Monday, 20 December 2021

সাতদেউল।


মন্দির নির্মাণ বাংলার একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। দেবালয় বা দেউল নির্মাণ একটা গৌরবময় ইতিহাস আছে বাংলা র। পাথর দিয়ে মন্দির তৈরি হলেও বাংলা পোড়া মাটির ইটে তৈরি হয়েছিল বিভিন্ন মন্দির।

 হাজার বেশি  বছরের পুরনো এই সব দেউল গুলো এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বাংলা র আনাচে কানাচে।লোকে বলে, বর্ধমান নামটি কিন্তু  জৈন তীর্থঙ্কর বর্ধমান মহাবীরের নাম থেকেই এসেছে।পূর্ব বর্ধমান আঝাপুর, জৈনদের মন্দির - সাতদেউল নির্মাণ হয়েছিল , আনুমানিক খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দী দিকে । নির্মাণ শৈলী দেখার মতো, রেখ দেউল স্থাপত্য এবং প্রবেশ পথ, অসম্ভব সুন্দর ,করবেল আর্চড, ক্রমবর্ধমান খিলানের মতো। 
রাঢ় বাংলার একসময়  রাজাদের  শাসন ছিলো, জৈন ধর্ম প্রচার প্রসার ছিলো তার প্রমান এটি। বর্ধমান থেকে পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার অম্বিকানগর, বিশাল জায়গা জুড়ে জৈনদের দেখা যায়‌ ।বর্তমানে পশ্চিম বর্ধমানের দামোদর নদের নিকটবর্তী তেলকুপি গ্রাম , তৈলকম্পি বন্দর ছিলো এক সময়।এই সময় অধিকাংশ ধনী ব্যাবসায়ীরা জৈন ধর্ম গ্রহন করেন। তাঁরাই হয়তো এই মন্দির নির্মাণ করেছিলো।

রেলপথে যেতে পারেন এখানে , হাওড়া বর্ধমান কর্ড লাইনের মসাগ্রাম স্টেশনে নেমে যাওয়া যায়। বিকল্প দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়ে ধরে এসে পালসিট টোল প্লাজার কাছেই আঝাপুর। NH2(19) থেকে মাত্র ১ কিমি দূরেই এই দেউল,  সাইকেল ভ্যান, টোটো যায় এখানে। সাত দেউল নাম হলেও , একটিই দেউল বেঁচে আছে। তাই সময় সুযোগ মতো এই রকম দেউল গুলো ঘুরে আসুন একটু আধটু ভিড় হলে এর গুরুত্ব বুঝে রক্ষা বেক্ষনে যত্নশিল হবে সমাজের প্রভাবশালী মহল।

Thursday, 16 December 2021

কাটুম কুটুম শিল্প


ছবিতে পুতুলটা দেখে  "কাটুম কুটুম শিল্পের" এর কথা মনে পড়লো।  অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম এই শিল্প রীতির প্রচলন করেন।অবিন্দ্রানাথ বাঁশের গাঁট থেকে উড়ন্ত পাখি, গাছের শাখা প্রশাখা থেকে চপ্পল হরিণ, এছাড়া গাছের বাকল, সুপারির খোসা,  নারকেলের ছোবড়া, আমের আঁটি তালের আঁটি, নারকেলের মালাই পাথরের টুকরো, দড়ি ইতালি থেকে গিরগিটি, কুকুর, বেড়াল, মাছ, প্রজাপতি ইত্যাদি তৈরি করলেন এবং তাদের নাম করন করলেন "কাটুম কুটুম" পুতুল।।
 মানুষের ব্যবহৃত ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়ে যেমন-ফলের বীজ,গাছের শিকড় ছাল এসব কাজে লাগিয়ে শিল্পী তার আপন মনে  ক্যানভাসে একটা ছবি তৈরি করে  শিল্পকলা ফুটিয়ে তোলেন। বীরভূমের আদিবাসী সম্প্রদায়ের  মানুষরা শান্তিনিকেতনের এখনো এই শিল্প সংস্কৃতির বাহক ওরা যেন জন্মসূত্রেই এই পুতুল গুলো বানাতে জানে ,ওরা জানে গাছের শিকড় ছাল ফল ফলের বীজ সংগ্রহ করে কি করে এই সুন্দর শিল্প বানাতে।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ল অন্য একটি শিল্পী গল্প।বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর এলাকার চূয়া মসিনা গ্রামের দরিদ্র উপজাতি সম্প্রদায়ে জন্ম পবন লোহারের।  পড়ালেখার সঙ্গে ছিল ছবি আঁকার অদ্ভুত টান।  মাধ্যমিক পরীক্ষার পর তিনি চলে গেলেন বোলপুর ছবি আঁকা টানে । সেখানেই কাটুম কুটুম শিল্পের সঙ্গে তাঁর পরিচয়।ছবি আঁকা না হলেও এই শিল্প সাধনায় মগ্ন হয়ে যান তিনি।সামান্য গাছের শিকড় থেকে জন্তু-জানোয়ার বা মানুষের প্রতিকৃতি খুঁজে দেখার জন্য যে চোখ থাকার দরকার, সেটা তো একজন প্রকৃত শিল্পীরই থাকে। তবু হয়তো পাশ্চাত্য ঘরনায় এই শিল্প স্বীকৃতি পায়নি বলেই আমাদের দেশেও অনাদৃত। 
এই শিল্প যেহেতু প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি তাই সম্পূর্ন Bio degradable। আপনার সুন্দর সাজানো গোছানো বাড়ি  যদি ওদের শিল্প রাখার জায়গা হয়,কিনবেন ওদের উৎসাহ দিয়ে, বাংলা ও বাঙালির শিল্প ও সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখবেন।
 সব শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি মনস্ক, সমস্ত বন্ধুদের অনুরোধ করবো, এই কাটুম কুটুম শিল্প কে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আর শিল্পীদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য পুতুল সংগ্রহ করুন। 
ছবিগুলিতে ক্ষুদে মিষ্টি মেয়েটিই শিল্পী । শহরের ছোট্ট  এই শিল্পী হয়তো খেলার ছলেই নারকেল এর খোসা দিয়ে বানিয়েছে এই পুতুল টি, সে হয়তো জানেই না কাটুম কুটুম শিল্প টা কি তবু সে তৈরি করেছে এই পুতুল গুলো। হতে পারে আপনার ঘরের মেয়ে এরকম পুতুল তৈরি করতে পারে। তাদের অবশ্যই উৎসাহিত করুন। কারণ বাঙালি র শিল্প মনন বাঙালি র অহংকার।

শিল্পী : তপস্যা মণ্ডল 

Manab Mondal

Tuesday, 7 December 2021

মাটির লক্ষী ভান্ডার



 বিখ্যাত শহর থাংশান , এই  শহরটিকে মৃৎশিল্পের শহর বলা হয়। এই শহরটি।চীনের অন্যতম প্রাচীন শহর পেইচিং থেকে ১৫০ কি.মি. উত্তর-পূর্বে অবস্থিত  এই শহরের পথে-প্রান্তরে, বিনোদন কেন্দ্র বা পার্ক গুলোতে মৃৎ শিল্পের বিভিন্ন শিল্পকর্ম দেখতে পাওয়া যায়।  শহরের  প্রায় ৬০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস  আছে, থাংশানের মৃৎশিল্পের উৎপত্তি ও বিকাশের সূত্রপাত মিং রাজবংশের ইয়ুং লে এর সময়ে,  এখানে নানা ধরনের চীনা মাটির ৫০০টিরও বেশি মৃৎশিল্প রয়েছে। এখানকার বিভিন্ন রকম মাটির মধ্যে প্রাচীন স্থাপত্য চীনামাটি, স্বাস্থ্যসম্মত চীনামাটি, শিল্পায়ন চীনামাটি, হাইটেক চীনামাটি, শিল্পকলা চীনামাটি ইত্যাদি অন্যতম। আবার শিয়া মহাদেশের মৃৎশিল্পের ইতিহাসে দেখা যায়, খ্রিস্টীয় ১৩ শতকে সং রাজবংশের সময় চীনে তৈরি হতো"সেলাডন' নামক মাটির তৈরি বাসনপত্র ও শো-পিস। এগুলোকে বলা হতো '  চীনারাই সর্বপ্রথম সেলাডন প্রস্তুত করেছিল।  চীনারা এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় সেলাডন রপ্তানি শুরু করে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এই সেলাডনগুলো মৌলিক সৌন্দর্যগুণে তুরস্কের শাসকসহ অন্যান্য শাসক এবং রাজাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।


ইতিহাস এর পাতা উল্টিয়ে দেখলে  সমস্ত উন্নত সংস্কৃতিতে মৃৎশিল্পের   শৈল্পিক প্রমাণ আছে। ২০০০ বছর আগে বিলুপ্ত আফ্রিকান নোক সংস্কৃতির মাটির তৈরি জিনিসপত্র আজকে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে  আছে।   কুমারের চাকা সম্ভবত মেসোপটেমিয়া এ ৪ র্থ সহস্রাব্দে মেসোপটেমিয়া আবিষ্কার করা হয়েছিল।বর্তমান যুগে যেসমস্ত সংস্কৃতি তাদের উৎকৃষ্ট মৃৎশিল্পের জন্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সেগুলির মধ্যে আছে চীনা মৃৎশিল্প, ভারতীয় উপমহাদেশের মৃৎশিল্প, ভূমধ্যসাগরের ক্রিট দ্বীপীয় মৃৎশিল্প, গ্রিক মৃৎশিল্প, পারসিক মৃৎশিল্প, মায়া সভ্যতার মৃৎশিল্প, জাপানি ও কোরীয় মৃৎশিল্প, এবং আধুনিক পাশ্চাত্য সংস্কৃতিগুলিতে  মৃৎশিল্প উল্লেখযোগ্য ছিলো।




মৃৎশিল্পের মৌলিক উপাদানগুলি হল মৃন্ময় বস্তুর আকৃতি, এটির বাহিরের  রঙচিত্র অঙ্কন করে বা খোদাই করে শোভাবর্ধন, এবং এটির উপরের চকচকে প্রলেপ দেওয়া হয়েছে কোথাও কোথাও। ইতিহাসের পর্বভেদে ও সংস্কৃতিভেদে এই উপাদানগুলির উপরে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় জোর দেওয়া হয়েছে, এটাই পার্থক্য। বাংলার মৃৎ শিল্প অনেক প্রাচীন, অনেক ই অনুমান মহেঞ্জোদারো সমসাময়িক আমাদের শিল্প। ধাতু আর প্লাসিক ব্যবহারে জন্য এ শিল্পের চাহিদা কমছে। কিন্তু এ শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে আমাদের ই পন্য চাহিদা তৈরি করতে হবে। যেমন ধরুন, মাটির ব্যাংক বা মাটির লক্ষী ভান্ডার।




নামটা শুনে ই ছেলেবেলা ফিরে গেলেন নিশ্চিত। মাটির রুই মাছ, পশু পাখি, ফল। একটা ছোট ছিদ্র থাকতো পয়সা ফেলার। পয়সা ফেলার পর প্রতি বার আমরা মাটির ব্যাংকটা ঝাকিয়ে শব্দ শুনতাম। মাটির ব্যাংকে কাঁচা পয়সার শব্দ মনের মধ্যে এক ধরনের শিহরণ জাগাতো। এরপর সেই মাটির ব্যাংকও কোনো এক বিপদের দিনে সেটা ভেঙে ফেলা হতো। এটার চাহিদা আছে এখনো।


Monday, 6 December 2021

বনবিবি

বনবিবির সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি বনভূমির আধিপত্য দক্ষিণ রায়ের কাছ থেকে হস্তান্তরিত হয় বনবিবিতে। এই বন বিবির বাহন হিসেবে বাঘ , কুমির হরিন কে দেখা যায়।  জল রাজ্যের অধিপতি কালু রায়ের সঙ্গে সেই অর্থে বনবিবির কোন বিরোধ ছিল না বরং বন্ধু ছিলেন। জলের দানব কুমির কল্পনায় কালু রায়েরই বাহন । বনবিবির বাহন হিসেবে মুরগি কেও দেখা যায় । বনবিবি বা বনদূর্গা দক্ষিণ রায় অর্থাৎ বাঘকে যুদ্ধে হারিয়ে ছিলেন। তাই বাঘকে বনবিবির বাহন হিসেবে দেখা যায় সব জায়গায়। কিন্তু হরিন বাহন কেন?



সুন্দরবনের  বকুলতলা থানার হরিনবাহিনী বনবিবি  সম্পর্কে, গবেষক সঞ্জয় ঘোষ বলছেন "দি রেভিনিউ হিস্ট্রি অফ সুন্দরবনস, ভলিউম টু বাই এফ ডি এস্কোলি্‌ ,পৃষ্ঠা ২১৬ বলা হয়েছে নভেম্বর ডিসেম্বর মাসে সুন্দরবনে হরিন ধান ক্ষেতের খুব ক্ষতি করে।মনে হয় এ  কারনে হরিনবাহিনী বনবিবি পূজা শুরু হয়।তবে এটা  পর্যন্ত জানা তথ্য।হরিন যুক্ত নাম পাওয়া যায় দক্ষিন বারাসাতে রামরুদ্রপুর মৌজায় হরিনখালির বাদায় জেলার  এ  পর্যন্ত জানা সবার বড় বাঘ বাহিনী বনবিবি পূজা ও মেলা হয়।আমার গরু খোঁজ়া অনুযায়ী বনবিবির উৎস মেদিনীপুরের     আদিবাসী সমাজের পূজিত বড়াম দেবী।এই বড়াম মেদিনীপুর আগত সুন্দরবনের আদি বসিন্দা দের বিশালাক্ষ্মী দেবীতে রুপান্তরিত হয় যখন তারা ট্রাইব থেকে কাস্ট  বিবর্তিত হন।মুসলিম আগমনের পর এই বিশালাক্ষ্মী দেবী বনবিবিতে রূপান্তরিত হন মাত্র।তাঁর বাহন থাকে বাঘ।"


গবেষক কবি সমীরণ মন্ডল বলেছেন"বনবিবি পুজো কী ব্রিটিশ পরবর্তী সুন্দরবনে আবাদ করার সময় শুরু হয়ে থাকবে? মেদিনীপুর থেকে এই সংস্কৃতি আমদানি হলে মনে হয় তার আগে মেদিনীপুরের লোক সেভাবে আসেনি। গল্প অনুযায়ী বনবীবী স্বামী পরিত্যক্ত মহিলার সন্তান। পরে মা ফিরে গেলেও বন হরিণের দুধে পালিত হন বনবিবি সাহজঙ্গুলি। এখানে হরিণ আসতে পারে ধারক, বাহক, পালক হিসাবে। "

কুক্কুট বা মুরগী জাতীয় পাখি , গোধা , কুমীর , বাঘ, মহিষ , ষাঁড় সবই উমার বাহন হিসাবে এক এক সময় গৃহীত । এই গুলি বনবিবির বিবর্তনে কোন ভাবে বাদ দেওয়া যায়না । আঞ্চলিক প্রয়োজনে বাহন গুলি আঞ্চলিক দেবীদের ক্ষেত্রে গৃহীত হয় ।


সোদপুরের কর্নমাধবপুর অঞ্চলে অবস্থিত মা বনবিবি-র মন্দিরে। এই মন্দিরে কোন দেবী মূর্তি নেই।  বনের পশুরাই দেবীর প্রতিকি হিসেবে পূজিত হয়। আর এখানে হরিন দেখা যায়।




বনবিবি বা বনদেবী বা ব্যাঘ্রদেবী একইসাথে হিন্দু ধর্মের দেবী ও  বনবাসী মুসলমানদের পীরানি।বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের  মধু আহরণকারী ও কাঠুরে জনগোষ্ঠী বাঘের আক্রমণ হতে রক্ষা পেতে বনবিবির পূজো করেন। দক্ষিণরায় (রায়মণি) হিংস্র বাঘের ছদ্মবেশে মানুষের উপর হামলা করে।মধু সংগ্রাহক, কাঠুরে, মৎসজীবী মানুষের দেবী বনবিবি, বাঘের তথা দক্ষিণ রায়ের হাত থেকে তাদের রক্ষা করবেন এই বিশ্বাসে পূজা করেন।


Saturday, 4 December 2021

ঝুলন পুতুল

ঝুলন মানেইউঠোনে, সিড়ির নীচে, বারান্দার এক কোণে কাদা মাটির পাহাড় সাজিয়ে সৈন্য জড়ো করে কিংবা গুহা রাঙিয়ে সেখানে সিংহ-বাঘকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ছেলেবেলায় ঝুলনে মেতেছেন অনেকেই। সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে ছুটেছে কল্পনার উড়ান। 

ঝুলন যাত্রা বৈষ্ণব ধর্মের অন্যতম বড় উত্‍সব রাধা কৃষ্ণের প্রেমের উদযাপন হয় এই উত্‍সবের মধ্যে দিয়ে। ছোট ছোট পুতুল দিয়ে এদিন বাচ্চারা ঝুলন সাজায়। বিভিন্ন আচার ও সাবেক প্রথা জড়িয়ে আছে বাঙালি সমাজের এই উত্‍সবটির সঙ্গে।বাঙালির যেমন ঝুলন, তেমনি অবাঙালি মারোয়াড়ি সম্প্রদায়ের মধ্যে জন্মাষ্টমী তে এই পুতুল সাজিয়ে নবজাতক কৃষ্ণের জন্মোৎসব পালন দেখা যায়। তবে এখন পুতুলের পসরা কমে গেছে। দুবছর আগেও প্রচুর বেনারসের কাঠের পুতুল, রাজস্থানী লোক শিল্পের পুতুল আসতো। সেই সাথে কৃষ্ণনগর থেকে কৃষ্ণলীলা র বিভিন্ন মডেল।

অনেক হয়তো এখন ছেলে বেলার কথা মনে পরবে। একটা ধর্মীয় উৎসব কিন্তু পুতুল শিল্প চাঙ্গা করে তুলতে পারে। ঝুলন শুধু উৎসব নয় নিছক। ধর্ম আসলে সমাজ বিজ্ঞান। ঝুলন সাজানো সাথে সাথেই আমরা বুঝতে পারতাম বাস্তুতন্ত্র। অর্থাৎ যে সব  পশুপাখি আজকাল বিপন্ন হচ্ছে। তাই হতো না আজকে যদি ঝুলনের মতো উৎসব দিয়ে বাস্তুতন্ত্র খেলার ছলেই বুঝতে পেরে যেতো ছোটরা।

এই পুতুলগুলি দুইভাবে তৈরি করা হয়। কখনও ছাঁচে আলাদাভাবে দুই খোলে বানিয়ে জোড়া দিয়ে, আবার কখনো হাতের আঙুলে টিপে টিপে। পুতুল বানাতে ব্যবহার করা হয় মজে যাওয়া এঁটেল মাটি ও বেলে মাটি। কাঁচা মাটির পুতুল রোদে শুকিয়ে তারপরে দেওয়া হয় রঙের প্রলেপ। রং করতে এলামাটি বা খড়িমাটির সঙ্গে মেশানো হয় গুঁড়ো রং এবং গদের আঁঠা। এইভাবেই মাটির পুতুলগুলি আস্তে আস্তে রঙিন হয়ে ওঠে।  মাছ-ধরা পুতুল,  সৈন্য পুতুল, হরেক রকমের পুতুল।

ঝুলনে সৈন্য, ঘোড়া, গরু, সব্জি, মাছ বিক্রেতা— এ ধরনের পুতুলের চল বেশি। কিন্তু আগের মতো পুতুল বিক্রি হয় না।চাহিদা না থাকায় বাড়েনি পুতুলের দামও। তবে ঘর সাজানোর জন্যে পুতুল বিক্রি হলেও ঝুলনের জন্য আলাদা করে পুতুলের চাহিদা নেই। আসলে বোধহয় আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ইঁদুর দৌড়ে ব্যাস্ত। তবে যৌথ পরিবার গুলো ভেঙে গেছে। এখন সব ফ্ল্যাট বাড়ি, ঝুলন বা কোথায় করবো আমরা । ঝুলন পুতুল তাই হয়তো হারিয়ে যাবে একদিন।

st Francis Xavier's church

আজ ০৩/১২/২০১২, বাংলায় নিশ্চিত ক্ষুদিরাম বসু র জন্মদিন নিয়ে উৎসব অনুষ্ঠান সবাই ব্যস্ত। এখান থেকেই বোঝা যায় ভারত শুধুমাত্র একটি যুক্ত রাষ্ট্র, যেখানে প্রতিটা অঞ্চলের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। জোর করে এক ভারত বানাতে একটি ধর্ম, একটি ভাষা একটি সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে পারবে না। না না আজকাল একটি ভাষা সব রাজ্যের ওপর দাদাগিরি করতে চায় তাই বললাম আর কি! ভারত প্রতিটি রাজ্য গঠিত হয়েছে ভাষা সংস্কৃতি দিয়ে, ধর্মের ভিত্তিতে নয়। গোয়া, আর গয়ার মধ্যে মিল পাবেন না।
তাই হয়তো গোয়াতে আমার দিনটা কালো অন্য রকম। আজ দিনেটা আমি কাটালাম বম জেসুস গির্জায়।বম জেসুস অর্থাৎ পবিত্র যীশু। সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ারকে উত্সর্গীকৃত গির্জা এটি । আজ  বার্ষিক নন-ফিট কিসিং সেন্টস ডে । এই সাধুকে  গোয়ার জনপ্রিয় দেবতা গোয়েঞ্চো সাইব নামে অভিহিত করা হয় । প্রতি বছর, বহু শতাব্দী ধরে গোয়ানদের আশীর্বাদ করার জন্য সাধুকে ধন্যবাদ জানাতে আজ বিশেষ ভোজের আয়োজন করা হয়। যদিও নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয় এবং জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে শেষ হয় এই উৎসব । ওল্ড গোয়ার প্রাচীনতম এবং খুব বিখ্যাত গির্জার একটি। অবশ্যই গোয়ার গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্থান। গির্জা, যাদুঘর, টাওয়ার গুলো শুধু   দেখার নয় অনেক কিছু অন্বেষণ করার  বা জানার জন্য এই জায়গাতে প্রচুর জিনিস রয়েছে। চার্চটি সুন্দর এবং প্রাচীন কাঠামো অসাধারণ। যদি আজ ছবি তোলার সুযোগ ছিলো না। আরো একদিন যাওয়া নিমন্ত্রণ পেলাম যদিও। সেন্ট অগাস্টিন টাওয়ারটি কাছে, এখানে অনেক সংগ্রহশালাও রয়েছে, যাদুঘর রয়েছে। গোয়ার ইতিহাস জানতেও দেখার জন্য একটি ভাল জায়গা।মূল গ্রীজায় বারোক শৈলীর  নিদর্শন মূল বেদীটি সোনালি করা এবং এতে সলোমনিক স্তম্ভগুলির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা লয়োলার ইগনাশিয়াসের মূর্তি রয়েছে যার উপরে IHS মনোগ্রাম এবং পবিত্র ট্রিনিটিতে যিশুর নাম রয়েছে।

আজ গির্জার মধ্যে  মূল আকর্ষণ হলো কোনো রাসায়নিক সূত্র ছাড়াই সংরক্ষিত সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ারের পবিত্র দেহ  । এটি প্রতি 10 বছরে একবার নামিয়ে আনা হয়। গির্জার নির্মাণ কাজ 1594 সালে শুরু হয়। গির্জাটি 1605 সালের মে মাসে আর্চবিশপ, ডোম ফর দ্বারা পবিত্র করা হয়েছিল। খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসে এটি একটি  ঐতিহ্যের স্মৃতিস্তম্ভ  হিসেবে পরিচিত । এটিতেই সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ারের মৃতদেহ রয়েছে।

তিনি 1506 সালে বর্তমানে স্পেনের নাভারে অঞ্চলের জেভিয়ার ক্যাসেলে জন্মগ্রহণ করেন।ফ্রান্সিস জেভিয়ার ফ্রান্সে একজন পণ্ডিত হিসাবে তাঁর জীবন শুরু করেন। তিনি ইতালিতে ভ্রমণ করেন এবং প্রচার করেন এবং তারপর 1541 সালে একজন ধর্মপ্রচারক হিসাবে গোয়া আসেন। সেন্ট ইগনাশিয়াস লয়োলার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যার সাথে তিনি সোসাইটি অফ জেসুস (জেসুইট) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । ফ্রান্সিস জেভিয়ার মারা যান Sancian দ্বীপ, 3 ডিসেম্বর 1552।ফ্রান্সিস জেভিয়ারের মৃতদেহ প্রথমে পর্তুগিজ মালাক্কায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং দুই বছর পর গোয়ায় আনা হয়। কথিত আছে যে, সাধুর মৃতদেহ দাফনের দিনের মতোই সতেজ ছিল। সাধুর দেহাবশেষ এখনও সারা বিশ্ব থেকে বিপুল সংখ্যক পর্যটকদের  আকর্ষণ করে, বিশেষ করে প্রতি দশ বছরে তার দেহকে জনসাধারণের দেখার সময়। কথিত আছে যে 1554 সালে একজন অতি উৎসাহী উপাসক তার ডান পায়ের গোলাপী আঙুলটি কেটে ফেলেছিল,  তখন কথিতভাবে জীবিত দেহ থেকে রক্ত ​​বের হয়েছিল। বলা হয় সাধুর  অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে।
এটি গোয়া এবং ভারতের প্রাচীনতম গির্জাগুলির মধ্যে একটি । মেঝে মার্বেল মূল্যবান পাথর দিয়ে জড়ানো। বিস্তৃত সোনালী বেদি ছাড়াও গির্জার অভ্যন্তরটি অসাধারণ। মূল বেদিতে লোয়োলার সেন্ট ইগনাশিয়াসের একটি বড় মূর্তি রয়েছে , যিনি সোসাইটি অফ জেসুস ( জেসুইটস ) এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ফ্রান্সিস জেভিয়ারের একজন সঙ্গী ছিলেন ।
 একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো 1545 সালে, জেভিয়ার পোপকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেন যে গোয়াতে ইনকুইজিশন আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করা হোক।( গোয়া ইনকুইজিশন নিয়ে পরে একদিন গল্প হবে।)
আজ এখানে মেলা ছিলো। হরেক দোকানে র মাঝে এই মেলাতে সেই পুরনো দিনের যাতা, শিলনোড়াও হামাল দিস্তা দেখলাম।
( প্রিয়া সারদ উপদেশে, গোয়ার ডাইরি শুরু করলাম। মতামত জানান, লেখা টা কি ধারাবাহিক চালাবো কিনা।)
🙏 Manab Mondal 🙏

Tuesday, 30 November 2021

দারু বিগ্রহ

সোমা মুখোপাধ্যায় যিনি বাংলার নানা ঐতিহাসিক ঐতিহ্য এর কথা তাঁর লেখা গ্রন্থের মাধ্যমে তুলে ধরেন তাঁর একটি পোস্ট দেখে , আমার এই লেখাটা লেখার  ইচ্ছে হলো। যদিও সায়ন রায়ের তৈরি তথ্য চিত্র গুলো য় অনেক গুলো দারুন বিগ্রহের কথা আমরা জানতে পারি। তার মধ্যে  ফরতাবাদ এর কাঠের কালি বিশেষ উল্লেখযোগ্য কারণ এই মন্দিরের পথ খুঁজে পাওয়া ই অনেক টা কঠীন কাজ অন্তত কোলকাতায় থাকাকালীন দুইবার তিনবার চেষ্টা করে আমি ব্যার্থ হয়েছিলাম, এবং তারাপদ সাঁতারার‌ লেখায় যদিও বহু দারু বিগ্রহের কথা আমরা জানতে পারি। শালকিয়ায় রমণী মোহন চ্যাটার্জীর বাড়িতে এক দারুময়ী জগদ্ধাত্রী আছেন তার রূপ সত্যি অসাধারণ। সোমা দেবীর কথা অনুযায়ী  রমণী বাবু একজন উদ্যোগপতি ছিলেন।তাঁর কাস্ট আয়রণের ব্যবসা ছিল।   হুগলির সঙ্গে হাওড়ার যোগসূত্রের কারণে বিগ্ৰহে তার অনেক প্রভাব আছে।
আমি আমার বিভিন্ন লেখায় তিনটি চারটি দারু বিগ্রহের কথা আপনাদের বলেছিলাম। বারুইপুর অঞ্চলের রামনগর থানার আদি মহামায়া, গড়িয়ার মহামায়া, বোড়ালের ত্রিপুরার সুন্দরী  , বনহুগলির চক্রবর্তী দের জগন্নাথ দেব কথা।  দারুন বিগ্রহ আসলে কি? সাদামাটা ভাষায় বললে কাঠের মূর্তি। কাঠের মূর্তি মানেই মনে পরে জগন্নাথের কথা, জগন্নাথের মূর্তি সাধারণত কাঠে তৈরি করা হয়। জগন্নাথকে মূলত আদিবাসী দেবতা মনে করেন। ওড়িশার আদিম আদিবাসী সরভরা ছিল বৃক্ষ-উপাসক। তারা তাদের দেবতাকে বলত "জগনাত"। সম্ভবত, এই শব্দটি থেকে "জগন্নাথ" শব্দটি এসেছে। নিম গাছের কাঠ দিয়ে জগন্নাথদেবের প্রধাণ বিগ্রহটি(জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা) নির্মিত। এই মূর্তির চোখদুটি বড়ো বড়ো ও গোলাকার। হাত অসম্পূর্ণ। মূর্তিতে কোনো পা দেখা যায় না। যদিও বিগ্রহে অসম্পূর্ণ হাত ও পায়ের অনুপস্থিতি নিয়ে নানা ধরনের মতবাদ এবং পবিত্র বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার কাঠের মূর্তি গুলো আসলে চৈতন্য মহাপ্রভুর দ্বারা প্রভাবিত। আপনারা সকলেই জানে বর্তমান দক্ষিণ কলকাতার কালিঘাট, কুঁদঘাট , গড়িয়া অঞ্চলের উপর দিয়ে বেয়ে গেছে টালির নালা, তাই আসলে আদি গঙ্গা। বানিজ্য এর স্বার্থে টলি সাহেব এই গঙ্গার সংঙ্কার করে বলে এরনাম টালির নালা। কুঁদঘাঘাট আসলে কুঁত - ঘাট , কুঁত আসলে আজকের দিনে র টোল ট্যাক্সের মতো জলপথ ব্যবহার কর আদায়ের স্থান।
এই আদি গঙ্গা পথ ধরে গড়িয়া , বারাইপুর, জয় নগর, ছত্র ভোগ হয়ে চৈতন্য মহাপ্রভু পুরি গিয়েছিলেন। তাই এই অঞ্চলে বৈষ্ণব ঘাটা, কীর্তনখোলা মতো জনপদের নাম শোনা যায়। এবং মন্দির গুলোতে বৈষ্ণব প্রভাবে কাঠের মূর্তি দেখা যায়। আমি যতোদূর জানি মহামায়া ও বৈষ্ণব প্রভাবিত দেবী।
কিন্তু অবাক লাগলো শালকিয়ায় কাঠের জগদ্ধাত্রী মূর্তি দেখে। সালকিয়া হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হাওড়া শহরের একটি অঞ্চল। এই জন পদের পুরাতন নাম ছিলো শালিখাঁ , ১৯শ শতক থেকে জনবসতিপূর্ণ হতে শুরু করে হুগলি নদীর তীরে মালি পাঁচঘড়া ও ঘুষুড়ি অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত এই অঞ্চল। বাংলায় জগদ্ধাত্রী পূজা বিখ্যাত চন্দন নগরে। অর্থনৈতিক কারণে এটি ঘটেছিলো। দূর্গা পূজার সময় এরা ব্যাস্ত থাকতো। তাই জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন করে এই বনিক মহল। তবে শালকিয়়াার সীতা রাম ঘোষ লেন এই বিগ্রহের বয়স একশ বছরের পুরনো নয়।
 আমার প্রশ্ন হলো বাংলায় কাঠের মূর্তি তৈরি হয়েছিল , সম্ভবতঃ পাথর ও ধাতুর বিকল্প হিসেবে মূর্তি র স্থায়ীত্ব বাড়ানোর জন্য । কিন্তু ঠিক পাঁচশত বছর পূর্বে চালু হলো কেন এই কাঠের মূর্তি  তৈরি ?
কারণ আমার চোখে দেখা প্রাচীন কাঠের মূর্তি বোধহয় চৈতন্য মহাপ্রভুর মূর্তি।চৈতন্যদেব ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তিন বছর পরে, ১৫১৩ সালে নির্মিত হয় ওই মূর্তি। বলা হয়, যে নিম গাছের তলায় তাঁর জন্ম হয়েছিল, সেই গাছের কাঠ দিয়েই তৈরি হয়েছিল চৈতন্যদেবের দারু বিগ্রহটি।
অন্যটিও নদীয়ার চাকদহ যশরায় চৈতন্যদেবের অন্তরঙ্গ পার্ষদ জগদীশ পণ্ডিত প্রতিষ্ঠিত প্রায় পাঁচশ বৎসরের সুভদ্রা বলরাম বিহীন দারু নির্মিত জগন্নাথ বিগ্রহ যদিও খুব বিখ্যাত। জগন্নাথ নামের অর্থ চলমান। কিন্তু ইনি রথে চড়েন না। এ নিয়ে একদিন গল্প হবে নাড়ায়।
আমার এক কবি বন্ধু বলেছিলো। কাঠের মূর্তি তৈরি সাথে অর্থনীতি অবস্থার একটা যোগাযোগ আছে। কাঠ সহজ লভ্য বলেই কাঠের মূর্তি তৈরি করা হতো বাংলায়।সে চৈতন্য মহাপ্রভু কে দেবতা অবতার হিসাবে দেখেনি কখনো। সে সমাজ সংস্কারক হিসেবে দেখতো। তিনি ব্রাম্ভণদের জাতপাত বিরুদ্ধে, পূজা র নামে সম্পদ বৃদ্ধির বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ ছিলেন। নদীয়ার চাকদহ যশরায় জগন্নাথ গল্প দেখুন, পান্ডাদের অত্যাচারে জগন্নাথ ছাড়লেন পুরীর মন্দির। আবার নগর কীর্তন শাসকদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ এক প্রচেষ্টা যা রাষ্ট্রের কাছে , নিজের ধর্ম পালনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। তবে বাংলা বৈষ্ণব রা দেবদেবীকে ঘরে সাধারণ সদস্যদের মতো ধরে নিয়ে ছিলো। গোপাল কখনো তাদের সন্তান, কৃষ্ণ তাদের সংখ্যা। ঘর সংসার সব কিছু এদের ঈশ্বরকে নিয়ে। এদিকে বৃন্দাবন অঞ্চলে এই সময়ে মন্দির গুলো ভাঙা পরেছে শাসকদের দ্বারা। সেই শাসকদের হাতে তখন বাংলার শাসন। ধর্মীয় দিক থেকে তাঁরা মূর্তি পূজা বিরোধী। তাই এই কাঠের মূর্তি যা নিয়ে সহজেই প্রদান পরিবর্তন করা যায়। এই মতকে আমি সমর্থন করি না, তবে যদি এটা সত্য হয়ে থাকে তবে বলতে হয়। তবে বলতে হবে ভয় ও সভ্যতাকে সুন্দর নিদর্শন গরতে সাহায্য করেছে। আর শিল্প মন কখনো হয়তো সামাজিক ঘটনায় অতটা প্রভাবিত হয়না, তাই তাঁরা অনেক দিন বেঁচে থাকে তাদের শিল্প কলার মধ্যে দিয়ে।

Monday, 29 November 2021

চীনা মাটির পুতুল

পরিব্রাজক গবেষক সায়ন রায়ের সংগ্রহ এর চীনা মাটির প্রদীপ, রুই মাছ দেখে মনে পরে গেলো , বাংলায় একসময় চীনামাটির পুতুল  তৈরি হতো খুব। পুতুল আসলে কি পরিস্কার করে বলে নেওয়া উচিত।পুতুল কখনও মানুষের চেহারার কাছাকাছি আবার কখন কোনো পশুর চেহারার অনুকরণে হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে বৃহত্তর দৃষ্টিতে মাটি, কাঠ, মোম, প্লাস্টিকের বানানো পশুপাখি থেকে ফল, গাছ সব কিছুকেই পুতুলের শ্রেণিভুক্ত করা যায়। 
এবার চীনা মাটির পুতুল এর কথা য় আসা যাক। চীনা মাটির নাম থেকে ই বোধহয় বুঝতে পরেন এটি বাংলার মাটি নয়। চীনামাটির সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয়।চীনারা সর্বপ্রথম মাটি দিয়ে পাত্র তৈরি করে।  এটি একটি সাদা মাটি  আর এ কারণেই এ মাটিকে চীনামাটি নামে নামকরণ করা হয়। তবে ক্যাওলিং টিলা থেকে সংগ্রহ করার জন্য কোথাও কোথাও এটি ক্যাওলিন বলা হয় । চীনামাটি হচ্ছে বিশেষ ধরনের মাটি, যা বিভিন্ন দ্রব্য তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়। এই মাটিতে আছে ৪৬ শতাংশ বালু, ৪০ শতাংশ অ্যালুমিনা ও ১৪ শতাংশ জল থেকে।
উচ্চ তাপে আগুনে পোড়ালে চীনামাটি সাদা, মসৃণ ও চকচকে হয়। এ বৈশিষ্ট্যের জন্যই এ মাটি দিয়ে কাপ, প্লেট, বাটি ইত্যাদি তৈরি করা হয়।
এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং দক্ষিণ আমেরিকার খনি থেকে প্রচুর পরিমাণে চীনামাটি সংগ্রহ করা হয়। পশ্চিম ইংল্যান্ডে কর্নওয়ালে ও পশ্চিম ডেভনে চীনামাটির পলি তলানি পাওয়া যায়। এ জন্য এসব এলাকায় নানা ধরনের মৃৎশিল্প গড়ে উঠেছে। মৃৎশিল্প বা মাটির তৈরি শিল্পের পাশাপাশি চীনামাটি কাগজ, রাবার, রঙ, প্রসাধনসামগ্রী ইত্যাদি তৈরিতেও ব্যবহার করা যায়।
তবে এই মাটির ও একটা ইতিহাস আছে। মনে হয় সুকুমার রায়ের কোন প্রবন্ধে পড়ে ছিলাম।দশ হাজার বৎসর আগে মিশরে  মাটির বাসন তৈরি হত, তাহ্ সুন্দর সুন্দর দেখতে ছিলো। বাসনগুলি সমস্তই হাতে গড়া, কারণ, কুমারের চাকে মাটি গড়িবার কায়দা সে সময়ে   জানা ছিল না। কিন্তু এ কাজে তাহাদের হাত এমন সাফাই ছিল যে, বড় বড় জালার মতো পাত্রগুলির গড়নেও কোথাও খুঁত ধরিবার যো ছিলো। বড় বড় জাহাজী নৌকা করিয়া এক সকল বাসন দেশ-বিদেশে রপ্তানি ও হতো । বাসনগুলির উপর চকচকে কালো পালিশ থাকিত, তার গায়ে সাদা রঙের কারুকার্য করা থাকতো।

মাটির বাসন নানারকমের। আমাদের দেশে সাধারণ 'মেটে বাসন' যা অল্প আঁচে পুড়িয়ে তৈরি হতো। গেলাস, ভাঁড়, সরা, মালসা  আরম্ভ করে কুঁজা, জালা পর্যন্ত ভারতবর্ষের প্রায় সর্বত্রই পাওয়া যায় এখনো। কিন্তু 'সাধারণ মাটির' জিনিসও যে কত সুন্দর হইতে পারে, তাই নিয়ে ই আমাদের চর্চা।

আর একরকম মাটির জিনিস হয় ভারতে, তাহাকে পাথুরে মাটি বলা যায়। এগুলোকে কড়া আগুনে পোড়ালে পাথরের মতো মজবুত হয় এবং তাহাকে অসংখ্য প্রকার দরকারী কাজে লাগান যায়। বাড়ি বানাইবার টালি, ড্রেনের পাইপ, নানারূপ খেলনা প্রভৃতি কত জিনিস তৈয়ারি হয়। তাহাতে আবার নানারকম রং দেওয়া ও ইচ্ছামত পালিশ ধরান চলে।

সাদা মাটির বাসন কথায় আসি এবার চীনে মাটির বাসন এক সময়ে কেবল চীন দেশেই ত পাওয়া যেতো। প্রায় সাত শত বৎসর আগে মুসলমান সম্রাট সালাদিনের কাছে চীন সম্রাট কতগুলো উপহার পাঠিয়েছিলেন, তাহার মধ্যে কতগুলা চীনা মাটির বাসন ছিল। তেমন বাসন কেউ চোখে দেখেননি। পাতলা ঝিনুকের মতো স্বচ্ছ, ডিমের খোলার মতো হালকা, সে আশ্চর্য বাসনের কথা চারিদিকে রটে গেল।

গ্রীস প্রভৃতি দেশে এক সময়ে অতি সুন্দর মাটির ঘড়া ও ফুলদানি তৈয়ারি হইত কিন্তু গ্রীক ও রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংস হইবার পর এই শিল্প নষ্ট হইয়া যায়। এই সময় আবার দক্ষিণ ইউরোপে, বিশেষত ইটালিতে নানারূপ শিল্পের বাসন তৈরি আগ্রহ দেখা দিতে থাকলো। তখনও তাহারা চীনা মাটি গড়িতে পারে নি কিন্তু মাটির উপর সাদা পালিশ চড়াইয়া তাহার চমৎকার নকল করেছিলেন। বহুদিন পর্যন্ত এই ব্যবসায় ইটালির একচেটিয়া ছিল। যাহাদের চেষ্টায় ও যত্নে এই শিল্পের ব্যবসা ইউরোপের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তাদের মধ্যে প্যালিসির নাম বিশেষভাবে করা যায়। 
তাই সাত কান্ড রামায়ণ বলে যেটা প্রমান করতে চাইছিলাম, বাংলার হস্তশিল্প ও সংস্কৃতি  কৃতিত্ব এটাই যে এই চীনা মাটি দিয়ে বাংলার শিল্পী রাত কিন্তু গেয়ে তুললো নানা ধরনের পুতুল। যা একটি শৈল্পিক নিদর্শন। সবচেয়ে বড় কথা যা আবার বাংলার সংস্কৃতি প্রতীক, যেমন বাঙালি র প্রিয় মাছ রুই, ভুড়িওয়ালা বৈষ্ণব, না খেতে পাওয়া রাগা শিব ঠাকুর।
চীনামাটির পাত্র বা পতুল তৈরি সহ কাজ নয়। চীনামাটির পুতুল তৈরির জন্য প্রথমে কোয়ার্টজ ও ফেলসপার চূর্ণ চীনামাটির সাথে মেশাতে হয়। পরে জল দিয়ে মণ্ড তৈরি করা হয়। সে মণ্ড থেকে তৈরি হয় নানা ধরনের মৃৎপাত্র বা পুতুল এর আকার দিতে হয়। এরপর পাত্রগুলো শুকানোর পর ১৩০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায়  পোড়ানো হয়। এরপর সেগুলোতে দেয়া হয় কাচের প্রলেপ; সেই সাথে বিভিন্ন ধরনের রঙ ব্যবহার করে নকশাও করা হয়। এভাবেই চীনামাটি থেকে পাওয়া যায় বিভিন্ন দ্রব্য মানে পুতুল বাসন পত্র। এগুলো বেশ জনপ্রিয় এখনো।
Manab Mondal

মাটির বাঁশি পুতুল


বিতর্ক উঠবে বলে পিছনে হটে যাবো এমনটি নয়। আমি বলবো, শ্রীকৃষ্ণ এর  যে মূর্তি আপনারা দেখতে পান, তা আসলে বাঙালীদের সৃষ্টি। কারণ যে ব্রজভুমিতে শ্রীকৃষ্ণ এর জন্ম সেখানকার ব্রজবাসীরা, শ্রীনাথ জি, দাউজি, গোবর্ধন পূজা করতে বেশি পছন্দ করেন এখনো। সে হিসেবে বাঁশি বাজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রাধাকৃষ্ণ এর মূর্তি বাঙালি দের রোমান্টিক মন, এবং যন্ত্রসঙ্গীত প্রেমের প্রমান। তাছাড়া একটু চিন্তা করে দেখুন । রাধা মাখন বেচতে মথুরা যেতেন। অর্থাৎ অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন ছিলেন। আজো গো বলয়ের মেয়েরা অতোটা স্বাধীনতা পায় না।

এবার আসি আসল কথায়। কৃষ্ণ হাতে র বাঁশি আজকের আলোচনা বিষয়। যদিও আমার মূল বিষয় হলো  মাটির বাঁশি পুতুল । শিল্প ও সংগীত বিষয়ক সংস্কৃত গ্রন্থ নাট্যশাস্ত্রে (~২০০ খ্রিঃপূঃ থেকে ২০০ খ্রিস্টাব্দ) উল্লিখিত হয়েছে, বাঁশি সে সময়ের এক গুরুত্বপূর্ণ বাদ্যযন্ত্র ছিল। অনেক হিন্দু গ্রন্থে বাঁশি বা বেণুকে সংগীতকলায় ব্যবহার করার জন্য মানুষের গলার স্বর ও বীণার পরিপূরক হিসেবে দেখানো হয়েছে (বাণী-বীণা-বেণু)। ঋগ্বেদের (১৫০০-১২০০ খ্রিঃপূঃ) মতো প্রাক্‌বৈদিক ও বৈদিক গ্রন্থে একে নাদী আর তূণর এবং পরবর্তী বৈদিক যুগের হিন্দু গ্রন্থে বাঁশিকে বেণু হিসেবে, উপনিষদ ও যোগেও বাঁশি  উল্লেখ আছে।
ভারতের সমস্ত প্রাচীন পুরাতাত্ত্বিক ভাস্কর্য ও চিত্রকলায় বাঁশিকে অনুভূমিকভাবে (একটু নিচু করে) বাজানোর রীতি পাওয়া যায়।  একটাও লক্ষণীয় বিষয় সেকালে বাদ্যযন্ত্র বাজানোতে কোনো লিঙ্গভেদ ছিল না― নিদর্শনগুলোতে প্রচুর নারীশিল্পীর ছবিও পাওয়া যায়। কিন্তু পঞ্চদশ শতাব্দী শুরু হতেই বাঁশি বাজানোর অধিকার ক্রমে ক্রমে পুরুষদের দখলে চলে যায় আর বাজানোতে আড়াআড়ি পদ্ধতির শুরু হয়। সম্ভবত ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের আগমন ও হিন্দুস্তানি সংগীতের উপর পশ্চিম এশীয় প্রভাব এই পরিবর্তনের জন্য দায়ী।
বাঁশিকে ভারতীয় সঙ্গীত জগত ভুলে গেছেন কিছুটা হলেও। বাংলার সংস্কৃতি  জগত একে ভোলে নি।বাংলায় বাঁশিকে মুরালি, মোহন বাঁশি, বংশী অথবা বাঁশরিও বলা হয় ।  ভারতীয় বাঁশি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাঁশি তৈরিতে তরলা বাঁশ ব্যবহার করা হয়। কেউ কেউ শখের বশে ষ্টিলের, তামার, পিতলের, রূপার এমনকি সোনার পাইপ দিয়েও বাঁশি তৈরী করিয়ে থাকেন। বাংলার মৃৎ শিল্পীরা নতুন করে যোগ করেছে মাটির বাঁশি। তাও আবার পুতুল এর আকারে।
 এই প্রাচীন এবং মনহরানো বাদ্যযন্ত্রের গায়ে সাতটি ছিদ্র (মাঝে মাঝে আটটিও করতে দেখা যায়) থাকে । যে নল বা পাইপটি দিয়ে বাঁশি তৈরী করা হয় তার একপাশ সম্পূর্ণ আটকে বায়ুরোধী করে দেওয়া হয়। বাঁশের তৈরী বাঁশিতে গিট বা গিরা একপাশকে বায়ুরোধী করার কাজে ব্যবহার করা হয়। বন্ধ এবং খোলা প্রান্তের মাঝামাঝিতে ছিদ্রগুলো করা হয়। যে ছিদ্রটি বন্ধ প্রান্তের ঠিক কাছাকাছি থাকে সেটা দিয়ে কৌশলে ফু দিতে হয় এবং বাকি ছ'টি ছিদ্র ডান হাতের মধ্যবর্তী তিনটি এবং বাম হাতের মধ্যবর্তী তিনটি আঙ্গুল দিয়ে কখনো আটকে কখনো ছেড়ে দিয়ে সুর তুলতে হয়। অতো জটিল গঠনতন্ত্র নেই এই মাটির বাঁশি তে। তবে নান্দনিক সৌন্দর্য এর আকর্ষণীয়।
 কোনটি কাঠালিয়া পুতুল, কোনটি ছলনের পুতুল, কোনো টি জো পুতুল মতো দেখতে।  বাংলাদেশ এক শতাব্দী পূর্বে এই বাঁশি  তৈরি করা শুরু হয়েছিল। তবে অনেক সৃজনশীল পশ্চিমবঙ্গের মাটির গহনা শিল্পী  হাওড়া বাসী রাজকুমার দেবনাথ।তার কাছে পেয়ে যাবেন ঘোড়া,হাঁস, বিড়াল হাতি আরো অনেক কিছু, তবে মাটির গহনা শিল্পী হিসেবে উনার সুনাম অনেক বেশি, সে নিয়ে পরর্বতী পর্বে আলোচনা করবো। শিল্পী হিসেবে উনি সরকারী বেসরকারী উদ্যোগে একটি পূরস্কারের তো দাবি রাখেন ই।
Manab Mondal

Sunday, 28 November 2021

ফেনি

গোয়া নামটি অস্তিত্বের মধ্যে এসেছিল তা স্পষ্ট নয়। এটি ইউরোপীয় বা পর্তুগিজ ভাষা থেকে উৎপন্ন হতে পারে। এটিও বিশ্বাস করা হয় যে, গোয়ার নামটি বৈদিক সংস্কৃত শব্দ 'go' থেকে উদ্ভূত হতে পারে যার অর্থ 'গরু'। এখানে প্রচুর পরিমাণে কাজুবাদাম পাওয়া যায়।১৭০০ সালে ভারতে প্রথম ভারতে কাজু বাদাম গাছ নিয়ে এসেছিলেন পর্তুগিজরা। ব্রাজিল থেকে তাঁরা কাজুবাদামের গাছ নিয় এসে গোয়ায় লাগিয়েছিলেন। গোয়ার পরিবেশের সঙ্গে খাপ খেয়ে গিয়েছিল কাজুবাদামের গাছ। এই কাজু বাদামের গাছ থেকেই ফেনির উৎপত্তি। কাঁচা কাজু পচিয়ে সেখান থেকে ফেনি তৈরি করা হয়। ফেনি তৈরির জন্য কাজু গাছ রীতিমত চাষ করে থাকে গোয়ার চাষীরা। গোয়ার অর্থকরী ফসল এই কাজু। পর্যটকদের কাছে আকর্ষনীয় করে তুলতে মশালা ফেনিও তৈরি করা হয়। তাতে মেশান হয় এলাচ, গোলমরিচল, লবঙ্গ, দারচিনি। তারপরে সেটিকে পর্যটকদের দেওয়া হয়। গোয়ায় এই মশালা ফেনি বেশ জনপ্রিয় পর্যটকদের কাছে।

Tuesday, 23 November 2021

হিঙ্গুল পুতুল

ছোট্ট আও আও নালিশের সুরে বলল" আমাকে একটা বার্বি ডল কিনে দিলে না তুমি।"মা জিজ্ঞেস করলো "সেটা আবার কি? "আমি বললাম "পুতুল। "মা ছোট বেলায় উনুনে পুড়িয়ে মাটির পুতুল বানিয়ে দিতো । সেই স্মৃতি টা উস্কে দিলো। আমি আমার অনেক কটি পোস্ট বলার চেষ্টা করছি বাংলার বিভিন্ন স্থানে যে পুতুল পাওয়া যায় , তা তৈরিতে আমাদের ধর্মীয় সংস্কৃতি অনেক অবদান আছে। অথচো আধুনিকতার  চাপে বাংলার ঘরে থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার পুতুল। অথচো পুতুল কেনা বন্ধ করে নি কিন্তু বাঙালী। বাঙালি র ঘরে আসছে,জাপানের তথা বৌদ্ধ ধর্মে দারুমা।দারুমা পুতুল ঐতিহ্যবাহী জাপানি খেলনা পুতুল। এটি ছোট, বৃত্তাকার/গোলাকার, দাড়িওয়ালা মানুষ চিত্রিত, ফাঁপা ও লাল রঙের হয়। তবে অঞ্চল ভেদে দারুমা পুতুলের নকশা, ডিজাইন ভিন্ন হয়।  এই পুতুল নাকি সৌভাগ্যে ফেরাবে বাঙালি র।
যাইহোক সোস্যাল মিডিয়ায় বিশিষ্ট পরিচিত নাম সায়ন রায় । সৌভাগ্য ক্রমে আমার ফোন বুকে তাঁর নাম্বার টি সেভ করা। তাঁর status দেখতে পেলাম একটা হারিয়ে যাওয়া পুতুল এর ছবি। এটা বীরভূমের পুতুল, মনে পরে গেলো,সাঁওতালি ঘরনা চাদর বাঁধনী পুতুল,বাঘরাইপুতুল , কিংবা হিঙ্গুলা পুতুল , আজ হারিয়ে যাওয়া র পথে। হিঙ্গুলা পুতুল এর কথা তাই বলতে ইচ্ছে করলো আপনাদের কাছে।পুতুলের নানা ভাগ,  কি দিয়ে তৈরি হচ্ছে সেটা দিয়ে বলি সাধারণত আমরা মাটির পুতুল, কাপড়ের পুতুল,কাঠের পুতুল,পাটের পুতুল,তালপাতার পুতুল,গালার পুতুল,ধাতুর পুতুল,কাগজের পুতুল,শোলার পুতুল। এদের মধ্যে একটি বাংলার প্রবাদ প্রবচনে থাকে গেলেও হারিয়ে গেছে বোধহয় আমাদের জীবন থেকে। তালপাতার সিপাই, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায়এই খেলনা উদ্ভাব। আজও আর দেখা যায় না। তবে আদিবাসী সাঁওতাল দেবতা সিং বোঙ্গার উদ্দেশ্যে তৈরি এই পুতুলের মুখ হয় হাতির মতো।এছাড়াও তালপাতার সেপাই তৈরি হতো তালপাতা দিয়ে। এতে থাকে যোদ্ধার অবয়ব। সেখান থেকে আসতে পারে তাল পাতার সেপাই বানানোর রীতি।
এছাড়া আগেই বলেছি বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে তৈরি শুরু হয় পুতুল বানানোর রীতি।

সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে পুতুলের নানা ভাগ আছে যেমন,:টুসু পুতুল,ভাদু পুতুল,রাণী পুতুল,আহ্লাদী পুতুল,বৌ পুতুল,ষষ্ঠী পুতুল,লক্ষ্মী পুতুল,হিঙ্গুল পুতুল,ঘাড় নাড়া পুতুল,জৌ পুতুল,যাদু পুতুল বা কালো পুতুল,পুতুল,আশ্চর্য প্রদীপ,বোঙ্গা হাতি পুতুল। আধুনিক বাংলা তৈরি হচ্ছে দেওয়ালী পুতুল।


হিঙ্গুলা পুতুলের কথায় আসি এবার । কারণ সায়ণ রায়ের  স্ট্যাটাসে হিঙ্গুলা পুতুল ছবিই আমি দেখেছি।বাঁকুড়ায় তৈরি হয় হিঙ্গুল রঙের হিঙ্গুলা পুতুল। কাঁচা মাটি দিয়ে তৈরি এইসব পুতুল দুর্গাপুজো, জন্মাষ্টমী ও টুসু পুজোর সময় বিক্রি হয়।ষষ্ঠীপুজো ও জিতাষ্ঠমীর ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে হিঙ্গুল পুতুল কাজে লাগে। কেউ কেউ মানত করার জন্য হিঙ্গুল পুতুল ব্যবহার করে থাকেন। ঘর সাজানোর জন্য অনেকেই কেনেন। হলুদ (হরিতালি), লাল ( হিঙ্গুলা), নীল .ওপর সূক্ষ্ম কাজ, রংবেরঙের কাঠের পুতুল, চমক এর আসল আকর্ষণ। হিঙ্গুল বা হিম এক ধরনের খনিজ পদার্থ। এক সময়ে বিখ্যাত হয় বিষ্ণুপুরের হিঙ্গুল পুতুলগুলো । পুতুল গুলো  রাঙিয়ে তুলতে লালচে রঙে এই হিঙ্গুল ।এই রং দিলে বেশ চকচকে হত পুতুলগুলো। এই কারণেই পুতুলগুলোর এমন নাম। কাঁচা মাটিকে হাতে টিপে পুতুলের রূপ দিয়ে রোদে শুকোনো হয়। তাতে পরে ভেষজ রঙের প্রলেপ। পুতুলের উচ্চতা হয় মোটামুটি এক আঙুলের মতো। বাচ্চাদের খেলনা হিসেবেই এই পুতুল জনপ্রিয়। পাশাপাশি,  তবে এখন খানিকটা ইউরোপীয় প্রভাব এসে মিশেছে এই পুতুলের সাজসজ্জায়। হিঙ্গুল পুতুলের পরনে থাকে ফ্রক, মাথায় পাশ্চাত্য রীতির টুপিও দেখা যায়।

.এই পুতুল তৈরি শুরু হ‍ওয়ার একটি গল্প শোনা যায় যে- যখন রাজবাড়িতে শিল্পী রা রাজাদের জন্য হাতে বানানো তাস নিয়ে যেতেন, তখন রাজবাড়ির শিশু রা তাঁদের কাছে বায়না করে বলতো ‛ আমাদের জন্য কি এনেছো? আমাদের-ও পুতুল দিতে হবে।’... তখন শিল্পীদের স্ত্রী রা মাটির ছোটো ছোটো পুতুল বানিয়ে রাজবাড়ির শিশুদের জন্য নিয়েযেতো।.... 

যাইহোক এর পরে  চাদর বাঁধনী পুতুলের কথা বলবো কারণ এর সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস ‌।
🙏🙏🙏🙏🙏🙏🙏🙏🙏🙏
কৃতজ্ঞতা জানাই - সায়ন রায় কে , ছোট্ট বয়সে  ও  অনেক কাজ করেছেন , ওর উৎসাহে পুতুল নিয়ে এই লেখা শুরু করলাম। 

হরিনাভি

আদি গঙ্গা নিয়ে কথা বলতে গেলে  দেখবেন  ষোলো শতাব্দী পর্যন্ত এর গর্ব বজায় ছিলো ধরে নেওয়া যেতে পারে। কালিঘাট বোড়াল, রাজপুর, হরিণাভি, মাহীনগর, বারুইপুর, বাহারু, জয়নগর, মজিলপুর, ছত্রভোগ ইত্যাদি পাঁচ শত বছরের পুরনো জনপদ এদাবিও করতে পারি। বিপ্রদাস পিপিলাইএর মনসবিজয়, 1495 সালে রচিত, এই অঞ্চলে অনেক জায়গার উল্লেখ করেছে। “চাঁদ সদাগর, এর বণিক চরিত্র মনসবিজয়পুরাতন ভাগীরথী এই শাখা  হয়ে কালীঘাট থেকে বারুইপুর পৌঁছেছিল। সেখান থেকে তিনি ছত্রভোগের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং তারপরে হাতিগড় পরগনা হয়ে খোলা সমুদ্রে পৌঁছে গেলেন। ” চৈতন্যদেব (1486-1534) এই পথ দিয়ে গেছে। নৌকায় ভ্রমণ পুরী তিনি বারুইপুরের নিকটবর্তী আতিসারা গ্রামে থামেন। "তার শেষ স্টপেজ 24 পরগনা ছত্রভোগে ছিল, এখন এই শহরটির অধীনে একটি গ্রাম মথুরাপুর থানা পুরানো ভাগীরথী নদীর তীরে ছত্রভোগ একটি গুরুত্বপূর্ণ নদ-বন্দর ছিল বলে মনে হয়। "রমা চন্দ্র খান, দ্য জমিদার ছত্রভোগের চৈতন্যদেবকে তাঁর যাত্রা চালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন।

কলকাতার দক্ষিণে ২৪ পরগণার অন্তর্গত হরিনাভী গ্রামে অবস্থিত ঘোষেদের জমিদার বাড়ী। ষ
হরিনাভী অঞ্চলটি সেইসময়ের "মদন মল্ল" পরগণার অন্তর্গত ছিল। মদন রায় ছিলেন মহারাজ প্রতাপাদিত্যর ঢালি ও সেনানায়ক।  মহারাজ প্রতাপাদিত্যর মোঘলদের কাছে পরাজয়ের পরে মদন রায় এই গ্রাম গড়ে তোলেন। নাভি পর্যন্ত প্রোথিত কষ্টি পাথরের বিষ্ণু মূর্তি পাওয়া যায় এই গ্রাম থেকে তাই এই গ্রামের নাম হয় হরিনাভী।    

১৭৫২ সালে শ্রী রামচন্দ্র ঘোষ হরিনাভী গ্রামের কিছু জায়গা কিনে নেন কলকাতার সিংহ পরিবারের কাছ থেকে। তাঁর পুত্র হরমোহন ঘোষ বর্তমান দূর্গামন্ডপ সহ বসতবাড়ি তৈরি করেন এবং পৌত্র নবীনচন্দ্র ঘোষ ১৬টি স্তম্ভ সহ নাটমন্দির তৈরি করেন। এরপরেই শুরু হয় রাসের মেলা, তাই লোকমুখে এটি রাসবাড়ি নামে পরিচিতি পায়। এই রাসবাড়ির নিকটেই অবস্থিত দূর্গাদালান। তবে আজ তার শোচনীয় অবস্থা দেখে সত্যিই কষ্ট হয়। নবীন ঘোষের আমলে গৃহদেবতা গোপীনাথ জিউ ও রাধাকে বসিয়ে রথ যাত্রার সূচনা হয়। পরবর্তীকালে ১৯৩৭ সালে একটি লোহার রথ তৈরি করেন হীরালাল ঘোষ ও সেই রথ টানার জন্য ৩০ জন লোকের প্রয়োজন হত। তবে বর্তমানে সেই রথ রাসবাড়ির সামনেই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।         
      
 বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের হরিনাভীর সাথে বেশ স্মৃতি জড়িয়ে আছে। হরিনাভী স্কুলে তিনি ১৯২০ সালে মাত্র ২৬ বছর বয়সে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। এখানে তিনি মাত্র ২ বছর শিক্ষকতা করেন। এখানে থাকাকালীন তাঁর সাহিত্যিক প্রতিভার বিকাশ ঘটে। প্রথমদিকে তিনি হরিনাভীর কাছেই রাজপুরে থাকতেন। তাঁর বাড়ির কাছেই ছিল একটি বকুল গাছ। মাঝে মাঝেই এই গাছের তলায় তাঁর সময় কেটেছে। "পথের পাঁচালি" থেকে "চাঁদের পাহাড়" অনেক গল্পের পটভূমিই  এই হরিনাভী গ্রাম। 

Monday, 22 November 2021

বাবু পুতুল

রানি পুতুল থেকে সাহেব মেম পুতুল  এর কথা যখন বলেছি  তখন বাবু পুতুল এর কথা বাদ যায় কেন? তবে তার আগে বলে নিতে হবে একটি অন্য গল্প। 
কলকাতা গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্য কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।  এদেশে তখন ইউরোপীয় ধারার চিত্রকলার সূচনা হয়েছে। দেখা গেল  যে কালীঘাট পটচিত্রের ধারা আদরনীয় হয়ে উঠেছে তখন। বাংলা শিল্পকলা ধারায় কালীঘাট পট চিত্ররীতি শুধু জনপ্রিয়ই নয়, তার রয়েছে এমন এক নিজস্ব শৈলীকলা।
তীর্থযাত্রীরা কালীঘাটে এলে তীর্থের স্মারক হিসেবে এই পট কিনে নিয়ে যেতেন সে সব দিনে। সেই চাহিদা অনুসারে আঁকা হত  শিব, কালী, রাম-সীতা, ইত্যাদিই ছবি । বালির মিলে তৈরি চৌকো আকৃতির কাগজে  আঁকা হত এই পট। তাই এই পটকে বলা হত ‘চৌকশ’।  বাংলার জড়ানো পটের থেকে আলাদা হয়ে যায় এই পট।
তীর্থযাত্রীদের জন্য তৈরি বলে গোড়ায় ছবির বিষয় দেবদেবী হলেও পরবর্তীকালে সমাজ সমালোচনায় মনোনিবেশ করেন শিল্পীরা। তাই  শিব, দুর্গা, কালী-র বিষয় থেকে বেড়িয়ে গিয়ে শিল্পীরা আঁকলেন ‘আলালের ঘরের দুলাল’, ‘বাবু ও বেশ্যা’, ‘ঘরে ছুঁচোর কেত্তন আর বছরে কেঁচোর পত্তন’ জাতীয় ছবিগুলি। পাশাপাশি দেখা গেল শুধু মাত্র আঙ্গিকে নয়, রূপের আদর্শেও  কালীঘাট বিশিষ্টতা অর্জন করল।পুরুষের  পটলচেরা চোখ, ধনুকাকৃতি ভ্রু, বাবরি করা চুল, নধর বাবু । নারীরা হল সুপুষ্ট দেহ আর লীলায়িত ভঙ্গিমা। চব্বিশ পরগনার মাটির পুতুল হয়ে উঠল কালীঘাট পটচিত্র শৈলীর অনুপ্রেরণা।
এবার আসি দঃ ২৪ পরগনার কথায়। এখনকার মজিলপুর শহরের পশ্চিমাংশের বিস্তৃত ধানক্ষেত 'গঙ্গার বাদা'র উপর দিয়েই আদিগঙ্গার প্রবাহ বইত। আদিগঙ্গার মজাগর্ভে নতুন বসতির উৎপত্তি হয়েছিল বলেই এই শহরের নাম 'মজিলপুর' হয়েছে। সপ্তদশ শতকের গোড়ার দিকে ভাগ্যবিপর্যয়ের ফলে যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের আমলা-অমাত্য, ব্রাহ্মণ-কায়স্থ, পণ্ডিত-পুরোহিতরা সুন্দরবনের এই জঙ্গলাকীর্ণ জনবিরল স্থানে বসবাস শুরু করেন।
প্রায় ২৫০ বছর আগে দত্ত-জমিদাররা কালীচরণ পেয়াদাকে যশোহর থেকে জয়নগরে এনেছিলেন। শোনা যায় কালীচরণ নাকি মাটি দিয়ে ‘টেপা পুতুল’ তৈরি করতেন। তাঁর ছেলে জানকীনাথ দাস জয়নগরে পুতুল তৈরি শুরু করেন। তাঁরই উত্তর পুরুষ শম্ভুবাবুর ঠাকুরদা মন্মথনাথ  জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। মন্মথের কাজ আজও দেখা যায় দেশ বিদেশের বিভিন্ন সংগ্রহালয়ে। এ ছাড়াও শম্ভুবাবুর বাবা পাঁচুগোপাল দাসও ছিলেন নাম করা শিল্পী। আজ নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও শম্ভু আঁকড়ে ধরে রেখেছেন এই শিল্পকে।
জয়নগর মজিলপুরের পুতুল দু’প্রকার। হাতে তৈরি এবং ছাঁচের। প্রচলিত দেবদেবীর পাশাপাশি তৈরি হয় নানা লৌকিক দেবদেবীর মূর্তি। হাতে তৈরি পুতুলের মধ্যে নারায়ণী, শীতলা, বনবিবি, দক্ষিণরায়, পঞ্চানন, মানিকপীর, আটেশ্বর, দক্ষিণেশ্বর উল্লেখযোগ্য। আর ছাঁচের পুতুলের মধ্যে রয়েছে গণেশজননী, জগদ্ধাত্রী, রাধাকৃষ্ণ, কালিয়দমন, ষড়ভূজচৈতন্য, কলকাতার বাবু, গয়লা-বৌ, কৃষক ইত্যাদি। এ ছাড়াও রথের সময় জগন্নাথ, ঝুলন-জন্মাষ্টমীর সময় রাধা-কৃষ্ণ, গোপাল, নববর্ষে লক্ষ্মী-গণেশের মূর্তির তৈরি করা হয়।আট পুরুষ ধরে, তৈরি করছে এরা পুতুল। বাংলার বাবুদের কৃত্রিমতা, ঔদ্ধত্যকে কটাক্ষ করে মজিলপুরে বাবু পুতুল বানানো শুরু হয়েছিল, সেগুলো এখনও জনপ্রিয়। তবে এই পুতুল গুলো তে কালিঘাট এর পটের  প্রভাব রয়েছে।
Manab Mondal

ছলনের পুতুল

ছলনের পুতুল এর শৈল্পিক মূল্য নেই তেমন, দৃষ্টি নন্দন এর গুন নেই এর মধ্যে। আমার লেখা ছোট গল্প " ছলনের পুতুল" যাঁরা পড়েছেন। তার বোধহয় সেটা আগে ভাগেই বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু গল্পে মধ্যে সেই ভাবে এর গুরুত্ব এর পরিচয় ঘটানোর সুযোগ ছিলোনা, লেখক হিসেবে সে হিসেবে আমি ব্যার্থ। 
যাইহোক দক্ষিণ ২৪ পরগনার নূরপুর ঘুরতে গিয়ে, দেওয়ানা তলার  এক মেলায় প্রথম ছলনের গুরুত্ব সম্পর্কে আমি পরিচিত হই। অথচ আমার বসত বাড়ি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্ব টালিগঞ্জ অঞ্চল তথা দক্ষিণ কলিকাতার এক মাত্র বনবিবির মন্দির, সেখানে এই ছলনের পুতুল বা ঘোড়া গুলো বিক্রি হলেও এ প্রতি আমি কখনো আগ্রহ দেখায় নি। কিন্তু এর গুরুত্ব আছে আমাদের কাছে অনেক খানি। কারণ ধর্ম ঠাকুর এর কাছে মানত করা ঘোড়া গুলো ই আজ বিশ্ব দরবারে তাদের শৈল্পিক সুন্দর জন্য, একটা জায়গা করে নিয়েছে। তেমনি এই পুতুল গুলো একটু শৈল্পিক ভাবনা রাঙিয়ে উঠলে, এগুলো ও সংগ্রহ যোগ্য হতে পারে।


তবে এর ধর্মী গুরুত্ব কথাই আসি। ভারত উপমহাদেশে মিশ্র ধর্মীয় সংস্কৃতিতে, কখনো কখনো , মানুষ জন  হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের পুতুল এর পূজারী বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। তাদের বলি,পাঁচ ভুত কথা জানেন আপনি। শাস্ত্র মতের পঞ্চভুত হল ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। বিজ্ঞান মানলে, এ বিশ্ব ব্রম্ভান্ডের বাস্তুতন্ত্র এদের ওপর নির্ভর করছে।
এবার একটু খুলে বলি। ক্ষিতি মানে হল- পৃথিবী, অপ কথার মানে হল- জল। তেজ কথার অর্থ হল- আগুন, আর মরুৎ মানে হল বাতাস। এবং ব্যোম বলতে বোঝায় শূন্যতা অর্থাৎ আকাশকে।  পুতুল কারিগর ক্ষিতি মানে পৃথিবী থেকেই মাটি নিয়ে আসে। তার পর অপ অর্থাৎ জল দিয়ে শিল্পী সেই মাটিকেই মাখে। সেই নরম মাটিকে সে পরিণত করে মনের মতন আঁকারে। এর পর শিল্পী ভাবেন কাঁচা মাটিকে পুড়িয়ে শক্ত করার কথা। আর তখনই তাঁর দরকার হয় আগুনের, অর্থাৎ তাঁর লাগে তেজ। এবার তো পুতুলকে ঠাণ্ডা করতে হবে। তাই সেই পোড়া উত্তপ্ত পুতুল সে দেয় বাতাসের কাছে। সুতরাং তাঁর লাগলো মরুৎ কে। এবার ব্যোম কে কাজে লাগাতে হবে শিল্পীর। কিন্তু শূন্যতাকে কি ভাবে পুতুলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে? এর উত্তর লোকো শিল্পী বের করে নেয় অবলীলায়। সে সমস্ত পুতুলগুলি বানাতে থাকে ফাঁপা করে। আর ফাঁপা মানেই হল শূন্যতা অথবা অসংখ্য ছিদ্র করা হয় পুতুলের গায়ে। 


পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমের জেলা গুলিতে মনসকামনা পুর্ন করতে ছলনের হাতি  পুতুল দেওয়া হয়। পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রাম থানা, জঙ্গলমহলের পবিত্র গড়াম স্থান, আদিবাসীদের জাগ্রত দেবতা কালুয়া  কাছে উৎসর্গের জন্য মাটির হাতি।কিন্তু মোটামুটি আমরা সবাই-ই 'ছলনের ঘোড়া'-র সাথে পরিচিত। পোড়ামাটির তৈরি চার পায়ের কৃত্রিম রং ছাড়া এক ধরণের পুতুল। তবে খেলনার জন্য কিন্তু এই ঘোড়ার কোনও ব্যবহার নেই। ধর্মরাজের পুজোয় বা ষষ্ঠীতলায়, বটতলায়, ওরা বিবির মন্দিরে এরকম বেশ কিছু ঘোড়া প'ড়ে থাকতে দেখেছেন আপনিও হয়তো।
কিন্তু লক্ষনীয় বিষয় হলো কৃষ্ণনগরের এই পীরতলায়  এক বিশেষ ধরণের একজোড়া ঘোড়া পীরকে উৎসর্গ ক'রে নানা প্রার্থনা করা হয় স্থানীয় হিন্দু ও মুসলিম বাসিন্দাদের মধ্যে। আপনি বলবেন  এই ঘোড়া 'ছলনের ঘোড়া'-র সাথে মেলেনা।  কারণ মুখ চৌকো আর চ্যাপ্টা এবং আর এতে দুটো রঙয়ের ব্যবহার থাকে। সাদা রং ভ'রে লাল দিয়ে দাগ কাটা বা ডোরাকাটা করা হয়। একেবারে চোখ, মুখ, কানকে যে লাল রং দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয় তা নয়; শুধু প্রতীকের ম'ত একটা ধারণা দেওয়া হয়। এই ঘোড়া দু রকমের আকারের পাওয়া যায়। যেটা একটু বড়, তার পিঠে বাঘের ম'ত ডোরাকাটা তিন-চারটে দাগ দেওয়া থাকে আর যেগুলো একটু ছোট আকারের, তাতে লম্বালম্বি, আড়াআড়ি কিছু দাগ দিয়ে দেওয়া থাকে।  সাধারণত যাদের সন্তানেরা বিকলাঙ্গ বা ঠিকম'ত কথা বলতে পারছে না ; সেইসব মায়েরা এই জোড়া ঘোড়া, ; মোমবাতি, ধূপ এসব দিয়ে আসে অশ্বত্থ গাছের তলায়।
আরো একটি ছলনের পুতুল  বাঘরাই এর বীরভূমের রাজনগরের পুতুল।এটি ছলনের পুতুল পোড়ামাটির লাল আর কালো রঙের হয়।শিল্পী  মনের মাধুরী মিশিয়ে  এই রঙ  করা ছবি দেখে আমার মনে হয় ছিলো প্রথম । নবগ্রামের প্যাঁচা যদি কিংবা ধর্ম রাজের ঘোড়া যদি শিল্প হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। একটু তত্ত্বাবধান করলে এটিও সংগ্রহ যোগ্য হতে পারে।

এ বিষয়ে দক্ষিণ পরগনার সঞ্জয় ঘোষ লিখেছিলেন"এর সাংস্কৃতিক নৃতাত্বিক মূল্য অসীম।আমার মনে হয় সেটা এই লেখায় এসেও আসেনি।কারন নৃতাত্বিক মূল্যায়ন না করা ।আদিবাসী অধ্যুষিত পুরুলিয়া,বাঁকুড়া,দুই মেদিনীপুর,বীরভুম ,হয়তো ঝাড়খনন্ড ও উড়িষ্যায় খোলা আকাশ্র নিচে বা গাছের নিচে লৌকিক দেব দেবীর থানে হাতি ও ঘোঁড়া অবশ্যই থাকবে ছলন হিসেবে।এবং এই আদিবাসীগন যেহেতু ক্রমান্বয়ে জৈন,বৌদ্ধ,হিন্দু ,মুসলিম ধর্ম গ্রহন করেছেন তাই সেই ধর্মেও এগুলি কোনো না কোনো ভাবে থেকেছে।বিশেষ করে সুফি ইস্লামের সমন্বয়ধর্মী ধর্মে পীর গাজী বিবি র ধারায়,ধর্মরাজ ,দক্ষিণ রায়ের পূজ়ায়।এমনকি সাগরে বিশালাক্ষী থানেও দু একটি ঘোড়া ছলন দেখেছি। "

🙏 Manab Mondal 🙏

Sunday, 21 November 2021

চদর বদর পুতুল

একসময় বাংলার বিনোদন জগতের গুরুত্বপূর্ণ জনপ্রিয় পুতুল নাচ ছিলো চদর বদর। পরাধীন ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের হাতিয়ার ছিলো এই নাচ।একসময় ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রচার করা হতো এই নাচ গুলো। অনেকের মতে চদরবদর হল পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন পুতুল নাচ৷ কিন্তু এর ইতিকথা খুব একটা জানা যায় না৷ কবে ঠিক কোন জায়গায় কোন ভূখণ্ড জনপদে এর জন্ম তার ঠিক নেই, নেই কোনও লিখিত ইতিহাস৷ কেউ কেউ বলেন ‘চদর’ কথাটা এসেছে চাদর থেকে৷ চাদরের তলায় এই নাচ দেখানো হয় বলে নাম হয়েছে চদরবদর৷ 
গ্রাম বাংলার এই পুতুলনাচ আজ লুপ্তপ্রায়। পুতুলনাচের তেমনই এক ধারা অন্তত ৩০ বছর আগেও বীরভূম, বর্ধমান, বাঁকুড়া-সহ কিছু জেলায় ভাল ভাবেই টিকে ছিল। 
 এই পুতুলনাচের পোশাকি নাম ‘চাদর বাঁধনি’। গ্রাম্য ভাষায় এরই নাম ‘চদর বদর’। এটি সাঁওতালি শব্দ। ‘চদর বদর’ নাচানো সাঁওতালি সংস্কৃতির অন্যতম নিদর্শন। ‘চদর বদর’ আদিবাসী নিজস্ব ঘরানার পুতুলনাচ, যা কোনও পশ্চিমী দেশ থেকে নকল করা নয়। নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ধরে রাখার প্রয়াস, আদিবাসীদের সারল্য, প্রযুক্তি এই পুতুলনাচের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। বাংলার মৃতপ্রায়, সুপ্রাচীন অথচ আলোচনা-গবেষণার আড়ালে থেকে গিয়েছে সাঁত্ততালি লোকাশিলোকাশিল্পটি।
চদর বদরের পুতুলগুলি সাধারণত ৭ থেকে ৯ ইঞ্চি লম্বা হয়। পুতুলগুলি গড়তে প্রয়োজন হয় কারিগরি দক্ষতা। শিরিষ, জাম, বট, ডুমুর ইত্যাদি হাল্কা কাঠ খোদাই করে পুতুল তৈরি করা হয়ে থাকে। কাঠের তৈরি পুতুলে তার পরে চলে রংয়ের কাজ। শেষে পুতুলকে কাপড় পরানো হয়। এই পুতুল নাচের কাঠি এবং সুতো দুটোরই ভূমিকা আছে৷ ছোটো ছোটো ধূসর বা কালো কাঠের টুকরো আর বাঁশ দিয়ে একদম নির্ভেজাল দেশি পদ্ধতিতে তৈরি এই পুতুল৷ এই কারিগরি অন্য কোনও পুতুল নাচে নেই৷ তা হল মূল একটা লাঠির সঙ্গে বিভিন্ন কাঠি এবং সুতোতে যুক্ত থাকে পুতুলগুলির বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, মূল লাঠিটি নাড়লেই সেগুলি একসঙ্গে নানা ভঙ্গিতে নড়তে থাকে৷ যে কোনও পুতুল নাচই হয় পথে অথবা খোলা জায়গায়৷ চদরবদর-এ পুতুল নাচে স্ট্যান্ডের ওপরে বসানো গোল অথবা চৌকো বাক্সের মতো চারদিক খোলা মঞ্চে৷ কোথাও বা স্ট্যান্ডের বদলে থাকে একটা গোল লাঠি৷ একপায়া কাঠের স্ট্যান্ডের ওপর ভর করে থাকে একটি বাক্স। সেটারই তিন দিক ঘিরে থাকে চাদরে। শাড়ি দিয়ে মোড়া থাকে বাক্সের নিচের অংশ। আর সেই বাক্সেই ধামসা মাদল সহযোগে নাচতে থাকে সাঁওতালি নারী-পুরুষের প্রতিরূপ সরূপ সারিবদ্ধ পুতুলগুলি।এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় চদরবদরের পুতুল নাচের মঞ্চটির একটু আধটু তফাত্‍ হয়৷ যেমন, বীরভূমের চদরবদরে মঞ্চটি গোল আবার উত্তর দিনাজপুরে চৌকো৷ কোথাও বা ছাদটা কাপড় দিয়ে ঢাকা৷ কোথাও বা ছাদটা হয় কাঠের৷ সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত চদরবদর পুতুলগুলিতে দেখেছি মঞ্চটি উন্মুক্ত৷ শুধু এ দিক থেকে ও দিক কয়েকটি লাঠি চলে গেছে৷ নাচের সব চরিত্রই আদিবাসী নারী-পুরুষ-শিশু৷ পুতুল থেকে নাচ দেখানোর স্ট্যান্ড লাগানো বাক্স তৈরি করেন শিল্পী নিজেই৷ গানও বাঁধেন নিজেরাই৷


ডাং পুতুলনাচের মতো ‘চদর বদর’ও দেখানো হয়ে থাকে ডাং বা লাঠির সাহয্যে। কিন্তু ডাং পুতুলনাচের শিল্পীরা নিজের কোমরে একটি ছোট চোঙ বেঁধে খাপে ডাংটিকে পুরে হাত দিয়ে সেই ডাংটিকে উপর নীচে তুলে ও ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুতুলনাচ দেখান। চদর বদরের ক্ষেত্রে ডাংটিকে দুইয়ের মধ্যবর্তী স্থানে ভারসাম্য এনে পুতুলনাচ দেখানো হয়। বেণী পুতুলের মতো চদর বদরের পুতুলগুলি ছোট হয়ে থাকে।

মঞ্চ সাজানো হলে। শিল্পীরা প্রত্যেকে বাজান। লাগড়া, মাদল, বাঁশি। আর পুতুলেরা বাজনার তালে তাল মিলিয়ে নাচছে। মজার বিষয় এদের পুতুল দের নাম থাকে।

চাদর বদর প্রদর্শনের সময় শিল্পীদের পোশাকেও থাকে বৈচিত্র। শিল্পীরা পাঞ্চি পরেন নিম্নাংশে। মাথায় গামছা ও হাঁসের পালক। চিরাচরিত উপজাতি বাদ্যযন্ত্রে অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখা যায় পুতুল নাচের সময়। বাজে বানাম, তুংদা (মাদল), লাগড়া, তিরেঞয়া( বাঁশি)। পুতুলনাচের সময় মোটমুটি নির্ভর করে দর্শকের উপরে। দর্শক চাইলে পুতুলনাচের সময় বাড়তেই পারে।


একটা পুতুল নাচ চলতে চলতেই বাঁধা হতে থাকে নতুন গান নতুন পালা৷ পুতুল তৈরি হয় সেই গানের গল্পাংশের ওপর ভিত্তি করে৷ এই জায়গাতে চদরবদরের সঙ্গে পটের একটা বড়ো মিল৷ পট আঁকার আগে গান বেঁধে নেন পটুয়ারাও৷ দমন এখন নতুন গান বাঁধছেন৷ সেই গানের বিষয় হবে গ্রামের ‘মাঝি হারাম’ মানে মোড়লের কাজকর্ম৷ পুতুল তৈরির উপকরণও হাতের কাছের বাঁশ আর কাঠকুটো থেকে থেকে পেয়ে যান শিল্পী৷ তাকে বলি, ওপরে যে পুতুলটা দুলতে দুলতে নানা কসরত্ দেখাচ্ছে তার সঙ্গে তো তোমার বলা কাহিনির কোনও যোগাযোগ নেই৷ ওটা কেন? ‘ইচ্ছে করেই করা, লোকের নজর কাড়ার জন্য৷ বাক্সের ভিতরের পুতুলগুলি দূর থেকে অনেকেই দেখতে পান না৷ সেটা দেখতে হলে কাছে এসে ভিতরের নজর দিতে হয়৷ কিন্তু ওপরের এই পুতুল নাচ দেখে আর গান শুনে লোকে ভিড় জমাবেই৷

Saturday, 20 November 2021

শিবের মুখোশ

বাংলার হস্ত শিল্প নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আগেই দেখিয়ে ছিলাম, আসলে আমাদের হিন্দু ধর্ম বিভিন্ন সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তাগিদায় তৈরি , পুতুল মুর্তি, মুখোশ , পরে ঐতিহ্য বাহী শিল্প নির্দেশন হিসেবে পরিচিত হয়েছে। শিবের মুখোশ ক্ষেত্রে ও এরচেয়ে আলাদা কিছু ই নয়।
শিবের মুখোশ নবদ্বীপের লৌকিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অংশ।চৈত্র মাসে শিবপার্বতীর বিয়ের সময় এই মুখোস তৈরি করা হয়। লৌকিক শৈব সংস্কৃতির সাথে এই মুখোশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটিকে মুখোশ বলা হলেও আসলে এটি মাটি দিয়ে তৈরি মূর্তি। বহুবর্ণশোভিত এই মুখোসটি লৌকিক শিল্পের অন্যতম নিদর্শন।
কাঁচা মাটি দিয়ে ছাঁচে ফেলে এটি তৈরি করা হয়। এরপর এটিকে রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়। রোদে শুকিয়ে গেলে সাদা রং করা হয় এবং চোখ নাক কান আঁকা হয়। মাথায় সোনালী রঙের টোপর পরানো হয়। টোপর বা মুকুটের উপরে ফনাযুক্ত সাপ থাকে।
চৈত্র মাসে শিবের বিয়ে উপলক্ষ্যে  এই মুখোশকে চতুর্দলায় সাজিয়ে নিয়ে বাড়ি বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। বাড়ি বাড়ি থেকে ভিক্ষা করে সেই টাকা দিয়ে শিবের বিয়ের আয়োজন করা হয়। মূলত ছোট ছোট ছেলেরা শিবের বিয়ের আয়োজন করে। 
তবে নবদ্বীপ শহরের কথা আলাদা। শিবের বিয়ে নবদ্বীপের একটি আঞ্চলিক ঐতিহ্য বাহী উৎসব। বাংলার শৈব সংস্কৃতি উৎসব এটি। তাদের মধ্যে নবদ্বীপে চৈত্র মাসে বাসন্তী পুজোর শেষ দিন অর্থাৎ দশমীর পরদিন ভোররাতে শিবের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। চোখ ধাঁধানো শোভাযাত্রার মাধ্যমে নানা রাস্তা ঘুরে শিব ও পার্বতীকে চতুর্দলায় সাজিয়ে পোড়ামাতলায় নিয়ে আসা হয়। এই অনুষ্ঠানটিকে সমাজের বিজ্ঞান এর চোখে দেখলে বলা যাবে সমাজের উচ্চ শ্রেণী ও নিম্ন শ্রেণীর মিলন বলা যেতে পারে। শিব এখানে নিম্ন শ্রেণী ও পার্বতী উচ্চ বংশীয় কন্যা, তাইএই বিয়ে সামাজিক মিলনের বহিঃপ্রকাশ।
শিবের বিয়ে নিয়ে নবদ্বীপের উন্মাদনা দেখার মতো। এখনে বুড়োশিবতলার,বুড়োশিব, যোগনাথ তলার যোগনাথ ,চারিচারা পাড়ার বালকনাথ এবং বউ বাজারের মালোদের শিবের  বিয়ে হয় জাঁকজমকের সঙ্গে নিজের নিজের মন্দিরের এলাকায়। মন্দিরের পাশে বিশাল মঞ্চ বাঁধা হয়। একবার আর পাঁচ টা সাধারণ বিয়ের সাথে এর কোন পার্থক্য থাকে না, এই মঞ্চ গুলো য় ,সাজানো হয় শহরের বড় বড় দোকানের থেকে উপহার হিসেবে আসা,পোশাক , আসবাব, সাইকেল , কাঁসা-পিতলের বাসনপত্র, বাইক , ফ্রিজ, এসি কিছুই বাদ থাকে না যাকিছু লাগে নতুন সংসার করতে সবই আসে। শহরের বড় বড় দোকান থেকে ব্যবসায়ীরা আনন্দের সঙ্গে ওই সব জিনিস বিয়ের বাসর সাজাতে দিয়ে থাকেন।
শুধু শিবের বিয়ে নিয়ে মাতেন না  নবদ্বীপ। খর চৈত্রের দিনগুলাে, গাজন, নীল, চড়কের মতাে উৎসব সাড়ম্বরে পালিত হয়। সংক্রান্তির পাঁচ দিন আগে থেকে শুরু হয়ে যায়,শিবের গাজন উৎসব। শহরের কেন্দ্র স্থলে রয়েছে বিশালাকার শিব লিঙ্গ। ১৬৬৯ সালে প্রথমবার নদিয়ারাজ রাঘব মন্দির গড়ে এই শিব প্রতিষ্ঠা করেন। তবে গঙ্গার ভাঙনের ফলে সে মন্দির বিনষ্ট হয়। ১৮২৫ সালে তা আবার প্রতিষ্ঠা করা হয়। নবদ্বীপের শিবের বিয়ে উৎসব অন্তত ৫০০ থেকে ৬০০ বছরের প্রাচীন উৎসব বলে মনে করা হয়। তর্কের খাতিরে তিনশ বছরের কম এর বয়স নয়।
বাংলা সব জায়গায় চৈত্র মাসের শুক্ল ষষ্ঠি,সপ্তমী,অষ্টমী, নবমী ও বিজয়া দশমী তিথি মেনে পাঁচদিন বাসন্তী দুর্গা পুজো  হয়। নবদ্বীপের বাসন্তী পুজোয় অতিরিক্ত সংযোজন হলো এই শিবের বিয়ের অনুষ্ঠান। বাসন্তী পুজোর শেষ দিনে অনুষ্ঠিত হয় শিবের বিয়ের । বাসন্তী পুজোর ভোরে শিবের মুখোশ তৈরি করে সেটিকে চতুর্দলায় সাজিয়ে নিয়ে বর সাজানো হয়। অন্যদিকে দুর্গা ঠাকুরকে (বাসন্তী ঠাকুরকে) দোলায় সাজিয়ে শহরের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে অবশেষে পোড়ামা তলায় নিয়ে আসা হয়। সেখানে বাঙালি হিন্দু বিবাহ রীতি মেনে শিব ও মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার বিয়ে দেওয়া হয়। সাতপাকে ঘোরা থেকে শুরু করে মালা বদল জলসাজ সবই হয়। এর পর আতশবাজির বাজির পোড়ানো হয়।
চৈতন্যদেবের জন্মস্থান হলেও নবদ্বীপে শিবের উপাসনা প্রাক্ চৈতন্য যুগের। একমাত্র বৈষ্ণব প্রভাবিত কিছু কিছু অঞ্চলের কথা বাদ দিলে বাঙালি সমাজ এবং সংস্কৃতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুরুষ দেবতা হলেন শিব।তাছাড়া বৈষ্ণব মতে শিব হলেন পরম বৈষ্ণব।তবে নবদ্বীপের শিব উপাসনার পিছনে হয়তো বৌদ্ধ প্রভাব থাকতে পারে। তাই চৈতন্যধাম জুড়ে রয়েছে বহু শিব মন্দির। নবদ্বীপের চার দিকে রয়েছেন চার শিব। উত্তরে যুগনাথ বা যোগনাথ, দক্ষিণে আলোকনাথ, পুবে হংসবাহন এবং পশ্চিমে বুড়োশিব। তাছাড়া বালকনাথ, বাণেশ্বর, দণ্ডপাণি ও পলেশ্বর।নবদ্বীপে যে শিবের গাজন হয়, পণ্ডিতদের মতে তা গাজন আসলে বৌদ্ধদের ধর্মগর্জন থেকে এসেছে। নবদ্বীপ এক সময়ে বৌদ্ধ প্রভাবিত অঞ্চল ছিল।  সেন রাজবংশের সময় থেকেই নবদ্বীপে তন্ত্রের প্রভাব বাড়তে শুরু করে। সেই সময়ে তন্ত্র বা শক্তি সাধনার অঙ্গ হিসাবে ভৈরবী এবং ভৈরব বা শিবের আরাধনা শুরু হয়। বৌদ্ধ মূর্তিগুলিতে চোখ মুখ একে  শিবে রূপ দেওয়া হয়।
🙏বাঁকুড়ার ঘোড়ার সম্পর্কে কিছু তথ্য জানতে এই linkটা দেখতে পারেন 🙏
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=4087420051274256&id=249406185075681