Saturday, 8 April 2023

রাইপুরের মহামায়া

গড়রাইপুর কিভাবে হলো রাইপুর?? এখানকার মা মহামায়ার সত্যি কি হাজার বছরের প্রাচীন?

ঝাড়গ্রাম থেকে জেলার দীঘা পর্যন্ত বিস্তৃত ৪নং রাজ্য সড়ক এবং দুর্গাপুর থেকে নয়াগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত ৯ নং রাজ্য সড়কের ওপর রাইপুর শহরটি অবস্থিত৷ এই রাইপুরের মা মহামায়া খুব জাগ্রত দেবী । 'জাগ্রত' বলার পিছনে যুক্তি অনেক লোক কাহিনী আছে এই মা মহামায়া লীলা সম্পর্কে। এই মন্দির টি যদিও এখন নতুন করে নব নির্মিত হয়েছে। ।

বিষ্ণুপুরের আসা এক শাঁখারি আলমসার পুকুরের পাড় ধরে শাঁখা বিক্রি করতে যাচ্ছিলেন । পুকুরের ঘাটে পাথরের উপর বসে থাকা কিশোরী একটি মেয়ে দুটি হাতে ছয়টি শাঁখা পরতে চায় । শাঁখারি বলেন " মা তুমি বাচ্চা মেয়ে স্নান করতে এসেছো পয়সা কোথায় পাবে ? "
মেয়েটি বলেন "কালাচাঁদ সন্ন্যাসীকে বলবেন তোমার মেয়ে শাঁখা পরেছে। কলঙ্গীতে ভাঁড়ের মধ্যে দেড় ছেদাম পয়সা আছে তা দিতে ।" শাঁখারি তাঁর কথা দুটি হাতে ছয়টি শাঁখা পরিয়ে দিয় । তারপর শাঁখারি কালাচাঁদ সন্ন্যাসীকে গিয়ে বলেন-
" আপনার মেয়ে পুকুরের ঘাটে শাঁখা পরেছে আর বলেছে কলঙ্গীতে ভাঁড়ের মধ্যে দেড় ছেদাম পয়সা আছে দিতে । " সন্ন্যাসী বিয়েই করিনি তাই তাঁর মেয়ে থাকার কথা নয়।শাঁখারি কথা শুনে সন্ন্যাসী তাঁকে সঙ্গে নিয়ে পুকুরের ঘাটে উপস্থিত হন । পুকুরের ঘাটে কেউ নেই দেখে । সন্ন্যাসী সব বুঝতে পেরে বলেন " মা কে ছয়টি শাঁখা পরেছিস বল , পয়সা আমি দিয়ে দেব কিন্তু কে পরেছিস দেখা দে।"
তখন সন্ন্যাসী ও শাঁখারি দেখতে পান পুকুরের মাঝে জলের উপরে জোড় হাত করা তিন জড়া হাত যার ছয়টি হাতে ছয়টি শাঁখা । রাইপুরের মা মহামায়ার ছয়টি হাত। সুতরাং সবাই বুঝতে পারেন শাঁখা পরেছেন মা নিজেই।বাড়িতে ফিরে এসে সন্ন্যাসী অবাক হয়ে দেখেন ভাঁড়ের মধ্যে দেড় ছেদাম পয়সা রাখা আছে । শাঁখারি পয়সা নিতে অস্বীকার। এবং শাঁখারি প্রতি বছর মায়ের পূজার সময় ছয়টি শাঁখা দেওয়ার অঙ্গীকার করে ফিরে যান । দুর্গা পূজার সময় ঐ শাঁখারির বংশ ধররা প্রতি বছর মা মহামায়া কে শাঁখা দিয়ে যান এখনো।

অতীতে মল্লরাজার অধীনস্থ ছিল রাইপুর।সপ্তদশ শতাব্দীতে বিষ্ণুপুরের রাজা বীর সিংহের ভাই ধরম সিংহ রাজত্ব করতেন এই রাইপুরে। কথিত আছে ধরম সিংহের রাজত্বকালে রাজা তাঁর পুত্র রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সিংহ স্বপ্নাদেশ পান দেবী মহামায়ার। তিনিই মা মহামায়াকে একটি ঝোপ থেকে উদ্ধার করেন। পরবর্তীকালে একটি খড়ের চালা তৈরি করে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করা হয়।এই রাজবংশের সুসন্তান রাজা দূর্জন সিংহ ও তাঁর পুত্র ফতে সিংহ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত ঐতিহাসিক চূয়াড় বিদ্রোহে নেতৃত্ত্ব দিয়েছিলেন ।রাজা বা জমিদার দুর্জন সিংহের ১৭৯৮ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন । রাইপুরের এই চুয়াড় বিদ্রোহকে পরে তিনি বগড়ির চুয়াড় বিদ্রোহের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন।আগে এই অঞ্চলে ‘গড়’ ছিল , তাই এই অঞ্চলের নাম ছিল গড় রাইপুর। চারপাশে জঙ্গল, দুপাশ দিয়ে ঘিরে রেখেছে তিনটি নদী – কংসাবতী, ভৈরববাঁকি ও তারাফেনি। শত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচতে এমনই জায়গায় কয়েকটি গড় তৈরি করেছিলেন রাজারা। এখন গড় নেই বলেই বোধহয় বাঁকুড়ার এই অঞ্চলের নাম হয়ে গেলো ‘রাইপুর’।
রাইপুরের নাম নিয়েও বিতর্ক আছে। লোকসংস্কৃতি গবেষকদের মতে, “রাইপুরের প্রাচীন নাম ছিল ধরমপুর। পরে রাজাদের কুলদেবী ‘রাই’ এর নাম অনুসারে ওই জনপদের নাম রাইপুর হয়েছে। আকবরনামায় এর নাম ‘রায়পুর’ রয়েছে। তখন রায়পুর সরকার জল্লেশ্বরের বা অধুনা ওড়িশা রাজ্যের অন্তর্গত ছিল।
কথিত আছে রাজা দুর্জন সিংহের রাজত্বের সময় অষ্টমীতে 'নরবলি' হত মহামায়ার মন্দিরে দুর্গাপুজোয়। ব্রিটিশরা তাঁর আন্দোলনকে হেয় করতে নাম দিয়েছিল ‘চুয়াড়’। এখানে ইংরেজরা চুয়াড় মানে বর্বর, অসভ্য, একগুঁয়ে বোঝাত। রাজপরিবারের পরবর্তী সময়জমিদার চলে যায়, কারণ ব্রিটিশ সরকার অনেক ক্ষতিপূরণ নিয়েছিলেন এদের কাছে থাকে। ফলে এরা ঋণগ্রস্ত হয় যায় ‌।

পরবর্তীকালে ছাগবলি চালু হয়। রাজপরিবারের সেই নিয়ম অনুযায়ী ছাগবলির পর সেই ছাগটিকে রাজবাড়ির অন্দরমহলে নিয়ে গিয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলার হয়।রাইপুরের মহামায়া মন্দিরে জন্য এরা একশত বিঘা জমি দান ।যদিও শোনা যায়।রাইপুরে রাজবংশের রাজপুত্র এখন খবরের কাগজ বিক্রেতা।কেউ অন্যের দোকানে শ্রমিকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন । জমিদারি প্রথার বিলোপ সাধন সূত্রে বা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ সূত্রে কোন প্রকার সরকারি কোন ভাতা এই পরিবার পায়না ।

দেবী মহামায়া এখানে ‘কোকোমুখা’।এখানের শিলাখণ্ড প্রথমে দেবী চণ্ডী রূপে পূজা পেতেন। পরে তা বিবর্তিত হতে হতে ‘মহামায়া’।গবেষকদের মতে, কোকামুখো আসলে দ্রাবিড়ীয় দুর্গামূর্তি, অনুমান করা হয় ১০২৪-১০২৫ খ্রিস্টাব্দে রাজেন্দ্র চোল বাংলা আক্রমণের করেন। তখন এই মূর্তিটি তিনি সঙ্গে এনেছিলেন। সেই অনুযায়ী মূর্তির বয়স হাজার বছর । মুঘল আমলে রাজপুতানা থেকে এসে চৌহান বংশীয় রাজা শিখর রাইপুরে বসতি স্থাপন করেন। শিখর বংশের সময়কালে আলমসায়ের, শিখরসায়ের-সহ সাতটি পুষ্করিণী খনন করা হয় এবং গড় নির্মাণ করা হয়। শিখরদের পতন পর রাজ পুরোহিত শাসন ভার গ্রহণ করে থেকে ধরম সিংহরা এই অঞ্চলের দখল নেয়।

মল্লরাজা কৃষ্ণ সিংহের ও ছোট ভাই ফতে সিংহ বরাহভূম রাজার সাহায্যে রাজপুরোহিতের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে রাইপুরে বসবাস শুরু করেন। পরে ফতে সিংহরা মুর্শিদাবাদের নবাবের কাছ থেকে রাজসনদ পান। সিংহরা ঋণের দায়ে জর্জরিত হয়। তখন রাইপুর জমিদারির হস্তান্তর ঘটে ১৯১৩ সালে। পরে এই অঞ্চল জমিদারি দ্বারভাঙা মহারাজের অধীনে যায়।

No comments:

Post a Comment