বিতর্ক উঠবে বলে পিছনে হটে যাবো এমনটি নয়। আমি বলবো, শ্রীকৃষ্ণ এর যে মূর্তি আপনারা দেখতে পান, তা আসলে বাঙালীদের সৃষ্টি। কারণ যে ব্রজভুমিতে শ্রীকৃষ্ণ এর জন্ম সেখানকার ব্রজবাসীরা, শ্রীনাথ জি, দাউজি, গোবর্ধন পূজা করতে বেশি পছন্দ করেন এখনো। সে হিসেবে বাঁশি বাজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রাধাকৃষ্ণ এর মূর্তি বাঙালি দের রোমান্টিক মন, এবং যন্ত্রসঙ্গীত প্রেমের প্রমান। তাছাড়া একটু চিন্তা করে দেখুন । রাধা মাখন বেচতে মথুরা যেতেন। অর্থাৎ অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন ছিলেন। আজো গো বলয়ের মেয়েরা অতোটা স্বাধীনতা পায় না।
এবার আসি আসল কথায়। কৃষ্ণ হাতে র বাঁশি আজকের আলোচনা বিষয়। যদিও আমার মূল বিষয় হলো মাটির বাঁশি পুতুল । শিল্প ও সংগীত বিষয়ক সংস্কৃত গ্রন্থ নাট্যশাস্ত্রে (~২০০ খ্রিঃপূঃ থেকে ২০০ খ্রিস্টাব্দ) উল্লিখিত হয়েছে, বাঁশি সে সময়ের এক গুরুত্বপূর্ণ বাদ্যযন্ত্র ছিল। অনেক হিন্দু গ্রন্থে বাঁশি বা বেণুকে সংগীতকলায় ব্যবহার করার জন্য মানুষের গলার স্বর ও বীণার পরিপূরক হিসেবে দেখানো হয়েছে (বাণী-বীণা-বেণু)। ঋগ্বেদের (১৫০০-১২০০ খ্রিঃপূঃ) মতো প্রাক্বৈদিক ও বৈদিক গ্রন্থে একে নাদী আর তূণর এবং পরবর্তী বৈদিক যুগের হিন্দু গ্রন্থে বাঁশিকে বেণু হিসেবে, উপনিষদ ও যোগেও বাঁশি উল্লেখ আছে।
ভারতের সমস্ত প্রাচীন পুরাতাত্ত্বিক ভাস্কর্য ও চিত্রকলায় বাঁশিকে অনুভূমিকভাবে (একটু নিচু করে) বাজানোর রীতি পাওয়া যায়। একটাও লক্ষণীয় বিষয় সেকালে বাদ্যযন্ত্র বাজানোতে কোনো লিঙ্গভেদ ছিল না― নিদর্শনগুলোতে প্রচুর নারীশিল্পীর ছবিও পাওয়া যায়। কিন্তু পঞ্চদশ শতাব্দী শুরু হতেই বাঁশি বাজানোর অধিকার ক্রমে ক্রমে পুরুষদের দখলে চলে যায় আর বাজানোতে আড়াআড়ি পদ্ধতির শুরু হয়। সম্ভবত ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের আগমন ও হিন্দুস্তানি সংগীতের উপর পশ্চিম এশীয় প্রভাব এই পরিবর্তনের জন্য দায়ী।
বাঁশিকে ভারতীয় সঙ্গীত জগত ভুলে গেছেন কিছুটা হলেও। বাংলার সংস্কৃতি জগত একে ভোলে নি।বাংলায় বাঁশিকে মুরালি, মোহন বাঁশি, বংশী অথবা বাঁশরিও বলা হয় । ভারতীয় বাঁশি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাঁশি তৈরিতে তরলা বাঁশ ব্যবহার করা হয়। কেউ কেউ শখের বশে ষ্টিলের, তামার, পিতলের, রূপার এমনকি সোনার পাইপ দিয়েও বাঁশি তৈরী করিয়ে থাকেন। বাংলার মৃৎ শিল্পীরা নতুন করে যোগ করেছে মাটির বাঁশি। তাও আবার পুতুল এর আকারে।
এই প্রাচীন এবং মনহরানো বাদ্যযন্ত্রের গায়ে সাতটি ছিদ্র (মাঝে মাঝে আটটিও করতে দেখা যায়) থাকে । যে নল বা পাইপটি দিয়ে বাঁশি তৈরী করা হয় তার একপাশ সম্পূর্ণ আটকে বায়ুরোধী করে দেওয়া হয়। বাঁশের তৈরী বাঁশিতে গিট বা গিরা একপাশকে বায়ুরোধী করার কাজে ব্যবহার করা হয়। বন্ধ এবং খোলা প্রান্তের মাঝামাঝিতে ছিদ্রগুলো করা হয়। যে ছিদ্রটি বন্ধ প্রান্তের ঠিক কাছাকাছি থাকে সেটা দিয়ে কৌশলে ফু দিতে হয় এবং বাকি ছ'টি ছিদ্র ডান হাতের মধ্যবর্তী তিনটি এবং বাম হাতের মধ্যবর্তী তিনটি আঙ্গুল দিয়ে কখনো আটকে কখনো ছেড়ে দিয়ে সুর তুলতে হয়। অতো জটিল গঠনতন্ত্র নেই এই মাটির বাঁশি তে। তবে নান্দনিক সৌন্দর্য এর আকর্ষণীয়।
কোনটি কাঠালিয়া পুতুল, কোনটি ছলনের পুতুল, কোনো টি জো পুতুল মতো দেখতে। বাংলাদেশ এক শতাব্দী পূর্বে এই বাঁশি তৈরি করা শুরু হয়েছিল। তবে অনেক সৃজনশীল পশ্চিমবঙ্গের মাটির গহনা শিল্পী হাওড়া বাসী রাজকুমার দেবনাথ।তার কাছে পেয়ে যাবেন ঘোড়া,হাঁস, বিড়াল হাতি আরো অনেক কিছু, তবে মাটির গহনা শিল্পী হিসেবে উনার সুনাম অনেক বেশি, সে নিয়ে পরর্বতী পর্বে আলোচনা করবো। শিল্পী হিসেবে উনি সরকারী বেসরকারী উদ্যোগে একটি পূরস্কারের তো দাবি রাখেন ই।
Manab Mondal
No comments:
Post a Comment