Tuesday, 30 November 2021

দারু বিগ্রহ

সোমা মুখোপাধ্যায় যিনি বাংলার নানা ঐতিহাসিক ঐতিহ্য এর কথা তাঁর লেখা গ্রন্থের মাধ্যমে তুলে ধরেন তাঁর একটি পোস্ট দেখে , আমার এই লেখাটা লেখার  ইচ্ছে হলো। যদিও সায়ন রায়ের তৈরি তথ্য চিত্র গুলো য় অনেক গুলো দারুন বিগ্রহের কথা আমরা জানতে পারি। তার মধ্যে  ফরতাবাদ এর কাঠের কালি বিশেষ উল্লেখযোগ্য কারণ এই মন্দিরের পথ খুঁজে পাওয়া ই অনেক টা কঠীন কাজ অন্তত কোলকাতায় থাকাকালীন দুইবার তিনবার চেষ্টা করে আমি ব্যার্থ হয়েছিলাম, এবং তারাপদ সাঁতারার‌ লেখায় যদিও বহু দারু বিগ্রহের কথা আমরা জানতে পারি। শালকিয়ায় রমণী মোহন চ্যাটার্জীর বাড়িতে এক দারুময়ী জগদ্ধাত্রী আছেন তার রূপ সত্যি অসাধারণ। সোমা দেবীর কথা অনুযায়ী  রমণী বাবু একজন উদ্যোগপতি ছিলেন।তাঁর কাস্ট আয়রণের ব্যবসা ছিল।   হুগলির সঙ্গে হাওড়ার যোগসূত্রের কারণে বিগ্ৰহে তার অনেক প্রভাব আছে।
আমি আমার বিভিন্ন লেখায় তিনটি চারটি দারু বিগ্রহের কথা আপনাদের বলেছিলাম। বারুইপুর অঞ্চলের রামনগর থানার আদি মহামায়া, গড়িয়ার মহামায়া, বোড়ালের ত্রিপুরার সুন্দরী  , বনহুগলির চক্রবর্তী দের জগন্নাথ দেব কথা।  দারুন বিগ্রহ আসলে কি? সাদামাটা ভাষায় বললে কাঠের মূর্তি। কাঠের মূর্তি মানেই মনে পরে জগন্নাথের কথা, জগন্নাথের মূর্তি সাধারণত কাঠে তৈরি করা হয়। জগন্নাথকে মূলত আদিবাসী দেবতা মনে করেন। ওড়িশার আদিম আদিবাসী সরভরা ছিল বৃক্ষ-উপাসক। তারা তাদের দেবতাকে বলত "জগনাত"। সম্ভবত, এই শব্দটি থেকে "জগন্নাথ" শব্দটি এসেছে। নিম গাছের কাঠ দিয়ে জগন্নাথদেবের প্রধাণ বিগ্রহটি(জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা) নির্মিত। এই মূর্তির চোখদুটি বড়ো বড়ো ও গোলাকার। হাত অসম্পূর্ণ। মূর্তিতে কোনো পা দেখা যায় না। যদিও বিগ্রহে অসম্পূর্ণ হাত ও পায়ের অনুপস্থিতি নিয়ে নানা ধরনের মতবাদ এবং পবিত্র বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার কাঠের মূর্তি গুলো আসলে চৈতন্য মহাপ্রভুর দ্বারা প্রভাবিত। আপনারা সকলেই জানে বর্তমান দক্ষিণ কলকাতার কালিঘাট, কুঁদঘাট , গড়িয়া অঞ্চলের উপর দিয়ে বেয়ে গেছে টালির নালা, তাই আসলে আদি গঙ্গা। বানিজ্য এর স্বার্থে টলি সাহেব এই গঙ্গার সংঙ্কার করে বলে এরনাম টালির নালা। কুঁদঘাঘাট আসলে কুঁত - ঘাট , কুঁত আসলে আজকের দিনে র টোল ট্যাক্সের মতো জলপথ ব্যবহার কর আদায়ের স্থান।
এই আদি গঙ্গা পথ ধরে গড়িয়া , বারাইপুর, জয় নগর, ছত্র ভোগ হয়ে চৈতন্য মহাপ্রভু পুরি গিয়েছিলেন। তাই এই অঞ্চলে বৈষ্ণব ঘাটা, কীর্তনখোলা মতো জনপদের নাম শোনা যায়। এবং মন্দির গুলোতে বৈষ্ণব প্রভাবে কাঠের মূর্তি দেখা যায়। আমি যতোদূর জানি মহামায়া ও বৈষ্ণব প্রভাবিত দেবী।
কিন্তু অবাক লাগলো শালকিয়ায় কাঠের জগদ্ধাত্রী মূর্তি দেখে। সালকিয়া হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হাওড়া শহরের একটি অঞ্চল। এই জন পদের পুরাতন নাম ছিলো শালিখাঁ , ১৯শ শতক থেকে জনবসতিপূর্ণ হতে শুরু করে হুগলি নদীর তীরে মালি পাঁচঘড়া ও ঘুষুড়ি অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত এই অঞ্চল। বাংলায় জগদ্ধাত্রী পূজা বিখ্যাত চন্দন নগরে। অর্থনৈতিক কারণে এটি ঘটেছিলো। দূর্গা পূজার সময় এরা ব্যাস্ত থাকতো। তাই জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন করে এই বনিক মহল। তবে শালকিয়়াার সীতা রাম ঘোষ লেন এই বিগ্রহের বয়স একশ বছরের পুরনো নয়।
 আমার প্রশ্ন হলো বাংলায় কাঠের মূর্তি তৈরি হয়েছিল , সম্ভবতঃ পাথর ও ধাতুর বিকল্প হিসেবে মূর্তি র স্থায়ীত্ব বাড়ানোর জন্য । কিন্তু ঠিক পাঁচশত বছর পূর্বে চালু হলো কেন এই কাঠের মূর্তি  তৈরি ?
কারণ আমার চোখে দেখা প্রাচীন কাঠের মূর্তি বোধহয় চৈতন্য মহাপ্রভুর মূর্তি।চৈতন্যদেব ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তিন বছর পরে, ১৫১৩ সালে নির্মিত হয় ওই মূর্তি। বলা হয়, যে নিম গাছের তলায় তাঁর জন্ম হয়েছিল, সেই গাছের কাঠ দিয়েই তৈরি হয়েছিল চৈতন্যদেবের দারু বিগ্রহটি।
অন্যটিও নদীয়ার চাকদহ যশরায় চৈতন্যদেবের অন্তরঙ্গ পার্ষদ জগদীশ পণ্ডিত প্রতিষ্ঠিত প্রায় পাঁচশ বৎসরের সুভদ্রা বলরাম বিহীন দারু নির্মিত জগন্নাথ বিগ্রহ যদিও খুব বিখ্যাত। জগন্নাথ নামের অর্থ চলমান। কিন্তু ইনি রথে চড়েন না। এ নিয়ে একদিন গল্প হবে নাড়ায়।
আমার এক কবি বন্ধু বলেছিলো। কাঠের মূর্তি তৈরি সাথে অর্থনীতি অবস্থার একটা যোগাযোগ আছে। কাঠ সহজ লভ্য বলেই কাঠের মূর্তি তৈরি করা হতো বাংলায়।সে চৈতন্য মহাপ্রভু কে দেবতা অবতার হিসাবে দেখেনি কখনো। সে সমাজ সংস্কারক হিসেবে দেখতো। তিনি ব্রাম্ভণদের জাতপাত বিরুদ্ধে, পূজা র নামে সম্পদ বৃদ্ধির বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ ছিলেন। নদীয়ার চাকদহ যশরায় জগন্নাথ গল্প দেখুন, পান্ডাদের অত্যাচারে জগন্নাথ ছাড়লেন পুরীর মন্দির। আবার নগর কীর্তন শাসকদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ এক প্রচেষ্টা যা রাষ্ট্রের কাছে , নিজের ধর্ম পালনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। তবে বাংলা বৈষ্ণব রা দেবদেবীকে ঘরে সাধারণ সদস্যদের মতো ধরে নিয়ে ছিলো। গোপাল কখনো তাদের সন্তান, কৃষ্ণ তাদের সংখ্যা। ঘর সংসার সব কিছু এদের ঈশ্বরকে নিয়ে। এদিকে বৃন্দাবন অঞ্চলে এই সময়ে মন্দির গুলো ভাঙা পরেছে শাসকদের দ্বারা। সেই শাসকদের হাতে তখন বাংলার শাসন। ধর্মীয় দিক থেকে তাঁরা মূর্তি পূজা বিরোধী। তাই এই কাঠের মূর্তি যা নিয়ে সহজেই প্রদান পরিবর্তন করা যায়। এই মতকে আমি সমর্থন করি না, তবে যদি এটা সত্য হয়ে থাকে তবে বলতে হয়। তবে বলতে হবে ভয় ও সভ্যতাকে সুন্দর নিদর্শন গরতে সাহায্য করেছে। আর শিল্প মন কখনো হয়তো সামাজিক ঘটনায় অতটা প্রভাবিত হয়না, তাই তাঁরা অনেক দিন বেঁচে থাকে তাদের শিল্প কলার মধ্যে দিয়ে।

1 comment: