Wednesday, 19 January 2022

বন বিবির মেলা

ঘুরে এলাম রামরুদ্রপুরের বনবিবির মেলা
          বারুইপুর জয়নগর সদর রাস্তায় বেলে চণ্ডীর বাজার থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে খাকুড়দহ হাট। সেখান থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার গ্রামের অলিগলি আর মেঠো রাস্তা পেরিয়ে বেলা একটার দিকে পৌঁছে গেলাম বনবিবির মন্দিরে। শুনলাম, সকাল হতেই দোকানিরা মন্দিরের চারিপাশে তাঁদের পসরা সাজিয়ে বসে আছেন মেলা দর্শনার্থী তথা খদ্দেরের অপেক্ষায়। নানান ধরনের কাঠের সামগ্রী, পোড়ামাটির জিনিসপত্র, বিবিধ প্রকারের খেলনা, বেত ও বাঁশের ধামা-পালি-পাতি-কুনকি-পোয়া-কুলো-ঝুড়ি, কাঠের নাগরদোলা কী নেই সেখানে! দেখলাম, এলাকার তালের গুড় দিয়ে আড়াই প্যাঁচের জিলিপি তৈরি হচ্ছে। ওদিকে স্থানীয় গজা, চপ ফুলরি পাল্লা দিচ্ছে এগরোল, চাউমিনের সঙ্গে। মেলার অন্যদিকে গোটাকতক কাঠের নাগরদোলা যখন বনবন করে ঘুরে দুপুরের রোদ্দুরে গায়ে বাতাস লাগিয়ে বেড়াচ্ছে তখন তারই একপাশে খানদুই মিকিমাউস যাতে নিজেদের দম ফুরিয়ে না যায় সেই কারণে পিছনদিকে লাগিয়ে রেখেছে একটি করে পেসমেকার, থুড়ি জেনারেটর। এই না হলে বিশ্বায়ন!      
         মন্দিরের অদূরে একদিকে মাথার উপর তেরপল টাঙিয়ে বসেছে তরজাগানের আসর। তরজা বনবিবিমেলার পুরাতন ঐতিহ্য। শোনা যায়, স্থানীয় বাসিন্দা ছোটুলাল মণ্ডলের সৌজন্যে সেই ১৯৫৪ সাল থেকেই এই তরজা অনুষ্ঠানের প্রচলন। ‘লুনোজমি’তে দীর্ঘদিন ভালো ফসল না হওয়ায় তিনি গ্রামবাসীদের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তাঁর জমির ফলন বৃদ্ধি পেলে মেলায় তরজাগানের যাবতীয় খরচা বহন করবেন। হলোও তাই, বনবিবির দয়ায় তাঁর জমির ধান বিঘাপ্রতি তিন-চার মণ থেকে বেড়ে হলো আট-দশ মণ। সেই থেকে এখানে আজও তরজাগানের রেওয়াজ। ছোটুলাল মণ্ডল আজ জীবিত নেই। তাঁর অবর্তমানে এই গানের খরচা চালান তাঁরই সুযোগ্য পুত্র শ্রীগোবন্দ মণ্ডল।    
          মেলায় ঘুরে ঘুরে খিদেয় পেটের নাড়িভুঁড়ি তখন সব ‘অগ্নি সহায়’ হয়ে গেছে। চারি দিকে এতো খাবের দোকান, ভাবছি কোনটা ফেলে কোনটা খাই। এমন সময় নজরে এলো রাস্তার উল্টোদিকে দর্শনার্থীদের খাওয়ার আয়োজন চলছে। সময় নষ্ট না করে বসে পড়লাম খাওয়ার সারিতে। বিনি পয়সায় এমন ভুরিভোজ আমি কখনই ছাড়িনে। ছেলেবেলায় এমন অতুল কীর্তি রাখতে গিয়ে বড়োদের তাড়াও খেয়েছি বহু জায়গায়। একবার গঙ্গাসাগর মেলাতে গ্যাঁটের কড়ি গ্যাঁটে গুঁজে গাণ্ডেপিণ্ডে গিলে বহু অন্নসত্রের মালিককে পুণ্যসঞ্চয়ের সুযোগ করে দিয়েছি। যাইহোক, এখানে সদ্য ফসল তোলা জমিতে বসে স্থানীয় মানুষের চাষের চালের ভাত, অঢ়হলের ডাল আর বাগানের সব্জির ঘণ্ট খাওয়া, সে এক অন্য অভিজ্ঞতা। আশা করি শুচিবাইগ্রস্থ ব্যক্তিরা এই অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হবেন। 
          দেখলাম দুপুর থেকেই পুণ্যার্থীরা মন্দিরের সামনের পুকুরে হাতমুখ ধুয়ে মেলা থেকে বাতাসা, পঞ্চমিষ্টি ইত্যাদি কিনে মন্দিরে যাচ্ছেন পুজো দিতে। মন্দিরের ভিতরে তিনটি বড়ো আকৃতির সিমেন্টের বনবিবিমূর্তি। তিনজনই ব্যাঘ্রবাহনা। একটি মূর্তির পাদদেশের একপাশে বনবিবির ভাই শাজঙ্গলি এবং অন্যপাশে তাঁর প্রথম ভক্ত দুখে। অন্য মূর্তি দুটি একক। এগুলি ছাড়াও ভক্তরা মানতস্বরূপ এইদিন একাধিক বনবিবি, গোপাল ঠাকুরের মূর্তি দিয়ে যান, যা মন্দিরের উঁচু চাতালে সার দিয়ে সাজানো থাকে। এখানে বনবিবির নিত্যপুজো হয় না, তবে এই বিশেষ উৎসবের দিন ছাড়াও প্রতি মঙ্গল ও শনিবার বনবিবি ভোগ পেয়ে থাকেন। পুজোর নির্দিষ্ট কোনো মন্ত্র বা পুরোহিত নেই। ভক্তিভরে মায়ের পায়ে ফুল-বাতাসা ছুঁইয়ে এবং থানের মাটি স্পর্শ করে ভক্তরা তাঁদের ভক্তি জ্ঞাপন করেন।    
          এবার আসি গৌরীসেনদের কথায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উত্তরোত্তর পুজোর খরচাও বাড়ছে। যেমন গতবছর(২০১৯ সাল) পুজোর খরচ হয়েছিল আশি হাজার টাকা এবছরে তা বেড়ে বাজেটে দাঁড়িয়েছে এক লাখ। তবে এই বিপুল পরিমাণ টাকার জন্য কোনো গ্রামবাসীদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাঁদা আদায় করা হয় না, কমিটির লোকজন এবং মেলার অসংখ্য দোকানদাররা সেই গৌরীসেনের ভূমিকা পালন করেন। 
          সবশেষে বলি, এতাদঞ্চলে বনবিবি পুজোকে কেন্দ্র করে ঘুড়ি ওড়ানোর রেওয়াজ বিশেষ নজর কাড়ে। রামরুদ্রপুর ছাড়াও ধপধপি দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের তিন কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত মুর্শিদতলা মাঠে ১লা মাঘ বনবিবিপুজো উপলক্ষেও এই ঘুড়ি ওড়ানোর রেওয়াজ লক্ষ করেছি। সারা শীতকাল জুড়ে ফসল তোলাফেলার হাড়ভাঙা খাটুনির পরে একদিন সকলে মিলে এই ঘুড়ি উৎসবে মেতে ওঠা -এর সঙ্গে নিছক বিনোদন ছাড়া ধর্মের কোনো যোগ দেখিনে। 
(১৭ই জানুয়ারি, ২০২০)

No comments:

Post a Comment