Friday, 28 January 2022

জাঁতাল উৎসব

সুন্দর বনের রাজা দক্ষিণেশ্বর।


বাবা দক্ষিণরায় বাবার আবির্ভাব দিবস,১ মাঘ।  ৺জাতাল উৎসব, বাবা এই দিন কল্পতুরু হন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ধপধপি দক্ষিনেশ্বর মন্দির  অনেক এর মতে ৩৫০ বছরের পুরানো ।ধপধপিতে


দক্ষিনেশ্বর মন্দিরটি স্বপ্নাদেশ পেয়ে রাজেন্দ্রনাথ


চৌধুরী প্রতিষ্ঠা করেন করেন । এখানে লক্ষণীয় সেগুন কাঠের


তৈরী বিগ্রহের সিংহাসনটি প্রায় ১২ - ১৪ ফুট


লম্বা এবং ৫ - ৬ ফুট চওড়া। সিংহাসনের উপর


অধিষ্ঠিত বিগ্রহের উচ্চতা প্রায় ৯ থেকে ১০ ফুট।


.


সহজেই ধপধপি স্টেশন থেকে ভ্যান যোগে ১০-১৫


মিনিটের পথ পর মন্দির টি,  আবার বারুইপুর স্টেশন


থেকেও অটোরিক্সা বা ম্যাজিক


গাড়িতে ধপধপি দক্ষিনেশ্বর মন্দির যাওয়া যায়।

প্রায় ৪০০ বছর আগের কথা ,তখন বারুইপুরের জমিদার ছিলেন মদনমোহন রায়চৌধুরী দেখলেন বারুইপুরের অদূরে বেশ কিছুটা এলাকা জঙ্গল হয়ে পড়ে রয়েছে। যেখান থেকে কোনও রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। তাই তিনি ওই এলাকার জঙ্গল সাফ করার মাধ্যমে ধবধবে পরিষ্কার করে ছিলেন। তাই এই জায়গার নাম ধপধপি।এই জঙ্গল সাফ করার কাজ ধীরে ধীরে এগচ্ছিল। এক জায়গাতে এসেই জমিদারের কর্মীরা বাধার সম্মুখীন হলেন। দেখা গেল, একটা উঁচু পাথরের চারপাশে কাঁটা জাতীয় গাছে বোলতা-ভীমরুল-মৌমাছি বিরাট সব চাক বেঁধে রেখেছে। সেখানে ঢোকাই যাচ্ছে না। কিন্তু স্থানীয় মানুষজনের কোনও অসুবিধা হয় না। জমিদারের বাহিনী যতই আগুন জ্বালিয়ে  চাকগুলিকে নষ্ট করা গেলো না । এক তরুণ গাছেকোপ মারে। অলৌকিক কাহিনির শুরু তখন, গাছের গা থেকে রসের বদলে বেরিয়ে আসে রক্ত। আর সেই তরুণ  মৃত্যুর  হয়।  রাতে জমিদার স্বপ্নে এলেন বাঘের রাজা। তিনি জমিদারকে নির্দেশ দিলেন, "আমার নাম দক্ষিণরায়। আমি এখানেই থাকি। আমাকে প্রতিষ্ঠা করো। "তারপর পয়লা মাঘ মন্দির প্রতিষ্ঠা করে শুরু হল লোকদেবতা দক্ষিণরায়ের পুজো। যে দিনটি আজও জাঁতাল উত্সব হিসেবে পালন হয়ে আসছে।


গোচরন একটা ঐতিহ্য কথা না বলেই নয়। এই অঞ্চলের বনবিবি , ও সত্ নারায়ণ বা কেওড়া দের মেলা র কথা আমি আপনাদের আগেই বলেছি। কিন্তু বলা হয়নি একটা বিশেষ উৎসবের কথা।বারুইপুর জয়নগর সদর রাস্তায় বেলে চণ্ডীর বাজার থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে খাকুড়দহ হাট। সেখান থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার গ্রামের অলিগলি । এখানে একটা মাঠ মন্দির আছে হঠাৎ এর কথায় আসার কারণ কি বলবেন।১ মাঘ জাঁতাল উৎসবের কথা সবাই জানেন। বনবিবির প্রভাব মুক্ত তখন সুন্দর বন। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি লৌকিক সংস্কৃতি বিশ্বাস কোন মেন স্টিম ধর্ম এর সাথে মেলে না। পুরান , বেদ , উপনিষদ, বাইবেল হোক কোরান কিংবা হদিস মতো উপধর্ম গ্রন্থেও এর উল্লেখযোগ্য থাকে না। বনবিবি তাৎপর্যপূর্ণ এখানেই বঙ্গ ভুমিতে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষরা হিন্দু বামুন সম্প্রদায়ের কাছে থেকে বিভিন্ন ভাবে অপমানিত হতেন। গাজীরা বা ধর্ম যোদ্ধারা এই সুযোগে ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন এই অঞ্চলে। কিন্তু বহিরাগত এই নতুন সংস্কৃতিকে আপনার করতে এদের সময় লাগে ছিলো। মূর্তি পূজা কিংবা এক কথায় দৈনন্দিন যে কোন সমস্যায়  তাদের দেবদেবী পাশে থাকার প্রভাব ভুলে যেতে পারছিলো না তাঁরা। অথচ দৈনন্দিন জীবনকথা ভুলে নিয়ম নিষ্ঠা মেনে প্রার্থনা করে মূত্যু পরে ৭২ হুর পাবার স্বপ্ন দেখানো ইসলামকে তাঁরা আপনার করতে পারছিলো না। লক্ষ্মী, গোপাল কিংবা দূর্গা পূজা করা বাঙালি র দেবদেবী ছিলো তাদের ঘরে ছেলে মেয়ে মতো, তাদের সুখ দুঃখের সাথী।


বনবিবির ও দক্ষিণ রায় লড়াই আসলে সেই মানসিক দ্বন্দ লড়াই। এবং এই ভাবেই নিম্ন শ্রেণীর হিন্দু ও  মুসলিম সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি র মিলনের ফল হলো বনবিবি। অবাক করার বিষয় এখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মহিলাদের সম্মান করে দেবীর স্থান  প্রদান  করেছে। কিন্তু মুসলিম ধর্মীয় সংস্কার মেয়েদের অতোটা গুরুত্বদেয়নি। তাই বনবিবি সাথে কিন্তু দক্ষিণ রায় লড়াই কখনো হয়নি। দক্ষিণ রায়ের মা নারায়নী লড়াই করতে যান এখানে। কিন্তু তাঁরা হয়ে গেলেন সই।


যাইহোক সেই সব গল্প। দক্ষিণ রায়ের একাই রাজা সুন্দরবনের বনবিবি আসার আগে। তাই দক্ষিণ রায় আবির্ভাব দিবস ১মাঘ দক্ষিণ এর সব গ্রামেই প্রচলিত ছিলো। দক্ষিণ রায় আসলে সুন্দর বনের বাঘ নৈবেদ্য তাঁর রান্না করা খাশির মাংস, শোল মাছের মত আমিস খাবার হওয়াই স্বাভাবিক।কিন্তু এই গ্রাম এই জাঁতাল উৎসবের অন্য রিতি। এই মঠ মন্দির থেকে । এই গ্রামের আর  সাতটি মন্দিরে পাঠানো হয় ফলপ্রসাদ। অর্থাৎ বৈষ্ণব প্রভাবিত হয়ে যাচ্ছে লোক সংস্কৃতি। তবে দক্ষিণ রায়, নারায়নী , বারা মুর্তি , নামে বাস্তূ পূজাতে নিরামীষ নৈবেদ্য দেওয়ার নিদর্শন পাওয়া যায়, এরকম কথা   জানান কয়েক জন পর্যবেক্ষক।


এবার জাঁতাল পুজো নিয়ে  আমার বন্ধু প্রিয় সারদা  একটা নতুন দিক দেখায়।নাম জাঁতাল শব্দটা এসেছে জাঁতার থেকে । আগেকার সময় ধান ,গম বা ওই জাতীয় শস্য ভাঙ্গাতে একমাত্র জাঁতার ব্যবহার হতো । যেহেতু পয়লা মাঘে নতুন ধান ঘরে আসার উৎসব হয় যা হিন্দু বাঙালি দের কাছে বিশেষ দিন । বাংলার ঘরে ঘরে নবান্নের উৎসব কিন্তু হয় অন্য নামে  । আর শুধু ধান বা গমের খোসা নয় সেগুলোকে পিসে গুঁড়োও করতে জাঁতাই ব্যবহার হতো । আর পয়লা মাঘ আমরা তো জানিই পিঠেপুলি উৎসবের দিন । আপামর বাঙালির কাছে পয়লা মাঘ মানেই চালের গুঁড়ো আর তাই দিয়ে বানানো পিঠেপুলি । আর ওই চাল এবং তার গুঁড়ো আসে জাঁতার সাহায্যেই তাই এখনও গ্রাম বাংলায় সেই রীতিকে সম্মান করে জাঁতাকে পুজো করা হয় তার সাথে ঢেঁকি, মই, গোলা এমন সবকিছুরই পুজো করা হয় যা ধান থেকে চাল  হতে সাহায্য করে । তবে আসলে জাঁতা দেখতে অনেকটা শিব ও শক্তির লিঙ্গ রূপ মানে শিবলিঙ্গের মত তাই পয়লা মাঘে শিব ও শক্তির যে সমস্ত মন্দির আছে সেখানে পুজো দেওয়া হয় ।


গোচরনের ঐ  গ্রামের বাড়িতে তবে শিব মন্দিরে ঐ দিন পুজোর সকলে দক্ষিণেশ্বর ও শিবের  ঠাকুরের পুজো হয় ,তারপর আবার নতুন ও শুদ্ধ পুজো সামগ্রী নিয়ে এই গ্রামে প্রতিষ্ঠিত আরো 6 টি মন্দিরে পুজো হয় ,তার মধ্যে সব কটিই দক্ষিণেশ্বর,শিব ও কালী মন্দির । আর প্রত্যেক মন্দিরে পুজো হওয়ার পর আবা দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে ফিরে নতুন সামগ্রী নিয়ে পুনরায় অন্যান্য মন্দিরে যাওয়া হয় ।


জাতাল আসলে দক্ষিণেশ্বরের আর এক নাম । জাঁতার সাথে যে প্রতীকি আমার চোখে পড়ছে তার সাথে শিব ও শক্তির মিল পাওয়া যায়  কিনা জানিনা না ? তবে ধর্ম বিশ্বাস কে আঘাত না দিয়ে বলি, শিব লিঙ্গ দেখে এবং পার্বতীর  শাকম্ভরী রূপ নিয়ে যে গল্প শুনি তাতে আমার ধরানা, শিব ও  পার্বতী আসলে  কৃষি কাজ ব্যবস্থা থেকে ই সৃষ্টি। লিঙ্গ আসলে লাঙ্গল , অতীতে তে পাথর দিয়ে কৃষি কাজ করা হয়েছিল সেই গুলো পুজিত হয়েছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের দ্বারা পরে তা লিঙ্গের রূপ নেয়। আর মা অন্নপূর্ণা বা শাকম্ভরী বা পার্বতী হলো কৃষি ভুমি।


জয়নগর মজিলপুরে দেবী ধ্বন্বন্তরী কালী পুজো উপলক্ষে মেলা বসে।বীজতলায় অঙ্কুরোদ্গম হয়ে তখন তা মাঠে রোপণ করতে হবে। আষাঢ়ের মাঝামাঝি অম্বাবতীর ঠিক পরেই হয় ‘জাঁতাল’ পুজো। গরাম থানে গ্রাম দেবতার পুজো হয়।বীজতলায় অঙ্কুরোদ্গম হয়ে তখন তা মাঠে রোপণ করতে হবে। আষাঢ়ের মাঝামাঝি অম্বাবতীর ঠিক পরেই হয় ‘জাঁতাল’ পুজো। গরাম থানে গ্রাম দেবতার পুজো হয়।

2 comments: