Tuesday, 20 September 2022

বিশ্ব কর্মা পূজা ও ঘুড়ি ওড়ানো


বিশ্বকর্মা পূজায় ঘুড়ি ওড়ানো বাংলার এক ঐতিহ্য। মানুষের আশা-আকাঙ্খা, আনন্দ, সুখও যেন উর্ধ্বমুখী হয় সেই আশাতেই রঙিন ঘুড়ি ওড়ানো হয়।শোনা যায় অনেক আগে থেকে, পাঞ্জাবে ঘুড়ির উৎসব বেশ জনপ্রিয় ছিল। বর্ধমান রাজারা নাকি পাঞ্জাব থেকে এসেছিলেন।এই রাজাদের হাত ধরেই বাংলায় ঘুড়ির উৎসবের শুরু হয়েছিল। পৌরাণিক কাহিনীতে বিশ্বকর্মা ঈশ্বরদের জন্য উড়ন্ত রথতৈরি করেছিলেন। এদিন আকাশে ঘুড়ি ওড়ানো হয় সেই রথের কথা স্মরণ করে । 
পুরাণ মতে, বিশ্বকর্মা কারিগর , এবং ঋগবেদ অনুসারে স্থাপত্য এবং যন্ত্রবিজ্ঞান বিদ্যার জনক। আমি জানি তিনিই কৃষ্ণের বাসস্থান দ্বারকা নগরী তৈরি করে দিয়েছিলেন। শ্রমিক থেকে ইঞ্জিনিয়ারদের দ্বারা পূজিত হন তিনি। তাঁর দিনে বহু বছর ধরেই বাংলার আকাশে ঘুড়ি ওড়ানোর রীতি আছে।
কেউ কেউ মনে করেন মুঘল যুগ থেকে ঘুড়ি উরানো চল হয় বাংলায়।ইতিহাস বলে মোটামুটি ১৮৫০ সাল থেকে বাংলায় বিশ্বকর্মা পুজোর দিন আকাশে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রচলন হয়। ঘুড়ি আসলে আশা, খুশি, উল্লাস, স্বাধীনতা, শুভ সন্দেশের প্রতীক। সংক্রান্তির শুভক্ষণে ঘুড়ি ওড়ানো খুশি ও স্বাধীনতার বার্তা দেয়। সুলতান শাসনের অবসান পর। বাঙালিরা আসলে অর্থনৈতিক ভাবে আবার সাবলম্বী হয়েছিলেন তাই এই উৎসবের জনপ্রিয়তা এই সময় থেকেই হয় বলে ধারণা।বাংলার কিছু ব্যবসায়ী এ সময় নিজেদের অর্থ এবং প্রতিপত্তি দেখানোর জন্য এদিন ঘুড়ির সঙ্গে টাকা বেঁধে আকাশে ওড়াতেন। এমনটাও শোনা যায় জমিদাররা নাকি টাকা দিয়েই ঘুড়িও বানিয়ে ফেলতেন!
তবে বাংলায় নয় ভারত বিভিন্ন রাজ্য ছাড়া বিদেশেও ঘুড়ি ধর্মীয় সংস্কৃতি উৎসবের অঙ্গ।ভারতের গুজরাতের উত্তরায়নের দিনে আয়োজিত হয় ঘুড়ি উৎসব। গুজরাটিরা ঘুড়ি উড়িয়ে সূর্য দেবতাকে খুশি করেন এবং মনের আকুতি, অভিলাষ জানান। 
মালয়েশিয়ায় পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে মানা হয় ঘুড়িকে।বাড়ির আশপাশে ভূত তাড়াতে ঘুড়ি উড়ায়।এরা ঘুড়িকে জ্বিন বা ভূতের ওঝা হিসেবে ব্যবহার করে। নেপালে ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব মাঘি নামে ডাকা হয়। মিয়ানমারে থিং ইয়ান,থাইল্যান্ডে সংক্রান, লাওসে পিমালাও, হিসেবে উৎসব পালন করা হয়। 
ইস্টারের সময় গায়ানায় ধর্মীয় ঐতিহ্য হিসেবে ঘুড়ি উৎসব হয় । আগস্ট জুড়ে ঘুড়ি উৎসব কলম্বিয়াতএ। স্বাধীনতা দিবসকে উপলক্ষে করে ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব পালন করা হয় চিলিতে। চিনে কানাডা আর যুক্তরাষ্ট্রের নানা রাজ্যজুড়ে ঘুড়ির নানা উৎসব পালিত হয়।
বাংলাদেশ কথা একটু আলাদা করেই বলতে হবে। বাংলাদেশে শীত মৌসুমের বাৎসরিক ঘুড়ি উৎসব উদ্‌যাপন করে।, ঘুড়ি উড়িয়ে পালন করা হয় পৌষসংক্রান্তি দিন। সংস্কৃত শব্দ 'সংক্রান্তি' ঢাকাইয়া অপভ্রংশে সাকরাইন ।সাকরাইন হল বাংলাদেশের ঘড়ি উৎসব।

তবে ঘুড়ি শুধু বিনোদন নয়।পৃথিবীর নানা প্রান্ত।যুদ্ধের কাজে ঘুড়ি ব্যবহার করা হয়েছে । চীন দেশের এক সেনাপতি হানসিন শত্রুর কেল্লার দূরত্ব মাপার জন্য এই ঘুড়ি ব্যবহার করেছিলেন। শত্রুপক্ষের চোখ এড়িয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের লোকদের কাছে সংবাদ প্রেরণের কাজেও ব্যবহৃত হতো ঘুড়ি। ঘুড়িতে ক্যামেরা বেঁধে শত্রুপক্ষের ছবি তোলা, বা ঘুড়িতে বিস্ফোরক বেঁধে শত্রুপক্ষের জাহাজ ধ্বংস করা থেকে শুরু করে নানা কাজে ব্যবহার হয়েছে ঘুড়িকে।
বিজ্ঞানের কাজে ঘুড়ির ব্যাপক ব্যবহার হয়েছে। ১৭৪৯ সালে আলেকজান্ডার উইলসন ঘুড়ি মাধ্যমে উর্ধ্বাকাশের থার্মোমিটার পাঠিয়ে তাপমাত্রা নির্ণয়ের চেষ্টা করেছিলেন। ১২ ডিসেম্বর ১৯০১ সালে ঘুড়িকে ব্যবহার করে বৈজ্ঞানিক মার্কনি আকাশের ইলেকট্রোম্যাগনেটিভ ওয়েভ ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৭৫২ সালে বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিন কৃত্রিমভাবে প্রস্তুত বিদ্যুৎ ও আকাশের বিদ্যুৎ যে এক তা প্রমাণ করেন ঘুড়ির সাহায্যেই।

খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ সনে গ্রিসের ট্যারাস্টাস শহরে আর্কিটাস নামের এক ভদ্রলোক প্রথম আকাশে ওড়ানোর ঘুড়ি ওড়ানো চেষ্টা করেছিলো বলে লোকমুখে শোনা যায় । কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ২০০ সনে চীন দেশের রাজা হানসিন নামের এক সেনাপতি প্রথম এ ঘুড়ি তৈরি করেছিলেন দাবি করা হয় । তবে প্রায় ২,৮০০ বছর আগে প্রাচীনকালের ছুনছিউ আমলে মুওছু নামের একজন দার্শনিক ৩ বছর সময় ধরে কাঠ দিয়ে একটি ঘুড়ি তৈরি করেছিলেন। যাকে বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো ঘুড়ি বলে বলা হয় । তবে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইউরোপের মানুষ , ইটালিয়ান পর্যটক মার্কো পোলোর মাধ্যমে ঘুড়ির কথা জানতে পারবেন । তবে ১৮৬০ সাল থেকে ১৯১০ ঘুড়ির স্বর্ণযুগ বলা হয় । তাই আমি মনে করি বাংলায় ১৮৫০ পর ঘুড়ি উরানো প্রচলন হয়েছিল হয়তো।

No comments:

Post a Comment