পুতুল কি? পুতুল কি শুধু ছেলে ভালোনোর উপকারণ ?
পাঁচ ভুতের কারবার এই পুতুল বানানো...'
না না এই ভুত সেই ভুত নয়! এক অ্যানাবেলে রক্ষে নেই আবার পাঁচ!! যারা মাটির পুতুল গড়েন তাদের কাছে এই পাঁচ ভুতই সৃষ্টির আধার - ক্ষিতি (মাটি), অপ (জল), তেজ (আগুন), মরুৎ (হাওয়া) ও ব্যোম (শূন্য)। মাটির তৈরী পুতুলে পৃথিবীর পঞ্চ ভুতের উপস্থিত ধর্মীয় ভাবে এর গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয় নিঃসন্দেহে। ভাবতে শেখায় পুতুল শুধু ছেলে ভোলানোর বিষয় নয়।
সাদা বাংলায় আবার পুতুল , একটি বিশেষ্য পদ যার অর্থ মানুষ জন্তু ইত্যাদির প্রতিমূর্তি। দেবতার প্রতিমূর্তি হলে তাকে সাধারণত আমরা প্রতিমা বলি। কিন্তু ছলন পুতুল অর্থাৎ দেবতার মূর্তি অথচ পূজা পায় না তাকে আমরা ছলন বলে থাকি।
এবার ইতিহাস পাতায় যাই ,ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যাবে সভ্যতার প্রথম লগ্ন থেকেই পুতুল তৈরি করা হতো খেলা বা বাড়িঘর সাজানোর জন্য নয়, দেবতা এবং অশুভ শক্তির প্রতীক হিসেবেই । তাই পুতুল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টি ভঙ্গিতেও।
যাইহোক পুতুল শব্দটি বাংলা ভাষায় কি করে এলো।তৎসম বা সংস্কৃত পুত্রিকা, থেকে প্রাকৃত পুত্তলিআ ; অথবা তৎসম বা সংস্কৃত পুত্র থেকে প্রাকৃত পুতুল্ল হয়ে এসেছে পুতুল শব্দটি। এ হিসেবে ষষ্ঠী পূজার সময় পুত্র সন্তান আকাংক্ষা বা মঙ্গল কামনায় পুতুল তৈরি প্রচলন হয়েছে এটা ধরে নেওয়া যায়। তাছাড়া আজ বাংলার বিভিন্ন বিখ্যাত পুতুল গুলো সব প্রায় নারীদের আশা আকাঙ্খা প্রতীক হিসেবেই তৈরি। সে নয়াগ্রামের পঁচা হতে পারে , হতে পারে মেদিনীপুরের জো পুতুল, পুতুল তৈরি পিছনের গল্প বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে পুতুল গুলো তৈরি হয়েছে কোন ব্রত কথা অথবা লোক উৎসবের উপলক্ষে।
বাংলা গঙ্গা রিডি সভ্যতা পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতা গুলোর মধ্যে একটি। তবুও ইউরোপ যা বলবে তাই আমাদের কাছে এখনো সম্পদ বাদবাকি বাদের খাতায়। তাই ইউরোপীয় দৃষ্টি ভঙ্গিতে পুতুল কি বোঝার চেষ্টা করি একবার।
ল্যাটিন শব্দ Pupa (Pupa / Doll) থেকে Puppet শব্দেটি পেয়েছি আমরা। পাপেট বা পুতুল হলো একটি সুস্পষ্ট অঙ্গবিশিষ্ট পুতুল, তবে একে বাহ্যিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যা মানুষ বা জীবজন্তুর আদলে গড়া। পুতুলগুলো জড়বস্তু বা বিমূর্ত কোনো ভাবনার প্রতিনিধিত্বও করে। একটি পুতুল পূর্ণ আকৃতির হলেও মানুষ বা পুতুল নিয়ন্ত্রকের তুলনায় এরা ক্ষুদ্র এককথা 'সাধারণ অর্থে ক্ষুদ্রায়তন মূর্তিকেই আমরা পুতুল বলি'।
আগেই বলেছি ‘পুতুল'- এই পুতুলের জন্ম আদিম গুহা মানুষের হাতে। শত্রুকে তাড়ানো, বুনো জন্তুকে পোষ মানিয়ে আপন করে নেওয়া, প্রাকৃতিক বাধা- বিপত্তি থেকে রক্ষা পাওয়া, বেঁচে থাকার প্রয়োজনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ইচ্ছাপূরণ- এসব কিছু জড়িয়ে আছে আমাদের বড্ড কাছের জিনিস পুতুলের মধ্যে। তখন প্রকৃতিকে পূজা চলছিলো, আদিম মানুষের মনেগাছ পাথর, বন্য জন্তু- এক একটি প্রতীক হয়ে দেখা দিলো এই পুতুল। প্রকৃতিরই উপাদানে মানুষ কালক্রমে পুতুল এর রূপ নিলো।
রূপ নিলো।
প্রকৃতির প্রতিকূলতা থেকে বাঁচার জন্য আদিম মানুষ পুতুলের পূজা করত, এখনও পৃথিবীর সব জায়গাতেই পুতুলের সেই অস্তিত্ব টিকেও রয়েছে। ‘ক্যাথলিক খ্রিষ্টান দেশেও এক সময় শিশু যিশুর মূর্তি ছোটদের খেলার পুতুলরূপে প্রচলিত ছিল । ১৫শ শতাব্দী থেকে বিভিন্ন ফ্যাশন পুতুল দেশে দেশে ছড়াইয়া পড়ে । তবে প্রাচীনকালের মিশর, গ্রিস এবং রোমের ছেলেমেয়েদের মধ্যে পুতুল অস্তিত্ব ছিলো খেলনা হিসেবে। ১৭শ শতকে ইউরোপে সাধারণভাবে পুতুলের ব্যবহার আরম্ভ হয়। পাকিস্তান ও ভারতের মহেঞ্জোদারো ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন প্রমান করে পুতুল 'ভারতে পুতুল নির্মাণের শিল্পটি অতি পুরাতন। উত্তর-পশ্চিমে বেলুচিস্থান এবং মহেঞ্জোদারো ইত্যাদি অঞ্চলে অসংখ্য মাটির তৈয়ারি পুতুল পাওয়া গিয়াছে। বাংলাদেশে তমলুক বাঁকুড়ার পোখরানা , ছাড়া সুন্দরবন অঞ্চলে অনেক পুতুল পাওয়া গেছে, যা প্রমাণ করে সিন্ধু সভ্যতার সমসাময়িক একটি সভ্যতার অস্তিত্ব ছিলো এ অঞ্চলে। পুতুল শুধু ছেলে ভোলানোর বিষয় নয়। পুতুল একটি সভ্যতা সংস্কৃতির স্মৃতি চিহ্ন।
No comments:
Post a Comment