Friday, 16 September 2022

মা মনসার স্বরূপ

অনেক রকম প্রাচীন দেবভাবনা ও রূপকল্পনা কাহিনী মিলেমিশে মনসামঙ্গলে মনসার কাহিনী তৈরি হয়েছে। আমার মনে হয় মনসা দেবীর মূতিটা কল্পনা এসেছে  বহু উপাদান অর্থাৎ বহু দেবদেবী মিশ্রনে।মনসার মূর্তিতে তাকে সর্প-পরিবেষ্টিত নারী রূপে দেখা গেলেও তিনি লক্ষী স্বরস্বতী মিশ্রন। দেবীর রূপটা লক্ষ করুন।তিনি একটি হংস বা পদ্মের উপর বসে থাকেন। তার বাহন হাঁস ও সাপ। তার চার হাত। তার উপরের দুটি হাতে থাকে পদ্ম ও নিচের দুটি হাতে থাকে সাপ। সাতটি সাপের ফনা তার মাথার উপর ছাউনির আকারে বিরাজ করে। কোনো কোনো মূর্তিতে তার কোলে একটি শিশুকে দেখা যায়। এই শিশুটি তার পুত্র আস্তিক। ‘একচক্ষু-বিশিষ্ট দেবী’ মনসা বলা হয়,মনসার মা চণ্ডী ক্রোধের বসে তার একটি চোখ পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। এখানে লক্ষ্য করুন, লক্ষ্মী, সরস্বতী, ষষ্ঠী দেবীর রূপের মিশিয়ে আছে।
মনসার ঘটকে দেখুন।মানব সমজের গতি অর্থাৎ প্রবহমানতার মাধ্যম হলো সৃষ্টি। এই মনসা ঘট হলো গর্ভবতী নারীর প্রতীক। যেখান থেকে প্রাণ সঞ্চার হয়ে মানব জীবন ক্রম বিবর্তনের মাধ্যমে এগিয়ে চলছে এ জগৎ সংসারে। মনসা ঘট যেমন গর্ভবতী নারীর প্রতীক তেমনই ফসলের উর্বরতার প্রতীক, তাই মানসা প্রজনন শক্তির প্রতীক হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে।
বাস্তুদেবতার, আরোগ্যের দেবতা অথবা সম্পদের দেবতা—এই বিভিন্ন নামে মনসার পূজা এদেশে বরাবর চলে এসেছে।বৈদিক ‘সর্পরাজ্ঞী’ বা বসুন্ধরা সাপের দেবতা, হয়েও তিনি নিজে সাপ নন। আরোগ্য ও পুষ্টির রূপকাশ্রিত দেব ভাবনা যদিও মহিমা বেদের সময় থেকেই ।  
তত
তবে দেখা যায় মনসা আসলে সরস্বতী, নামান্তর ইলা, পুষ্টি, শ্রী।সরস্বতী যেমন বিদ্যাদেবী, তেমনি মনসা প্রথমে বাক্ পরে মূর্তিমতী বিষবিদ্যা। সরস্বতী গীতবাদ্যের দেবী, মনসার গীতবাদ্যপ্রিয়।গান-বাজনা না হলে তার পূজা হয় না এবং মঙ্গল কাব্য দেখুন এই গীতনৃত্য করেই বেহুলা মনসার প্রসাদ বা আশীর্বাদ লাভ করেছিলেন।  
মনসাই আবার  গৌরী যিনি জল কেটে একপদী দ্বিপদী চতুষ্পদী অষ্টাপদী নবমপদী সৃষ্টি করেছিলেন। ইনিই বাক্দবী যিনি নারীরূপে গন্ধর্বদের ছলনা করে দেবতাদের সোম এনে দিয়েছিলেন, যা আসলে অমৃত। দেবীর এই প্রসন্ন রূপ ।
কিন্তু  বাংলা সাহিত্যে গোড়া থেকেই এ কথা গুলো ঢাকা পড়ে গিয়েছে । এখানে মনসা চণ্ডীর প্রতিদ্বন্দ্বী, শিবভক্তের বিদ্বেষিণী।
ঋগ্বেদের একটি রূপক ভাবনাও পরে দেবীত্বে মূর্তি এই রূপ পেয়েছিল। তিনি দুর্গম অরণ্যের দেবী। পৌরাণিক সাহিত্যে ইনি দুর্গতের দেবতা দুর্গা এবং পার্বতী, চণ্ডী হয়েছেন। তারও আগে ইনি সরস্বতী ও শ্রীর সঙ্গে অভিন্ন ছিলেন। পৌরাণিক যুগের আগেই সরস্বতী ও শ্রীর সঙ্গে বাস্তুনাগ দেবতার পূজা মিশে গিয়েছে মনসা রূপ নিয়েছে। তখন থেকেই মনসা নিজে নাগ না হয়েও সর্পরাজ্ঞী। এবং সরস্বতী ও শ্রী দুই পৃথক দেবতায় মনসা ও লক্ষ্মী পরিণত হবার আগেই দেবীকে  নাগদেবী-পূজা শুরু হয়ে গেছে । পরে সরস্বতী ও শ্রী যখন ভাগাভাগি হল তখন মনসার ভাগে পড়ল সর্পনাগ আর লক্ষ্মীর ভাগে পড়ল হস্তীনাগ। মনসা ও লক্ষ্মীর  একছিলেন তার অনেক প্রমাণ আছে। দুই জনেরই নামান্তর কমলা ও পদ্মা। পদ্মদলে মনসার উৎপত্তি আর কমলার আসন পদ্মে। লক্ষ্মীর উৎপত্তি সাগরে, মনসার উৎপত্তি হ্রদে।
পৌরাণিক সাহিত্যে মনসার ও সরস্বতীর প্রাচীনত্বের ও মৌলিকত্বের বিশেষত্ব অত্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়।। সরস্বতী অবিবাহিত কেউ কেউ বলেন  তিনি বিষ্ণুপত্নী, মনসাও স্বাধীন নারী জরৎকারুর সঙ্গে তার বিবাহ দেবসমাজে কেবল মুখরক্ষা মাত্র। সরস্বতীকে স্রষ্টা ব্রহ্মা কামনা করেছিলেন। মনসাকে তার পিতা শিব কামনা করেছিলেন। যদিও মঙ্গলকাব্যে শিবকে মনসার পিতা বলা হলেও , পুরাণে সেই তথ্যের সমর্থন পাওয়া যায় না। 
কাহিনীতে বলা হয়‌।সাপ ও সরীসৃপরা পৃথিবীতে উৎপাত থেকে মুক্তি পেতে  , ঋষি কশ্যপ নিজের মন থেকে মনসা দেবীর জন্ম দেন । মন থেকে জন্ম বলে তার নাম হয় ‘মনসা’ । সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা তাকে সর্প ও সরীসৃপদের দেবী করে দেন । মনসা তার পৃথিবীতে নিজের কর্তৃত্ব বিস্তার করেন । এরপর মনসা শিবকে প্রসন্ন করেন । শিব তাকে বলেন নারায়ণ প্রসন্ন করতে । মনসার প্রতি প্রসন্ন হয়ে নারায়ণ তাকে সিদ্ধি নামক দৈবী ক্ষমতা প্রদান করেন । এর ফলে দেবী হিসেবে মনসার স্বীকৃতি পথ প্রস্থ্য হয় ।
এদিকে রাঢ়ে চৈতন্যদেবের সময়ে মনসাকে মা দূর্গার এক রূপ মনে করা হত।চৈতন্যদেবের সময় বাংলাদেশে মাটির প্রতিমা গড়ে ঘটা করে মনসা পূজা হতো । কিংবদন্তি অনুসারে, শিব বিষ পান করার পর মনসা মধ্যে তা সঞ্চার হয় এবং মনসা ‘বিষহরী’ নামে পরিচিত হন। মনসার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায় এবং তা দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে মনসা-কেন্দ্রিক ধর্মীয় গোষ্ঠীটি শৈবধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হয়। এর ফলে শিবের কন্যা রূপে মনসার জন্মের উপাখ্যানটি রচিত হয় এবং  চন্ডীর সাথে বিবাদের গল্পটিও আমাদানি হয়।শেষ পর্যন্ত শৈবধর্মও এই আদিবাসী দেবীকে মূলধারার হিন্দুধর্মের ব্রাহ্মণ্য ধারার অন্তর্ভুক্ত করে। তাই আমরা দেখি শিব ভক্ত চাঁদ সদাগর হাতে পূজা পেয়ে তিনি দেবী হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছেন।
যদিও এদেশে মনসা-কাহিনীর সূত্রপাত বৈদিক যুগে, কিন্তু পূর্ব-ভারতে বৈদিক যুগ শেষ হওয়ার আগেই মনসা বাস্তুদেবতায় ও গ্রামদেবীতে পরিণত হয়েছিলেন। তারপর ধাপে ধাপে তার অবনতি ঘটে। আধুনিক সময়ে তিনি ভদ্র দেবসমাজ-বহিস্কৃত নারীপূজিত দেবী রূপেই প্রধানতঃ রয়ে গিয়েছেন।গ্রামদেবীরূপে তিনি পশ্চিমবঙ্গে চণ্ডী বা বিশালাক্ষী রূপ পূজিত হয়ে চলছে।
তবে মনসা শব্দটি বিশ্লেষণ করলে অর্থ দাড়ায় মনচিন্ত। আমাদের মনের মধ্যে বিষ থাকতে পারে সেই বিষ অবশ্যই মনকে বিষাক্ত করে। মনকে বিষমুক্ত ও চিন্তা মুক্ত করার জন্য মনসা পূজা করা হয়  বোধহয় আসলে।

+ ছবি গুলো সংগৃহীত , গ্যালারিতে পরেছিলো তাই কাদের তোলা এ মুহূর্তে মনে নেই।

No comments:

Post a Comment