Friday, 30 September 2022

ব্যঙের বিয়ে

কুচবিহার বা উত্তরের তরাই ডুয়ার্স এ স্বাভাবিক ভাবেই প্রতিবছর অতি বৃষ্টি হতো l সবসময়  বন্যা না হলেও এতে বাড়ির মায়েরা বড় বিপদে পড়তেন, জামা কাপড় শুকনো র সমস্যা, ভেজা জ্বালানি র সমস্যা ইত্যাদি তে জেরবার হয়ে তাঁরা বৃষ্টি বন্ধ এর কামনা করতেন l আর তার জন্য  বেশ কিছু"  তুকতাক" তাঁরা পালন করতেন, যার মধ্যে কাঁচা লঙ্কা ঝাঁটার কাঠিতে গুঁজে উঠোনে রেখে আসা ছিল অন্যতম l
আবার বৃষ্টি কামনায় ব্যাঙের বিয়ে দেওয়া হয় ভারত-বাংলাদেশসহ এশিয়ার অনেক দেশে । তবে খরা বা অনাবৃষ্টি থেকে রেহায় পেতে এই আয়োজন  সাধারণত আদিবাসীরাই সাধারণত এই বিয়ের। এরা রীতিমতো পুরুত ডেকে সাজসজ্জা পরিয়ে  বিয়ে দেয় ব্যাঙেদের ।উলুধ্বনি দিলেন মহিলারা। মন্ত্রোচ্চারণ করলেন পুরোহিত। মহা ধুমধামের সঙ্গে অনুষ্ঠিত করা হয় ব্যাঙের বিয়ে। তবে  বিয়েতে  খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও থাকে বরপক্ষ ও কন্যাপক্ষের লোকজনের। বিশ্বাস হচ্ছে না Google জিজ্ঞেস করুন। নাম করা সংবাদ পত্রে পেয়ে যাবেন ব্যাঙের বিয়ের খবর ‌।
আসলে ব্যাঙের সঙ্গে বৃষ্টির সম্বন্ধ বোধ হয় মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে  বহু দিন ধরে। প্রায় প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়ের  ধারা জলে গ্রাম বাংলা ভাসে মাঠঘাট ভরে যায়  জলে। তখন দিনেরাতে ব্যাঙের ডাকে কান পাতা দায়। মানুষের ধারণা এই ব্যাঙের ডাক বৃষ্টিকে ডেকে আনে। আর ভাবেই বা না কেন? কিছুদিনের মধ্যে দেখা যেতো ডোবা, খাল, বিল,  পুকুরের জলে ভাসছে অসংখ্য ছোটো ছোটো  ব্যাঙের ডিম।  কয়েকদিন যেতে না যেতেই দেখতাম ব্যাঙের কালোকালো ব্যাঙাচীর দখলে চলে যেতো জলাশয় গুলো।  এই বৃষ্টি  হলে ওদের বংশবৃদ্ধি কারণ। 
অনাবৃষ্টি আবার মানুষের ফসল নষ্ট এর কারণ। তাই মানুষ  আবিষ্কার করলো ব্যাঙেদের বিয়ে দিলেই বৃষ্টি হয়। এ বিশ্বাসে আজো ব্যাঙের বিয়ে দেওয়া হয় অনেক জায়গায়। 

Sunday, 25 September 2022

বাংলার মিষ্টি সবার সেরা কেন??

মতিচূরের লাড্ডু‌ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রাচীন মিষ্টি যার বয়স প্রায় দুই হাজার বছরেরও বেশি।সন্দেশ-রসগোল্লার বয়স মাত্র দুই-আড়াই'শ বছরের মতো হবে। তবে মজার বিষয় বাঙালিরা ছানা তৈরি করতে শুরু করে প্রথম ভারতে। বাংলার পর্তুগিজদের কাছ থেকে বাঙালি ময়রারা ছানা ও পনির তৈরির কৌশল শেখে। ভাস্কো দা গামা কালিকট বন্দরে এসেছিলেন ১৪৯৮ সালে।এর কিছু দিন পর তার বাংলায় এসে উপনিবেশ স্থাপন করে।

প্রথম দিকে ছানা ও ছানার মিষ্টির তৈরি চলছিলো না   ধর্মীয় কারনে । বৈদিক যুগে দুধ ও দুধ থেকে তৈরি ঘি, দধি, মাখন ইত্যাদি ছিল দেবতাদের খাদ্য। বিশেষ করে ননি ও মাখন অত্যন্ত প্রিয় ছিল শ্রীকৃষ্ণের। এ জন্য দুধ থেকে রূপান্তরিত ওই সব খাদ্য শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হলেও ছানা তৈরি হয় দুধ বিকৃত করে, এ জন্য মনুর বিধানমতে, ছানা ছিল অখাদ্য। তাই ছানা  মিষ্টির তৈরির কৌশল ভারতীয়রা শেখে  অনেক পরে।

সুকুমার সেনের কলিকাতার কাহিনী বইয়ে লিখেছেন, "ক্ষীর-মাখন-ঘি-দই—এগুলো কাচা দুধের স্বাভাবিক পরিণাম, কৃত্রিম অথবা স্বাভাবিক। কিন্তু কোনোটিই দুধের বিকৃতি নয়। ‘ছানা’ কিন্তু ফোটানো দুধের কৃত্রিম বিকৃতি। বাঙালি অন্য দ্রব্য সংযোগ করে দুধ ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে, যাতে সারবস্তু ও জলীয় অংশ পৃথক হয়ে যায়। এভাবে দুধ ছিন্নভিন্ন করা হয় বলেই এর নাম হয়েছিল বাংলায় ‘ছেনা’, এখন বলা হয় ‘ছানা’। সংস্কৃত ভাষায় ছানার কোনো রকম উল্লেখ নেই। অন্য ভাষাতেও ছিল না। আগে অজ্ঞাত ছিল বলেই শাস্ত্রসম্মত দেবপূজায় ছানা দেওয়ার বিধান নেই।"

তবে আগেও সন্দেশ তৈরি করা হতো চিনির বা মিষ্টি সাথে বেসন, নারকেল ও মুগের ডালের মিশিয়ে।  শুধু চিনি দিয়ে তৈরি এক ধরনের চাকতিকেও অনেক সময় সন্দেশ বলা হতো এখন পূজা তে এগুলো ব্যবহার করা হয়। নীহাররঞ্জন রায়ের" বাঙালির ইতিহাস "বইয়ে বাঙালির মিষ্টিজাতীয় যে খাদ্যের বিবরণ দিয়েছেন, তাতে তাই ছানার কোনো মিষ্টির উল্লেখ নেই। দুধ থেকে তৈরি মিষ্টির বলতে  দই, পায়েস ও ক্ষীরের কথা। সন্দেশের উল্লেখ আছে, তবে সেই সন্দেশ ছানার নয়। তিনি বলেছেন, ‘কোজাগর পূর্ণিমা রাত্রে আত্মীয়-বান্ধবদের চিপিটক বা চিঁড়া এবং নারিকেলের প্রস্তুত নানা প্রকারের সন্দেশ পরিতৃপ্ত করিতে হইত এবং সমস্ত রাত বিনিদ্র কাটিত পাশা খেলায়।’

যাইহোক চিনির সঙ্গে ছানার মিশিয়ে  সন্দেশ ও রসগোল্লার তৈরি করে বাঙালি অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে। হুগলিতে যেহুতু পর্তুগিজরা প্রথম এসেছিলেন তাই এই আধুনিক  সন্দেশ আবিষ্কর্তা হুগলির হালুইকররা। পরে কলকতায় তৈরি হয় , লেডি কেনি, রসগোল্লার মতো মিষ্টি। প্রথম দিকে  সন্দেশের  মিষ্টি কম থাকতো তাই এই ছানার সন্দেশকে বলা হতো ‘ফিকে সন্দেশ’ । শাস্ত্রসম্মত নয় বলে ছানার সন্দেশ অনেকে খেতে চাইত না। কলকাতার ময়রাদের সৃজনশীলতায় কড়াপাক, নরমপাক, কাঁচাগোল্লা, চন্দন সন্দেশসহ হাজার রকম সন্দেশের  তৈরি করেছিলেন। এরা সন্দেশ  বৈচিত্র্যময় করে তোলে গুড়ের ব্যবহারে। শীতকালের সন্দেশ আর গ্রীষ্মের সন্দেশে তো পার্থক্য আছেই,। পরে এরা ফলের ব্যবহার শুরু করে মিষ্টিতে‌।

গোপাল গোল্লা  ছিলো রসগোল্লার আদি নাম । পরে চিনির রসে ডোবানো  ছানার গোল্লাকে নাম হয় রসগোল্লা। আর রসগোল্লার সর্বশেষ নিরীক্ষাধর্মী সংস্করণ হলো স্পঞ্জ রসগোল্লা। ছানা ও চিনির রসায়নে নানা আকৃতি ও স্বাদে নানা নামে   বৈচিত্র্যময় হয়মিষ্টির সম্ভার ।  লেডিকেনি, চমচম, পানিতোয়া, কালোজাম, আমৃতি, রসমালাই—হরেক রকম। । লোকমুখে এর চলতি নাম লেডিকেনি আসলে।  রসগোল্লার মতোই গোলাকার লাল রঙের লেডিকেনি নামে মিষ্টিটি তৈরি হয়েছিল ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিংয়ের স্ত্রীর সম্মানে।   ছানার মিষ্টি  বাংলায়  জনপ্রিয় হলেও  ভারতের অন্যত্র এখনো ছানার মিষ্টি তেমন তৈরি হয় নাবএখনো লাড্ডু মিষ্টি প্যাড়া, মেওয়ার শুকনো মিষ্টি ।

বাংলাতে আসলে তিন ধরনের মিষ্টি পাওয়া যায়।
সুকুমার সেন বাংলার মিষ্টিকে দু'ভাগে ভাগ করেছেন ।
একক উপাদানে তৈরি মিষ্টি। এ ধরণের মিষ্টিতে গুড় বা চিনির সাথে আর কিছু মিশ্রিত থাকে না। যেমনঃ গুড় বা চিনির নাড়ু ও চাকতি, পাটালি, বাতাসা, খাজা, ছাঁচ ইত্যাদি।
দ্বিতীয় ধরণের মিষ্টিকে আরো দু' রকমে ভাগ করেছেন ।
গুড় বা চিনির সাথে দুগ্ধজাত  উপকরণ ( ছানা , ক্ষীর)  ছাড়া অন্য দ্রব্য সহযোগে তৈরিকৃত মিষ্টান্ন। যেমনঃ নারকেল, তিল এসবের নাড়ু, চিঁড়া, মুড়ি, খৈ-এর মোয়া ইত্যাদি।
দুগ্ধজাত দ্রব্যযোগে মিষ্টি । মানে চিনির বা গুঁড়ের সাথে ছানার মিশিয়ে তৈরি হয় সন্দেশ ও মন্ডা। আবার এই ছানা রসে মাখিয়ে তৈরি হয় রসগোল্লা, দুধে ডোবালে রসমালাই। বেসনের ছোট ছোট দানা ঘিয়ে ভেজে তৈরি হয় বুন্দিয়া, যা দেখতে ছোট বিন্দুর মতো। কড়া পাকে প্রস্তুতকৃত বুন্দিয়াই মতিচুর, লাড্ডুর কাঁচামাল। দুগ্ধজাত নানান ধরণের মিষ্টি রসিক ও মিষ্টিপ্রিয় বাঙালির কাছে প্রিয়। এবং জগৎ বিখ্যাত।


Saturday, 24 September 2022

মহালয়া কে কেন "শুভমহালয়া " বলা হয় না ???

প্র: *মহালয়া কে কেন "শুভ* মহালয়া " *বলা হয় না* ??? *মহিষাসুর মর্দিনী* *আর মহালয়া----- কি এক* *???**
এর জন্য আমাদের মহাভারতের পাতা উল্টাতে হবে।মৃত্যুর পর কর্ণের আত্মা পরলোকে গমন করলেন । তখন সেখানে তাঁকে খাদ্য হিসেবে সোনা ও রত্ন দেওয়া হয়েছিলো। কর্ণ এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তাঁকে বলা হয়, তিনি সারা জীবন স্বর্ণ ও রত্ন দান করেছেন অনেক, কিন্তু প্রয়াত পিতৃগণের উদ্দেশ্যে কখনও খাদ্য বা পানীয় দান করেননি। তাই স্বর্গে খাদ্য হিসেবে তাঁকে সোনাই দেওয়া হয়েছে। তবে একথা শুনে বিমর্ষ কর্ণ বলেন, তাঁর পিতৃপুরুষ কারা সেটা তো তিনি মৃত্যুর মাত্র একদিন আগেই জানতে পেরেছেন। তার দোষ কোথায়! যমরাজ তখন বোঝেন, সত্যিই তো, এতে কর্ণের কোনো দোষ নেই। এই কারণে কর্ণকে পক্ষকালের জন্য ফের মর্ত্যে ফিরে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করার অনুমতি দেওয়া হয়! এই পক্ষই পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত হয়। আর সেই থেকেই হিন্দুদের মধ্যে তর্পণের প্রথা চালু হয়।
যেহেতু পিতৃপক্ষে প্রেতকর্ম (শ্রাদ্ধ), তর্পণ ইত্যাদি মৃত্যু-সংক্রান্ত আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয়, সেই হেতু এই পক্ষ শুভকার্য করা হয় না। দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে গণেশ উৎসবের পরবর্তী পূর্ণিমা সাধারণত ভাদ্রপূর্ণিমা তিথিকে এই পক্ষ সুচনা এবং সমাপ্ত অমাবস্যা কে ধরা হয়। একে মহালয়া অমাবস্যা বা মহালয়া দিবসে। উত্তর ভারত ও নেপালে ভাদ্রের পরিবর্তে আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষকে পিতৃপক্ষ ধরা হয়।
এদিনই আবার দেবীর দুর্গার চক্ষুদান হয়। মহালয়া শব্দটির অর্থ, মহান আলয় বা আশ্রয় । দেবী দুর্গাই হলেন, আমাদের মহান আলয়।সেইদিক থেকে মহালয়া শুভ কারণ দুর্গাপুজো বয়ে আনে আনন্দ, আশার, শুভ বার্তা।হিন্দু ধর্মের যে কোনও শুভ কাজেই পিতৃপুরুষদের স্মরণ করে থাকে তাই মহালয়াকে শুভ বলা যেতে পারে। ‘মহালয়া’ শব্দটিকে স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয় কারণ এই দিনেই পিতৃপক্ষের অবসান হয় এবং অমাবস্যার অন্ধকার দূর হয়ে আলোকময় দেবীপক্ষের শুভারম্ভ হয়।লােক বিশ্বাস-— কৈলাস থেকে দেবী দুর্গা মহালয়া দিন বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। 
আবার সমুদ্র মন্থনের গল্পটি দেখলে দেখা যাবে। মােহিনী তথা বিষ্ণুর ছলনায় দেবতারা অমৃত পান করে অমর, অসুররা অমৃত বঞ্চিত হয়ে মরণশীল হয়ে যান।এই সময় দেবী মােহিনী হন দেবতাদের আশ্রয়স্থল অর্থাৎ মহৎ আলয়। দেবী মােহিনীকে দেবতারা মহালয়া তিথিতে আরাধনা করেছিলেন। দেবী মোহিনী মহালয়া নামে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।
আমার মতে মহালয়াকে পবিত্র শুভদিন বলা যেতে পারে ৷ এই দিন পূর্বপুরুষের আত্মার শান্তির জন্য পবিত্র গঙ্গাজল দেওয়া হয়৷ তাই এটি একটি পূন্যতিথি৷ দেবীপক্ষের সূচণাও এই দিনেই হয়৷
আসলে আর্য ও অনার্য জনজাতীর মেলবন্ধনের একটা বড় উদাহরণ এটি ৷যার সাথে সম্পর্কযুক্ত পূর্বপুরুষ পূজা৷ যেটি পৃথিবীর বিভিন্ন জনজাতীর মধ্যে বিভিন্নরূপে লক্ষ্যণীয়৷ ১লা মাঘ মাসে সমগ্র সুন্দরবনের আদিম জনজাতীর মধ্যে তথা অস্র্টিক জনজাতীর মধ্যে পূর্বপুরুষ পূজার নিদর্শন দেখা যায়৷ যদি বাস্তুপূজা হিসাবে ধরা হয় সেটিকে।৷

আমার মতে মহালয়াকে পবিত্র শুভদিন বলা যেতে পারে ৷ এই দিন পূর্বপুরুষের আত্মার শান্তির জন্য পবিত্র গঙ্গাজল দেওয়া হয়৷ তাই এটি একটি পূন্যতিথি৷ দেবীপক্ষের সূচণাও এই দিনেই হয়৷


আসলে আর্য ও অনার্য জনজাতীর মেলবন্ধনের একটা বড় উদাহরণ এটি ৷যার সাথে সম্পর্কযুক্ত পূর্বপুরুষ পূজা৷ যেটি পৃথিবীর বিভিন্ন জনজাতীর মধ্যে বিভিন্নরূপে লক্ষ্যণীয়৷ ১লা মাঘ মাসে সমগ্র সুন্দরবনের আদিম জনজাতীর মধ্যে তথা অস্র্টিক জনজাতীর মধ্যে পূর্বপুরুষ পূজার নিদর্শন দেখা যায়৷ যদিও বাস্তুপূজা হিসাবে ধরা হয় সেটিকে।৷

,,,,,,,

কৈলাস রহস্য

মা কয়েক দিন বাদে তার বাপের বাড়ি আসছেন। তাঁর আগে একবার মায়ের শশুর বাড়ি মানে শিবের ঘর কৈলাশের সম্পর্কে কিছু কথা জেনে নিই আসুন।হিন্দুদের মতে কৈলাস পর্বতেই শিব সপরিবারে বাস করেন ।গ্যাঙ্গডিস পর্বতের চূড়া যা তিব্বতের হিমালয় পর্বতমালার একটি অংশ। এটি এশিয়ার বৃহৎ সিন্ধু নদী, শতদ্রু নদী, ব্রহ্মপুত্র নদ প্রভৃতি নদীগুলোর উৎস স্থান।সংস্কৃতে কেলাস বা Crystal কথা থেকে কৈলাস কথাটির এসেছে। কারণ বরফে ঢাকা কৈলাসকে দেখে মনে হয় স্ফটিক। 
ছটি পর্বত শ্রেণী পদ্ম ফুলের পাপড়ির মতো ঘিরে আছে কৈলাস পাহাড়কে।কৈলাসকে ঘিরে রয়েছে নানা রহস্য, এই রহস্যে ঘেরা এই পর্বত সম্পর্কে এখনও অনেক কিছুই অজানা থেকে গিয়েছে। এই কৈলাস পর্বতের চূড়ায় এখনও পর্যন্ত কেউ উঠতে পারেননি। কৈলাস সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬ হাজার ৬৫৬ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। এভারেস্টের উচ্চতা ৮ হাজার ৮৪৯ মিটার হলেও এর চূড়ায় ঠিকই পর্বতারোহীদের পা পড়েছে। জানলে অবাক হবেন, এভারেস্টের চেয়েও কম উচ্চতাসম্পন্ন এই পর্বতে আজও কেউ উঠতে পারেনি।   তিব্বত মালভূমি থেকে ২২ হাজার ফুট ওপরে অবস্থিত কৈলাশ পর্বত  শুধু হিন্দুদের নয় বৌদ্ধ এবং জৈনদের কাছেও পবিত্র।  
ধর্মীয় প্রচলিত বিশ্বাস, যেহেতু কৈলাশে দেব-দেবীর বাস, সেখানে গেলেই দেবতাদের রোষে পড়তে হবে।তাই কোনও মানুষ সেখানে যেতে পারে না।  এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। পৌরাণিক বিশ্বাস, কৈলাশ পর্বতের পাদদেশেই রয়েছে মানস সরোবর এবং রাক্ষসতাল। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১৪ হাজার ৯৫০ ফুট ওপরে অবস্থিত মানস সরোবর বিশ্বের উচ্চতম মিষ্টি জলের হ্রদ।।মানস-রাক্ষস দুই হ্রদ পাশাপাশি আছে। অথচ মানসের পানি মিষ্টি ও শান্ত। আর রাক্ষসের পানি নোনা ও অশান্ত।
শোনা যায়, কয়েক জন সাইবেরিয়ান পর্বতারোহী কৈলাশ পর্বতের ‘ গিয়েছিলেন ,সঙ্গে সঙ্গে তাদের বয়স নাকি কয়েক দশক বেড়ে গিয়েছিল।, ওই পর্বত থেকে ফেরার পর হঠাৎ করেই নাকি নখ বা চুল বড় হয়ে যায়।  সেই থেকে এ ঘটনা রহস্যের মধ্যেই আছে।  
কথিত আছে, ১১ শতকে মিলারেপা নামে এক বজ্রযানী বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এই পর্বতের চূড়ার কাছাকাছি উঠতে যেতে পেরেছিলেন। তিনি নাকি  সবাইকে সাবধান করেন যে, ঈশ্বরের বাসস্থানে না যাওয়ার উপদেশ দেন। যদিও তারপরেও নাকি অনেকে সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তবে সবাই পথভ্রষ্ট হয়ে,  দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে মারা গিয়েছেন। 
কৈলাশ পর্বত দেখতে কিছুটা পিরামিডের মতো।  কৈলাশেই স্বর্গ এসে পৃথিবীতে মিলেছে বলে হিন্দুদের বিশ্বাস। হিন্দু পুরাণে মতে কৈলাস পর্বত হলো শিবের 'লীলাধাম'।  শিব ও তার সহধর্মিনী দুর্গা এবং কার্তিক-গণেশ ও শিবের অনুসারী ভক্তরা কৈলাশে  মহা আনন্দে বাস করেন। ২২ হাজার ফুট উচ্চতার কালো পাথরের এই পাহাড়কে প্রাচীন কাল থেকেই পৃথিবীর স্তম্ভ বলে মনে করা হয়, যা ধরে রেখেছে পৃথিবীর ভর।
তবে এই পবর্তটি খাড়া হওয়ায় চূড়ায়  যাওয়া সম্ভব হয়না। এখানে কোনো বরফ না জমে নিচে পড়ে যায়। আর  বরফ গলে গিয়ে উৎপত্তি হয় নদীগুলোর।  হাজার বছর ধরে পর্বতের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাতে চারপাশে ৫০ কিলোমিটার ট্র্যাকের পথে হেঁটেছেন অনেক তীর্থযাত্রীরা । এ পর্বতের গায়ে  অনেক প্রাচীন গুহা আছে।যেখানে বহু বছর ধরে  বৌদ্ধ ও হিন্দু সন্ন্যাসী তাপস্যে মগ্ন আছেন।বিজ্ঞানীরা বলছেন কৈলাসে নাকি কোনো চুম্বকীয় ক্ষেত্র নেই। যে কারণে কোনো কোনো কম্পাস কাজ করে না।
১৯৯৯ সালে রাশিয়ার এক চক্ষু বিশেষজ্ঞ এর্নেস্ট মুলদাশিফ এবং তার দল ঠিক করেন কৈলাস পর্বতের রহস্য উন্মোচন করবেন।হোয়ার ডু উই কাম ফ্রম’ বা ‘আমরা যেখান থেকে এসেছি’। বইয়ে তিনি কৈলাস পর্বতে সময় কাটানোর অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন।
 এর্নেস্ট মুলদাশিফ বলেছেন, বাস্তবে কৈলাস পর্বতে একটি মানব নির্মিত পিরামিড আছে। আর এ পিরামিডটি নির্মাণ করা হয় প্রাচীনকালে। তিনি দাবি করেন, একটি বড় পিরামিডকে অনেক ছোট ছোট পিরামিড ঘিরে আছে আর সেখানে ঘটে অলৌকিক ঘটনা।

তিনি লেখন, "রাতের নিস্তব্ধতায় পাহাড়ের ভেতর থেকে ফিসফিস করে কথা বলার শব্দ আসে। এক রাতে আমি আর আমার দুই সহযোগী পাথর পড়ার আওয়াজ পেয়েছি। আর এ আওয়াজ কৈলাস পর্বতের পেটের ভেতর থেকে আসছিল। আমরা ভেবেছিলাম, পিরামিডের মধ্যে হয়তো কোনো শক্তি আছে, যারা ঠিক মানুষের মতোই কথা বলছে।"
তিনি লিখেছেন"বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে আমার পক্ষে কঠিন এ বিষয়ে চর্চা করা । তবে আমি পরিষ্কারভাবে বলতে পারি,  পৃথিবীর বাইরের জগতের সঙ্গে জড়িত আছে কৈলাস পর্বত।

Friday, 23 September 2022

কলকাতার গিন্নী মা

কলকাতার গিন্নি মা কথা বলতে গেলে প্রথমে যে কথা মনে পরে সেটা হলো।শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেব এই মন্দিরে আসতেন । ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ বলতেন, "ওরে এই মা সকলের মনবাঞ্ছা পূর্ণ করেন।  তোদের যা যা কামনা তাই তিনি পূর্ণ করতে পারেন।" যখন ব্রাহ্মসমাজের কেশবচন্দ্র সেন  মরণাপন্ন অসুস্থ হয়েছিলেন । তখন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর রোগমুক্তির কামনায় এখানে মানত করেন। এবং তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন।এই মন্দিরের দেবীকে ‘উত্তর কলকাতার গিন্নি’ বলতেন নাট্যসম্রাট গিরিশচন্দ্র ঘোষ।

লোক কথা অনুযায়ী ১৬০০ খ্রিস্টাব্দেরও আগে কুমোরটুলি অঞ্চলে   হোগলা পাতার ছাউনির নীচে মা  সিদ্বেশ্বরী কালী  মূর্তিটি পুজো করতেন কালীবর তপস্বী নামে এক সন্ন্যাসী । তাই এই  মূর্তির সঠিক প্রতিষ্ঠাকালের আজও হদিশ পাওয়া যায়  নি ।  তবে   ১৭৩০-৩২ মধ্যে কুমোরটুলির গোবিন্দরাম মিত্র মন্দিরটি তৈরি করেন বলে জানা যায়। এটি আগে নবরত্ন মন্দির ছিল।  ১৮৪০ সালের ভূমিকম্পে তা ভেঙে যায়। 
সাহেবরা মায়ের নাম দেন "ব্ল্যাক প্যাগোডা" ।
ব্ল্যাক প্যাগোডা আর গোবিন্দ রামের গল্পটা বলা দরকার। সাহেবরা বলতেন 'গোবিন্দরাম মিটারস প্যাগোডা'। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসিত বাংলাতে শ্রী গোবিন্দরাম মিত্র  ছিলেন  সরকারি ট্যাক্স কালেক্টর।  ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা যখন সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের কাছ থেকে কলিকাতা, গোবিন্দপুর ও সুতানুটি, এই তিনটি গ্রাম কিনে নিয়ে তাদের নিজস্ব জমিদারি প্রতিষ্ঠা করে, তখন তারা কর আদায়ের জন্য ভারতীয় ডেপুটি ট্যাক্স কালেক্টর নিয়োগ করে শ্রী নন্দরাম সেনকে । শ্রী নন্দরাম সেন প্রথম ভারতীয় ডেপুটি ট্যাক্স কালেক্টর ছিলেন । তাঁর ঠিক পরেই কোম্পানি শ্রী গোবিন্দরাম মিত্র কে ট্যাক্স কালেক্টরের পদে নিয়োগ করে। ট্যাক্স কালেক্টর হিসাবে শ্রী গোবিন্দরাম মিত্র প্রচুর অর্থ উপার্জন করে ছিলেন ।  গোবিন্দ মিত্র বাবুর প্রাসাদসম বাড়ি ছিল কলকাতার কুমোরটুলি অঞ্চলে। এই বাড়িটি প্রায় ৫০ বিঘা জমি জুড়ে ছিল। এছাড়া নন্দন বাগান বলে অন্য একটি স্থানেও তার আর একটি প্রাসাদসম বাড়ি ছিল। তার বাড়িতে ধুমধাম করে দূর্গা পূজা হত। মা দূর্গার মূর্তিটি সোনা ও রুপার অলংকারে সুসজ্জিত ছিল। মন্দিরে প্রতিদিন প্রায় ৩৭ কেজির অন্নভোগ দান করা হত। প্রায় হাজার ব্রাহ্মন দূর্গা পূজার প্রতিদিন তার গৃহে অন্ন গ্রহণ করতেন ও দামি উপহার পেতেন। 'গোবিন্দরামের ছড়ি', এই প্রবাদ বাক্যটি গোবিন্দরাম মিত্রের সাথেই সম্পর্কিত। আগে বাংলায়, বিখ্যাত লোকেদের নিয়ে একটি ছড়া ছিল। সেটি হল-

"বনমালী সরকারের বাড়ি,
গোবিন্দরাম মিত্রের ছড়ি,
উমাচন্দের দাড়ি,
হুজুরীমালের টাকাকড়ি"।

শ্রী গোবিন্দরাম মিত্র নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি দেখাবার জন্যই, কলকাতার কুমোরটুলিতে গঙ্গার ধারে, এই সুবিশাল নবরত্ন কালী মন্দিরটি বানান ১৭২৫ খ্রিস্টাব্দে কেউ বলেন ১৭৩১ খ্রিস্টাব্দে। মন্দিরটি প্রায় ১৬৫ ফুট বা তার বেশী উঁচু ছিল। মন্দিরের চূড়ায় বসানো ছিল, গঙ্গায় চলা জাহাজের জন্য দিক নির্দেশক চিহ্ন। তবে গোবিন্দরাম, মন্দিরটিকে কখনোই সম্পূর্ন রূপে নির্মাণ করে যেতে পারেন নি। তার মৃত্যুর পরে, এই সুবিশাল মন্দির রক্ষণ করাও তার পরিবারের পক্ষে সম্ভব হয় নি। পরে মন্দিরটির মূল চূড়া সমেত অংশটি ভেঙ্গে পড়ে যায়।  ধীরে ধীরে ভগ্ন হয়ে যায় মন্দিরটি।

দেবী মূর্তি কালো মৃন্ময়ী।  বিবস্ত্রা নন।  বিশেষ লক্ষনীয় দেবীর দুই পা আগে পিছে না হয়ে পাশাপাশি। তবে দেবীর বাম পা মহাদেবের বুকে।এক  হাতে খড়্গ ও এক  কাটা নরমুন্ডু। 

শোনা যায় কালীপুজোর রাতে আজও এখানে তন্ত্রোক্ত বিধিতে দেবীর পুজো হয়।   ১৬০৪ সালে পর্যন্ত নাকি এখানে নরবলি হয়েছে। পরে এখানে পশুবলি হতো । কার্তিকী অমাবস্যা , বুদ্ধপূর্ণিমায় ফুলদোল এবং জ্যৈষ্ঠ মাসের ফলহারিণী কালীপুজো এখানে বড় করে পালিত হয়। রাজা নবকৃষ্ণ দেবের সময় থেকে আজো শোভাবাজার বাজার থেকে সব্জি আসে ভোগের জন্য। কালীপুজোর দিন সুধা ভোগের থাকে। এইভোগে থাকে খিচুড়ি, ভাজা, সাদাভাত, ডাল, নানা ধরনের তরকারি, ডালনা, মাছ, চাটনি পায়েস ইত্যাদি থাকে। 


Tuesday, 20 September 2022

বিশ্ব কর্মা পূজা ও ঘুড়ি ওড়ানো


বিশ্বকর্মা পূজায় ঘুড়ি ওড়ানো বাংলার এক ঐতিহ্য। মানুষের আশা-আকাঙ্খা, আনন্দ, সুখও যেন উর্ধ্বমুখী হয় সেই আশাতেই রঙিন ঘুড়ি ওড়ানো হয়।শোনা যায় অনেক আগে থেকে, পাঞ্জাবে ঘুড়ির উৎসব বেশ জনপ্রিয় ছিল। বর্ধমান রাজারা নাকি পাঞ্জাব থেকে এসেছিলেন।এই রাজাদের হাত ধরেই বাংলায় ঘুড়ির উৎসবের শুরু হয়েছিল। পৌরাণিক কাহিনীতে বিশ্বকর্মা ঈশ্বরদের জন্য উড়ন্ত রথতৈরি করেছিলেন। এদিন আকাশে ঘুড়ি ওড়ানো হয় সেই রথের কথা স্মরণ করে । 
পুরাণ মতে, বিশ্বকর্মা কারিগর , এবং ঋগবেদ অনুসারে স্থাপত্য এবং যন্ত্রবিজ্ঞান বিদ্যার জনক। আমি জানি তিনিই কৃষ্ণের বাসস্থান দ্বারকা নগরী তৈরি করে দিয়েছিলেন। শ্রমিক থেকে ইঞ্জিনিয়ারদের দ্বারা পূজিত হন তিনি। তাঁর দিনে বহু বছর ধরেই বাংলার আকাশে ঘুড়ি ওড়ানোর রীতি আছে।
কেউ কেউ মনে করেন মুঘল যুগ থেকে ঘুড়ি উরানো চল হয় বাংলায়।ইতিহাস বলে মোটামুটি ১৮৫০ সাল থেকে বাংলায় বিশ্বকর্মা পুজোর দিন আকাশে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রচলন হয়। ঘুড়ি আসলে আশা, খুশি, উল্লাস, স্বাধীনতা, শুভ সন্দেশের প্রতীক। সংক্রান্তির শুভক্ষণে ঘুড়ি ওড়ানো খুশি ও স্বাধীনতার বার্তা দেয়। সুলতান শাসনের অবসান পর। বাঙালিরা আসলে অর্থনৈতিক ভাবে আবার সাবলম্বী হয়েছিলেন তাই এই উৎসবের জনপ্রিয়তা এই সময় থেকেই হয় বলে ধারণা।বাংলার কিছু ব্যবসায়ী এ সময় নিজেদের অর্থ এবং প্রতিপত্তি দেখানোর জন্য এদিন ঘুড়ির সঙ্গে টাকা বেঁধে আকাশে ওড়াতেন। এমনটাও শোনা যায় জমিদাররা নাকি টাকা দিয়েই ঘুড়িও বানিয়ে ফেলতেন!
তবে বাংলায় নয় ভারত বিভিন্ন রাজ্য ছাড়া বিদেশেও ঘুড়ি ধর্মীয় সংস্কৃতি উৎসবের অঙ্গ।ভারতের গুজরাতের উত্তরায়নের দিনে আয়োজিত হয় ঘুড়ি উৎসব। গুজরাটিরা ঘুড়ি উড়িয়ে সূর্য দেবতাকে খুশি করেন এবং মনের আকুতি, অভিলাষ জানান। 
মালয়েশিয়ায় পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে মানা হয় ঘুড়িকে।বাড়ির আশপাশে ভূত তাড়াতে ঘুড়ি উড়ায়।এরা ঘুড়িকে জ্বিন বা ভূতের ওঝা হিসেবে ব্যবহার করে। নেপালে ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব মাঘি নামে ডাকা হয়। মিয়ানমারে থিং ইয়ান,থাইল্যান্ডে সংক্রান, লাওসে পিমালাও, হিসেবে উৎসব পালন করা হয়। 
ইস্টারের সময় গায়ানায় ধর্মীয় ঐতিহ্য হিসেবে ঘুড়ি উৎসব হয় । আগস্ট জুড়ে ঘুড়ি উৎসব কলম্বিয়াতএ। স্বাধীনতা দিবসকে উপলক্ষে করে ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব পালন করা হয় চিলিতে। চিনে কানাডা আর যুক্তরাষ্ট্রের নানা রাজ্যজুড়ে ঘুড়ির নানা উৎসব পালিত হয়।
বাংলাদেশ কথা একটু আলাদা করেই বলতে হবে। বাংলাদেশে শীত মৌসুমের বাৎসরিক ঘুড়ি উৎসব উদ্‌যাপন করে।, ঘুড়ি উড়িয়ে পালন করা হয় পৌষসংক্রান্তি দিন। সংস্কৃত শব্দ 'সংক্রান্তি' ঢাকাইয়া অপভ্রংশে সাকরাইন ।সাকরাইন হল বাংলাদেশের ঘড়ি উৎসব।

তবে ঘুড়ি শুধু বিনোদন নয়।পৃথিবীর নানা প্রান্ত।যুদ্ধের কাজে ঘুড়ি ব্যবহার করা হয়েছে । চীন দেশের এক সেনাপতি হানসিন শত্রুর কেল্লার দূরত্ব মাপার জন্য এই ঘুড়ি ব্যবহার করেছিলেন। শত্রুপক্ষের চোখ এড়িয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের লোকদের কাছে সংবাদ প্রেরণের কাজেও ব্যবহৃত হতো ঘুড়ি। ঘুড়িতে ক্যামেরা বেঁধে শত্রুপক্ষের ছবি তোলা, বা ঘুড়িতে বিস্ফোরক বেঁধে শত্রুপক্ষের জাহাজ ধ্বংস করা থেকে শুরু করে নানা কাজে ব্যবহার হয়েছে ঘুড়িকে।
বিজ্ঞানের কাজে ঘুড়ির ব্যাপক ব্যবহার হয়েছে। ১৭৪৯ সালে আলেকজান্ডার উইলসন ঘুড়ি মাধ্যমে উর্ধ্বাকাশের থার্মোমিটার পাঠিয়ে তাপমাত্রা নির্ণয়ের চেষ্টা করেছিলেন। ১২ ডিসেম্বর ১৯০১ সালে ঘুড়িকে ব্যবহার করে বৈজ্ঞানিক মার্কনি আকাশের ইলেকট্রোম্যাগনেটিভ ওয়েভ ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৭৫২ সালে বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিন কৃত্রিমভাবে প্রস্তুত বিদ্যুৎ ও আকাশের বিদ্যুৎ যে এক তা প্রমাণ করেন ঘুড়ির সাহায্যেই।

খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ সনে গ্রিসের ট্যারাস্টাস শহরে আর্কিটাস নামের এক ভদ্রলোক প্রথম আকাশে ওড়ানোর ঘুড়ি ওড়ানো চেষ্টা করেছিলো বলে লোকমুখে শোনা যায় । কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ২০০ সনে চীন দেশের রাজা হানসিন নামের এক সেনাপতি প্রথম এ ঘুড়ি তৈরি করেছিলেন দাবি করা হয় । তবে প্রায় ২,৮০০ বছর আগে প্রাচীনকালের ছুনছিউ আমলে মুওছু নামের একজন দার্শনিক ৩ বছর সময় ধরে কাঠ দিয়ে একটি ঘুড়ি তৈরি করেছিলেন। যাকে বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো ঘুড়ি বলে বলা হয় । তবে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইউরোপের মানুষ , ইটালিয়ান পর্যটক মার্কো পোলোর মাধ্যমে ঘুড়ির কথা জানতে পারবেন । তবে ১৮৬০ সাল থেকে ১৯১০ ঘুড়ির স্বর্ণযুগ বলা হয় । তাই আমি মনে করি বাংলায় ১৮৫০ পর ঘুড়ি উরানো প্রচলন হয়েছিল হয়তো।

Friday, 16 September 2022

মা মনসার স্বরূপ

অনেক রকম প্রাচীন দেবভাবনা ও রূপকল্পনা কাহিনী মিলেমিশে মনসামঙ্গলে মনসার কাহিনী তৈরি হয়েছে। আমার মনে হয় মনসা দেবীর মূতিটা কল্পনা এসেছে  বহু উপাদান অর্থাৎ বহু দেবদেবী মিশ্রনে।মনসার মূর্তিতে তাকে সর্প-পরিবেষ্টিত নারী রূপে দেখা গেলেও তিনি লক্ষী স্বরস্বতী মিশ্রন। দেবীর রূপটা লক্ষ করুন।তিনি একটি হংস বা পদ্মের উপর বসে থাকেন। তার বাহন হাঁস ও সাপ। তার চার হাত। তার উপরের দুটি হাতে থাকে পদ্ম ও নিচের দুটি হাতে থাকে সাপ। সাতটি সাপের ফনা তার মাথার উপর ছাউনির আকারে বিরাজ করে। কোনো কোনো মূর্তিতে তার কোলে একটি শিশুকে দেখা যায়। এই শিশুটি তার পুত্র আস্তিক। ‘একচক্ষু-বিশিষ্ট দেবী’ মনসা বলা হয়,মনসার মা চণ্ডী ক্রোধের বসে তার একটি চোখ পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। এখানে লক্ষ্য করুন, লক্ষ্মী, সরস্বতী, ষষ্ঠী দেবীর রূপের মিশিয়ে আছে।
মনসার ঘটকে দেখুন।মানব সমজের গতি অর্থাৎ প্রবহমানতার মাধ্যম হলো সৃষ্টি। এই মনসা ঘট হলো গর্ভবতী নারীর প্রতীক। যেখান থেকে প্রাণ সঞ্চার হয়ে মানব জীবন ক্রম বিবর্তনের মাধ্যমে এগিয়ে চলছে এ জগৎ সংসারে। মনসা ঘট যেমন গর্ভবতী নারীর প্রতীক তেমনই ফসলের উর্বরতার প্রতীক, তাই মানসা প্রজনন শক্তির প্রতীক হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে।
বাস্তুদেবতার, আরোগ্যের দেবতা অথবা সম্পদের দেবতা—এই বিভিন্ন নামে মনসার পূজা এদেশে বরাবর চলে এসেছে।বৈদিক ‘সর্পরাজ্ঞী’ বা বসুন্ধরা সাপের দেবতা, হয়েও তিনি নিজে সাপ নন। আরোগ্য ও পুষ্টির রূপকাশ্রিত দেব ভাবনা যদিও মহিমা বেদের সময় থেকেই ।  
তত
তবে দেখা যায় মনসা আসলে সরস্বতী, নামান্তর ইলা, পুষ্টি, শ্রী।সরস্বতী যেমন বিদ্যাদেবী, তেমনি মনসা প্রথমে বাক্ পরে মূর্তিমতী বিষবিদ্যা। সরস্বতী গীতবাদ্যের দেবী, মনসার গীতবাদ্যপ্রিয়।গান-বাজনা না হলে তার পূজা হয় না এবং মঙ্গল কাব্য দেখুন এই গীতনৃত্য করেই বেহুলা মনসার প্রসাদ বা আশীর্বাদ লাভ করেছিলেন।  
মনসাই আবার  গৌরী যিনি জল কেটে একপদী দ্বিপদী চতুষ্পদী অষ্টাপদী নবমপদী সৃষ্টি করেছিলেন। ইনিই বাক্দবী যিনি নারীরূপে গন্ধর্বদের ছলনা করে দেবতাদের সোম এনে দিয়েছিলেন, যা আসলে অমৃত। দেবীর এই প্রসন্ন রূপ ।
কিন্তু  বাংলা সাহিত্যে গোড়া থেকেই এ কথা গুলো ঢাকা পড়ে গিয়েছে । এখানে মনসা চণ্ডীর প্রতিদ্বন্দ্বী, শিবভক্তের বিদ্বেষিণী।
ঋগ্বেদের একটি রূপক ভাবনাও পরে দেবীত্বে মূর্তি এই রূপ পেয়েছিল। তিনি দুর্গম অরণ্যের দেবী। পৌরাণিক সাহিত্যে ইনি দুর্গতের দেবতা দুর্গা এবং পার্বতী, চণ্ডী হয়েছেন। তারও আগে ইনি সরস্বতী ও শ্রীর সঙ্গে অভিন্ন ছিলেন। পৌরাণিক যুগের আগেই সরস্বতী ও শ্রীর সঙ্গে বাস্তুনাগ দেবতার পূজা মিশে গিয়েছে মনসা রূপ নিয়েছে। তখন থেকেই মনসা নিজে নাগ না হয়েও সর্পরাজ্ঞী। এবং সরস্বতী ও শ্রী দুই পৃথক দেবতায় মনসা ও লক্ষ্মী পরিণত হবার আগেই দেবীকে  নাগদেবী-পূজা শুরু হয়ে গেছে । পরে সরস্বতী ও শ্রী যখন ভাগাভাগি হল তখন মনসার ভাগে পড়ল সর্পনাগ আর লক্ষ্মীর ভাগে পড়ল হস্তীনাগ। মনসা ও লক্ষ্মীর  একছিলেন তার অনেক প্রমাণ আছে। দুই জনেরই নামান্তর কমলা ও পদ্মা। পদ্মদলে মনসার উৎপত্তি আর কমলার আসন পদ্মে। লক্ষ্মীর উৎপত্তি সাগরে, মনসার উৎপত্তি হ্রদে।
পৌরাণিক সাহিত্যে মনসার ও সরস্বতীর প্রাচীনত্বের ও মৌলিকত্বের বিশেষত্ব অত্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়।। সরস্বতী অবিবাহিত কেউ কেউ বলেন  তিনি বিষ্ণুপত্নী, মনসাও স্বাধীন নারী জরৎকারুর সঙ্গে তার বিবাহ দেবসমাজে কেবল মুখরক্ষা মাত্র। সরস্বতীকে স্রষ্টা ব্রহ্মা কামনা করেছিলেন। মনসাকে তার পিতা শিব কামনা করেছিলেন। যদিও মঙ্গলকাব্যে শিবকে মনসার পিতা বলা হলেও , পুরাণে সেই তথ্যের সমর্থন পাওয়া যায় না। 
কাহিনীতে বলা হয়‌।সাপ ও সরীসৃপরা পৃথিবীতে উৎপাত থেকে মুক্তি পেতে  , ঋষি কশ্যপ নিজের মন থেকে মনসা দেবীর জন্ম দেন । মন থেকে জন্ম বলে তার নাম হয় ‘মনসা’ । সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা তাকে সর্প ও সরীসৃপদের দেবী করে দেন । মনসা তার পৃথিবীতে নিজের কর্তৃত্ব বিস্তার করেন । এরপর মনসা শিবকে প্রসন্ন করেন । শিব তাকে বলেন নারায়ণ প্রসন্ন করতে । মনসার প্রতি প্রসন্ন হয়ে নারায়ণ তাকে সিদ্ধি নামক দৈবী ক্ষমতা প্রদান করেন । এর ফলে দেবী হিসেবে মনসার স্বীকৃতি পথ প্রস্থ্য হয় ।
এদিকে রাঢ়ে চৈতন্যদেবের সময়ে মনসাকে মা দূর্গার এক রূপ মনে করা হত।চৈতন্যদেবের সময় বাংলাদেশে মাটির প্রতিমা গড়ে ঘটা করে মনসা পূজা হতো । কিংবদন্তি অনুসারে, শিব বিষ পান করার পর মনসা মধ্যে তা সঞ্চার হয় এবং মনসা ‘বিষহরী’ নামে পরিচিত হন। মনসার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায় এবং তা দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে মনসা-কেন্দ্রিক ধর্মীয় গোষ্ঠীটি শৈবধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হয়। এর ফলে শিবের কন্যা রূপে মনসার জন্মের উপাখ্যানটি রচিত হয় এবং  চন্ডীর সাথে বিবাদের গল্পটিও আমাদানি হয়।শেষ পর্যন্ত শৈবধর্মও এই আদিবাসী দেবীকে মূলধারার হিন্দুধর্মের ব্রাহ্মণ্য ধারার অন্তর্ভুক্ত করে। তাই আমরা দেখি শিব ভক্ত চাঁদ সদাগর হাতে পূজা পেয়ে তিনি দেবী হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছেন।
যদিও এদেশে মনসা-কাহিনীর সূত্রপাত বৈদিক যুগে, কিন্তু পূর্ব-ভারতে বৈদিক যুগ শেষ হওয়ার আগেই মনসা বাস্তুদেবতায় ও গ্রামদেবীতে পরিণত হয়েছিলেন। তারপর ধাপে ধাপে তার অবনতি ঘটে। আধুনিক সময়ে তিনি ভদ্র দেবসমাজ-বহিস্কৃত নারীপূজিত দেবী রূপেই প্রধানতঃ রয়ে গিয়েছেন।গ্রামদেবীরূপে তিনি পশ্চিমবঙ্গে চণ্ডী বা বিশালাক্ষী রূপ পূজিত হয়ে চলছে।
তবে মনসা শব্দটি বিশ্লেষণ করলে অর্থ দাড়ায় মনচিন্ত। আমাদের মনের মধ্যে বিষ থাকতে পারে সেই বিষ অবশ্যই মনকে বিষাক্ত করে। মনকে বিষমুক্ত ও চিন্তা মুক্ত করার জন্য মনসা পূজা করা হয়  বোধহয় আসলে।

+ ছবি গুলো সংগৃহীত , গ্যালারিতে পরেছিলো তাই কাদের তোলা এ মুহূর্তে মনে নেই।

রান্না পূজা

অরন্ধন উৎসব বাঙালির একটা ঐতিহ্য।যদিও পশ্চিমবঙ্গে বছরে দু'বার 'অরন্ধন' উৎসব পালিত হয়। একবার মাঘ মাসে শ্রীপঞ্চমী তথা সরস্বতী পূজার পরের দিন শীতলষষ্ঠীতে।  কোথাও কোথাও শিলনোড়া পূজা বলে। তবে রান্না পূজা বলতে আমরা ভাদ্র সংক্রান্তিতে মনসা পূজার দিনকে বুঝি ।মনসা পূজার অবিচ্ছেদ্য অংশই হল - 'অরন্ধন' উৎসব বা রান্না পূজা। তবে পশ্চিমবঙ্গের স্থানভেদে বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসব্যাপী যে কোন শনিবার বা মঙ্গলবারে এবং নাগপঞ্চমী হতে প্রতি পঞ্চমী তিথিতে মনসাদেবীর পূজা শুরু হয় এবং ভাদ্র সংক্রান্তিতে মনসাদেবী ও অষ্টনাগপূজা সমাপন ও ভাসান হয়। সেই উপলক্ষে  সংক্রান্তি দিন  পালিত হয় 'অরন্ধন'। যেহেতু ভাদ্র মাসের শেষ দিনে রান্না করা হয়তাই  অরন্ধন উৎসবকে  ভাদ্রে রেঁধে আশ্বিনে খাওয়ার উৎসব-ও বলা হয়।ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে মনসা পূজোর দিন  অরন্ধন উৎসব পালিত হয় তাকে উনুন পূজো বলা হয় । এই দিন বাড়িতে উনুন জ্বালাবার নিয়ম নেই। তাই আগের দিন রান্না করে সেই বাসি খাবার খাওয়ার রীতি অরন্ধন উৎসবে।

পূজার ব্যবস্থা অনুযায়ী অরন্ধন দুই ধরনের রান্না দেখা যায়। ইচ্ছারান্না, ও ধরাটে রান্না বা আটাশে রান্না । ইচ্ছা রান্না - ভাদ্র মাসের মঙ্গলবার ও শনিবার রাতে এই রান্না পুজো হয়। যেহেতু নিজেদের ইচ্ছে মতো দিনে এই রান্না পুজো হয় তাই ইচ্ছে রান্না বলে।  আর  গাবড়া রান্না বা আঠাশে রান্না -  দখনো বা দখিনারি দের বাড়িতে হয়ে থাকে ভাদ্র মাসের আঠাশ তারিখে এই রান্না পুজো হয় তাই একে আঠাশে রান্না।
বিশ্বকর্মা পূজার দিন পালিত হলে সেই অরন্ধনটিকে ‘বুড়োরান্না’ বলা হয়ে থাকে।রান্না করে পান্তা খাওয়ার রীতি আছে বলে অনেক জায়গায় একে পান্তা পুজোও বলে।
হেঁশেলের একস্থানে পরিষ্কার করে ফণিমনসা কিংবা শালুক গাছের ডাল সাজিয়ে মনসার ঘট সাজিয়ে বিশেষ পুজো করা হয়। বিশ্বকর্মা পুজোর (Vishwakarma Puja) আগের দিন প্রায় সারা রাত জুড়ে চলে রান্নাবান্নার চরম ব্যস্ততা সাথে।সারারাত ভোগরান্নার পরে সিঁধ বৃক্ষের বায়মনসা গাছের  পাশে রান্নাপুজোর ভোগ রাখা হয়। মনসার ঘট বা পাঁচফণার ঘট পেতে মাটিতে গোবর ছড়া দিয়ে , কুলোয় পদ্মপাতা বা কলাপাতা বা পাথরের বা কাঁসার থালাতে সবরকম ভোগ সাজিয়ে  দেবীকে উৎসর্গ করা হয়। ঘরের উনুনেকেও এইদিন মনসা ডাল , শাপলা র মালা ও আল্পনা দিয়ে সাজানো হয় ও পুজো করা হয়।পুজোর জায়গায় চমৎকার আল্পনা দিয়ে ফুল সাজিয়ে দেওয়া হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি রাখির পাশাপাশি অরন্ধন উৎসব কেও জনপ্রিয় করে তোলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি রাখির পাশাপাশি অরন্ধন উৎসব কেও জনপ্রিয় করে তোলেন। আসলে যেটা হয়েছিল ব্রিটিশ সরকারের বঙ্গভঙ্গ নীতি আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয়েছিল ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর। আগে থেকেই আন্দোলনকারীরা ওই দিন ব্যাপক হরতাল ও জাতীয় শোক দিবস পালন করবেন ঠিক করে ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে প্রস্তাব রাখেন, ১৬ অক্টোবর কোনো বাড়িতে রান্নাবান্না হবে না। অরন্ধন এবং উপবাস পালন করা হবে বাংলা জুড়ে। 

বর্ষা পর যেহেতু চারিদিকের নদী নালা জলে ভরে । এসময় গ্রাম বাংলায় বাড়িতে সাপের উপদ্রব বাড়ে যেতো। তাই  অতীত কাল থেকে মা মনসাকে তুষ্ট করতে এই বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়। দক্ষিণ বঙ্গের সব বাড়িতে  মা মনসার মঞ্চ দেখা যায়।



তবে  বাংলা আরো দুইটি রান্না পূজা দেখা যায়। ষষ্ঠীর দিন এই রান্না পুজো হয় তাই একে ষষ্ঠী রান্না , প্রচলিত আছে তাকে দূর্গা রান্না বলা হয়। যেটি দূর্গা পুজোর সময় হয়।

প্রায় সব রান্না পুজোতেই কমবেশি এক ধরনের রান্না হয়। যেহেতু পান্নার দিন বাসি খেতে হয় তাই মূলত ভাজা বেশী হয়। তাহলে দেখা যাক কি কি রান্না করা হয়।


Sunday, 11 September 2022

ব্যান্ডেল চার্চের ইতিকথা

১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ নির্মিত ব্যান্ডেল গির্জা বা ব্যান্ডেল চার্চ পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীনতম খ্রিষ্টান গির্জাগুলির একটি। এই গির্জার পোষাকি নাম দ্য ব্যাসিলিকা অফ দ্য হোলি-রোসারি, ব্যান্ডেল।  ব্যান্ডেল শব্দেটি কিন্তু  ইংরেজি শব্দ নয়। পর্তুগিজ ভাষায় ব্যান্ডেল শব্দের অর্থ হল, জাহাজের মাস্তুল। একটা গির্জার নাম কেন জাহাজের মাস্তুল হবে? তা জানতে ফিরতে হবে আজ থেকে চারশো বছরেরও বেশি আগে, ষোড়শ শতকের শেষ ভাগে।

ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে পর্তুগিজরা ব্যান্ডেল শহরটিকে বন্দর হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। পর্তুগিজরা প্রথম বাংলায় আসে ১৫১৮ খ্রীষ্টাব্দে। এর প্রায় ১৯ বছর পর ১৫৩৭ খ্রীষ্টাব্দে বাঙলার তৎকালীন নবাব মাহমুদ শাহের ফর্মানের বলে তাদের বাঙলায় ব্যাবসা-বাণিজ্যের স্বপ্ন বাস্তবে রূপান্তরিত হয়।১৫৩৭-এ পর্তুগিজ অ্যাডমিরাল সাম্পায়ো যুদ্ধ জাহাজ ও সেনা নিয়ে শের খাঁ-কে আক্রমণ করেন । সেই যুদ্ধ জয়ের দৌলতেই পর্তুগিজরা গঙ্গার পাশে বাণিজ্যকুঠি গড়ে তোলার সুযোগ পায়।১৫৭১ খ্রিষ্টাব্দে তারা মুঘল সম্রাট আকবরের নিকট থেকে হুগলিতে একটি শহর নির্মাণের অনুমতি পায়।  তখন থেকেই এখানে বসবাস শুরু করলে এরা। ক্যাপ্টেন পেড্রো তাভারেস বন-জঙ্গল সাফ করে নতুন নগর ও বন্দরের পত্তন করলেন। নাম রাখলেন ‘উগোলিম’ (ইংরাজিতে আগলি)। ঐতিহাসিক সেই নাম-শব্দেরই অপভ্রংশ ‘হুগলি’।সরস্বতী নদীর ক্রমহ্রাসমান নাব্যতার কারণে পর্তুগিজরা সপ্তগ্রাম ছেড়ে ভাগীরথীর তীরে হুগলীতে বসতি স্থাপন করতে বাধ্য হয়। শীঘ্রই হুগলী হয়ে ওঠে বাঙলায় পর্তুগিজদের দখলে থাকা বন্দর শহর গুলোর মধ্যে সব থেকে সমৃদ্ধ এবং জনবহুল শহর। ১৫৮৮ সালে হুগলীতে আসা ব্রিটিশ পর্যটক ও বণিক র‍্যালফ ফিচ হুগলীকে পর্তুগিজদের প্রধান ঘাঁটি হিসাবে বর্ণনা করেন।
এদিকে ক্যাপ্টেন পেদ্রো তাভারেস সর্বসমক্ষে ক্যাথলিক ধর্মপ্রচার ও গির্জা নির্মাণ করার জন্য সম্রাটের অনুমতি লাভ করেন।পাদ্রিরা স্থানীয় লোকেদের ধর্মান্তরিত করতে শুরু করেন। ১৫৭৯ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগিজেরা হুগলি নদীর তীরে  এই অঞ্চলে,একটি বন্দর ও দুর্গ নির্মাণ করে ফেলেন এখানে।১৫৯৮ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ হুগলিতে ক্যাথলিক খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ হাজার। ১৫৯৯ সাল নাগাদ হুগলি নদীর তীরে এই জায়গায়  গড়ে তুলল পর্তুগিজরা আর সেখানেই একটা গির্জা তৈরি করল উপাসনার জন্য। 
চলছিল বেশ কিন্তু পর্তুগিজদের লুঠপাট ইত্যাদির জন্য মুঘলরা বেশ অসন্তুষ্ট ছিল তাদের উপর।  তবে শুধু লুটপাট নয় শোনা যায় তাঁর দাস করা জন্য মানুষ তুলে নিয়ে যেতো।  ১৬২১ থেকে ১৬২৪ সালের মধ্যে পর্তুগিজরা সুন্দরবন তথা বাংলার নদী সংলগ্ন অসংখ্য গ্রাম থেকে হিন্দু-মুসলিম মিলিয়ে মোট প্রায় ৪২,০০০ মানুষকে ক্রীতদাস বানিয়ে চট্টগ্রামে নিয়ে যায়, যাদের মধ্যে প্রায় ২৮,০০০ মানুষকে ধর্মান্তরিত করা হয়।
সেই সব কারণে, সম্রাট শাহজাহান আদেশ,  ১৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে নবাব কাশেম খান জুভেয়নীর নেতৃত্বে মুরেরা হুগলি পর্তুগিজ কলোনি আক্রমণ করলেন। আসলে ১৬২২-এ সম্রাট জাহাঙ্গির-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন যুবরাজ হারুণ বা শাহজাহান। পর্তুগিজের গভর্নর মাইকেল রডড্রিগস শাহজাহানকে সাহায্যের করতে রাজি হননি। তাই ১৬২৮ শাহজাহান সিংহাসনে বসে বদলা নিতে চেয়েছিলেন পর্তুগিজ দের ওপর। আর বিভিন্ন অরাজকতার অভিযোগ পেতে মুঘল সুবেদারকে ব্যান্ডেল অভিযান করতে নির্দেশ দেন সম্রাট শাহজাহান।

 ২৪ জুন, সেন্ট জন দ্য ব্যাপটিস্ট-এর উৎসব কথা আপনাদের জানা আছে। ১৬৩২-এর এই দিন এই দূর্গার কোন বিশ্বাসঘাতকের সাহায্যে কপটতার সাথে, মুঘল সেনারা দূর্গের পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকে অস্ত্রভাণ্ডারের দখল করে বারুদখানায় আগুন লাগায়।  সাধারণ খ্রিস্টানদের গণনিধন হয়।  তৎকালীন পর্তুগিজ গভর্নরকে এবং নিহত হয় পাঁচ পাদ্রিকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। দুর্গ , চার্চ সহ সব ভবনগুলিও ধুলিসাৎ করে দেওয়া হয়। মুঘল রাজধানী আগ্রার দুর্গে প্রবীণ পাদ্রি ফাদার জোয়ান ডে ক্রজ এবং ৪০০০-এর বেশি পর্তুগিজ নরনারীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ।
এখানেই ঘটে এক অলৌকিক ঘটনা। বন্দি গির্জার পাদ্রি ফাদার জোয়ান ডে ক্রুজকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে এক মত্ত হাতির সামনে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, সেই মত্ত হাতি ফাদারকে পায়ে না পিষে, শুঁড়ে করে নিজের পিঠে বসিয়ে নেয়। ওই অলৌকিক ঘটনা দেখে সম্রাট শাহজাহান ফাদার ও তাঁর সঙ্গীসাথীদের মুক্তি দিলেন । এর সাথে সম্রাট শাহজাহান গির্জা পুনর্গঠনের জন্য অর্থ প্রদান করেন । এবং ১৬৩৩-এ ব্যান্ডেলের ৭৭৭ একর জমি নিষ্কর হিসাবে পর্তুগিজদের দান করেছিলেন তিনি।
১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে গোমেজ দে সোতো একটি নতুন গির্জা নির্মাণ করেন। মঠের পূর্ব দ্বারে এখনও পুরনো গির্জার কীস্টোন বা ভিত্তিপ্রস্তরটি দেখা যায়।নতুন গির্জা তৈরির কাজ তখন শেষ পর্যায়ে। এমন সময়ে সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া একটা পর্তুগিজ জাহাজ হঠাৎই ওই নতুন গির্জার চুড়ো দেখে দিক নির্ণয় করে সেখানে পৌঁছে গেল। ওই জাহাজের ক্যাপ্টেন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তীর খুঁজে পেলে প্রথম যে গির্জা দেখতে পাবেন, সেখানেই তিনি জাহাজের মাস্তুলটা দান করবেন এবং সেই মতো তিনি মাস্তুলটা গির্জাকে দান করে দিলেন। আর পর্তুগিজ ভাষায় ব্যান্ডেল শব্দের অর্থ যেহেতু মাস্তুল তাই ওই গির্জা এবং সেই সূত্রে জায়গাটার নামও হয়ে গেল ব্যান্ডেল। ব্যান্ডেল চার্চে আজও রয়েছে সেই পুরনো মাস্তুলটা। তবে অনেক বলেন পর্তুগিজ ‘ব্যান্ডেল’ শব্দের অর্থ হল বন্দর।পূর্ব ভারতে চুঁচুড়া, হুগলি, চন্দননগর এবং শ্রীরামপুর দিয়ে গঙ্গা অববাহিকা মুঘল আমল থেকেই হয়ে উঠেছিল ইউরোপীয় শক্তিগুলির প্রধান বাণিজ্যপথ। একটি জনপ্রিয় মতানুসারে বাংলা শব্দ ‘বন্দর’-এর পর্তুগীজ অপভ্রংশে ব্যান্ডেল শহরের নামাঙ্কন।

তথ্য_এই সময় ও ডিঙি

করম পরব

''আইজ রে করম ঠাকুর,
ঘরে দুয়ারে রে, ঘরে দুয়ারে।
কাইল রে করম ঠাকুর,
সাঁক/কাঁস নদীর পারে।।''

সবুজ আঁচলে মোড়া আমাদের বাংলা । আরো বেশি সবুজ শাল, পিয়াল, কেঁন্দু, মহুয়া, হরিতকী, বহড়া.নানান গাছ - গাছালি ঘেরা সাঁওতাল পরগনা। এককথায় ছোটনাগপুরের কৃষি উৎসব 'করম' উৎসব।এখানকার ছায়ায় ঘেরা  গ্রাম - গঞ্জের মানুষদের পূজিত দেবতা হলো করম ঠাকুর। যদিও পূর্ব মধ্য ভারতের আদিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে বড়ো উৎসব হলো-" করম পরব"। ইহা মূলত কৃষি ভিত্তিক জাতীয় উৎসব। ছোটনাগপুর মালভূমির বিহার, ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা সহ পশ্চিমবঙ্গের মূলত জঙ্গল মহলের বাঁকুড়া,পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম জেলায় ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে এই উৎসব পালন করা হয়ে থাকে।

" করম পরব "
" আমার করম, ভাইয়ের ধরম "...  
অনেক সময় ভাই -এর মঙ্গল কামনায় দিদির করম উপবাস যাপন। অথাৎ ভাই সারা বছর নিজের কৃষি কর্ম করে থাকে,  আর বোন করম উৎসব পালন করে ভাইয়ের কৃষি কর্মের মধ্য দিয়ে উন্নত  ফসলের জন্য মঙ্গল কামনাই হলো এই উৎসবের পালনের মূল উদেশ্য।  দিদিরা ভাইয়ের মঙ্গল কামনায়     "করম পরব" উপবাসের মধ্য করে। 


জঙ্গল মহলের শ্রেষ্ট কৃষি ভিত্তিক জাতীয় উৎসব।কচিকাচাদের উৎসাহ ও উদ্দিপনা তুঙ্গে।'করম' কথাটি এসেছে মূলত 'কর্ম' থেকে।'কর্ম' -- অর্থাৎ কোনো কিছু করা।আর এই 'করা' যাঁর দ্বারা সম্পন্ন হয় বা যিনি নিয়ন্ত্রণ করেন, তিনিই করম। কৃষিজীবী মানুষের কৃষিকাজই মূখ্য, তাই 'করম' কৃষি দেবতা, 'করম' গাছে তাঁর অধিষ্ঠান। তাঁর আরাধনাই করম পরব।
কুমারী ছেলে মেয়েরা সারাদিন উপবাস থেকে জাওয়া ডালি নিয়ে নাচ গানের মাধ্যমে দিনটি পালন করে থাকে। গ্রাম বাসীরা বাড়িতে  বাড়িতে  নতুন শস্য র চারা রোপন করে একটা ঝুড়িতে ,  সেগুলো সব গ্রামের একটা জায়গায় এনে জড়ো করে এবং ধামসা মাদল বাজিয়ে নাচ গান করে , ছেলে মেয়েরা নির্বিশেষে প্রচুর হাঁড়িয়া খেয়ে নেশা করে দিনের বেলাতেই,  কার  শস্য (চাল , ডাল, গম ) চারা বেশি পুষ্ট দেখতে হয়  এটাই মুখ্য , উদ্দেশ্য যদিও।


   সভ্যতার এই উৎসবের শুরু কবে থেকে  তার বলা  অসম্ভব। তবে মানব সভ্যতায় কৃষিকাজের  সূচনা মেয়েদের হাত ধরেই। আদিম গুহাবাসী ছেলেরা যখন শিকারের খোঁজে জঙ্গলে যেত, তখন শিশু,বৃদ্ধ, রুগ্নদের   পরিচর্যায় থাকত মেয়েরা । সেই সময়েই  তারা লক্ষ্য করে উদ্ভিদ বা গাছপালা বা শস্যের জীবনচক্র দেখেছে । পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে   কোনো পাথরের পাত্রে মাটি ভরে ছড়িয়ে দেয় সংগৃহীত শস্যদানা। নিয়মিত জল দিয়ে একসময়  সেই শস্যের অঙ্কুরোদ্গম ঘটিয়ে চারার বানিয়ে  থাকে গুহাবাসী মেয়েরা, হয়তো  আয়ত্ত  করে ফেলে কৃষিবিদ্যার প্রথম পাঠ। গুহাবাসী মেয়েদের প্রচেষ্টাই এখানকার কৃষিজীবী আদিবাসী বোনেদের 'জাওয়া ডালি'তে।

ভাদ্রমাসের অমাবস্যার পর একাদশতম দিন (পাঁজিতে যা শুক্ল একাদশী নামে চিহ্নিত)
ভাদ্রমাসের একাদশীর পূণ্য তিথিতে "করম পরব" অনুষ্ঠিত হয়ে । ইহা মূলত কুমারী মেয়েরা সারাদিন উপবাস থেকে জাওয়া নাচ ও গীতের মাধ্যমে, করম ডালের পূজা,  "কর্মু-ধর্মু " কহিনীর ইতিকথা শ্রবনের মাধ্যমে ভালো শস্য উৎপাদনের মঙ্গল কামনায় দিনটি  করম দেবতার  সংকল্পে নিবেদিত করে।
      'করম পরবে'র ঠিক পাঁচ বা সাত বা নয় দিন আগে কুমারী মেয়েরা নদী, পুকুর বা কোনো জলাশয়ে গিয়ে স্নান করে  এক সাথে।বাঁশের টুপা ( ঝুড়ির) বা ডালায় বালি ভরে তাতে পাঁচ বা সাত বা নয় ধরনের শস্য যেমন-ধান, গম, যব, , ছোলা, মটর, মুগ,ভুট্টা কুরত্থি, রমা, বুনে হলুদজল ছিড়িয়ে দেয়। একে  'জাওয়া পাতা' বা 'জাওয়া উঠা' বলা হয়। 'জাওয়া' শব্দটির মানে হলো 'অঙ্কুরিত হওয়া'।  বিভিন্ন শস্যের অঙ্কুরোদ্গম ঘটানো হয় এভাবে। তাই  একে 'জাওয়া পরব' বলা হয়। জাওয়া পাতার সময় বিভিন্ন গান গাওয়া হয়‌
যেমন--
    '' আয় লো সঙ্গতি সবাই জাওয়া পাতাব লো।
গঙ্গা যমুনার বালি ছাঁক্যে উঠাব লো।।
কাঁসাই নদীর বালি নিয়ে জাওয়া পাতাব লো।
আমাদের জাওয়া উঠে যেমন
শাল ধুঁধের পারা লো।।''

মেয়েরা জাওয়া ডালিগুলো ঘিরে   নাচ গান করে,  ডালি নিয়ে ঘরে ফিরে আসে। গ্রামে ঢোকার আগে, তাড়া আসে 'করম' ঠাকুরের আখড়ায়,। করম মূলত লোকদেবতা এবং জল - জমিন - জঙ্গল কেন্দ্রীক জীবন ধারার প্রতীক।
এই ঠাকুরের কোনো মূর্তি নেই। 
করম  ,  অশ্বত্থ, বট, পাকুড় বা কোনো বড়ো গাছের নীচে করম ডাল পুঁতে তার সামনে মাটির তৈরি হাতি - ঘোড়া রেখে পুজো করা হয়।
পুজোর থালাতে সবাই ফুল, প্রসাদ, সিঁন্দুর ও পুজোর নানান উপাচারের সাথে একজোড়া মাটির হাতি ও ঘোড়াও নিয়ে আসে। যা করম দেবতার থানে সমর্পিত হয়।
তাই মাটির তৈরি হাতি - ঘোড়া এখানকার খুবই জনপ্রিয় ও প্রসিদ্ধ জিনিস। এটি শৈল্পিক নিদর্শন ও।
করম দেবতা আখড়ায়  মানে গাছের নীচে আবার নাচ গান হয়।
'' প্রথমে বন্দনা করি, 
গাঁয়েরই গরাম হরি।(২)
তারপরে বন্দনা করি,
করম ঠাকুর।
কিআ দিঁয়ে বন্দিব,
গাঁয়েরই গরাম হরি (২)
কিআ দিঁয়ে বন্দিব,
করম ঠাকুর।।
ঘিয়ে দুধে বন্দিব,
গাঁয়েরই গরাম হরি।(২)
জাওয়া দিঁয়ে বন্দিব,
করম ঠাকুর।।''
      
  এরপর   নিজের নিজের বাড়িতে  পরিস্কার কুলুঙ্গিতে পিঁড়ির উপর জাওয়াডালি রাখে তারা। যে কদিন জাওয়া বাড়িতে থাকে, 'পারবতী'দের এক কঠিন, কঠোর অনুশাসন  থাকতে হয়।  'পারবতী'দের স্নান, খাওয়া, শোয়া, সবকিছুতেই নানা নিয়ম মেনে চলতে হয়। নিয়ম ভাঙলে কৃষিকাজ  বা সংসার  অমঙ্গল হবে বলে বিশ্বাস করা হয়।
      এসময় রোজ স্নান করে পবিত্র হয়ে জাওয়া ডালিতে হলুদ জল দেওয়া হয়। 'পারবতীরা সন্ধ্যাবেলায় করম আখড়ায় জাওয়াডালি গুলো ঘিরে নাচ গান করে ।
   'করম' পরবের দিন সকাল থেকে 'পারবতী'দের অনেক কাজ।  গোবর দিয়ে নিকানো হয় করম আখড়আ।  গান গাইতে গাইতে নিকটবর্তী বনে থেকে দাঁতন, পাতা সংগ্রহ করতে হয় উপবাসী থেকে। বনে গিয়েও একপ্রস্থ নাচ গান করে তারা। এ সময় গ্রামের পুরোহিত বা  লায়া জঙ্গল থেকে বুড়ি করমের পুরানো করম গাছ ডাল এনে আখড়াতে পুঁতেন ।  করম ঠাকুরের উদ্দেশ্যে পাতার খালাতে জল দাঁতন ও ঝিঙে পাতায় তেল হলুদ নিবেদন করা হয় সন্ধ্যাবেলায় জলাশয়ে গিয়ে।স্নান সেরে পারবতী'রা  নতুন কাপড় পরে  'করম ডালা' সাজায় বাড়িতে এসে।  ঘিয়ের প্রদীপ, সিঁদূর, কাজল, আতপচালের গুঁড়ি ইত্যাদি সহ ঝিঙেপাতার উপর একটা সবৃন্তক 'কাঁকুড়' রাখা হয় একটা বাঁশের নতুন ডালায়। 'পারবতী'দের ভবিষ্যত সন্তানের প্রতীক 'কাঁকুড়'বা 'বেটা' নামে পরিচিত, । সবাই ডালা নিয়ে আখড়াতে হাজির হলে।  'লায়া' করমডাল ও ধানগাছি হলুদ রঙের কাপড়ে বেঁধে সূর্য ও বসুমতীর প্রতীকি বিয়ে  সম্পন্ন করেন।করম ডাল এখানে সুর্য ও ধানগাছি বসুমতীর বা পৃথিবীর প্রতীক। লোক বিশ্বাস এই যে, এই বিয়ের  ফলে বসুমতী মান পৃথিবী ফলবতী হবেন‌।সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা হবে পৃথিবী।  ডালা থেকে 'বেটা' বের করে সিঁদূর, কাজল, চালের গুঁড়ির ফোঁটা দেয় 'পারবতী'রা। লায়া মুখে ' করমু- ধরমু'র গল্প শুনে । করম ঠাকুরের পূজা দিয়ে পারবতী'রা ঘরে ফেরে । ভাত  বাদে অন্য কিছু খেয়ে উপবাস ভঙ্গ করে  তারা। জাওয়াডালি নিয়ে উপস্থিত হয় আবার আখড়ায়। এরপর সারারাত নাচগান চলে । পরেরদিন সকালে করম ঠাকুরের বিসর্জনের হয় । একটু নাচগানের করে‌  'জাওয়া ভাঙা' ভক্তি ভরে। জাওয়াডালির শস্যচারা উপড়ে নিয়ে সবাইকে দেওয়া হয়। এগুলো ধানক্ষেত, সব্জিবাগান, গোয়ালঘর, নানা জায়গায়  ছড়িয়ে দেওয়া হয়।  শস্য , গোসম্পদ শ্রীবৃদ্ধি হবার কামনায়। 
ছেলেদের হাতে 'করম ডোর' বেঁধে দেয় মেয়েরা, তাদের ভাই বা দাদার  মঙ্গলকামনায়। এরপর বাজনা সহকারে  লায়া করম ডাল বিসর্জন দিতে যান জলাশয়ে।
     '' যাও যাও করম ঠাকুর,
   যাও ছয় মাস রে, যাও ছয় মাস।
পড়িলে ভাদর মাস আনব ঘুরাঁই।।''

  বিসর্জন পর স্নান করে এসে পারবতী'রা পারণ করেন ।  গোবর দিয়ে  করমু ধরমু দুই ভাইয়ের প্রতীকি ছবি আঁকে বাড়ির কোনো দেওয়ালে।এঁকে তাতে সিঁদূর, কাজল, চালের গুঁড়োর ফোঁটা দিয়ে থাকে তারা। আলতি পাতায় বাসিভাত ও ঝিঙের তরকারি ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয় সেখানে। এই প্রসাদ খেয়ে পার্বতীরা পারণ করে। শস্যকামনা সন্তানকামনা ও ভাইয়ের মঙ্গলকামনার এক কৃচ্ছ্রসাধন অধ্যায় শেষ হয়।

   ছবি - তির্থঙ্কর ওঝা ও অনতো মাহাতো

Thursday, 8 September 2022

দূর্গা পূজা কেন ইংরেজদের বিজয় উৎসব?

আধুনিক কালে  কিছু মানুষ বলে থাকেন ইংরেজদের বিজয় উৎসব হলো বাঙালির দূর্গা উৎসব। পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হারানোর জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে হাত মেলায় বাংলার কয়েকজন প্রভাবশালী হিন্দু জমিদার এ কথা সকলের জানা। মাঝখানে থেকে মির্জাফরকে লোকজন বিশ্বাস ঘাতক বলেন। তারা যুদ্ধে ইংরেজদেরকে বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ  ও আর্থিক সাহায্য প্রদান করেছিলো বলে শোনা যায়। যুদ্ধে সিরাজের পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকে অভিনন্দন করে এ কারণে বাঙালি অভিযুক্ত করার কারণ নেই । বাংলার শাসন ক্ষমতা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ায় কোলকাতা হয়ে ওঠে পূর্ব ভারতের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র। আসলে এর মাধ্যমে বাঙালি জাতি ফিরে পায় তার পুরোনো মর্যদা। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের থেকে বাংলা সব সময় আলাদা ছিলো। এবং উন্নত ছিলো। মঙ্গলকাব্য গুলো খুলে দেখতে পাবেন বাংলার বানিজ্য তরী বিদেশে পাড়ি দিতো একটা সময়। কিন্তু ইসলামী সুলতানদের কিছু কিছু পদক্ষেপ বানিজ্য পিছিয়ে দিচ্ছিলো বাঙালিকে। বিশেষ করে পর্তুগিজদের ( মগদুস্যু) বারবারন্ত বাঙালি জাতিকে আরো বিপদে ফেলে।

যুদ্ধে সহায়তার কারণে সেসব জমিদারের অনেকেই কোম্পানির সাথে নানা ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশীদার হয়ে যায়, হয় তাদের এজেন্ট এবং তারা সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। বলা যায় ইংরেজদের প্রভাবে সমাজে হিন্দু জমিদারদের অনেকেরই প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়।  এক শ্রেণির মানুষ জমিদার নাহলেও  ইংরেজদের সাথে বিভিন্ন রকম ব্যবসা-বাণিজ্য করে প্রভূত ধনসম্পত্তির মালিক হয়ে ওঠে।

ইংরেজদের সাথে সুসম্পর্ক বজার রাখার জন্য, তাদের কৃপাদৃষ্টি অক্ষুণ্ন রাখতে এবং সমাজে নিজেদের বিত্তবৈভব দেখানোর জন্য সেসব ধনীদের কাছে দূর্গা পূজা হয়ে ওঠে প্রধান ধর্মীয় উৎসব। ধনীর সংখ্যা যত বাড়তে থাকে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে দূর্গা পূজার সংখ্যাও। এই পূজাকে ঘিরে তাদের মধ্যে শুরু হয় খরচ করার একটা প্রতিযোগিতা।
মনে রাখবেন সিরাজের পরাজয়ে বাঙালির পরাজয় হিসেবে কেউ তখন দেখে নি। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আমবাগানে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজয়ে বাঙালির পরাজয় হিসেবে দেখা হয়নি । সিরাজউদ্দৌলার মাতৃভাষা যেমন ফার্সি ছিলো ।  এবং তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের চোখে ঘৃণার পাত্র ছিলেন।সিরাজউদ্দৌলাকে যখন ইংরেজ সেনা বেঁধে নিয়ে যাচ্ছিল তখন রাস্তার দুপাশের অসংখ্য কৃষকেরা নিশ্চিন্তমনে জমি চাষ করছিলেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ খুশিতে হাতেতালিও দিচ্ছিলেন।  বিষয়টি অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, বাংলাদেশের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া তার 'মৃদুভাষণ' নামক প্রবন্ধ গ্রন্থে। শাহ এ এম এস কিবরিয়া বলেন:

"২৬ মার্চ যখন ফিরে আসে তখন কবিগুরুর অনুপম চরণগুলো হৃদয়-মনকে উতলা করে তোলে।
আমাদের হাজার বছরের ইতিহাসে গর্ব করার মতো কি আছে তা নিয়ে অনেকেই লেখালেখি করেছেন। আমি এসব অতীত কাহিনী পড়ে তেমন উজ্জীবিত হই না। পাঠান আমলে বাংলাদেশে একটা স্বাধীন রাজ্য স্থাপিত হয়েছিল, সন্দেহ নেই। কিন্তু এও সত্য যে, তৎকালীন পাঠানরা কোনো বিচারেই বাঙালি ছিলেন না। বাঙালি জাতীয়তাবোধ তাঁদের কাছে অজ্ঞাত ছিল বলে আমি মনে করি। রাজ্য শাসনের সুবিধার জন্য এবং স্থানীয় লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য তাঁরা স্থানীয় ভাষার চর্চাকে উৎসাহ দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁরা বাংলায় কথাও বলতেন না এবং আচার আচরণে খাঁটি বাঙালি সমাজের কাছাকাছিও ছিলেন না। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব স সিরাজউদ্দৌলার করুণ পরিণতির কাহিনী পড়ে আমরা বেদনা অনুভব করি, কিন্তু কেউ কি দাবি করবেন যে, নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাঙালি ছিলেন? ইতিহাসে পড়েছি নবাব আলীবর্দী খান ইরান দেশ থেকে ভাগ্যান্বেষণে ভারতে এসেছিলেন। তাঁর দৌহিত্র সর্বাংশেই একজন ইরানী ছিলেন। হয়তো সে কারণেই আমরা দেখি, যখন পলাশীর আম্রকাননে লড়াই হচ্ছে তখন, তার পাশেই, শস্যক্ষেত্রে বাঙালি কৃষকরা নির্বিকারভাবে কৃষিকর্ম করে যাচ্ছে। তাদের দৃষ্টিতে এটা ছিল দুই বিদেশী শক্তির মধ্যে ক্ষমতার সংঘাত। বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা ছিল অনুপস্থিত।"
(শাহ এ এম এস কিবরিয়া ১৯৯৭: ৫)

মুর্শিদাবাদের নবাব সিরাজউদ্দৌলার মাত্র একবছর দুইমাসের মত শাসন ক্ষমতা ছিলেন । (১৭৫৬  থেকে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের)।  নবাব  সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়ে বিভিন্ন মিথ বাংলায় প্রচলিত আছে,তা ঐতিহাসিক ভাবে সত্য কিনা জানিনা। নবাব  সিরাজউদ্দৌলাকে বিভিন্ন মিথের পিছনে দুটি কারণ। তবে ধর্মগত সাদৃশ্যের কারণে, তার পূর্বপুরুষ তুর্কি থেকে আগত হলেও তাকে অনেক বাঙালি স্বদেশীয় প্রমাণ করতে ব্যস্ত থাকে। যুক্তি দেওয়া হয়, বাংলায় বা ভারতবর্ষে তুর্কি, পাঠান বিভিন্ন শাসকেরা বিদেশি বংশদ্ভূত হলেও, তারা যেহেতু এদেশে বসবাস করত তাই তার এদেশীয় হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয়ত কলকাতা কেন্দ্রিক সাহিত্যিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং বুদ্ধিজীবীগণ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে গৌরবান্বিত করার বিবিধ প্রচেষ্টা শুরু করে। সে লক্ষ্যে তারা বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করে।ব্রিটিশেরা যেহেতু নবাব সিরাজউদ্দৌলার হাত থেকে ধীরেধীরে বাংলার শাসনভার নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে। তাই তারা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের স্বার্থে ব্রিটিশ পূর্ববর্তী নবাব সিরাজউদ্দৌলাসহ অন্যান্য শাসকদের গুনগান করেন।

সিরাজউদ্দৌলা বাঙালি ছিলেন না, তিনি বাংলায় কথা বলতেন কিনা সে বিষয়টিও সুনিশ্চিত নয়। নবাব সিরাজুদ্দৌলার সম্পূর্ণ নাম ছিল, মির্জা মুহম্মদ সিরাজউদ্দৌলা। তিনি ছিলেন  আলীবর্দী খানের নাতি এবং জৈনুদ্দীন আহমদ খান ও  আমিনা বেগমের পুত্র। ১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলা তুর্কি জাতির বংশধর ছিলেন।আলীবর্দী খানের প্রকৃত নাম মির্জা মুহম্মদ আলী।তার পিতার নাম  ছিলো মির্জা মুহম্মদ মাদানি। তুর্কি বংশোদ্ভূত মির্জা মুহম্মদ মাদানি মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র আজম শাহের দরবারের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলার দাদু আলীবর্দী খানের কোন পুত্রসন্তান ছিল না। শুধুই তিন কন্যাসন্তান ছিল। তিনি তার কন্যাদের বড়ভাই হাজি আহমদের তিন ছেলের সাথে বিবাহ দেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলা দাদু আলিবর্দী বা ঠাকুর্দা হাজি আহমেদের বাবা মির্জা মুহম্মদ মাদানি ছিলেন তুর্কি বংশোদ্ভূত। তাই পিতৃপুরুষের পরিচয়ে নবাব সিরাজুদ্দৌলা আদতে তুর্কি বংশোদ্ভূত, কোনমতেই বাঙালি নয়।
নবাব নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব বলা হলেও , তথ্যটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। প্রকৃত তথ্য হল, তখনো পর্যন্ত ভারতবর্ষে মুঘল শাসনের অধীনে ছিল। যেহেতু মুঘল সম্রাট ছিলেন, তাই নবাব সিরাজউদ্দৌলা কোন স্বাধীন শাসক ছিলেন না। তিনি ছিলেন, তৎকালীন দিল্লীর মুঘল সম্রাটের পক্ষে বাংলার আঞ্চলিক প্রতিনিধি। তিনি ছিলেন সম্রাটের অধিনস্থ বাংলার নবাব। অনেকটা বর্তমানের  কেন্দ্রীয় সরকারের অধিনস্থ মুখ্যমন্ত্রীর মত। নবাব সিরাজউদ্দৌলার চরিত্র সম্পর্কে ইতিহাসকারগণ যে সকল তথ্য দিয়েছেন, সেই তথ্যানুযায়ী তাকে সচ্চরিত্রের অধিকারী ছিলেন না। মাতামহ আলিবর্দী খানের মৃত্যুশয্যায় নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে তার ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করে প্রতিজ্ঞা করানো হয় যে, তিনি মদ্যপান থেকে বিরত থাকবেন।  অবশ্য তিনি মদ্যপান থেকে পরবর্তীতে বিরত ছিলেন কিনা এ নিয়ে ইতিহাসে পাতায় কিছু লেখা নেই।

এক কথায় সিরাজ ছিলেন খানিকটা উদ্ধত এবং কিছুটা অসহিষ্ণু। অস্থির চিত্তের সিরাজের মধ্যে দৃঢ়তার অভাব ছিল। এছাড়া সংকটকালে সিদ্ধান্তহীনতাও তাঁর অন্যতম ত্রুটি। তবে এ কথা মনে রাখা দরকার যে, সিরাজ তখন ছিলেন মাত্র চবিবশ বছরের এক অপরিণত যুবক। ক্ষমতা ও উচ্চাসন তাঁকে কিছুটা বেপরোয়াও করে তুলেছিল। নবাব সিরাজউদ্দৌলার সবচেয়ে বড় ত্রুটি ছিল এই যে, অনভিজ্ঞতার কারণে তিনি তাঁর সকল প্রতিদ্বন্দ্বীকে একই সাথে মোকাবিলা করতে চেয়েছিলেন, তারা যাতে সংঘবদ্ধ হতে না পারে সেরূপ কোন পদক্ষেপ তিনি নেন নি। এরূপ সাবধানতা অবলম্বনে তাঁর ব্যর্থতা এবং শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করার মতো মানসিক দৃঢ়তার অভাবের কারণেই তাঁর পতন হয়। কারণ তিনি নিজেই প্রথম ইংরেজদের আক্রমণ করেছিল।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর  রচিত 'বাঙ্গালার ইতিহাস, দ্বিতীয় ভাগ' গ্রন্থে নবাব সিরাজুদ্দৌলার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর  নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নির্বোধ, নৃশংস, ও অবিমৃশ্যকারী, কুপ্রবৃত্তির উত্তেজক মানুষের সঙ্গী, নারীর সতীত্ব লুণ্ঠনকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। প্রাপ্ত তথ্যমতে নবাব সিরাজউদ্দৌলা কোন সুশাসক ছিলেন না। তিনি ছিলেন নিয়ন্ত্রণহীন এক তরুণ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের তথ্য অনুসারে জানা যায় যে, ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের কাছে পরাজয় না হলেও তার নবাবী দিল্লির মুঘল সম্রাটেরা এমনিতেই কেড়ে নিতেন। কারণ সকতজঙ্গ বার্ষিক কোটি মুদ্রা কর প্রদান প্রতিশ্রুতি দিয়ে সুবাদারী প্রার্থনা করেছিলেন, দিল্লীর মুঘল সম্রাট একপ্রকার সম্মত হয়ে গিয়েছিলেন।
সিরাজউদ্দৌলা, সিংহাসনে বসে মাতামহের পুরাণো কর্মচারী ও সেনাপতিদিগকে পদচ্যুত করতে শুরু করেন। কিছু দুষ্টু মানুষের সঙ্গ দোষে এবং পরামর্শের  ফলে, তখন, প্রায় কোন ব্যক্তির সম্পত্তি বা কোনও স্ত্রীলোকের সতীত্ব রক্ষা পাচ্ছিলো না ওদের হাতে থাকে।

রাজ্যের প্রধান প্রধান লোকেরা, এই সমস্ত অত্যাচার সহ্য করিতে না পারে, তাঁর পরিবর্তে, অন্য কোনও ব্যক্তিকে সিংহাসনে বসাইবার চেষ্টা করলেন। তাঁরা, আপাততঃ, সকতজঙ্গকেই নির্বাচন করেন। তাঁরা নিশ্চিত জানতেন, তিনি সিরাজউদ্দৌলা অপেক্ষা ভদ্র না; কিন্তু, মনে মনে এই আশা করেছিলেন, আপাততঃ, উপস্থিত বিপদ হইতে মুক্ত হয়ে পরে, কোনও যথার্থ ভদ্র ব্যক্তিকে সিংহাসনে বসাবেন।

এ কথা আমার নয় , বিদ্যাসাগরের।ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হিন্দু পন্ডিত তাঁর কথা অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে। কিন্তু কথার সত্যতা পাওয়া যায়, নবাব সিরাজউদ্দৌলার সমসাময়িক ইউসুফ আলি খানের বিবরণে। তার রচিত 'তারিখ-ই-বাঙ্গালা -ই-মহব্বত জঙী' গ্রন্থে তিনি নবাব সিরাজুদ্দৌলা সম্পর্কে বলেছেন:

"সিরাজ-উদ-দৌলা এই পৃথিবীর রাজত্বে তৃপ্ত ছিলেন না এবং (কোনো কিছুতেই তিনি) সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাঁর অত্যধিক অত্যাচারের মাত্রা, অত্যধিক রক্তপিপাসুতা ও সীমাহীন গালিগালাজপ্রিয়তা এই দেশের সব সিংহের পিত্তকে পানিতে পরিণত করতে পারত। আজ তাঁর মাথার উপরে ছিল একটি টুপি, (পরিধানে) ছিল পায়জামা এবং কাঁধে ছিল একটি কম্বল। সেই অবস্থায় পৃথিবীর মানুষের কাছে তিনি এই ধরণীর একটি ক্ষুদ্র কোণ মাত্র প্রার্থনা করেন। কিন্তু তাঁর এই বিধ্বস্ত দেহ বিরাট বিক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়ালে তিনি তাঁর সেই ইচ্ছা পূরণের সুযোগ আর পাননি এবং মহা প্রতিশোধ গ্রহণকারী বিচারকের আদেশে মৃত্যুর তরবারি তাঁর সব আকাঙ্ক্ষার শিকল ছিন্ন করে দেয়। মীর মোহাম্মদ জা'ফর খান বাহাদুরের আদেশে তাঁকে মহাবত জঙের সমাধির পাশে সমাহিত করা হয়। এই ঘটনা এগারশ একাত্তর হিজরী সনের ১৫ই শওয়াল তারিখে ঘটে। তাঁর রাজত্বকাল দুর্যোগপূর্ণ হলেও এক বছর তিন মাস ছিল।"
(আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া ১৯৯৭:১৯০-৯১)

নবাব সিরাজউদ্দৌলার সমসাময়িক ইউসুফ আলি খানের বিবরণে 'তারিখ-ই-বাঙ্গালা-ই-মহব্বত জঙী' গ্রন্থের মত নবাব সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যু এবং পরবর্তী মৃতদেহের বিবরণ 'মোজাফফরনামা' গ্রন্থেও পাওয়া যায়। মোজাফফরনামা গ্রন্থটির রচয়িতা হলেন, করম আলি খান। নবাব সিরাজউদ্দৌলার মৃতদেহকে কি পরিমাণে অমর্যাদা করা হয়েছিলো সে বিবরণ করম আলি খানের মোজাফফরনামায় পাওয়া যায়:

"সিরাজের দেহে বিশটি আঘাত করেও কাজ শেষ করতে না পেরে মোহাম্মদী বেগ তাঁর সঙ্গীদের মধ্য থেকে একজন মোঘলকে এ কাজের জন্য নিযুক্ত করে এবং সে ব্যক্তি ছোরার এক আঘাতেই সিরাজের জীবনের সমাপ্তি ঘটায়। তাঁর দেহ একটি হস্তীর পৃষ্ঠে স্থাপন করে সীমাহীন অমর্যাদার সঙ্গে সমগ্র নগরে ঘোরানো হয়। সেই হস্তী সিরাজের জননীর বাসভবনের সামনে আসলে তিনি খালি পায়ে ও খালি মাথায় দৌড়িয়ে এসে হস্তীর পায়ের কাছে নিজেকে নিক্ষেপ করেন। কিন্তু খাদিম হোসেন খানের লোকজন তাঁকে বলপ্রয়োগ করে সেখান থেকে সরিয়ে দেয়। (সিরাজের মৃতদেহ নিয়ে) খাদিম হোসেন খানের বালাখানার সামনে উপস্থিত হলে তিনি নির্লজ্জ হয়ে মৃতদেহ সমাহিত করার জন্য একখানা বস্ত্র মৃতদেহের উপর নিক্ষেপ করেন।

অবশেষে সিরাজের মৃতদেহ বাজারের চত্বরে নিক্ষেপ করা হলে কেউ তা দাফন করতে সম্মত হয়নি। এই পরিবারের ঐতিহ্যকে স্মরণ রেখে এবং নিজেকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করে মীর্জা জয়নুল আবেদীন বাকাওয়াল মৃতদেহকে গোসল করান এবং একটি কফিনে ভরে তা আলিবর্দীর কবরের পাশে সমাধিস্থ করেন। সিরাজের রাজত্বকাল পনেরো মাস স্থায়ী হয়।"
(আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া ১৯৯৮: ১২৮)

মাঝেমধ্যে দুইএকটা ব্যতিক্রম ছাড়া বাঙালি ১২০৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে  পরাধীনই ছিল।  ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন প্রভু বদল হয়েছিল মাত্র। তখনকার বাঙালির মতে তুর্কিদের হাত থেকে কিছুটা সভ্য এবং কিছুটা মানবিক  ব্রিটিশদের হাতে।
বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'পূরবী' কাব্যগ্রন্থের 'শিবাজি-উৎসব' কবিতায় বলেছেন:

"সেদিন এ বঙ্গপ্রান্তে পণ্যবিপণীর এক ধারে
নিঃশব্দচরণ
আনিল বণিকলক্ষ্মী সুরঙ্গপথের অন্ধকারে
রাজসিংহাসন।
বঙ্গ তারে আপনার গঙ্গোদকে অভিষিক্ত করি
নিল চুপে চুপে-
বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল পোহালে শর্বরী
রাজদণ্ডরূপে।"
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২০০৭:৩০৫)
তাই বাঙালিরা ইংরেজদের শাসন প্রতিষ্ঠার বিজয় উৎসবকে দূর্গা পূজা হিসেবে পালন করলেও তার কোন দোষের ছিলো না।এই দূর্গাপূজা পরে নিজের চরিত্র বদলায়।ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু বারোয়ারি দূর্গোৎসবকে বেছে নিলেন। ১৯২৭ সালে বার্মার জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কোলকাতায় ফিরে এসে নেতাজি বিভিন্ন সামাজিক এবং সেবামূলক কাজে জড়িয়ে পড়েন। সে সুবাদে পরবর্তীকালে তিনি বেশ কিছু বারোয়ারি দূর্গা পূজার সাথে যুক্ত হন। দক্ষিণ কোলকাতার আদি লেক পল্লীর পূজা, মধ্য কোলকাতার ৪৭ পল্লীর পূজা, উত্তর কোলকাতার বাগবাজার, কুমারটুলি, সিমলা ব্যায়াম সমিতি- এই বারোয়ারি পূজাগুলোর সাথে নেতাজী বিভিন্ন সময়ে যুক্ত ছিলেন। এই পূজা গুলো বিপ্লবী সংগঠনগুলোর শক্তি প্রদর্শন ও সদস্য সংগ্রহ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে ছিলো।

তথ্য সহায়তা:
১. আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া (অনূদিত), ইউসুফ আলী খান, তারিখ-ই-বাঙ্গালা-ই-মহব্বত জঙী, ঢাকা: বাংলা একাডেমী, জুন১৯৯৭

২.আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া (অনূদিত),
মোজাফফরনামা ও নওবাহার- ই-মুর্শিদকুলী খানি,ঢাকা: বাংলা একাডেমী, মার্চ ১৯৯৮

৩. তীর্থপতি দত্ত ( সম্পাদিত),বিদ্যাসাগর রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড), কলকাতা: তুলি-কলম, মার্চ ২০০২

৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সঞ্চয়িতা, ঢাকা: মেরিট ফেয়ার প্রকাশন,ফেব্রুয়ারি ২০০৭

৫ শাহ এ এম এস কিবরিয়া, মৃদুভাষণ, ঢাকা: ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড,১৯৯৭
৬. সিরাজউদ্দৌলা,বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়া, ঢাকা: এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০১৫
৭. সিরাজউদ্দোলা , কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী ( চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)


Tuesday, 6 September 2022

বিতর্কিত শিক্ষক

মাঝে মাঝে আমরা ফেসবুক পাড়ায় লেখা চুরির অভিযোগ পাই। কিন্তু জানেন কি আসলে এই লেখা চুরির অভিযোগটা উঠেছিল , আমাদের জাতীয় শিক্ষাকের বিরুদ্ধে ও। অধ্যাপক যদুনাথ সিংহ ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে অধ্যাপক যদুনাথ সিংহ ভারতের সারস্বত সমাজকে নাড়িয়ে দিয়ে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের বিরুদ্ধে থিসিস চুরির অভিযোগে কলকাতা উচ্চআদালতে মামলা করেন।  প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তির জন্য যে গবেষণাপত্রটি ইন্ডিয়ান সাইকলজি অব পারসেপশন প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড জমা দিয়েছিলেন, যদুনাথ সিংহ আর সেই গবেষণাপত্র থেকে ব্যাপকভাবে copy করে ধরা পড়েছিলেন রাধাকৃষ্ণান।

ডঃ যদুনাথ সিংহের গবেষণাপত্রটি ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল রাধাকৃষ্ণানের "ইন্ডিয়ান ফিলজফি"র দ্বিতীয় খণ্ড, হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল । রাধাকৃষ্ণানের এই বইটি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।ডঃ সিংহ এই চুরির বিষয়টি জানতে পারেন যখন ১৯২৮ সালে রাধাকৃষ্ণানের দ্য বেদান্ত অ্যাকর্ডিং টু শংকর অ্যান্ড রামানুজ নামে আরো একটি বই প্রকাশিত হয়। এই বইটি ছিল রাধাকৃষ্ণনের ইন্ডিয়ান ফিলজফি দ্বিতীয় খণ্ডের অষ্টম এবং নবম অধ্যায়ের একটি স্বতন্ত্র পুনর্মুদ্রণ। যদুনাথ সিংহ দাবি করেন  তার গবেষণার প্রথম দুটি অধ্যায় থেকে অনেক অনুচ্ছেদ খ্যাতনামা অধ্যাপক রাধাকৃষন চুরি করেন।
যদুনাথ সিংহ ১৯১৭ সালে এমএ পাশ করেন।প্রেমচন্দ রায়চন্দ স্কলারশিপের আবেদনের সঙ্গে জমা দিয়েছিলেন তাঁর গবেষণাপত্রের প্রথম খণ্ড ১৯২২ সালে এবং দ্বিতীয় খণ্ড ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে । অভিযোগ, এই গবেষণাপত্রের দ্বিতীয় খণ্ড থেকেই অনেকটা নকল করে; রাধাকৃষ্ণ ১৯২৭ সালে তাঁর বই লন্ডন থেকে স্বনামে প্রকাশ করেন। আসলে ওই সময়ে রাধাকৃষ্ণাণ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চপদে  কর্মরত ছিলেন।

ডঃ সিংহ রাধাকৃষ্ণনের এই চৌর্যবৃত্তির ইতিবৃত্ত তুলনামূলক ভাবে মর্ডান রিভিউ পত্রিকায় প্রকাশ করেন। সিংহপুরুষ যদুনাথ সিংহ মরিসন রিভিউ পত্রিকার মাধম্যে ও কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করে রাধাকৃষ্ণনের মতো মহান মানুষের প্রকৃত মুখোশ খুলে দেন। 
সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণের জন্মদিন শিক্ষক দিবস হিসেবে সারা দেশে পালিত  হয়। নিজের জন্মদিনকে এভাবেই নিজের জীবদ্দশাতেই; অমর করে দিয়েছিলেন ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি। কিন্তু জানেন কি যে দুই খণ্ডের ‘ইন্ডিয়ান ফিলজফি’ বইটির জন্য; রাধাকৃষ্ণণ প্রসিদ্ধ, অভিযোগ সেটি মোটেই তাঁর লেখা নয়। সেটি নাকি লিখেছিলেন; তাঁরই ছাত্র যদুনাথ  সিংহ।  

১৯২৯ এর জানুয়ারি। মিরাট কলেজের দর্শনের তরুণ অধ্যাপক যদুনাথ সিংহ, সারা ভারতের শিক্ষা সমাজকে নাড়িয়ে দিয়ে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দার্শনিক অধ্যাপক ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের বিরুদ্ধে প্লেজিয়ারিজমের অভিযোগ তুলে মামলা করে বসলেন। প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তির জন্য জমা দেওয়া যদুনাথের গবেষণা; “ইন্ডিয়ান সাইকলজি অব পারসেপশন” প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড  থেকে,  ব্যপকভাবে নকল করে ধরা পড়েছিলেন রাধাকৃষ্ণাণ।   

যদুনাথ তাঁর অসাধারণ মেধা ও পাণ্ডিত্যের জন্য ১৯২৩ সালে গ্রিফিথ পুরস্কার; ১৯২৪ সালে মোয়াট মেডেল ও তার আগে ১৯১৫-১৬ সালে ক্লিন্ট মেমোরিয়াল ও ফিলিপ স্মিথ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন।  

১৯২৫ সালে যদুনাথের গবেষণা শেষ হয়েছিল। আর ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল রাধাকৃষ্ণানের বই; “ইন্ডিয়ান ফিলজফি”র দ্বিতীয় খণ্ড।  যদুনাথ সুদূর মিরাটে থাকার দরুন কলকাতার শিক্ষা সমাজের সব খবর যথাযথ সময়ে ঠিকঠিক পেয়ে ওঠেন নি। তিনি ঘুণাক্ষরেও টের পান নি যে; তাঁর মৌলিক গবেষণাটি থেকে রাধাকৃষ্ণান টুকলি করেছেন।
১৯২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কিং জর্জ ফাইভ চেয়ার অফ মেন্টাল অ্যান্ড মোরাল সায়েন্স’ পদে নির্বাচিত হন ডঃ সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন। মনে রাখা দরকার, সেই সময় দাঁড়িয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিশেষ পদটি ছিল দর্শনশাস্ত্রের নিরিখে গোটা ভারতের মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য ও সম্মানজনক চেয়ার। যদুনাথ সিনহার সেই গবেষণাপত্রটি তিনি সেখানেই পড়েন। এরপরই মিরাট কলেজে অধ্যায়নের জন্য চলে যান যদুনাথ; আর সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন নিজের বই তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাঁর অন্যতম বিখ্যাত বই ‘ইন্ডিয়ান ফিলোসফি’ বিশ দশকের শেষের দিকে বের হয়। মোট দুটি ভলিউমে দেখার চেষ্টা করেন ভারত ভূখণ্ডের দর্শনচিত্রকে। 

বিষয়টি তাঁর গোচরে য়াসতেই পরের বছর; অর্থাৎ ১৯২৮ সালে রাধাকৃষ্ণাণের “দ্য বেদান্ত অ্যাকর্ডিং টু শংকর অ্যান্ড রামানুজ” নামে;  আরও একটি বই বেরোল। এই বইটি ছিল আসলে “ইন্ডিয়ান ফিলজফি”-র দ্বিতীয় খণ্ডের অষ্টম এবং নবম অধ্যায়ের একটি পুনর্মুদ্রণ।  এই বইটি পড়েই যদুনাথ আবিষ্কার করেছিলেন যে, তাঁর গবেষণার প্রথম দুটি অধ্যায় থেকে অনুচ্ছেদের পর অনুচ্ছেদ; নিজের বইতে টুকে বসিয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম জর্জ অধ্যাপক ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান!     

বিখ্যাত “মর্ডার্ন রিভিয়্যু” ইংরেজি পত্রিকার দপ্তরে ক্ষুব্ধ যদুনাথ, সরাসরি রাধাকৃষ্ণাণকে চুরির দায়ে অভিযুক্ত করে, দীর্ঘ এক চিঠি লিখে পাঠিয়েছিলেন সেই সময়ের । আর তাঁরা এটি প্রকাশ করে।, কারণ রাধাকৃষ্ণাণের “ইন্ডিয়ান ফিলজফি”-র দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হওয়ার পর, এই পত্রিকাই দেখিয়েছিল যে রাধাকৃষ্ণান তাঁর বেশ কিছু  সিদ্ধান্তের পিছনে যথাযথ তথ্যসূত্র উল্লেখ করেনি। তারা সেই নিয়ে প্রশ্নও তুলেছিলেন ??কিন্তু রাধাকৃষ্ণাণ কোনো জবাব দিতে পারেনি।

তাছাড়া আরো তার প্রমাণ হাতেই ছিল। যদুনাথের গবেষণাকর্মের প্রথম দুই অধ্যায়ের নির্যাস নিয়ে, যদুনাথ বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ রাধাকৃষ্ণাণের বই প্রকাশিত  হওয়ার আগেই, ১৯২৪ থেকে ১৯২৬ সালের মধ্যে মিরাট কলেজের পত্রিকায় ছাপিয়ে ফেলেছিলেন।

রাধাকৃষ্ণাণ এই খবরটা সম্ভবত রাধাকৃষ্ণাণ জানতেন না। কিন্তু এর ফলে যদুনাথের পক্ষে রাধাকৃষ্ণাণের চুরি প্রমাণ করা খুব সহজ হয়ে গিয়েছিল। ১৯২৯ এর আগস্টে কলকাতার উচ্চ ন্যায়ালয়ে; যদুনাথ স্বত্বাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন এবং ক্ষতিপূরণ বাবদ দাবী করেন কুড়ি হাজার টাকা।

যদুনাথ সিংহ সুবিচার যদিও পাননি। যদিও শিক্ষাজগতের প্রবীণ সদস্যেরা প্রায় সকলেই যদুনাথের অভিযোগের সত্যতা মেনে নিয়েছিলেন। অনেকেই সহানুভূতিশীলও ছিলেন প্রকৃত বিদ্বান এই মানুষটির প্রতি। কিন্তু সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণের খ্যাতি-প্রতিপত্তি ও রাজনৈতিক মহলে  তাঁর প্রতাপের কারণে পরোক্ষ প্রভাবের কারণে যদুনাথ সিংহের উপর  তখন নানাভাবে চাপ তৈরি করা হয়েছিল আদালতকক্ষের বাইরে বিষয়টি মিটিয়ে নেওয়ার জন্য।  

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাঁদেরই এক অধ্যাপকের সঙ্গে তাঁদেরই এক গবেষকের মামলা চলছে, তাঁদেরই শিলমোহর পাওয়া গবেষণা নিয়ে। অথচ তাঁরা উচ্চবাচ্যও করেনি।

১৯২৯ এর আগস্টে শুরু হয়ে মামলা চলেছিল ১৯৩৩ এর মে মাস পর্যন্ত। মামলার বিপুল খরচ টানা, তাঁর পক্ষে অসুবিধাজনক হয়ে উঠছিল।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের পক্ষ থেকে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় দু’পক্ষের সঙ্গে কথা বলেন। যেহেতু মূল সমস্যার মঞ্চ বিশ্ববিদ্যালয়, তাই সেখানেই মিটিয়ে নেওয়া হোক সবটা। মামলার রফা-নিষ্পত্তি হয় আদালতের বাইরে। ১৯৩৩ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে অ্যাক্টিং চিফ জাস্টিস ফণীভূষণ চক্রবর্তীর সামনে; একটি ডিক্রির মধ্যে দিয়ে দুটি মামলা মিটিয়ে দেওয়া হয়। ডিক্রির শর্তগুলি কিন্তু আজও সবার অজানা।