Friday, 3 February 2023

আর্যরা কি বর্হিরাগত ?

আর্যরা কি বহিরাগত??? অনার্যরাই কি সত্যি কি অসুর?
'আর্যরা বহিরাগত' এই তত্ত্বটি ইউরোপীয় প্রচারিত। এরা ধর্ম এবং বানিজ্য প্রসারের জন্য প্রথমেই ভারতীয় ভাষা শেখে । এবং ভারতীয় পুঁথি, মহাকাব্য পড়ে ও এরা তাদের চেয়ে উন্নততর সমাজের খোঁজ পায়। ইসলাম ধর্মীয়দের দ্বারা আক্রান্ত এবং প্রভাবিত হলেও, প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার দর্শন, বিজ্ঞান, আয়ুর্বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, স্থাপত্য বিজ্ঞান অনেক উন্নত ছিল যে অষ্টাদশ শতাব্দীতেও ইউরোপীয় পণ্ডিতদের সেটা মেনে নিতে পারে নি। হিন্দু মুসলমান মধ্যে শুধু নয় তাঁরা ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যেও বিভাজন করতে আর্য অনার্য তত্ত্বের আমাদানি করলো। উত্তর ভারতকে আর্যদের বাসস্থান দক্ষিণ ভারতকে অনার্যদের বাসস্থান বলে উল্লেখ করে ভৌগলিক ভাবেও ভারতকে অনৈক্য করে তুলতে সচেষ্ট হলো।

উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতীয়দের মধ্যে অথচ কোনপার্থক্য নেই। কুমারাসামি থঙ্গরঞ্জন বিশ্বাস আর্য এবং দ্রাবিড় তত্ত্বের বিরোধীতা করেছেন। প্রাচীন ভারতীয়রা উত্তর ও দক্ষিণে বসতি স্থাপন হয়েছিল হাজার বছর আগে থেকেই। গবেষণায় ভারতের 13 টি রাজ্যের 25 টি ভিন্ন বর্ণ গোষ্ঠীর 132 জনের জিনে পাওয়া 500,000 জেনেটিক মার্কার বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ফিনল্যান্ডের এস্তোনিয়ার তার্টু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয়দের ডিএনএ ক্রোমোজোমের উপর একটি গবেষণা হয়েছিল। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড: কিউইসচাইল্ডের নির্দেশনায় এস্তোনিয়ার তার্টু বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্তোনিয়ান বায়োসেন্টারের গবেষক জ্ঞানেশ্বর চৌবে তাঁর গবেষণায় প্রমাণ করেছেন যে সমস্ত ভারতীয় জিনের ভিত্তিতে একই পূর্বপুরুষের সন্তান, অর্থাৎ ভিত্তিতে ক্রোমোজোমের ক্ষেত্রে, ক্রোমোজোমের ভিত্তিতে আর্য এবং দ্রাবিড়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।ভারতীয়দের মধ্যে যে জিনগত ক্রোমোজোম পাওয়া যায় তা পৃথিবীর অন্য কোন দেশে পাওয়া যায় না।তা শুধু ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং নেপালের জনসংখ্যার মধ্যে বিদ্যমান।

ডেকেন কলেজ উপাচার্য ড. বসন্ত আচার্য, লখনউয়ের বীরবল সাহানি ইনস্টিটিউটের গবেষক নীরজ রাই, হাভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষক ভিএম নরসিংহম, নাদিন রোল্যান্ড, ডেভেড রেক, নিক পিটারসনরা দলবদ্ধ হয়ে একটি গবেষণা চালিয়েছেন।
সাড়ে চার হাজার বছরের পুরনো এক মহিলার কঙ্কালের ডিএনএ পরীক্ষা করে জানা যায় আর্যদের অস্তিত্ব। ফলে আর্যদের আগমনের থিওরি নিয়ে প্রশ্ন উঠে পড়ে। এই পরীক্ষা থেকেই তাঁরা সিদ্ধান্ত উপনীত হন যে, বৈদিক যুগের মানুষ হরপ্পা জাতিরই অন্তর্গত।

আর্যরা যদি বহিরাগত হয়ে নয়, তাদের সাহিত্যে বেদমন্ত্রে জম্বুদ্বীপ মানে ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়া আর কোনও জায়গার উল্লেখ নেই । তাদের সপ্তসিন্ধু মানে পবিত্রতম নদীগুলি হল গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী, গোদাবরী, নর্মদা, কাবেরী ও সিন্ধু– সবকটিই ভারতের নদী।দেবাদিদেব মহাদেব, গিরিরাজ যক্ষ, ও অন্যান্য একাধিক দেবতা ও গন্ধর্বরা কৈলাস বা হিমালয়বাসী। স্বর্গের পথটাও তুষারাবৃত হিমালয়ের মধ্যে দিয়ে। গঙ্গার পৌরাণিক উৎস হিমালয় পর্বতেরই অংশ কৈলাসে স্থিত শিবের জটায়। এবং ভৌগোলিক উৎস গঙ্গোত্রী হিমবাহও হিন্দু তীর্থ। সত্যিকারের বহিরাগতদের হলে তীর্থস্থানগুলো মক্কা মদিনা জেরুজ়ালেম বেথলেহেম ইত্যাদি পশ্চিম এশীয় মরুদেশে বা ইউরোপে হতো। আর সতীর একান্নটি দেহাংশও পড়েছে এই ভারতীয় উপমহাদেশেই, যার মধ্যে রয়েছে বর্তমান রাজনৈতিক সীমানায় আবদ্ধ ভারতবর্ষ ছাড়াও পাকিস্তান, আফগানিস্তান, তিব্বত, নেপাল, মায়ানমার, চীনের অংশবিশেষ ও শ্রীলঙ্কা?


আবার অনার্য গায়ের রঙ কালো বলে বর্ণনা করেছেন অনেক। কিন্তু দেবদেবী দের মধ্যে কৃষ্ণ কালি শনি ও যম তাহলে কি অনার্য? আবার রাবণ অনার্য ছিলেন, কারণ তিনি দক্ষিণ ভারতের মূল বাসিন্দা। কিন্তু পুরাণ অনুযায়ী শশী বিশ্রবের পুত্র,স্বয়ং ব্রহ্মার নাতি। রাবণএকজন সারস্বত ব্রাহ্মণছিলেন, দলিত আদিবাসী নয় । ঋষি কশ্যপেরবংশধর, আবার ব্রাহ্মণ।প্রকৃতপক্ষে সমস্ত অসুররা জন্মসূত্রেসংস্কৃতভাষী ব্রাহ্মণ। অসুরেরা দেবতাদের মাসতুতো ভাই, আবার একই বাবার সন্তান।
মহিষাসুর ছিলেন ঋষি কশ্যপেরবংশধর, আবার ব্রাহ্মণ।প্রকৃতপক্ষে সমস্ত অসুররা জন্মসূত্রেসংস্কৃতভাষী ব্রাহ্মণ।
মহিষাসুরের পিতৃপরিচয় পাওয়া যায় দেবী ভাগবত, ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণ ও কালিকাপু্রাণে। ব্রহ্মার পুত্র মরীচি, মরীচির পুত্র কশ‍্যপ এক বিখ‍্যাত মুনি। এই কশ‍্যপমুনির পুত্র রম্ভ যার পুত্র অর্থাৎ কশ্যপের পৌত্র হল মহিষ। মহিষ শিবের পরম উপাসক। তবে সেও অনার্য নয়।

সাধারণত ক্ষত্রিয় রাজাদের আর্যপুত্র বলে সম্বোধন করা হতো। অনেকে আর্য মানে একটি উচ্চ পদকে বুঝিয়েছেন। ভারতের আদি নাম আর্যাবর্ত। এখনো হিন্দি ভাষায় এর নমুনা পাওয়া যায়।আর্য সম্বোধন অপভ্রংশ হয়ে হিন্দি তে আজা, আজি, আইয়া, আয়া শব্দ গুলো এসেছে।
ইরান থেকে বেহিস্তান শিলালিপি আবিষ্কৃত হওয়ার এ দাবি জোরালো হয় । যীশুর জন্মের প্রায় ৪৮৬ বছর আগে উৎকীর্ণ এই লেখতে পারস্য সম্রাট দারায়ুস নিজকে দাবী করেন-‘’ A Persian, a son of a Persian and an Aryan of Aryan Descent’’ হিসেবে।
ভাষার প্রসঙ্গে এরা সংস্কৃতের সাথে ইউরোপীয় ভাষার মিল খুঁজে বের করলেও এ ভাষা ভারতের বাইরের ভাষা নয়। ঋক বেদের বৈদিক সংস্কৃত থেকে পরিবর্তিত হয়ে আজকের সংস্কৃত তৈরি হয়েছে। ভারতের বাইরে এ ভাষার প্রচলন নেই। ইউরোপীয় ভাষার সাথে সামঞ্জস্য প্রমাণ করেলে দেখা যায় বেশি স্বর বর্ণ ও ব্যঞ্জন বর্ণের ব্যবহার সংস্কৃত ভাষায় দেখা যায়।

ভাষার প্রসঙ্গে থেকেই বলি ভাষাবিদ জোহানেস স্মিথ ‘Wave Theory’ বলেছেন পাথর ফেললে একটি কেন্দ্র বরাবর ঢেউ যেমন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে,তেমনই একটি আদিম ভাষা থেকে নতুন নতুন ভাষার উৎপত্তি হয়। কিন্তু আর্যদের উৎস বিশ্লেষণে ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতি দিয়ে বাসস্থান কোথায় ছিল,তা নির্ণয় করা যায় নি।সংস্কৃতের সাথে অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষার ব্যাপক সাদৃশ্যের প্রেক্ষিত্তে অনেকেই ভারতকে আর্যদের আদি বাসভূমি রূপে অভিহিত করতে বাধ্য হন।
ঋগ্বেদের অনুযায়ী যে নদীগুলির নামোল্লেখ রয়েছে সেগুলি পূর্ব থেকে পশ্চিমে অর্থাৎ গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী। তার অর্থ আর্যরা পূর্ব থেকে পশ্চিমে গমন করে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। আসলে হরপ্পা তে নদীর ছিল 4000 খ্রিস্টপূর্বাব্দের মাঝামাঝি সময়ে শুকিয়ে যেতে শুরু করে। অন্যান্য অনেক বড় আকারের ভৌগোলিক পরিবর্তন ঘটে এবং খ্রিস্টপূর্ব ২ হাজার সালে এই পরিবর্তনের কারণে উত্তর-পশ্চিমে প্রবাহিত নদীগুলির মধ্যে এটি বিলুপ্ত হয়ে যায়।ফলে বেদে আর্যদের বাসস্থানকে ‘সপ্তসিন্ধু’ সাথে আর্যসুক্তে (10/75) প্রবাহিত নদীর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তে গুলি কাবুল নদী, ক্রুগু (কুড়রম), গোমতী (গোমাল), সিন্ধু, পরুষনী (রবি), শুতুদ্রী (সুতলজ), বিতস্ত (ঝিলাম), সরস্বতী, যমুনা এবং গঙ্গা। আর্যরা এসব নদীর চারপাশে এবং করত।


এছাড়া ঋক বেদে যে গাছপালা নাম পাওয়া যায়, তা সব ভারতীয় উপমহাদেশের। আর ধর্ম প্রসঙ্গে বলা যায়।Wheeler উল্লেখ করেছিলেন সিন্ধু সভ্যতার ধর্ম ও আর্য সভ্যতার ধর্ম আলাদা ছিল । সিন্ধু সিভ্যতার মানুষ শৈব ছিলেন তাঁর প্রমাণ মেলে । গুজরাটের লোথাল, রাজস্থানের কালিবাঙ্গান অঞ্চলে বৈদিক শাস্ত্র অনুযায়ী ব্যবহৃত পূজা ও যজ্ঞের জিনিসপত্র পাওয়া গেছে।
এছাড়া হরপ্পা সভ্যতাতে অশ্বের নিদর্শন নেই।ফলে ভারত আর্যদের আদি বাসস্থান নয় এই তত্ত্বে সমর্থন যোগ্য নয়।আর্যরা ঘোড়ায় টানা রথে উত্তর পশ্চিম ভারতের দূর্গম পার্বত্য অঞ্চল পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। এ তথ্য ভুল। দূর্গম পার্বত্য অঞ্চল কোনভাবেই রথে করে অতিক্রম করা সম্ভব ছিল কি? পরবর্তী সময়ে খননকার্যে প্রমাণ পাওয়া যায় সিন্ধু সভ্যতা নয় তারও আগের সময়েও ভারতে ঘোড়ার ব্যবহার হত । সিন্ধু সভ্যতার একটি সীলমোহরে চাকার চিহ্ন আছে ফলে তারা চাকার ব্যবহারও জানতো ।

No comments:

Post a Comment