Thursday, 20 April 2023

ধুনো পড়া

ধুনো পড়া কি?

ধুনো শব্দের বাংলা অর্থ গন্ধদ্রব্যবিশেষ;যা শালগাছের নির্যাস। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সমকালীন,জনপ্রিয় বনেদি বাড়ির পুজো জলেশ্বরীর পুজো প্রসঙ্গে এলেই ‘ধুনো পোড়া" কথা আসে যায়। এই পুজো ঐতিহ্যে এবং এক বিশেষ আকর্ষণ ‘ধুনো পোড়া’ । ভক্তরা দেবীর কাছে মানত করেন ধুনো দেওয়ার, আর মানত পূরণ হলে দেবীকেধুনো অর্পণ করেন । কৃষ্ণনগরের মালোপাড়ার মা জলেশ্বরীর পূজা তে এই বিশেষ রীতি পালন হয় নবমীর দিনে।

ভক্তদের মানত পূরণ হলে। তাঁরা সরা নিয়ে বসেন মায়ের সামনে।এই সরায় আগুনে দেওয়া হয় ধুনো।

ধুনোর আগুন যত উঁচুতে ওঠে, ততই শুভ বলে মনে করা হয়। প্রতি বছর এই ধুনো পোড়া স্বচক্ষে দেখতে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে থেকে কৃষ্ণনগরে ভিড় করেন হাজার হাজার মানুষ।

তবে দক্ষিণ ২৪ পরগনার লোক বা গ্রামীণ সংস্কৃতির অঙ্গ এটা।মনসা পূজা , শীতলা পূজা, গাজন উৎসবে, মোটামুটি ভাবে যারা মানত করেন মানত পুরণ হলে তারা ধুনো পোড়া প্রথা পালন করে মানত পরিশোধ করেন। নীচে টি ছবিটা যেমন ক্ষেত্র সমীক্ষাক সঞ্জয় ঘোষ তুলেছিলেন।নিমপীঠে শীতলা থানে মনসা পূজায় এক মহিলাকে ধুনো পোড়া প্রথা পালন করতে দেখা যাচ্ছে দু হাতে দুটি সরা ও মাথায় একটি মালসা কূল কাটাঁয় আগুন জ্বেলে তাতে ধুনো দিতে থাকেন ব্রাহ্মণ।পুরোহিত বা ব্রাহ্মণ ধুনো পোড়া অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি করছেন একটি মালসা ও দুটি সরায় কূল কাঁটা ছোট ছোটটুকরো করে ভর্তি করেন।

Saturday, 15 April 2023

ভুতের মেলা

ভুতের মেলা কোথায় হয় জানেন???


ফুলিয়া মানে শুধু তাঁত শিল্প নয়। ফুলিয়া মানে কীর্তিবাসের জন্ম স্থান, যবন হরিদাসের ভজনস্থলী বা সাধনপীঠ। হরিদাস ঠাকুর কথা হয়তো অনেকর অজানা, জাতিতে মুসলমান হয়েও তিনি শ্রীচৈতন্যের একান্ত অনুরক্ত ভক্ত হয়েছিলেন। তিনি সবসময় নাম জপ করতেন। মুসলমান হয়েও বৈষ্ণবীয় ক্রিয়াকলাপে লিপ্ত থাকার অপরাধে এ রাজের শাসনকর্তা তাঁকে ‘বাইশ বাজারে’ বেত্রাঘাত করার আদেশ দেন। তবু তিনি হরিনাম ছাড়েন নি। যাইহোক নদীয়ার ফুলিয়া একটা পবিত্র তীর্থস্থান।এই ফুলিয়াতেই নববর্ষের দিন আয়োজিত হয় ভুতের মেলা।


বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে ফুলিয়া তালতলায় ভূতের মেলার জাঁকজমক ও ভিড় চোখে পড়ার মত‌। ভূত বলছি বটে, আসলে তা কবন্ধ (মস্তকবিহীন মূর্তি)। নদিয়া ভূতের মেলা আসলে একটা লোকদেবতার পূজা।লোক মুখে মুখে এটিই ভূত মেলা নামে জনপ্রিয় হয়েছে ।
কবন্ধ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আগে , এই মেলা সম্পর্কে কিছু কথা বলে নিতে চাই।কবন্ধের পুজো ঘিরে মেলায় মাত শান্তিপুরে ফুলিয়ার তালতলা গ্রাম প্রতিবছরই। প্রায় ষাট বছরের বেশি সময় ধরে এই কবন্ধের পুজো চলে আসছে সাথে আয়োজিত হয় মেলা। এই বর্তমানে জনপ্রিয় হয়েছে পেয়েছে ভুতের মেলা নামেই। আমরা জানি এক সময়ে ওপার বাঙলায় থেকে বহু মানুষ এই বাংলায় ফুলিয়াতে এসে বসবাস শুরু করেছেন। সেই সব মানুষদের পূর্ব পুরুষেরা এই পুজো করতেন ওপার বাঙলায় । ওপার বাঙলা থেকে এদেশে চলে আসার পরে, তাঁদের পূর্ব পুরুষরা এখানেও এই পুজোর প্রচলন করেছেন।


বাংলাদেশ নিশকাইন্দার নামে এক দেবতার পূজা হয় যাকে ভুত দেবতা বলে পূজিত হয়। তবে কবন্ধ আর নিশকাইন্দার এক নয়।বরং নিশকাইন্দার কাছাকাছি আরেকটি ভূতদেবতার ‘নিশিকান্ত’ মিল বেশি। । নদিয়া এলাকার ফুলিয়া গ্রামে এই নিশিকান্তের থান। এটিও স্থানীয় অপদেবতা তবে আদিতে নিশিকান্তর পূজা হতো বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার বামনকুইটা গ্রামে। সেই গ্রামের বসাক পরিবার কয়েক শতাব্দী ধরে ভূতদেবতা নিশিকান্তের পূজা করতেন। দেশভাগের পর তাঁরা নদীয়া চলে যান। সেখানে গিয়ে নিশিকান্তের পূজার প্রচলন করেন। নদীয়ার নিশিকান্তের মূর্তির ছবির সঙ্গে অনেকটাই মিল আছে নবাবগঞ্জের নিশকাইন্দার মূর্তির।


কবন্ধ পূজার যাবতীয় উদ্যোগশুরু হয়ে যায় চৈত্রমাসেই । গাজন উৎসবের মতো এখানেও শিবের পাটা মাথায় নিয়ে সন্ন্যাসীরা ঘোরেন গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে । এলাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করেন ,চাল, ডাল, আনাজ ইত্যাদি। 'ভুক্তা'-বলে একে । দিনের শেষে তাঁরা কোনো একটি জায়গায় বসে তা রান্না করে খান। তাঁরা এই সময় নিরামিষ খান । এই জায়গায় পয়লা বৈশাখের দিনই পুজিত হয় একটি কবন্ধ মুর্তি।কবন্ধ মুর্তি মাটির ওপরেই শায়িত থাকে। এই মূর্তি তৈরি করেন স্থানীয় বাসিন্দারাই। যার মাথা থাকে না, চোখ, নাক ইত্যাদি ঢুকে থাকে শরীরের একটু নীচের দিকে। গলা থাকে না।
তবে কবন্ধের এই রূপ কেন ? সেটা জানতে হলে যেতে হবে রামায়ণ কাহিনীতে।রামায়ণ অরণ্যকাণ্ড
বলা হয়েছে রাম, লক্ষণ জটায়ুর অন্তিম সংস্কার করে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন । চারপাশে বন জঙ্গল আর টিলা। দূরে ঋষমূক পর্বত দেখা যাচ্ছে,এই পর্বতে মতঙ্গ মুনির আশ্রম । তা রাম ও লক্ষণ জানতেন । মতঙ্গ মুনি তখন জীবিত নেই। তবুও তাঁর পবিত্র আশ্রম আছে সেখানে তাঁরা যাবেন। তারা দুজনে যেতে যেতে দশানন রাবণের আর সীতা সম্বন্ধে নানা কথা আলোচনা করতে করতে এগুতে থাকলেন তারা বনের মধ্য দিয়ে ।
হঠাত একসময় মনে হল যেনো সহস্র হাতী একসাথে ধেয়ে আসছে। বনের গাছ গুলি তৃণ মতো উপরে পড়লো । মুহুর্মুহু চরণ ফেলবার শব্দে চারিপাশ কম্পমান হল ভূমিকম্পের মতো। কে যেনো গাছ গুলিকে উপরে ফেলে করে তাদের দিকে আসছে । রাম ও লক্ষণ উভয়ে ধনুর্বাণ উচিয়ে ধরলেন । তাদের সামনে এক অদ্ভুদ দৈত্য বের হল। তাঁর বড়ই বিকট দর্শন চেহারা। এই সেই কবন্ধ। অতি স্থূল, পর্বতপ্রমাণ দীর্ঘ চেহারা। ধড়ে মুণ্ড নেই। বুকে বিশাল চোখ, নাকের গর্ত এক দুটি গহ্বরের মতো। রক্তবর্ণ ওষ্ঠের মধ্যে বিশাল তীক্ষ্ণ হাতিদাঁতের মতো দন্তসাড়ি বেরিয়ে আছে । সেই কবন্ধ বলল- “আহা বড়দিন বাদে নর মাংস ভোজনের সুযোগ এসেছে। রোজ রোজ পশুপক্ষী ভোজন করে ক্লান্ত হয়েছি। আজ মানুষের মাংস খাবো।” রাম , লক্ষণ বললেন- “কবন্ধ! বাঁচতে চাইলে সামনে থেকে পলায়ন কর। আমাদের ক্রোধের বলি হবে।” কবন্ধ জানালো- সে এই মানুষের থেকে ভীত নয়। এই বলে দুই হাত দিয়ে রাম লক্ষণ কে ধরল। রাম বললেন- “তবে তুই মর ।” এই বলে রাম খড়্গবাণ নিক্ষেপ করলেন। রাম তীরে কবন্ধের দুই হস্ত কেটে আলাদা হয়ে গেলো।

কবন্ধ বলল- “আপনারা কারা? আপনারা কোন সাধারন মানব নন।” রাম ও লক্ষণ নিজ পরিচয় দিলেন, রাবণ দ্বারা সীতা হরণ কথাও জানালেন । কবন্ধ বললেন- “হে প্রভু রামচন্দ্র! আপনি সেই বৈকুণ্ঠের বিষ্ণু । অভিসাপে আমার এই অবস্থা হয়েছিল । আগে আমি সুন্দর এক দানব ছিলাম । কিন্তু রূপে যৌবনে অহঙ্কার জন্মায় আর অহঙ্কার থেকে হয় সর্বনাশ। একসময়ে আমি এইরূপ মায়াবলে বিকৃতরূপ ধরে এখানে সাধু সন্ন্যাসীদের ভয় দেখাতাম । একদিন মহর্ষি স্থূলশিরাকে ভয় দেখানোর পাপ করেছিলাম। মহর্ষি স্থূলশিরা বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে আমাকে এই বিকৃত রূপে সদা এখানে থাকবার অভিশাপ দিয়েছিলেন। মহর্ষি জানিয়েছিলেন ভগবান বিষ্ণু ধরিত্রীতে অবতার ধারন করে এখানে এসে যখন আমার হস্তদ্বয় ছিন্ন করে আমাকে কৃপা করবেন, তখনই আমার মুক্তি ঘটবে। এরপর দেবরাজ ইন্দ্রের সাথে যুদ্ধের সময় দেবরাজ ইন্দ্রের বজ্রের আঘাতে আমার রূপ হয়। আমার মাথা , বুকে প্রবেশ করে। হে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র , আমাকে আপনি মুক্তি দান করুন। আমাকে আগুনে সমর্পণ করুন।” রামচন্দ্র কৃপা করলেন। কবন্ধকে মুক্তি দান করতে, আগুন জ্বালিতে বললেন লক্ষণকে । ভগবান রাম কবন্ধকে প্রশ্ন করলেন- “আমার স্ত্রী সীতাকে, রাবণ অপহরণ করে নিয়ে গেছে। তুমি জানো সে কোথায় সীতাকে নিয়ে গেছে?” কবন্ধ বলল- “প্রভু! দেবী সীতাকে রাবণ কোথায় নিয়ে গেছে তা আমি জানি না। কিন্তু সীতাদেবীকে খুঁজে বের করার একটি উপায় আমি জানি। আমাকে আগে আগুনে প্রবেশ করতে দিন। বর্তমানে এই পিশাচ রূপে আমি কোন শুভ কর্ম করতে অসমর্থ।” কবন্ধ অগ্নিতে প্রবেশ করলে, তাঁর দেহ দাহ হয়ে এক সুন্দর দেবতা প্রকট হলেন। রামচন্দ্রকে বন্দনা করে বললেন- “প্রভু! সামনেই ঋষমূক পর্বতে বানররাজ বালির ভয়ে তার ভ্রাতা সুগ্রীব , হনুমান, জাম্বুবান , নল, নীল লুকিয়ে আছে। বালিকে মতঙ্গ মুনি বহু পূর্বে শাপ দিয়েছিলো। যার ফলে বালি এই পর্বতে আসতে পারে না। আপনি সুগ্রীবের সাথে মিত্রতা করুন। বানরেরা অবশ্যই মাতা সীতাকে খুঁজে বের করবে।” এই বলে কবন্ধ মুক্তি পেয়ে ভগবানের ধামে গমন করলো।
এই কবন্ধ নাকি শিব ভক্ত ছিলেন। তাই শিবের পূজার সাথে সাথে শিবের সঙ্গী হিসেবে তাঁর পূজা করা হয় পয়লা বৈশাখে। হয়তো অশুভের বিনাশে পর শুভ সুচনা প্রতীক এই পূজা।


Sunday, 9 April 2023

রাঢ়েশ্বর শিবমন্দির

জানেন কি কোন পুকুরে শিব ঠাকুর রোজ স্নান করতে আসতেন??

বাংলা বুকে সেখানে আজো আছে মন্দির। এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করে সুস্থ হয়েছিল রাজার কঠিন অসুখ। ইতিহাস বলে সম্রাট বল্লাল সেন রাঢ়েশ্বর শিবমন্দির দ্বাদশ শতাব্দীতে তৈরি করেন । শাক্ত হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে বলা হতো মহাদেবের বরপুত্র।কথিত আছে গৌড়েশ্বর বল্লাল সেন প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে ছিলেন এক সময়। । এই অসুস্থ অবস্থাতেই একদিন রাতে বল্লাল সেন মহাদেব স্বপ্নাদেশে পেলেন - "আমি কালদিঘির পাশে বর্তমান, প্রতিষ্ঠা করো আমাকে ঐ কালদিঘির পাশেই"। এরপর তিনি অলৌকিক ভাবে সুস্থ হয়ে জান।

তবে এই মন্দিরের কোন প্রতিষ্ঠা ফলক না থাকায় আরো একটি কাহিনী প্রচলিত আছে।এই অঞ্চলেটি আসলে আগে রাঢ়াপুরী নামে একটি রাজ্য ছিল। ঈশান ঘোষ বা ইছাই ঘোষের প্রপিতামহ ধূর্ত ঘোষ এই রাঢ়াপুরীর রাজা ছিলেন। পরিচিত ছিলেন রাঢ়াধীপ নামে। তিনিই রাঢ়াপুরীতে এই শিব মন্দিরটি নির্মাণ করেন। সেই হিসেবে এই মন্দিরটির বর্তমান বয়স হবে হাজার বছর।
লোক বিশ্বাস প্রতিদিন মহাদেব কালদিঘিতে স্নান করতে আসতেন। তবে বল্লাল সেন স্বপ্নদেশ অনুযায়ী এখানেই 'রাঢ়েশ্বর শিবমন্দির' তৈরি করেছেন এটা জনপ্রিয় তত্ত্ব।মন্দিরটির বেলে ও ঝামা পাথর দিয়ে তৈরি । পূর্বভারতের পাথর দিয়ে মন্দিরের মধ্যে এর কারুকার্য জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করে।। পাল আমলে প্রচলিত দেউল স্থাপত্যের উৎকৃষ্ট নিদর্শন। গৌড়ীয় স্থাপত্য রীতিতে পীরা দেউল নিদর্শন ।

দুর্গাপুরের রাঢ় গ্রামই ছিল বল্লাল সেন রাজধানী। লোকমুখে রূপান্তরিত হয়ে আড়া নামে পরিচিত হয়। বল্লাল সেন ছিলেন সমগ্র রাঢ়ের অধিপতি । তিনি নিজ রাজধানী রাঢ় অর্থাৎ বর্তমানের আড়ায় শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। রাঢ দেশে মন্দির প্রতিষ্ঠা হওয়ায় নাম দেওয়া হয় রাঢ়েশ্বর শিব মন্দির।
বর্ধমান জেলার Steel City of India দুর্গাপুরের কাঁকসা থানার অন্তর্গত আড়া গ্রামে অবস্থিত এই 'রাঢ়েশ্বর শিবমন্দির'। প্রায় ৮০০ বছর প্রাচীন ও ভারত সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগের অন্তর্গত ASI দ্বারা সংরক্ষিত এই মন্দির ।

মূল মন্দিরের গর্ভগৃহের পরিসরের স্বল্প । তবে ভিতরে আছে বিশালাকার গ্রানাইট পাথরের শিবলিঙ্গ। পিনাক বা শিবের ধনুক আছে। প্রতিদিন সকালে এখানে মহাদেবের রুদ্রাভিষেক' শৃঙ্গার হয় ১১ টায় । এরপর হয় পুজো ও আরতি। তার আগে পর্যন্ত গর্ভগৃহের গেট বন্ধ থাকে। প্রতি সোমবার এখানে ভোগের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া বিশেষ বিশেষ দিনগুলিতেও ভোগের আয়োজন থাকে। এছাড়াও মানত সম্পূর্ণ হলেও ভক্তরা ভোগ দেন। এখানে বসে বিশাল মেলা মাকুরি সপ্তমীতে । বৈশাখ মাস ও শ্রাবণ মাসের প্রতি দিনই থাকে ভীষণ ভীড়। মন্দিরের ডান পাশে অবস্থিত মানতবৃক্ষে ভক্তরা মানত করে ঢিল বাঁধে।
মন্দিরের বাইরে রয়েছে বিশাল চত্বর। রয়েছে অনেক বড় বড় গাছ যাদের নিচে বাঁধানো বসার জায়গা। চোখে পড়লো কয়েকটি সাম্প্রতিক কালে নির্মিত মন্ডপও।ষ স্থানীয় বিশ্বাসে জাগ্রত এই রাড়েশ্বর শিবমন্দির প্রাঙ্গনে বসে চৈত্র মাসে গাজনের মেলা, শ্রাবন মাসের প্রতি সোমবার ভক্তেরা আসেন শিবের মাথায় জল ঢালতে আর শিবরাত্রিতে ঘটে বিশাল ভক্ত সমাগম।

বেন কিভাবে::-
দুর্গাপুর স্টেশন, সেখান থেকে জয়দেবগামী বাসে আড়া শিব মন্দির। অথবা দুর্গাপুরের মুচিপাড়া বাসস্ট্যান্ড, সেখান থেকে টোটো, ট্রাকার বা বাসে আড়া শিব মন্দির

Saturday, 8 April 2023

রাইপুরের মহামায়া

গড়রাইপুর কিভাবে হলো রাইপুর?? এখানকার মা মহামায়ার সত্যি কি হাজার বছরের প্রাচীন?

ঝাড়গ্রাম থেকে জেলার দীঘা পর্যন্ত বিস্তৃত ৪নং রাজ্য সড়ক এবং দুর্গাপুর থেকে নয়াগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত ৯ নং রাজ্য সড়কের ওপর রাইপুর শহরটি অবস্থিত৷ এই রাইপুরের মা মহামায়া খুব জাগ্রত দেবী । 'জাগ্রত' বলার পিছনে যুক্তি অনেক লোক কাহিনী আছে এই মা মহামায়া লীলা সম্পর্কে। এই মন্দির টি যদিও এখন নতুন করে নব নির্মিত হয়েছে। ।

বিষ্ণুপুরের আসা এক শাঁখারি আলমসার পুকুরের পাড় ধরে শাঁখা বিক্রি করতে যাচ্ছিলেন । পুকুরের ঘাটে পাথরের উপর বসে থাকা কিশোরী একটি মেয়ে দুটি হাতে ছয়টি শাঁখা পরতে চায় । শাঁখারি বলেন " মা তুমি বাচ্চা মেয়ে স্নান করতে এসেছো পয়সা কোথায় পাবে ? "
মেয়েটি বলেন "কালাচাঁদ সন্ন্যাসীকে বলবেন তোমার মেয়ে শাঁখা পরেছে। কলঙ্গীতে ভাঁড়ের মধ্যে দেড় ছেদাম পয়সা আছে তা দিতে ।" শাঁখারি তাঁর কথা দুটি হাতে ছয়টি শাঁখা পরিয়ে দিয় । তারপর শাঁখারি কালাচাঁদ সন্ন্যাসীকে গিয়ে বলেন-
" আপনার মেয়ে পুকুরের ঘাটে শাঁখা পরেছে আর বলেছে কলঙ্গীতে ভাঁড়ের মধ্যে দেড় ছেদাম পয়সা আছে দিতে । " সন্ন্যাসী বিয়েই করিনি তাই তাঁর মেয়ে থাকার কথা নয়।শাঁখারি কথা শুনে সন্ন্যাসী তাঁকে সঙ্গে নিয়ে পুকুরের ঘাটে উপস্থিত হন । পুকুরের ঘাটে কেউ নেই দেখে । সন্ন্যাসী সব বুঝতে পেরে বলেন " মা কে ছয়টি শাঁখা পরেছিস বল , পয়সা আমি দিয়ে দেব কিন্তু কে পরেছিস দেখা দে।"
তখন সন্ন্যাসী ও শাঁখারি দেখতে পান পুকুরের মাঝে জলের উপরে জোড় হাত করা তিন জড়া হাত যার ছয়টি হাতে ছয়টি শাঁখা । রাইপুরের মা মহামায়ার ছয়টি হাত। সুতরাং সবাই বুঝতে পারেন শাঁখা পরেছেন মা নিজেই।বাড়িতে ফিরে এসে সন্ন্যাসী অবাক হয়ে দেখেন ভাঁড়ের মধ্যে দেড় ছেদাম পয়সা রাখা আছে । শাঁখারি পয়সা নিতে অস্বীকার। এবং শাঁখারি প্রতি বছর মায়ের পূজার সময় ছয়টি শাঁখা দেওয়ার অঙ্গীকার করে ফিরে যান । দুর্গা পূজার সময় ঐ শাঁখারির বংশ ধররা প্রতি বছর মা মহামায়া কে শাঁখা দিয়ে যান এখনো।

অতীতে মল্লরাজার অধীনস্থ ছিল রাইপুর।সপ্তদশ শতাব্দীতে বিষ্ণুপুরের রাজা বীর সিংহের ভাই ধরম সিংহ রাজত্ব করতেন এই রাইপুরে। কথিত আছে ধরম সিংহের রাজত্বকালে রাজা তাঁর পুত্র রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সিংহ স্বপ্নাদেশ পান দেবী মহামায়ার। তিনিই মা মহামায়াকে একটি ঝোপ থেকে উদ্ধার করেন। পরবর্তীকালে একটি খড়ের চালা তৈরি করে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করা হয়।এই রাজবংশের সুসন্তান রাজা দূর্জন সিংহ ও তাঁর পুত্র ফতে সিংহ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত ঐতিহাসিক চূয়াড় বিদ্রোহে নেতৃত্ত্ব দিয়েছিলেন ।রাজা বা জমিদার দুর্জন সিংহের ১৭৯৮ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন । রাইপুরের এই চুয়াড় বিদ্রোহকে পরে তিনি বগড়ির চুয়াড় বিদ্রোহের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন।আগে এই অঞ্চলে ‘গড়’ ছিল , তাই এই অঞ্চলের নাম ছিল গড় রাইপুর। চারপাশে জঙ্গল, দুপাশ দিয়ে ঘিরে রেখেছে তিনটি নদী – কংসাবতী, ভৈরববাঁকি ও তারাফেনি। শত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচতে এমনই জায়গায় কয়েকটি গড় তৈরি করেছিলেন রাজারা। এখন গড় নেই বলেই বোধহয় বাঁকুড়ার এই অঞ্চলের নাম হয়ে গেলো ‘রাইপুর’।
রাইপুরের নাম নিয়েও বিতর্ক আছে। লোকসংস্কৃতি গবেষকদের মতে, “রাইপুরের প্রাচীন নাম ছিল ধরমপুর। পরে রাজাদের কুলদেবী ‘রাই’ এর নাম অনুসারে ওই জনপদের নাম রাইপুর হয়েছে। আকবরনামায় এর নাম ‘রায়পুর’ রয়েছে। তখন রায়পুর সরকার জল্লেশ্বরের বা অধুনা ওড়িশা রাজ্যের অন্তর্গত ছিল।
কথিত আছে রাজা দুর্জন সিংহের রাজত্বের সময় অষ্টমীতে 'নরবলি' হত মহামায়ার মন্দিরে দুর্গাপুজোয়। ব্রিটিশরা তাঁর আন্দোলনকে হেয় করতে নাম দিয়েছিল ‘চুয়াড়’। এখানে ইংরেজরা চুয়াড় মানে বর্বর, অসভ্য, একগুঁয়ে বোঝাত। রাজপরিবারের পরবর্তী সময়জমিদার চলে যায়, কারণ ব্রিটিশ সরকার অনেক ক্ষতিপূরণ নিয়েছিলেন এদের কাছে থাকে। ফলে এরা ঋণগ্রস্ত হয় যায় ‌।

পরবর্তীকালে ছাগবলি চালু হয়। রাজপরিবারের সেই নিয়ম অনুযায়ী ছাগবলির পর সেই ছাগটিকে রাজবাড়ির অন্দরমহলে নিয়ে গিয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলার হয়।রাইপুরের মহামায়া মন্দিরে জন্য এরা একশত বিঘা জমি দান ।যদিও শোনা যায়।রাইপুরে রাজবংশের রাজপুত্র এখন খবরের কাগজ বিক্রেতা।কেউ অন্যের দোকানে শ্রমিকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন । জমিদারি প্রথার বিলোপ সাধন সূত্রে বা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ সূত্রে কোন প্রকার সরকারি কোন ভাতা এই পরিবার পায়না ।

দেবী মহামায়া এখানে ‘কোকোমুখা’।এখানের শিলাখণ্ড প্রথমে দেবী চণ্ডী রূপে পূজা পেতেন। পরে তা বিবর্তিত হতে হতে ‘মহামায়া’।গবেষকদের মতে, কোকামুখো আসলে দ্রাবিড়ীয় দুর্গামূর্তি, অনুমান করা হয় ১০২৪-১০২৫ খ্রিস্টাব্দে রাজেন্দ্র চোল বাংলা আক্রমণের করেন। তখন এই মূর্তিটি তিনি সঙ্গে এনেছিলেন। সেই অনুযায়ী মূর্তির বয়স হাজার বছর । মুঘল আমলে রাজপুতানা থেকে এসে চৌহান বংশীয় রাজা শিখর রাইপুরে বসতি স্থাপন করেন। শিখর বংশের সময়কালে আলমসায়ের, শিখরসায়ের-সহ সাতটি পুষ্করিণী খনন করা হয় এবং গড় নির্মাণ করা হয়। শিখরদের পতন পর রাজ পুরোহিত শাসন ভার গ্রহণ করে থেকে ধরম সিংহরা এই অঞ্চলের দখল নেয়।

মল্লরাজা কৃষ্ণ সিংহের ও ছোট ভাই ফতে সিংহ বরাহভূম রাজার সাহায্যে রাজপুরোহিতের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে রাইপুরে বসবাস শুরু করেন। পরে ফতে সিংহরা মুর্শিদাবাদের নবাবের কাছ থেকে রাজসনদ পান। সিংহরা ঋণের দায়ে জর্জরিত হয়। তখন রাইপুর জমিদারির হস্তান্তর ঘটে ১৯১৩ সালে। পরে এই অঞ্চল জমিদারি দ্বারভাঙা মহারাজের অধীনে যায়।

Friday, 7 April 2023

বাংলার ভেল উৎসব

ভেল উৎসব কি? বাংলায় কোথায় ভেল উৎসব হয়??

হুগলি জেলার ব্যান্ডেলে ’ খুব জনপ্রিয়।হুগলি জেলার ‘ভেল উৎসব" শতাব্দী প্রাচীন । ভেল উৎসব মেলা প্রতিবছর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে অর্থাৎ বাংলা নববর্ষের ৯ থেকে ১০ দিন আগে হয়। পশ্চিম বাংলার একমাত্র ব্যান্ডেলেই এই উৎসব হয়। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে , পার্বতী তাঁর পুত্র মুুরুগানকে বা কার্তিককে একটি ভেল দিয়ে ছিলেন। মুুরুগান এই শূল জাতীয় অস্ত্র দিয়ে দুষ্ট আত্মা সুরপদ্যমানকে পরাজিত করেন। মুরুগান ও সুরপদ্যমান এর যুদ্ধে, সুরপদ্যমানের সমস্ত মন্দের বাহিনীকে চূর্ণ করার জন্য মুরুগান এই ভেল ব্যবহার করেছিলেন।

এই "ভেল ভেল" উৎসব আসলে, তামিল জনগোষ্ঠীর একটি বাৎসরিক উৎসব।দক্ষিন ভারতের মুুরুগানের বা কার্তিকর মন্দিরগুলিতে এই উৎসব বিশেষ ভাবে পালিত হতে দেখা যায়।তামিলদের রাজরাজারা প্রাচীনকালে ভেল যুদ্ধে ব্যবহৃত করতেন। ভেল অস্ত্র আসলে বর্শা কিংবা শূলকে বলা হত।প্রাচীনকালে তামিলদের রাজরাজারা যুদ্ধে জিতেই এই ভেল ভেল বলে চিৎকার বা রণহুংকার দিতো।এই ভেলকে কেন্দ্র করেই এই উৎসব বলে একে ভেল বা ভেল ভেল উৎসব বলে।।

ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি মেনে প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তির আগে ব্যান্ডেলে এই উৎসব হয়।হুগলির ভক্তরা ভগবান শ্রী মুথু মারিয়ামমা বা মাতা ওলাইচন্ডী বা মা শীতলার পবিত্র অনুগ্রহ বা আশির্বাদ অর্জনের জন্য এই উৎসব পালন করেন। আনুষ্ঠানিক বলিদান এবং অর্ঘ্য দেন । ব্যান্ডেলের ওলাইচণ্ডী মন্দিরে সকাল থেকেই ভক্তদের ভিড় । এই স্থানীয় এলাকার মানুষ মিছিল বা দল গঠন করে ওলাইচন্ডিতলায়, নিজস্ব শৈলীতে সজ্জিত রথ নিয়ে তাদের দেবতাকে নিয়ে জড়ো হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের চড়ক বা গাজনের মতো এই ভেল উৎসব।

কেউ কেউ বলেছেন ব্যান্ডেল, নামটি “বান্দার” শব্দ থেকে এসেছে একথা ঠিক নয়। পর্তুগিজ ভাষায় ব্যান্ডেল শব্দের অর্থ হল, জাহাজের মাস্তুল। আসলে একটি মাস্তুল উপহার হিসেবে দেওয়া হয় চার্চে তাই থেকে এই নামকরন। পর্তুগিজ উপনিবেশ ছিলো এখানে।ফলে তামিল জনগোষ্ঠীর অনেকেই হুগলি জেলার ব্যান্ডেলে বসবাস করেন। এই তামিল‌ জনগোষ্ঠীর লোক জন বহু বছর আগে বাংলাতেও এই "ভেল ভেল"উৎসব শুরু করেন। এই ভেল উৎসবে প্রতিটি দলে প্রায় এক বা একাধিক লোক থাকে যারা মূল ভক্ত হিসাবে কাজ করেন। প্রথমে তারা ওলাইচণ্ডী তলার একটি পুকুরে স্নান করে এর পর ভক্তদের ওপর দেবতা বা ইত্যাদির অধিষ্ঠান হয়, যাকে বলা হয় ‘ভর’ ।

এরপর তাঁদের নিয়ে আসা হয় ওলাইচণ্ডী মন্দিরে। ওলাইচন্ডীমাতা মন্দিরে আশীর্বাদ গ্রহণকারে প্রধান ভক্ত অন্যান্য দলের সদস্যদের সাথে নিয়ে শোভাযাত্রার শুরু করেন। এরা মুখ দিয়ে বর্শা বিদ্ধ করে, শুধু তাই নয়, সেখানে তাঁরা তাঁদের জিভ, কপালে, শূল বিদ্ধ করা হয়। বঁড়শি গাঁথা হয় পিঠে, বুকে, বঁড়শির নীচে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন সামগ্রী।আবার কেউ কেউ তাদের পিঠের মাংসের সাথে হুক রথের দড়ি আটকে , রথকে টানতে থাকে।এই রথে তাদের দেবতা বসিয়ে তারা এলাকা পরিক্রমা করায় । বাংলার গাজন উৎসবের মত ভক্তরা নিজেদের শরীরকে বিভিন্ন উপায়ে যন্ত্রণা দিয়ে , কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে ইষ্ট দেবতাকে তৃপ্ত করার চেষ্টা করেন আশির্বাদ আশায়।

ওলাইচন্ডী তালায় সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে, শোভাযাত্রার দল , বালিকাটা শীতলা মন্দির দিকে যাত্রা করে।এই যাত্রাপথের দূরত্ব 3 কিলোমিটারেরও বেশি।এই যাত্রাপথে অনেক মানুষ তাঁদের পায়ে জল দেন। শোভাযাত্রায় অবিরাম বলে চলা হয় ভেল ভেল। এবং মাটিতে শুইয়ে দেন তাদের শিশুদের ভক্তদের পদধূলি নেওয়ার জন্য।

Wednesday, 5 April 2023

খেদাইতলার সাপের মেলা

বাংলায় সাপের মেলা কোথায় হয় জানেন কি???

বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে জ্যৈষ্ঠ থেকে ভাদ্র পর্যন্ত মনসা পুজোর আয়োজন করা হয়। তবে ভাসান উৎসব হয় শ্রাবণ মাসের সংক্রান্তিতে । ভাসান উৎসব বসে মেলাও । সাপুড়েরাও ভিড় জমায় এই মনসা পুজো উপলক্ষএ ।দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুর, বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর, মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা, পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম ,বর্ধমানের জাহাননগরে এমন দেখা যায়। এই লোক সংস্কৃতির ধারা বহু প্রাচীন বীরভূমে । বীরভূমে সবচেয়ে বেশি মনসা পূজা দেখা যায় ।

তবে নদীয়া জেলা পিছিয়ে নেই। চাকদা-র কাছে খেদাইতলা একটি প্রাচীন জনপদ । প্রায় চাশো বছর ধরে শ্রাবণী সংক্রান্তিতে মনসাপুজো ও সাপের মেলা অনুষ্ঠিতহয়। সারা পশ্চিমবঙ্গ সহ পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থেকেও শতাধিক সাপুড়িয়া তাদের সাপের ঝাঁপি নিয়ে উপস্থিত থাকে। নদীয়া জেলা সহ সারা রাজ্যের মানুষই এখানে হাজির হয় বিভিন্ন রকমের সাপ, বিষধর এবং বিষহীন, দেখতে।

যদিও সাপুড়িয়ার সংখ্যা কমছে। কারণ সাপের খেলা দেখিয়ে আর পেট ভরছে সাপুড়িয়ার দের। সারা বছর সাপ পুষতে অনেক খরচ হয় । তাছাড়া সরকারের বন্য আইন কড়াকড়ি একটা কারণ। এই মেলায় মহিলা সাপুড়িয়া দেখা মেলে। উপস্থিত মানুষদের সাপ দেখিয়ে শতাধিক মহিলা সাপুড়িয়া টাকা উপার্জন করে ।

তবে এ মেলার পসরার বৈচিত্র্য এখানে নজরকাড়ে।বেতের কাজ, মাটির কাজ, বাঁশের কাজ মানুষের নিত্য ব্যবহার্য দা-কুড়ুল-কোদাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকম মাছ ধরার জাল সহ বিভিন্ন রকমের যন্ত্রাংশ এখানে পাওয়া যায়। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে মেলায় । । মেলায় বাংলা থেকে হারিয়ে যাওয়া হুঁকো পাওয়া যায়।

ধর্মীয় মেলা হলেও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে হাজির হয়। তবে আদিবাসী এবং নিম্নবিত্ত মানুষের সংখ্যা বেশি।মেলায় মূলত পূজিত হন, মনসাদেবী এবং শিবঠাকুর। প্রচুর ছাগবলি হয়।এই সময় হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষ সব ধর্মের স্থানীয় মানুষরা অরন্ধন পালন করে। এক গ্রাম্য মেলাটি এটি সম্প্রীতির উৎসব হয়ে ওঠে। এই মেলা এক দিনের মেলা হলেও মেলা চলে প্রায় ৩-৪ দিন ধরে।

খেদাইতলা মেলা বা,বিষ্ণুপুরের মেলা প্রাচীন । আসলে বিষ্ণুপুর,দেউলিয়া,সাঁতরা, হাঁড়ি পুকুর অঞ্চলে অনেক সাপুড়েদের বাস ছিল। অতীতে এই অঞ্চলে জঙ্গলছিল। এইসব অঞ্চলে সাপেদের নিশ্চিন্ত-আবাস। আসলে বিষ্ণুপুর,পদ্মাবিলা খেদাইতলা ত্রিভুজাকৃতি জমি। তিন বিন্দুতে তিনটি গ্রামের মাঝেই এই মেলা। বিষ্ণুপুরের ‘বেলে’ বা পদ্মবিলার ‘বিলা’ যোগ হয়েছে , বিল বা জলাশয়ের কারণে। বোধহয় বড় বিল ছিলে এ অঞ্চলে। বর্ষায় ডুবে যেত আশেপাশের জমি।শালকির মাঠ একে বলা হত ।মাঠের একধারে বড় নিমগাছের নীচে ছিল মনসার থান যা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন খেদাই ঠাকুর ।

লোককথা অনুযায়ীয় সাধুচরন শেঠ ব্যক্তি পুরো অঞ্চলটি কিনে নেন চাষ আবাদের জন্য।স্থানীয় লোকজনের বারন না শুনে বন-জঙ্গল কেটে চাষ উপযোগী জমি তৈরি করার জন্য। অনেক সাপ কাটা পড়ে, এর ফলে। এই সময়সাপের কামড়এ সাধুচরনে একমাত্র ছেলে প্রান যায়। তারপর মা মনসার স্বপ্নাদেশে ,দেবীর পূজা করে পুত্রের প্রান ফিরে পান। এই থেকে এই মনসা পূজা প্রচলন।

তবে,খেদাইতলার মেলা নামকরণের পিছনে ও একটা গল্প আছে। মা মনসা দেবী স্বপ্নে দিয়ে বলেন তিনি খেদাইয়ের পুজো চান । এবং গ্ৰামের পদ্মপুকুরের পাড়ে নিমগাছ তলায় যেন তাঁকে প্রতিষ্ঠা করা হয়।।লোককথা অনুযায়ী খেদাই ছিলেন শ্রেণী বাগদি। কেউ বলেন মুসলিম জেলের সন্তান। তবে খেদাই ছিলেন ভক্ত সাধক। এখানে কোন মূর্তি নেই। একটি নিমগাছ তলায় দেবী পুজিত হয়।

আবার কেউ বলে ৩০০ বছর আগে নদীপথে ব্যবসা করতে আসা এক বণিক দল খেদাইতলা আস্তানা গড়ে ।হঠাৎই মড়ক লাগে ওই বণিক দলে। বণিকদের প্রধান সেই সময় মনসা পুজোর স্বপ্নাদেশ পান । স্বপ্নে তাঁকে বলা হয়, মনসা পুজো করলেই বিপদ থেকে রক্ষা পাবেন তিনি। সেই থেকেই খেদাইতলায় মনসা পুজো শুরু হয়। যদিও এই ইতিহাস নিয়ে মতান্তর রয়েছে।

যেমন স্থানীয় লোকেরা মুখে প্রচার হতে থাকলো এই অঞ্চলের মনসারই আবাস, । সেই কথা শুনে বরিশালের সোলক গ্রাম থেকে ঘোর বর্ষায় জলে, যমুনা ইছামতী নদী ধরে এসে এক ব্রাহ্মণের পুজো দিতে এলো । এই কথা প্রচার হতে বিলের নাম হয়ে গেল সলাকির বিল। এদিকে খেদাই বাগদির কোন সন্তানাদি ছিল না। তাই শ্রাবণ সঙ্ক্রান্তির আগে খেদাই বাগদির বউ খেদাইকে বলল সে নিমতলায় যাব মায়ের পুজো দিতে। খেদাই খুব রেগে গেলো এইকথা শুনে। সে আসলে দেবদেবী মানত না। আর তার বৌ যাতে পূজা না দিতে যেতে পারে তাই কলার কাঁদি সুদ্ধু বাড়ির সব গাছ কেটে ফেলল। বাছুরের গলার দড়ি খুলে গরুর সব দুধ খাইয়ে দিল।

“পরদিন সকালেই সাপের কামড় খেল খেদাই।খেদাইকে ওঝাগুণিন , বৈদ্যি কেউ বাঁচাতে পারল না ।সবাই বলল সাপে কাটা দেহ কলার ভেলায় করে জলায় ভাসিয়ে দাও। কিন্তু খেদাইএর বউ বললো , দেবীর থানে পুজো না দেবার জন্যই, দেবীর অভিশাপ নেমে এসেছে , সাপে কেটেছে তার স্বামীকে।তাই তিনি নিমতলায় দেবীর থানে গিয়ে শাঁখা সিঁদুর সুদ্ধু স্বামীর সাপেকাটা দেহ ওই গাছের তলায় রেখে দেবে।

শ্রাবণ পূর্ণিমার আগের দিন এই ঘটনা ঘটে। শ্রাবণ মাস, ঝড় বৃষ্টির সময়। খেদাইএর বউয়ের ইচ্ছে মতো গ্রামের লোকেরা খেদাইএর দেহ নিমগাছের তলায় রেখে দেয়। পরদিন ৩১শে শ্রাবণ পুজো দিতে এসে সবাই দেখে গাছের তলায় খেদাইএর মৃতদেহ নেই। প্রান ফিরে পেয়ে ফিরে সে বাড়িতে গেছে। সেই থেকে এই জায়গাটার নাম হয় খেদাইতলা।


Tuesday, 4 April 2023

মাদপুরের মা মনসা

খড়্গপুর থেকে হাওড়ামুখী রেললাইনের পাশে মাদপুর ও জকপুর    মাঝামাঝি  মাঠের মাঝখানে  মায়ের মনসা দেবীর মন্দিরটি আছে ।পশ্চিম বঙ্গের মেদিনীপুর জেলার, খড়গপুর  থানার ,  লজমাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের, গোবিন্দ নগর মৌজার   মহিষা গ্রামের  এই বিখ্যাত মা মনসা দেবীর মন্দির মাদপুরের মা মনসা মন্দির বলে জনপ্রিয় ৷ অনেক অলৌকিক কাহিনী আছে এই মন্দির নিয়ে।
 পশ্চিমবাংলার গঙ্গাসাগর মেলার পর মাদপুরের মনসা মায়ের মেলা পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম মেলা বলে বহু মানুষের দাবী।প্রায় 400 বছর আগে জবপুরের জমিদার যোগেশ্বর রায়  এই মহিষা গ্রামেরও জমিদার । ভোররাতে মা মনসার স্বপ্নাদেশ পান যোগেশ্বর রায় । তিনি দেখেন যে চতুর্ভুজা মা মনসা ,  তাকে বলছেন মহিষা গ্রামের জঙ্গলে উই ঢিপিতে তিনি বিরাজ করছেন। তাঁকে পূর্ণ মর্যাদা পুজো করার আদেশ দেন।
জমিদার  স্ত্রীকে ডেকে বলেন সব কথা । জমিদার বাড়িতে হুলুস্থুল কাণ্ড বাঁধে যায়, সেই মূহুর্তের মধ্যে কাকভোরে  যে যেখানে ছিল  সবাই হাজির হয়ে যায় । সাপের কথা সকলের জানা ঐ জঙ্গলের  ।সকলেই প্রত্যক্ষ করেছে  মা মনসার থান বলে, ওই জঙ্গলে যে স্থানটিতে স্থানীয় মানুষ পুজো করে সেখানে এক মস্ত উইঢিপি আছে  । তার নীচে কিলবিল করে অসংখ্য সাপ  একথা  সকালেই জানান। সূর্যোদয়ের পরেই সেদিন জমিদার সদলবলে ঐ স্থানে গিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে মায়ের নিয়মিত পুজোর ব্যবস্থা করা কথা ঘোষণা করেন ।  কাঠুরেরা কুঠার আর হাঁসুয়া দিয়ে ভয়ে ভয়ে জঙ্গল কেটে  সাফ করে ফেলে । এবং মায়ের থানে আসার রাস্তাও কাটা হয় । চোখের সামনে তারা বিষধর সাপেদের রাস্তা এপার ওপার করতে দেখে সবাই । পরে কংক্রিটে মুড়ে দেওয়া হয় উইঢিপিটিকে  । উইঢিপির পাশে একটি লাল পদ্ম বানানো হয়  । ঢাক, শাঁখ ও ঘন্টার ধ্বনিতে জঙ্গলের চির নীরবতাকে ভেঙে  মনসার থান তৈরি হয় । এখন সেই খানেই হাজার হাজার নারীপুরুষ নিজের হাতে মায়ের পুজো দেয় । 
লোক কাহিনী অনুযায়ী এখানে রেল লাইন পাতা হবার কথা উঠেছিল তখন স্থানীয় মানুষ বৃটিশদের কাছে অনেক কাকুতি মিনতি জানায় মায়ের থানের বেদীকে বাঁচিয়ে রেলের লাইন নির্মাণ করতে। সাহেবরা স্থানীয় মানুষের বাধা ও অনুরোধকে  তোয়াক্কা না করে বাইরে থেকে আনা হাজার হাজার শ্রমিক দিয়ে  , জঙ্গল পরিষ্কারের কাজ শুরু করে দিল । বিষধর সাপ বৃটিশ ইঞ্জিনিয়ার সহ আরো অনেক উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে দংশন করে তাদের প্রাণ নিল । হাজার হাজার বিষধর সাপ দেখে শ্রমিকেরা প্রাণের ভয়ে ত্রিসীমানা ছেড়ে জীবন নিয়ে দৌড়ে পালাল । নতুন শ্রমিক এনে আগুন  জঙ্গলে লাগিয়ে দেওয়া হলো । সাপ গুলোর কোন ক্ষতি হলো না।
খোলা আকাশের নিচে মায়ের আরাধনা শুরু হয়েছিল ।মন্দিরটিতে প্রথম থেকেই যেভাবে ছিলো সেইভাবেই আছে কারণ মা  আবদ্ধ ঘরে থাকতে নারাজ। তাই মন্দির নির্মাণ করলেও মাথায় কোন ছাদ রাখা যাবে না।  মন্দির নির্মাণের চেষ্টা করা হয়েছে অনেকবার কিন্তু মন্দির ভেঙে পড়েছে। মায়ের ভক্তরা সারা বছর ধরে প্রতিদিন মায়ের পুজো হলেও,  শনি ও মঙ্গলবার ভক্তদের ভিড় বাড়ে। এখানে ভক্তরা উই ঢিপি ও পদ্মফুলে ফুল, দুধ-কলা, সিঁদুর মাখিয়ে নিজেরাই পুজো করেন। এখানে এই মন্দিরে মনসা মায়ের কোন মূর্তি।ইচ্ছামত যা খুশি দাও ।পান্ডা বা পূজারীরও উপদ্রব নেই ।পুত্রলাভের আশায়, হারানো গরুর খোঁজে,মারণ ব্যাধির নিরাময়ে, বেকারের চাকুরীর আশায়,   মায়ের থানে মানত করে যায় সবাই এখানে। 
মেলা ও মহাপুজোর দিন নানাপ্রকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে পুজো কমিটি ।প্রতি বছর চৈত্র মাসের তৃতীয় মঙ্গলবার মায়ের বিশেষ পূজা হয়। লক্ষ ভক্ত জমায়েত হয় এই পূজা উপলক্ষ্যে লক্ষ  মায়ের কাছে। এইদিনের মেলাক ই পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম মেলা বলে মনে করা হয়। ভিড়ের দিক  এক দিনের মেলা হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম স্থান । এই দিনে গ্রামে অরন্ধন থাকে৷  এই দিনে প্রায় এক হাজার বেশি ছাগল বলি হয় এখানে ৷ মনসা মায়ের মন্ত্রপূতঃ জলে স্নান করিয়ে হলুদ মাখিয়ে, পায়রা উড়িয়ে দেওয়ার হয়, হাঁস ছেড়ে দেওয়া হয় এখানকার পুকুরে ৷ এইদিনে এই পুজো কমিটি স্বেচ্ছায় রক্তদান শিবির, বস্ত্রদান, দুঃস্থ ছাত্রদের পুস্তকদানের মত উন্নয়ন মূলক কাজও করে থাকে ।
#মাদপুরের মা #মনসা