Tuesday, 31 January 2023

শিব লিঙ্গ কি??

শালগ্রাম শিলাকে পুরুষাঙ্গের অনুষঙ্গ বলাটা এক কাল্পনিক আবিষ্কার মাত্র। শিবলিঙ্গর সঙ্গে পুরুষাঙ্গের যোগ বৌদ্ধধর্মের পতনের পর আগত ভারতের অন্ধকার যুগে কিছু অশাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তির মস্তিস্কপ্রসূত গল্প। স্বামী যৌনাঙ্গের প্রতীক বলে স্বীকার করি না ।হিন্দু কিংবা আদি ধর্ম গুলো দেবি দেবতাদের মূর্তি সাধারণত মানুষ বা পশুর মতো হতো কিন্তু শিব লিঙ্গ একটু আলাদা।সে হিসেবে আমাদের অনেকেই স্বামী বিবেকানন্দ মতকে সমর্থন করে বলি এটি শিবলিঙ্গ ধারণাটি এসেছে বৈদিক যূপস্তম্ভ বা স্কম্ভ ধারণা থেকে। যূপস্তম্ভ বা স্কম্ভ হল বলিদানের হাঁড়িকাঠ। এটিকে অনন্ত ব্রহ্মের একটি প্রতীক মনে করা হয়। কিন্তু এটি কি শেষ কথা?
বাংলার প্রাচীন মন্দির স্হাপত্য দেখুন, মানে জটার দেউলের মতো দেউল গুলোকে দেখে মনে হতেই পারে সত্যিই তো শিব লিঙ্গ ও যৌনাঙ্গের পরিবর্তী রূপ।

 প্রথমেই বলি শিব বৈদিক দেবতা নয়।শিব ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন দেবতা তাঁর আরাধনার হতো মহেঞ্জোদারোতেও।সিন্ধু সভ্যতা থেকে উদ্ধার করা একটি সিলমোহরের দেখা যায়, ত্রিমুখবিশিষ্ট, মাথায় পশুর শিং ধারণ করা,চারপাশে নানান পশু পরিবেষ্টিত, যোগমুদ্রায় উপবেশনকারী, উত্থিত লিঙ্গ পুরুষের মূর্তি পাওয়া যায়।এই পুরুষকে আদি শিব বা পশুপতি বলা হয় । যা বৈদিক দেবতা রুদ্র আদি শিবের রূপেই কল্পিত হয়েছিল।আর্যদের আগে, সিন্ধুসভ্যতা ও উপমহাদেশে লিঙ্গ,যোনি প্রভৃতির পূজা প্রচলিত ছিল তা ধারণা পাওয়া যায়।শিব যে বৈদিক দেবতা নন তাই লিঙ্গ পূজা আর্যদের কাছে নিন্দনীয় ছিল,তার প্রমাণ ঋগ্বেদ বেদ মেলে।বিদ্বেষবশত লিঙ্গোপাসকদের তারা ‘শিশ্নদেব’ বলে ডাকতো। আর হিন্দু শেষ ধর্ম সংস্কারক চৈতন্য মহাপ্রভুর বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারীরা শিব পরম বৈষ্ণব মনে নিও তাঁর প্রসাদ খেতে অস্বীকার করে। তাই এই প্রশ্ন মনে ঘোরাঘুরি করে। তাহলে কি সত্যি মহিলাদের যৌন শিক্ষা দেবার জন্য শিব লিঙ্গ পূজা ও ব্রত করা হয়? না অন্য কোন রহস্য উদঘাটন করতে পারি আমরা শিব লিঙ্গ থেকে।
আসলে শিব লিঙ্গকে পুরুষের যৌনঙ্গ হিসেবে ভাবার কারণ ভারতে বাইরে বিভিন্ন ধর্মে যৌনাঙ্গ পূজার প্রচলন ছিল আগে,জননাঙ্গের বিশ্বের নানা সভ্যতায়, নানা ধর্মেই এই পূজা দেখা যায়। তাই থেকে শিব লিঙ্গ পুরুষের যৌনাঙ্গ বলে আমার ধারণা করে নিয়ে থাকি সহজেই।

সবচেয়ে পুরোনো লিঙ্গ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়,২৮ হাজার বছর পুরোনো Hohle Fels এ প্রাপ্ত লিঙ্গকে ।গ্রীসের শহর ট্রায়ারনাভাসে প্রতিবছর লিঙ্গ উৎসব পালিত হয়।গ্রীক পুরাণে হারমিসকে লিঙ্গ দ্বারা চিহ্নিত করা হত। গ্রীক উর্বরতার দেবতা প্রায়াপাসের প্রতীক একটা বিশাল লিঙ্গ। তিনি গাছ,বাগান, ফল ও পুং জননেন্দ্রিয়ের রক্ষক।
মিশরের দেবতা ওসাইরাসের দেহকে ১৪ টুকরো করা হয়েছিল , তার দেহাংশগুলোকে সমগ্র মিশরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ওসাইরাসের স্ত্রী আইসিস ওসাইরাসের দেহের সমস্ত অংশকে একত্রিত করে ছিলেন কেবল তার লিঙ্গ ছাড়া। ওসাইরাসের লিঙ্গ মাছ খেয়ে ফেলেছিল। ওসাইরাসের লিঙ্গের স্থানে একটি কাঠের লিঙ্গ স্থাপন করা হয়।যা উর্বরতার প্রতীক ছিল।
প্রাচীন স্কেন্ডেনেভিয়াতে নরস গড ফ্রাইর একজন ফ্যালিক ও উর্বরতা ও প্রেমের প্রতীক ছিলেন।এশিরিয়াতে প্রধান দেবতা Bel ও তার স্ত্রী Mylitta কথায় আসি, ইনি ছিলেন উর্বরতার প্রতীক। ইনি ছিলেন প্রকৃতির অধিপতি। এই দেবতার প্রতীক ছিল লিঙ্গ। মনুষ্য লিঙ্গকে পবিত্র বস্তু মনে করে Liber এর মন্দিরে রক্ষা করা হয়েছে এবং স্ত্রী অঙ্গ রক্ষিত হয়েছে Liberia তে । এই দুই বস্তুকেই পিতা এবং মাতা বলা হয়েছে। যা আমাদের শিবলিঙ্গ ও গৌরিপট্ট কথা মনে করায়।।
শিব লিঙ্গকে পূরুষ যৌনাঙ্গ ধরে নিলে গৌরিপটকে নারী যোনি ধরে নিতে হয়।এবার আসি হিন্দু শাস্ত্র কথায়।তন্ত্রের শাক্ত সাধকেরা বলেন,“শক্তি যুক্ত না থাকলে শিব শব স্বরূপ হন।“ এক কথায় শিব লিঙ্গ হল একই সাথে একটি পূরুষ ও নারীদের দেহের মিলিত রূপ। আমার মতে শিব লিঙ্গ কৃষি সংস্কৃতি একটি প্রতীক।প্লুটার্ক বলেন, “মানুষের কাছে আকাশ হল পিতৃ স্বরূপ আর পৃথিবী হল মাতৃ স্বরূপা। আকাশ পিতা কারণ তিনি পৃথিবীতে বীজ বপন করেন, পৃথিবী তা গ্রহণ করে ফলপ্রদায়িনী হন, তাই তিনি মাতা।“
আষাঢ় মাসের নির্দিষ্ট দিনে সুর্য যখন মিথুন রাশিতে প্রবেশ করে তখন পালিত হয় অম্বুবাচী ব্রত। লাঙ্গল চালানো মানে ধরিত্রীতে লিঙ্গ প্রবেশ করিয়ে মৈথুন করা। লোক বিশ্বাস অনুযায়ী অম্বুবাচীর তিনদিন বসুমতী ঋতুমতী থাকে, তাই ওই সময়ে ভূমিতে লাঙ্গল প্রবেশ করাতে নেই। এই বিশ্বাসে আজো অম্বুবাচীতে কৃষক কাজ বন্ধ থাকে গাছ লাগানো হয় না। 
 শিব ও শক্তি অবস্থান করেন শিবলিঙ্গের মধ্যেও। আদিতে যে দুর্গা অন্নপূর্ণা ছিলেন, বসুমাতা বা মাতৃকা দেবী, উর্বরতার দেবী ছিলেন, কালের বিবর্তনে শিবের সাথে যুক্ত হয়ে তিনিই হয়েছেন বিশ্বের সৃজনকারিনী। শিব লিঙ্গ আসলে কৃষি সংস্কৃতি প্রতীক পূজা। যে পাথর গুলোকে দিয়ে এক সময় কৃষি ভুমিকে চাষ যোগ্য করা হতো তাঁকে এরা পূজা করা শুরু করে পরে তাতে গৌরিপট যুক্ত হয়।
মাত্র ১৫০০ বছর পূর্বে চালু হয়েছে ইসলাম ধর্ম। মোটামুটি ভাবে দেখলে দেখা যায় সব ধর্ম গ্রন্থকে copy paste করা আছে তাদের ধর্ম গ্রন্থে। তাঁরাও নারীদের শস্যক্ষেত্রে রূপেই দেখায়। সব ধর্মশাস্ত্রেই মেয়েদের ‘ক্ষেত্র' বা 'ভূমি' বলা হয়, এবং তাই মাতৃরূপ পৃথিবীকে কর্ষণ করে শস্য উৎপাদন করা ধারণা তৈরি হয়। এবং তারা পুরুষের লিঙ্গস্বরূপ এক যষ্টি বানিয়ে নিয়ে ভূমি কর্ষণ করে । তাই ‘লিঙ্গ’, ‘লাঙ্গুল' ও ‘লাঙ্গল’- এই তিনটি শব্দ একই ধাতুরূপ থেকে উৎপন্ন। লিঙ্গরূপী যষ্টি হলো passive, ভূমিরূপী পৃথিবী active , Active মানেই হচ্ছে শক্তির আধার। ফসল তোলার পর ‘নবান্ন' থেকে ই জন্ম নিল লিঙ্গপূজা ও ভূমিরূপী পৃথিবীর পূজা।'
প্রসঙ্গত একটা কথা বলী যে, সংস্কৃত ভাষায় ‘লিঙ্গ’ শব্দটির অর্থ চিহ্ন। নির্গুণ শক্তি যখন সগুণ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা শুরু করে তখন লিঙ্গই হয়ে ওঠে সেই ওঠে । শিবলিঙ্গের গায়ে যে সাপটি থাকে তা আসলে সুপ্ত চেতনার প্রতীক।সেটি আসলে কুলকুণ্ডলিনীর প্রতীক। এই শক্তির জাগরণকে চিহ্নিত করে শিবলিঙ্গ।

No comments:

Post a Comment