Sunday, 21 November 2021

চদর বদর পুতুল

একসময় বাংলার বিনোদন জগতের গুরুত্বপূর্ণ জনপ্রিয় পুতুল নাচ ছিলো চদর বদর। পরাধীন ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের হাতিয়ার ছিলো এই নাচ।একসময় ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রচার করা হতো এই নাচ গুলো। অনেকের মতে চদরবদর হল পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন পুতুল নাচ৷ কিন্তু এর ইতিকথা খুব একটা জানা যায় না৷ কবে ঠিক কোন জায়গায় কোন ভূখণ্ড জনপদে এর জন্ম তার ঠিক নেই, নেই কোনও লিখিত ইতিহাস৷ কেউ কেউ বলেন ‘চদর’ কথাটা এসেছে চাদর থেকে৷ চাদরের তলায় এই নাচ দেখানো হয় বলে নাম হয়েছে চদরবদর৷ 
গ্রাম বাংলার এই পুতুলনাচ আজ লুপ্তপ্রায়। পুতুলনাচের তেমনই এক ধারা অন্তত ৩০ বছর আগেও বীরভূম, বর্ধমান, বাঁকুড়া-সহ কিছু জেলায় ভাল ভাবেই টিকে ছিল। 
 এই পুতুলনাচের পোশাকি নাম ‘চাদর বাঁধনি’। গ্রাম্য ভাষায় এরই নাম ‘চদর বদর’। এটি সাঁওতালি শব্দ। ‘চদর বদর’ নাচানো সাঁওতালি সংস্কৃতির অন্যতম নিদর্শন। ‘চদর বদর’ আদিবাসী নিজস্ব ঘরানার পুতুলনাচ, যা কোনও পশ্চিমী দেশ থেকে নকল করা নয়। নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ধরে রাখার প্রয়াস, আদিবাসীদের সারল্য, প্রযুক্তি এই পুতুলনাচের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। বাংলার মৃতপ্রায়, সুপ্রাচীন অথচ আলোচনা-গবেষণার আড়ালে থেকে গিয়েছে সাঁত্ততালি লোকাশিলোকাশিল্পটি।
চদর বদরের পুতুলগুলি সাধারণত ৭ থেকে ৯ ইঞ্চি লম্বা হয়। পুতুলগুলি গড়তে প্রয়োজন হয় কারিগরি দক্ষতা। শিরিষ, জাম, বট, ডুমুর ইত্যাদি হাল্কা কাঠ খোদাই করে পুতুল তৈরি করা হয়ে থাকে। কাঠের তৈরি পুতুলে তার পরে চলে রংয়ের কাজ। শেষে পুতুলকে কাপড় পরানো হয়। এই পুতুল নাচের কাঠি এবং সুতো দুটোরই ভূমিকা আছে৷ ছোটো ছোটো ধূসর বা কালো কাঠের টুকরো আর বাঁশ দিয়ে একদম নির্ভেজাল দেশি পদ্ধতিতে তৈরি এই পুতুল৷ এই কারিগরি অন্য কোনও পুতুল নাচে নেই৷ তা হল মূল একটা লাঠির সঙ্গে বিভিন্ন কাঠি এবং সুতোতে যুক্ত থাকে পুতুলগুলির বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, মূল লাঠিটি নাড়লেই সেগুলি একসঙ্গে নানা ভঙ্গিতে নড়তে থাকে৷ যে কোনও পুতুল নাচই হয় পথে অথবা খোলা জায়গায়৷ চদরবদর-এ পুতুল নাচে স্ট্যান্ডের ওপরে বসানো গোল অথবা চৌকো বাক্সের মতো চারদিক খোলা মঞ্চে৷ কোথাও বা স্ট্যান্ডের বদলে থাকে একটা গোল লাঠি৷ একপায়া কাঠের স্ট্যান্ডের ওপর ভর করে থাকে একটি বাক্স। সেটারই তিন দিক ঘিরে থাকে চাদরে। শাড়ি দিয়ে মোড়া থাকে বাক্সের নিচের অংশ। আর সেই বাক্সেই ধামসা মাদল সহযোগে নাচতে থাকে সাঁওতালি নারী-পুরুষের প্রতিরূপ সরূপ সারিবদ্ধ পুতুলগুলি।এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় চদরবদরের পুতুল নাচের মঞ্চটির একটু আধটু তফাত্‍ হয়৷ যেমন, বীরভূমের চদরবদরে মঞ্চটি গোল আবার উত্তর দিনাজপুরে চৌকো৷ কোথাও বা ছাদটা কাপড় দিয়ে ঢাকা৷ কোথাও বা ছাদটা হয় কাঠের৷ সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত চদরবদর পুতুলগুলিতে দেখেছি মঞ্চটি উন্মুক্ত৷ শুধু এ দিক থেকে ও দিক কয়েকটি লাঠি চলে গেছে৷ নাচের সব চরিত্রই আদিবাসী নারী-পুরুষ-শিশু৷ পুতুল থেকে নাচ দেখানোর স্ট্যান্ড লাগানো বাক্স তৈরি করেন শিল্পী নিজেই৷ গানও বাঁধেন নিজেরাই৷


ডাং পুতুলনাচের মতো ‘চদর বদর’ও দেখানো হয়ে থাকে ডাং বা লাঠির সাহয্যে। কিন্তু ডাং পুতুলনাচের শিল্পীরা নিজের কোমরে একটি ছোট চোঙ বেঁধে খাপে ডাংটিকে পুরে হাত দিয়ে সেই ডাংটিকে উপর নীচে তুলে ও ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুতুলনাচ দেখান। চদর বদরের ক্ষেত্রে ডাংটিকে দুইয়ের মধ্যবর্তী স্থানে ভারসাম্য এনে পুতুলনাচ দেখানো হয়। বেণী পুতুলের মতো চদর বদরের পুতুলগুলি ছোট হয়ে থাকে।

মঞ্চ সাজানো হলে। শিল্পীরা প্রত্যেকে বাজান। লাগড়া, মাদল, বাঁশি। আর পুতুলেরা বাজনার তালে তাল মিলিয়ে নাচছে। মজার বিষয় এদের পুতুল দের নাম থাকে।

চাদর বদর প্রদর্শনের সময় শিল্পীদের পোশাকেও থাকে বৈচিত্র। শিল্পীরা পাঞ্চি পরেন নিম্নাংশে। মাথায় গামছা ও হাঁসের পালক। চিরাচরিত উপজাতি বাদ্যযন্ত্রে অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখা যায় পুতুল নাচের সময়। বাজে বানাম, তুংদা (মাদল), লাগড়া, তিরেঞয়া( বাঁশি)। পুতুলনাচের সময় মোটমুটি নির্ভর করে দর্শকের উপরে। দর্শক চাইলে পুতুলনাচের সময় বাড়তেই পারে।


একটা পুতুল নাচ চলতে চলতেই বাঁধা হতে থাকে নতুন গান নতুন পালা৷ পুতুল তৈরি হয় সেই গানের গল্পাংশের ওপর ভিত্তি করে৷ এই জায়গাতে চদরবদরের সঙ্গে পটের একটা বড়ো মিল৷ পট আঁকার আগে গান বেঁধে নেন পটুয়ারাও৷ দমন এখন নতুন গান বাঁধছেন৷ সেই গানের বিষয় হবে গ্রামের ‘মাঝি হারাম’ মানে মোড়লের কাজকর্ম৷ পুতুল তৈরির উপকরণও হাতের কাছের বাঁশ আর কাঠকুটো থেকে থেকে পেয়ে যান শিল্পী৷ তাকে বলি, ওপরে যে পুতুলটা দুলতে দুলতে নানা কসরত্ দেখাচ্ছে তার সঙ্গে তো তোমার বলা কাহিনির কোনও যোগাযোগ নেই৷ ওটা কেন? ‘ইচ্ছে করেই করা, লোকের নজর কাড়ার জন্য৷ বাক্সের ভিতরের পুতুলগুলি দূর থেকে অনেকেই দেখতে পান না৷ সেটা দেখতে হলে কাছে এসে ভিতরের নজর দিতে হয়৷ কিন্তু ওপরের এই পুতুল নাচ দেখে আর গান শুনে লোকে ভিড় জমাবেই৷

No comments:

Post a Comment