আজ এমন একটি অপরিচিত শিব মন্দিরে কথা বলতে চাই, যেটি মনসা মঙ্গল কাব্য সাথে জড়িত। মঙ্গল কাব্য হলো বাংলার নিজের। মহাভারত রামায়ণ এর চেয়ে এটা আলদা। মঙ্গলকাব্য বিশারদ আশুতোষ ভট্টাচার্য মনসামঙ্গল কাব্যের সম্পর্কে এরকম বলেছেন “রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ-নিরপেক্ষ একটি স্বাধীন লৌকিক কাহিনী” ।খ্রিষ্টীয় দশম-একাদশ শতাব্দী থেকে বাংলায় মনসার মূর্তিনির্মাণ শুরু হয়। মনসামঙ্গল কাব্যের মূল লৌকিক কাহিনিটি তারও আগে থেকে পল্লিগীতি ও ছড়ার আকারে বাংলার লোকসমাজে প্রচলিত ছিল বলে অনুমান করা হয়। খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে এক লোককথাটি শক্তিশালী কবিদের নিপুণ হাতে পড়ে কাব্যকৃতির রূপ নেয়। ক্রমে তার মধ্যে নানা উপকাহিনি ও পৌরাণিক উপাখ্যানের সমাবেশ ঘটে।বৈদ্যপুর, উদয়পুর, হাসনহাটি প্রভৃতি গ্রামের নামকরণ হয়েছে এই কাব্য অনুসারে৷লৌকিক দেবী হলেও কালক্রমে মনসা ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক হিন্দুসমাজেও প্রতিপত্তি অর্জন করে; এমনকি চৈতন্যদেবের সমসাময়িক কালে শিক্ষিত বাঙালি সমাজেও মনসার পূজা প্রচলিত হয়।
এই কাব্যে সেযুগের হিন্দু বাঙালি সমাজের সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি সম্পর্কে নানা অনুপূঙ্খ বর্ণনা পাওয়া যায়। চাঁদ সদাগর শুধুমাত্র এই কাব্যেরই নয়, বরং সমগ্র বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বলিষ্ঠ চরিত্র; বেহুলা-লখিন্দরের করুণ উপাখ্যানটিও তার মানবিক আবেদনের কারণে আজও বাঙালি সমাজে জনপ্রিয়।
চাঁদ সদাগর মনসামঙ্গল কাব্যধারার একটি কিংবদন্তি চরিত্র। তিনি ছিলেন প্রাচীন ভারতের চম্পক নগরের একজন ধনী ও ক্ষমতাশালী বণিক। যদিও বিপ্রদাস পিপলাই তার মনসামঙ্গল কাব্যে উল্লেখ করেছেন যে, চাঁদ সদাগরের বাণিজ্যতরী সপ্তগ্রাম ও গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত ত্রিবেণী হয়ে সমুদ্রের পথে যাত্রা করত।তবে আদি গঙ্গাকে তাঁর বানিজ্য পথ বলেই ধরে নেওয়া হয়। লোকজন দাবি চাঁদ সওদাগর এই আদি গঙ্গার তীরে অনেক গুলো শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গড়িয়া মহামায়া তলা অঞ্চলের তেঁতুলতলা করগঙ্গা শিব জোড়ামন্দির ও নাকি চাঁদ সওদাগর প্রতিষ্ঠিত।
ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতার বিশিষ্ট ধনী ভোলা দত্ত নিজেকে চাঁদ সদাগরের বংশধর বলে দাবি করতেন। তিনি মনসামঙ্গলে বর্ণিত ‘শঙ্কর ভবানী’ মূর্তি পূজা করতেন। তার বংশধরেরা আজও সেই শিবদুর্গা মূর্তিরই পূজা করে পাশে বসে থাকে কার্তিক গণেশ ও লক্ষ্মী ও সরস্বতী মায়ের ছেলে মেয়েরা আসছেন। এই মূর্তিতে দুর্গা শিবের কোলে বসে থাকেন; দেবী সপরিবারে থাকলেও মহিষাসুর থাকে না; দেবীও সিংহের পরিবর্তে শিবের বৃষস্কন্ধে বসে থাকেন।পায়ের তলায় নিজে বসে দেবীর বাহন বীর কেশর সিংহ।
অতিতে ভাগীরথী খাতে প্রবাহিত গঙ্গা নদীর নিম্ন প্রবাহটি একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে যেমন ছিল, তেমনটি আগে ছিল না। ব্যান্ডেলের কাছে ত্রিবেণীতে এটি তিনটি শাখায় ভাগ হয়ে যেত। দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে সপ্তগ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যেত সরস্বতী নদী। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বয়ে যেত যমুনা নদী মাঝখান দিয়ে বইত হুগলি নদী। এখন যেখানে কলকাতা শহর সেখানে হুগলি বাঁক নিত এবং কালীঘাট, বারুইপুর ও মগরা হয়ে সমুদ্রে গিয়ে মিশত। এই আদি খাতটিকেই বলা হয় আদিগঙ্গা।
এখন টালিগঞ্জ, আজাদগড়, রানিকুঠি, নেতাজিনগর, আলিপুর, বাঁশদ্রোণী, নাকতলা, রথতলা, বৈষ্ণবঘাটা, গড়িয়া, বোড়াল, মহামায়াতলা, নরেন্দ্রপুর, রাজপুর, হরিনাভি, কোদালিয়া, চাঙারিপোতার (অধুনা সুভাষগ্রাম) মধ্যে দিয়ে আদিগঙ্গা প্রবাহিত। এই পর্যন্ত আদিগঙ্গা "টালির নালা" নামেও পরিচিত। এর পর মাহিনগর ও বারুইপুর (আগে অতিসারা গ্রাম) হয়ে এটি পৌঁছেছে জয়নগর ও মজিলপুরে। শেষপর্যন্ত আদিগঙ্গা মিশেছে বঙ্গোপসাগরে।নগরায়ণের ফলে আদিগঙ্গার অধিকাংশ অংশ শুকিয়ে গেছে। বিশেষ করে বর্তমানে নরেন্দ্রপুর থেকে রাজপুর-সোনাপুর পর্যন্ত তিন কিলোমিটার এলকায় বস্তুত কোনো নদীর নাম নিশানা নেই। এসব স্থানে নির্মান করা হয়েছে কংক্রিটের দালান, কমিউনিটি হল আর রাস্তাঘাট। খুব কাছেই দেখা যায় দীর্ঘায়িত কিছু জলাধার বা পুকুর যেগুলো আবার নামকরণও করা হয়েছে, যেমন ‘করের গঙ্গা’, ‘ঘোষের গঙ্গা’ বোসের গঙ্গা' প্রভৃতি। নানা নামে অভিহিত হয়ে বৃহৎ পুষ্করিণী আকারে পূর্ণ গঙ্গা মর্যাদায় অস্তিত্ব রক্ষা করে চলেছে। এর তীরে তীরে এখনও বহু শশ্মানঘাট বিদ্যমান। আর এই আদি গঙ্গার মন্দির গুলো প্রমাণ করে, বানিজ্য করতে যাবার জন্য বনিক সম্প্রদায় তাদের ইষ্ট দেবতার পূজা র জন্য এইসব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাই করগঙ্গা শিব মন্দির টি যত জীর্ণ হোক এটি বাঙালির ঐতিহ্য।
No comments:
Post a Comment