বাংলায় সাপের মেলা কোথায় হয় জানেন কি???
বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে জ্যৈষ্ঠ থেকে ভাদ্র পর্যন্ত মনসা পুজোর আয়োজন করা হয়। তবে ভাসান উৎসব হয় শ্রাবণ মাসের সংক্রান্তিতে । ভাসান উৎসব বসে মেলাও । সাপুড়েরাও ভিড় জমায় এই মনসা পুজো উপলক্ষএ ।দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুর, বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর, মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা, পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম ,বর্ধমানের জাহাননগরে এমন দেখা যায়। এই লোক সংস্কৃতির ধারা বহু প্রাচীন বীরভূমে । বীরভূমে সবচেয়ে বেশি মনসা পূজা দেখা যায় ।
তবে নদীয়া জেলা পিছিয়ে নেই। চাকদা-র কাছে খেদাইতলা একটি প্রাচীন জনপদ । প্রায় চাশো বছর ধরে শ্রাবণী সংক্রান্তিতে মনসাপুজো ও সাপের মেলা অনুষ্ঠিতহয়। সারা পশ্চিমবঙ্গ সহ পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থেকেও শতাধিক সাপুড়িয়া তাদের সাপের ঝাঁপি নিয়ে উপস্থিত থাকে। নদীয়া জেলা সহ সারা রাজ্যের মানুষই এখানে হাজির হয় বিভিন্ন রকমের সাপ, বিষধর এবং বিষহীন, দেখতে।
যদিও সাপুড়িয়ার সংখ্যা কমছে। কারণ সাপের খেলা দেখিয়ে আর পেট ভরছে সাপুড়িয়ার দের। সারা বছর সাপ পুষতে অনেক খরচ হয় । তাছাড়া সরকারের বন্য আইন কড়াকড়ি একটা কারণ। এই মেলায় মহিলা সাপুড়িয়া দেখা মেলে। উপস্থিত মানুষদের সাপ দেখিয়ে শতাধিক মহিলা সাপুড়িয়া টাকা উপার্জন করে ।
তবে এ মেলার পসরার বৈচিত্র্য এখানে নজরকাড়ে।বেতের কাজ, মাটির কাজ, বাঁশের কাজ মানুষের নিত্য ব্যবহার্য দা-কুড়ুল-কোদাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকম মাছ ধরার জাল সহ বিভিন্ন রকমের যন্ত্রাংশ এখানে পাওয়া যায়। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে মেলায় । । মেলায় বাংলা থেকে হারিয়ে যাওয়া হুঁকো পাওয়া যায়।
ধর্মীয় মেলা হলেও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে হাজির হয়। তবে আদিবাসী এবং নিম্নবিত্ত মানুষের সংখ্যা বেশি।মেলায় মূলত পূজিত হন, মনসাদেবী এবং শিবঠাকুর। প্রচুর ছাগবলি হয়।এই সময় হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষ সব ধর্মের স্থানীয় মানুষরা অরন্ধন পালন করে। এক গ্রাম্য মেলাটি এটি সম্প্রীতির উৎসব হয়ে ওঠে। এই মেলা এক দিনের মেলা হলেও মেলা চলে প্রায় ৩-৪ দিন ধরে।
খেদাইতলা মেলা বা,বিষ্ণুপুরের মেলা প্রাচীন । আসলে বিষ্ণুপুর,দেউলিয়া,সাঁতরা, হাঁড়ি পুকুর অঞ্চলে অনেক সাপুড়েদের বাস ছিল। অতীতে এই অঞ্চলে জঙ্গলছিল। এইসব অঞ্চলে সাপেদের নিশ্চিন্ত-আবাস। আসলে বিষ্ণুপুর,পদ্মাবিলা খেদাইতলা ত্রিভুজাকৃতি জমি। তিন বিন্দুতে তিনটি গ্রামের মাঝেই এই মেলা। বিষ্ণুপুরের ‘বেলে’ বা পদ্মবিলার ‘বিলা’ যোগ হয়েছে , বিল বা জলাশয়ের কারণে। বোধহয় বড় বিল ছিলে এ অঞ্চলে। বর্ষায় ডুবে যেত আশেপাশের জমি।শালকির মাঠ একে বলা হত ।মাঠের একধারে বড় নিমগাছের নীচে ছিল মনসার থান যা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন খেদাই ঠাকুর ।
লোককথা অনুযায়ীয় সাধুচরন শেঠ ব্যক্তি পুরো অঞ্চলটি কিনে নেন চাষ আবাদের জন্য।স্থানীয় লোকজনের বারন না শুনে বন-জঙ্গল কেটে চাষ উপযোগী জমি তৈরি করার জন্য। অনেক সাপ কাটা পড়ে, এর ফলে। এই সময়সাপের কামড়এ সাধুচরনে একমাত্র ছেলে প্রান যায়। তারপর মা মনসার স্বপ্নাদেশে ,দেবীর পূজা করে পুত্রের প্রান ফিরে পান। এই থেকে এই মনসা পূজা প্রচলন।
তবে,খেদাইতলার মেলা নামকরণের পিছনে ও একটা গল্প আছে। মা মনসা দেবী স্বপ্নে দিয়ে বলেন তিনি খেদাইয়ের পুজো চান । এবং গ্ৰামের পদ্মপুকুরের পাড়ে নিমগাছ তলায় যেন তাঁকে প্রতিষ্ঠা করা হয়।।লোককথা অনুযায়ী খেদাই ছিলেন শ্রেণী বাগদি। কেউ বলেন মুসলিম জেলের সন্তান। তবে খেদাই ছিলেন ভক্ত সাধক। এখানে কোন মূর্তি নেই। একটি নিমগাছ তলায় দেবী পুজিত হয়।
আবার কেউ বলে ৩০০ বছর আগে নদীপথে ব্যবসা করতে আসা এক বণিক দল খেদাইতলা আস্তানা গড়ে ।হঠাৎই মড়ক লাগে ওই বণিক দলে। বণিকদের প্রধান সেই সময় মনসা পুজোর স্বপ্নাদেশ পান । স্বপ্নে তাঁকে বলা হয়, মনসা পুজো করলেই বিপদ থেকে রক্ষা পাবেন তিনি। সেই থেকেই খেদাইতলায় মনসা পুজো শুরু হয়। যদিও এই ইতিহাস নিয়ে মতান্তর রয়েছে।
যেমন স্থানীয় লোকেরা মুখে প্রচার হতে থাকলো এই অঞ্চলের মনসারই আবাস, । সেই কথা শুনে বরিশালের সোলক গ্রাম থেকে ঘোর বর্ষায় জলে, যমুনা ইছামতী নদী ধরে এসে এক ব্রাহ্মণের পুজো দিতে এলো । এই কথা প্রচার হতে বিলের নাম হয়ে গেল সলাকির বিল। এদিকে খেদাই বাগদির কোন সন্তানাদি ছিল না। তাই শ্রাবণ সঙ্ক্রান্তির আগে খেদাই বাগদির বউ খেদাইকে বলল সে নিমতলায় যাব মায়ের পুজো দিতে। খেদাই খুব রেগে গেলো এইকথা শুনে। সে আসলে দেবদেবী মানত না। আর তার বৌ যাতে পূজা না দিতে যেতে পারে তাই কলার কাঁদি সুদ্ধু বাড়ির সব গাছ কেটে ফেলল। বাছুরের গলার দড়ি খুলে গরুর সব দুধ খাইয়ে দিল।
“পরদিন সকালেই সাপের কামড় খেল খেদাই।খেদাইকে ওঝাগুণিন , বৈদ্যি কেউ বাঁচাতে পারল না ।সবাই বলল সাপে কাটা দেহ কলার ভেলায় করে জলায় ভাসিয়ে দাও। কিন্তু খেদাইএর বউ বললো , দেবীর থানে পুজো না দেবার জন্যই, দেবীর অভিশাপ নেমে এসেছে , সাপে কেটেছে তার স্বামীকে।তাই তিনি নিমতলায় দেবীর থানে গিয়ে শাঁখা সিঁদুর সুদ্ধু স্বামীর সাপেকাটা দেহ ওই গাছের তলায় রেখে দেবে।
শ্রাবণ পূর্ণিমার আগের দিন এই ঘটনা ঘটে। শ্রাবণ মাস, ঝড় বৃষ্টির সময়। খেদাইএর বউয়ের ইচ্ছে মতো গ্রামের লোকেরা খেদাইএর দেহ নিমগাছের তলায় রেখে দেয়। পরদিন ৩১শে শ্রাবণ পুজো দিতে এসে সবাই দেখে গাছের তলায় খেদাইএর মৃতদেহ নেই। প্রান ফিরে পেয়ে ফিরে সে বাড়িতে গেছে। সেই থেকে এই জায়গাটার নাম হয় খেদাইতলা।
No comments:
Post a Comment