Friday, 23 September 2022

কলকাতার গিন্নী মা

কলকাতার গিন্নি মা কথা বলতে গেলে প্রথমে যে কথা মনে পরে সেটা হলো।শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেব এই মন্দিরে আসতেন । ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ বলতেন, "ওরে এই মা সকলের মনবাঞ্ছা পূর্ণ করেন।  তোদের যা যা কামনা তাই তিনি পূর্ণ করতে পারেন।" যখন ব্রাহ্মসমাজের কেশবচন্দ্র সেন  মরণাপন্ন অসুস্থ হয়েছিলেন । তখন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর রোগমুক্তির কামনায় এখানে মানত করেন। এবং তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন।এই মন্দিরের দেবীকে ‘উত্তর কলকাতার গিন্নি’ বলতেন নাট্যসম্রাট গিরিশচন্দ্র ঘোষ।

লোক কথা অনুযায়ী ১৬০০ খ্রিস্টাব্দেরও আগে কুমোরটুলি অঞ্চলে   হোগলা পাতার ছাউনির নীচে মা  সিদ্বেশ্বরী কালী  মূর্তিটি পুজো করতেন কালীবর তপস্বী নামে এক সন্ন্যাসী । তাই এই  মূর্তির সঠিক প্রতিষ্ঠাকালের আজও হদিশ পাওয়া যায়  নি ।  তবে   ১৭৩০-৩২ মধ্যে কুমোরটুলির গোবিন্দরাম মিত্র মন্দিরটি তৈরি করেন বলে জানা যায়। এটি আগে নবরত্ন মন্দির ছিল।  ১৮৪০ সালের ভূমিকম্পে তা ভেঙে যায়। 
সাহেবরা মায়ের নাম দেন "ব্ল্যাক প্যাগোডা" ।
ব্ল্যাক প্যাগোডা আর গোবিন্দ রামের গল্পটা বলা দরকার। সাহেবরা বলতেন 'গোবিন্দরাম মিটারস প্যাগোডা'। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসিত বাংলাতে শ্রী গোবিন্দরাম মিত্র  ছিলেন  সরকারি ট্যাক্স কালেক্টর।  ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা যখন সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের কাছ থেকে কলিকাতা, গোবিন্দপুর ও সুতানুটি, এই তিনটি গ্রাম কিনে নিয়ে তাদের নিজস্ব জমিদারি প্রতিষ্ঠা করে, তখন তারা কর আদায়ের জন্য ভারতীয় ডেপুটি ট্যাক্স কালেক্টর নিয়োগ করে শ্রী নন্দরাম সেনকে । শ্রী নন্দরাম সেন প্রথম ভারতীয় ডেপুটি ট্যাক্স কালেক্টর ছিলেন । তাঁর ঠিক পরেই কোম্পানি শ্রী গোবিন্দরাম মিত্র কে ট্যাক্স কালেক্টরের পদে নিয়োগ করে। ট্যাক্স কালেক্টর হিসাবে শ্রী গোবিন্দরাম মিত্র প্রচুর অর্থ উপার্জন করে ছিলেন ।  গোবিন্দ মিত্র বাবুর প্রাসাদসম বাড়ি ছিল কলকাতার কুমোরটুলি অঞ্চলে। এই বাড়িটি প্রায় ৫০ বিঘা জমি জুড়ে ছিল। এছাড়া নন্দন বাগান বলে অন্য একটি স্থানেও তার আর একটি প্রাসাদসম বাড়ি ছিল। তার বাড়িতে ধুমধাম করে দূর্গা পূজা হত। মা দূর্গার মূর্তিটি সোনা ও রুপার অলংকারে সুসজ্জিত ছিল। মন্দিরে প্রতিদিন প্রায় ৩৭ কেজির অন্নভোগ দান করা হত। প্রায় হাজার ব্রাহ্মন দূর্গা পূজার প্রতিদিন তার গৃহে অন্ন গ্রহণ করতেন ও দামি উপহার পেতেন। 'গোবিন্দরামের ছড়ি', এই প্রবাদ বাক্যটি গোবিন্দরাম মিত্রের সাথেই সম্পর্কিত। আগে বাংলায়, বিখ্যাত লোকেদের নিয়ে একটি ছড়া ছিল। সেটি হল-

"বনমালী সরকারের বাড়ি,
গোবিন্দরাম মিত্রের ছড়ি,
উমাচন্দের দাড়ি,
হুজুরীমালের টাকাকড়ি"।

শ্রী গোবিন্দরাম মিত্র নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি দেখাবার জন্যই, কলকাতার কুমোরটুলিতে গঙ্গার ধারে, এই সুবিশাল নবরত্ন কালী মন্দিরটি বানান ১৭২৫ খ্রিস্টাব্দে কেউ বলেন ১৭৩১ খ্রিস্টাব্দে। মন্দিরটি প্রায় ১৬৫ ফুট বা তার বেশী উঁচু ছিল। মন্দিরের চূড়ায় বসানো ছিল, গঙ্গায় চলা জাহাজের জন্য দিক নির্দেশক চিহ্ন। তবে গোবিন্দরাম, মন্দিরটিকে কখনোই সম্পূর্ন রূপে নির্মাণ করে যেতে পারেন নি। তার মৃত্যুর পরে, এই সুবিশাল মন্দির রক্ষণ করাও তার পরিবারের পক্ষে সম্ভব হয় নি। পরে মন্দিরটির মূল চূড়া সমেত অংশটি ভেঙ্গে পড়ে যায়।  ধীরে ধীরে ভগ্ন হয়ে যায় মন্দিরটি।

দেবী মূর্তি কালো মৃন্ময়ী।  বিবস্ত্রা নন।  বিশেষ লক্ষনীয় দেবীর দুই পা আগে পিছে না হয়ে পাশাপাশি। তবে দেবীর বাম পা মহাদেবের বুকে।এক  হাতে খড়্গ ও এক  কাটা নরমুন্ডু। 

শোনা যায় কালীপুজোর রাতে আজও এখানে তন্ত্রোক্ত বিধিতে দেবীর পুজো হয়।   ১৬০৪ সালে পর্যন্ত নাকি এখানে নরবলি হয়েছে। পরে এখানে পশুবলি হতো । কার্তিকী অমাবস্যা , বুদ্ধপূর্ণিমায় ফুলদোল এবং জ্যৈষ্ঠ মাসের ফলহারিণী কালীপুজো এখানে বড় করে পালিত হয়। রাজা নবকৃষ্ণ দেবের সময় থেকে আজো শোভাবাজার বাজার থেকে সব্জি আসে ভোগের জন্য। কালীপুজোর দিন সুধা ভোগের থাকে। এইভোগে থাকে খিচুড়ি, ভাজা, সাদাভাত, ডাল, নানা ধরনের তরকারি, ডালনা, মাছ, চাটনি পায়েস ইত্যাদি থাকে। 


No comments:

Post a Comment