Saturday, 20 November 2021

রাজপুর বিপত্তারিনী চন্ডী

দুর্গা তিনিই বিপদতারিনী,যিঁনি সমগ্র বিপদ থেকে রক্ষা করেন বা যিঁনি বিপদ সমূহ নাশ ।  তিনি দেবী সঙ্কটনাশিনী এবং দেবী দুর্গা(পার্বতী)-এর ১০৮ অবতারের অন্যতম। হিন্দুরা মূলত বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য এই দেবীর পূজা করেন।আষাঢ় মাসের রথ থেকে উল্টোরথের মধ্যে মঙ্গলবার ও শনিবার-এ হিন্দু মহিলারা বিপত্তারিণী ব্রত পালন করেন।আষাঢ়ে বাংলার অন্যতম উৎসব বিপত্তরিণী পুজো। তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, এই উৎসবটির মতো জনপ্রিয়তা খুব কম উৎসবের রয়েছে। বিপত্তারিণী পুজোর দিন থেকে লক্ষ করুন, কত জন মানুষ হাতে লাল ডোরে দুব্বোঘাস বেঁধে তাগা ধারণ করেছেন। স্পষ্ট বুঝতে পারবেন, বাংলার সংস্কৃতির অন্তঃস্থলে ঠিক কতটা জায়গা অধিকার করে রয়েছেন এই দেবী।
বিপদ তারিণী পুরাণে কৌশিকীদেবী নামে খ্যাতা।  তিনিই জয়দুর্গা,দেবীর উৎপত্তি হয়েছিলো  শিবের অর্ধাঙ্গিনী হিসাবে। দেবী পার্বতীর কৃষ্ণ কোশ থেকে- তাই তিনি কৌশিকী। কথিত আছে, শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক দুই অসুরের হাতে দেবতারা পরাজিত হয়ে হিমালয়ে গিয়ে মহামায়ার স্তব করতে লাগলেন। সেই সময় পরমেশ্বরী ভগবতী পার্বতী সেই স্থান দিয়ে যাচ্ছিলেন। দেবী তাদের স্তব শুনে বললেন –"আপনারা এখানে কার স্তব করিতেছেন?” সেই সময় ভগবতী পার্বতীর শরীর থেকে তার মতন দেখতে আর এক জন দেবী বের হয়ে আসলেন। সেই নব আবির্ভূতা দেবী জানালেন – “ইহারা আমারই স্তব করিতেছেন।” এই দেবী যুদ্ধে শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক অসুরের বধ করেছিলেন । এই দেবী মোহাচ্ছন্ন শুম্ভাসুরকে অদ্বৈত জ্ঞান দান করে বলেছিলেন-"এই জগতে এক আমিই আছি। আমি ছাড়া আমার সাহায্যকারিনী আর কে আছে? ওরে দুষ্ট ভাল করে দেখ , ব্রহ্মাণী প্রভৃতি শক্তি আমারই অভিন্না বিভুতি বা শক্তি। এই দেখ তারা আমার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।”আবার আরোএকটি গাঁথানুসারে ভগবান মহাদেব দেবী পার্বতীকে ‘কালী’ বলে উপহাস করেন। এতে দেবী ক্রুদ্ধ হয়ে তপস্যার মাধ্যমে নিজের “কৃষ্ণবর্ণা” রূপ পরিত্যাগ করলেন। সেই কৃষ্ণবর্ণা স্বরূপ দেবীই হলেন , দেবীর পার্বতীর অঙ্গ থেকে সৃষ্টা জয়দুর্গা, কৌশিকীদেবী ও বিপদতারিনীদুর্গা।
বিপত্তারিণী মা চণ্ডী দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার,  রাজপুরে অবস্থিত প্রাচীন এক দেবী প্রতিমা। কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গে এই মন্দির চণ্ডীর বাড়ি হিসাবে পরিচিত। মন্দিরে প্রতিদিন নিষ্ঠা সহকারে পুজো হয় এবং মন্দিরের সাথেই জড়িয়ে রয়েছে বহু মাহাত্ম্যপূর্ণ কাহিনী। আষাঢ় মাসের বিপত্তারিণী পুজোকে কেন্দ্র করে মন্দির চত্বরে ভক্তদের ভীড় দেখার মতন। শিয়ালদহ সাউথ স্টেশন থেকে ট্রেন পথে সােনারপুরে নেমে রাজপুর আসা যায়। এই রাজপুরেই অধিষ্ঠাতা হয়ে রয়েছেন মা বিপত্তারিণী।
বাবা দুলাল তাঁর প্রথম ইচ্ছায় দক্ষিণাকালীর মূর্তি তৈরি করতে দিয়েছিলেন। কিন্তু দেবী তাঁকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে বলেন দক্ষিণাকালী নয়, বিপত্তারিণী চণ্ডীর মূর্তি গড়তে। দেবী তাঁর রূপও বলে দেন, অর্থাৎ এখানে দেবী সিংহবাহিনী, তাঁর চার হাত, এক হাতে মহাশূল, এক হাতে খড়গ ও অন্য দুই হাতে বরাভয় ও অভয় দান করছেন তিনি। তিনি আরও জানিয়ে দেন, সকল ভক্তকে বিপদে উদ্ধার করতেই তিনি বাবা দুলালকে দিয়ে তাঁর প্রচার করাতে চান। শুধুমাত্র মূর্তিরই বর্ণনা নয়, তিনি পুজোর পদ্ধতিও শিখিয়ে গিয়েছিলেন দুলাল বাবাকে। সেই থেকে রাজপুরে মা বিপত্তারিণী চণ্ডী রয়েছেন।

নিয়ম অনুসারে এখানে সোজা রথ ও উলটোরথের মাঝের মঙ্গলবারে বিপত্তারিণীর পুজো হয়। পুজোর দিন একেবারে ভোর থেকেই এখানে ভক্ত সমাগম শুরু হয়ে যায়। সবাই মাকে তেরো রকমের ফল, মিষ্টান্ন দিয়ে পুজো দেন।
এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা বাবা দুলাল(দুলাল চন্দ্র দাস) নিয়ে কাহিনী প্রচলিত আছে । ১৩২৩ সনের কার্তিক মাসে কার্তিক পুজোর দিন ভোরে জন্ম নেন। ইনি জন্মানোর কিছুক্ষন পরেই ঐ ভোরের বেলায় কযেকজন অপরিচিত কীর্তনীয়া রাজপুর গ্রামের রাস্তা দিয়ে কীর্তন গেযে যেতে,যেতেই তাঁরা হঠাৎ করে শ্রী সাধন চন্দ্র দাসের বাড়ির ভিতরে ঢুকে বাবা দুলাল যে ঘরে জন্মান সেই ঘরের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কীর্তন গাইতে লাগলেন, ” যশোদা নন্দন,নন্দের দুলাল এলো রে, রাজপুর ধামেতে বাবা দুলাল এলো রে ” । শোনা যায় শিশু দুলাল একদিন পাঠশালায় পডার শেষে বাকিন্তু সাধনবাবু ছেলেকে বললেন,আমরা বংশগত বিচারে ব্রাহ্মণ নয,আমরা নীচ জাতির, মাহিষ সম্প্রদায়ের, তাই আমাদের ঐ পূজা দেখা ঠিক নয়।" বাবা সাধনবাবু ছেলের বাযনার কাছে হেরে গিয়ে বললেন, “ঠিক আছে,নিয়ে যেতেই পারি,কিন্তু তোমাকে প্রচুর শীত বস্ত্র পডতে হবে, নাহলে শীতের রাতে ঠান্ডা লেগে যাবে।শিশু দুলাল বাবার বায়না মেনে তাতেই রাজি হয়ে গেল ।সেখানে পৌঁছিয়ে দেখা গেলো মা চন্ডী যেন তাকে দেখে হাসছেন,যেন চেনা লোকের সঙ্গে মা চন্ডীর হঠাত দেখা হয়ে গিয়েছে,তাই তিনি হাসেছেন। এপর থেকে তার মনের আয়নায় মা চন্ডীর ত্রিনয়নী মুখ বারংবার ভেসে উঠতে লাগল। এর কিছুদিন পরে ঠাকুরদার পিঠ চুলকিযে পাওয়া টাকানিয়ে পটুয়াপাড়ায গিয়ে মা চন্ডীর ছোট মূর্তি তৈরির বায়না করলেন । মূর্তি তৈরি হলে সেই শিশু দুলাল নিজে মাতৃমূর্তি চন্ডী মায়ের মূর্তি মাথায় নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিলে পটুয়া তাঁকে বাধা দেয় , শিশু মৃন্ময়ী মাতৃমূর্তি মাথায় নিয়ে বাড়ি যেতে পারবে না । সবাইকে অবাক করে শিশু দুলালের মাথায় মা চন্ডীর মাতৃমূর্তি উঠিয়ে নিলেন অনায়াসে।এসব কান্ডর কথা সবার অজানা। পাঠশালা থেকে ছেলে কোথায় গেলো সেই নিয়ে সবাই চিন্তিত।শিশু দুলাল একটা মৃন্ময়ী চন্ডী মাতৃমূর্তি মাথায় নিয়ে বাড়ির দিকে আসছে।এই দৃশ্য দেখেই তিনি প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পড়লেন তাঁর বাবা।  তিনি দুলালকে বললেন,”তুমি এই চন্ডী মূর্তি নিয়ে ঘরে ঢুকবে না।ঐ মূর্তি সদর দরজার বাহিরে রাস্তায় রেখে ঘরে ঢুকবে কারন আমরা নিম্ন বর্নের মানুষ,তাই আমাদের ঐ মূর্তি ঘরে ঢোকানোর অধিকার নেই।তুমি ঐ মূর্তি দরজার বাহিরে রেখে ঘরে ঢুকবে “।এই কথা তিনি বললেও শিশু দুলাল কোন উওর না দিয়ে মাতৃমূর্তি মাথায় নিয়ে বাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকলেন। দুলাল জননী তখন দুলালের এই রকম অবাধ্যতা দেখে খুব রেগে গিয়ে বাড়ির উঠোনে একটু ঝোপঝাড়ে রাখা একটা বেতের ডাল নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শিশু দুলালকে মারতে শুরু করলেন কিন্তু শিশু দুলাল নির্বিকার।তখন শিশু দুলালেকে ঠাকুরদা রক্ষা করলেন এই মার খাওয়া র হাত থেকে । রাতে দুলাল এর  মা  স্বপ্নে দেখলেন,যেন একটা শ্যামবর্না অপরুপা সুন্দরী কিশোরী কন্যা লাল বেনারসি শাডি পরে যেন,আডাল থেকেই তাঁকে বলছে,”তুই আমার পিঠের দিকে তাকিয়ে দেখ,আমার পিঠে কিরকম কালশিটে দাগ পডেছে।তুই দুলালকে মারলি, বেত দিয়ে। ঐটুকু বাচচা ছেলে কি ঐরকম মার সহ্য করতে পারে?সেইজন্যই দুলালের পিঠের উপরে আমার পিঠ দিয়ে ওকে রক্ষা করতে চেষ্টা করেছি বলে,আমার পিঠে কালশিটে দাগ পড়েছে।"এইকথা বলে সেই শ্যামবর্না অপরুপা সুন্দরী কিশোরী কন্যা অদৃশ্য হয়ে গেলেন, স্বপ্নে। তখনই দুলাল জননীর ঘুম ভেঙে গেলে তিনি বুঝতে পারলেন,এই শ্যাম বর্না কিশোরী কন্যা স্বয়ং মা চন্ডী।তিনি ছাড়া অন্য কেউ নন। দুলাল জননী তারপর চন্ডী প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করলেন‌।সেই থেকেই আজও মাযের মৃন্ময়ী মূর্তি শিশু দুলালের বাড়িতে পূজিতা হয়ে আসছেন,দুলালের অবর্তমানেও।এইভাবে মা চন্ডী বাবা দুলালের গৃহে মৃন্ময়ী মাতৃমূর্তিতে প্রতিষ্ঠিত হলেন। এরপরের পর্যায়গুলিতে মা চন্ডী বাবা দুলালের সাথে কিভাবে লীলা করেছিলেন তা ধীরে ধীরে প্রচারিত হতে থাকে।

লোকজন বিশ্বাস করেন রাজপুর বিপত্তারিনী চন্ডী বাড়িতে মায়ের আরতির সময় মাকে আপনার সমস্যা জানান,মা ঠিক সমাধান করে দেবেন। এখানে মা চন্ডীকে ভগবান ভেবে নয়,নিজের মা ভেবে সব কিছু মনে মনে জানান,মা নায্য বিচার করে সমাধান করে দেবেন।

No comments:

Post a Comment