রতিনিধিত্বও করে। একটি পুতুল পূর্ণ আকৃতির হলেও মানুষ বা পুতুল নিয়ন্ত্রকের তুলনায় এরা ক্ষুদ্র এককথা 'সাধারণ অর্থে ক্ষুদ্রায়তন মূর্তিকেই আমরা পুতুল বলি'। 

 আগেই বলেছি ‘পুতুল'- এই পুতুলের জন্ম আদিম গুহা মানুষের হাতে। শত্রুকে তাড়ানো, বুনো জন্তুকে পোষ মানিয়ে আপন করে নেওয়া, প্রাকৃতিক বাধা- বিপত্তি থেকে রক্ষা পাওয়া, বেঁচে থাকার প্রয়োজনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ইচ্ছাপূরণ- এসব কিছু জড়িয়ে আছে আমাদের বড্ড কাছের জিনিস পুতুলের মধ্যে। তখন প্রকৃতিকে পূজা চলছিলো, আদিম মানুষের মনেগাছ পাথর, বন্য জন্তু- এক একটি প্রতীক হয়ে দেখা দিলো এই পুতুল। প্রকৃতিরই উপাদানে মানুষ কালক্রমে পুতুল এর রূপ নিলো।

রূপ নিলো।


প্রকৃতির প্রতিকূলতা থেকে বাঁচার জন্য আদিম মানুষ পুতুলের পূজা করত, এখনও পৃথিবীর সব জায়গাতেই পুতুলের সেই অস্তিত্ব টিকেও রয়েছে। ‘ক্যাথলিক খ্রিষ্টান দেশেও এক সময় শিশু যিশুর মূর্তি ছোটদের খেলার পুতুলরূপে প্রচলিত ছিল । ১৫শ শতাব্দী থেকে বিভিন্ন ফ্যাশন পুতুল দেশে দেশে ছড়াইয়া পড়ে । তবে প্রাচীনকালের মিশর, গ্রিস এবং রোমের ছেলেমেয়েদের মধ্যে পুতুল অস্তিত্ব ছিলো খেলনা হিসেবে। ১৭শ শতকে ইউরোপে সাধারণভাবে পুতুলের ব্যবহার আরম্ভ হয়। পাকিস্তান ও ভারতের মহেঞ্জোদারো ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন প্রমান করে পুতুল 'ভারতে পুতুল নির্মাণের শিল্পটি অতি পুরাতন। উত্তর-পশ্চিমে বেলুচিস্থান এবং মহেঞ্জোদারো ইত্যাদি অঞ্চলে অসংখ্য মাটির তৈয়ারি পুতুল পাওয়া গিয়াছে। বাংলাদেশে তমলুক বাঁকুড়ার পোখরানা , ছাড়া সুন্দরবন অঞ্চলে অনেক পুতুল পাওয়া গেছে, যা প্রমাণ করে সিন্ধু সভ্যতার সমসাময়িক একটি সভ্যতার অস্তিত্ব ছিলো এ অঞ্চলে। পুতুল শুধু ছেলে ভোলানোর বিষয় নয়‌। পুতুল একটি সভ্যতা সংস্কৃতির স্মৃতি চিহ্ন।