Monday, 22 November 2021

ছলনের পুতুল

ছলনের পুতুল এর শৈল্পিক মূল্য নেই তেমন, দৃষ্টি নন্দন এর গুন নেই এর মধ্যে। আমার লেখা ছোট গল্প " ছলনের পুতুল" যাঁরা পড়েছেন। তার বোধহয় সেটা আগে ভাগেই বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু গল্পে মধ্যে সেই ভাবে এর গুরুত্ব এর পরিচয় ঘটানোর সুযোগ ছিলোনা, লেখক হিসেবে সে হিসেবে আমি ব্যার্থ। 
যাইহোক দক্ষিণ ২৪ পরগনার নূরপুর ঘুরতে গিয়ে, দেওয়ানা তলার  এক মেলায় প্রথম ছলনের গুরুত্ব সম্পর্কে আমি পরিচিত হই। অথচ আমার বসত বাড়ি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্ব টালিগঞ্জ অঞ্চল তথা দক্ষিণ কলিকাতার এক মাত্র বনবিবির মন্দির, সেখানে এই ছলনের পুতুল বা ঘোড়া গুলো বিক্রি হলেও এ প্রতি আমি কখনো আগ্রহ দেখায় নি। কিন্তু এর গুরুত্ব আছে আমাদের কাছে অনেক খানি। কারণ ধর্ম ঠাকুর এর কাছে মানত করা ঘোড়া গুলো ই আজ বিশ্ব দরবারে তাদের শৈল্পিক সুন্দর জন্য, একটা জায়গা করে নিয়েছে। তেমনি এই পুতুল গুলো একটু শৈল্পিক ভাবনা রাঙিয়ে উঠলে, এগুলো ও সংগ্রহ যোগ্য হতে পারে।


তবে এর ধর্মী গুরুত্ব কথাই আসি। ভারত উপমহাদেশে মিশ্র ধর্মীয় সংস্কৃতিতে, কখনো কখনো , মানুষ জন  হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের পুতুল এর পূজারী বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। তাদের বলি,পাঁচ ভুত কথা জানেন আপনি। শাস্ত্র মতের পঞ্চভুত হল ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। বিজ্ঞান মানলে, এ বিশ্ব ব্রম্ভান্ডের বাস্তুতন্ত্র এদের ওপর নির্ভর করছে।
এবার একটু খুলে বলি। ক্ষিতি মানে হল- পৃথিবী, অপ কথার মানে হল- জল। তেজ কথার অর্থ হল- আগুন, আর মরুৎ মানে হল বাতাস। এবং ব্যোম বলতে বোঝায় শূন্যতা অর্থাৎ আকাশকে।  পুতুল কারিগর ক্ষিতি মানে পৃথিবী থেকেই মাটি নিয়ে আসে। তার পর অপ অর্থাৎ জল দিয়ে শিল্পী সেই মাটিকেই মাখে। সেই নরম মাটিকে সে পরিণত করে মনের মতন আঁকারে। এর পর শিল্পী ভাবেন কাঁচা মাটিকে পুড়িয়ে শক্ত করার কথা। আর তখনই তাঁর দরকার হয় আগুনের, অর্থাৎ তাঁর লাগে তেজ। এবার তো পুতুলকে ঠাণ্ডা করতে হবে। তাই সেই পোড়া উত্তপ্ত পুতুল সে দেয় বাতাসের কাছে। সুতরাং তাঁর লাগলো মরুৎ কে। এবার ব্যোম কে কাজে লাগাতে হবে শিল্পীর। কিন্তু শূন্যতাকে কি ভাবে পুতুলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে? এর উত্তর লোকো শিল্পী বের করে নেয় অবলীলায়। সে সমস্ত পুতুলগুলি বানাতে থাকে ফাঁপা করে। আর ফাঁপা মানেই হল শূন্যতা অথবা অসংখ্য ছিদ্র করা হয় পুতুলের গায়ে। 


পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমের জেলা গুলিতে মনসকামনা পুর্ন করতে ছলনের হাতি  পুতুল দেওয়া হয়। পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রাম থানা, জঙ্গলমহলের পবিত্র গড়াম স্থান, আদিবাসীদের জাগ্রত দেবতা কালুয়া  কাছে উৎসর্গের জন্য মাটির হাতি।কিন্তু মোটামুটি আমরা সবাই-ই 'ছলনের ঘোড়া'-র সাথে পরিচিত। পোড়ামাটির তৈরি চার পায়ের কৃত্রিম রং ছাড়া এক ধরণের পুতুল। তবে খেলনার জন্য কিন্তু এই ঘোড়ার কোনও ব্যবহার নেই। ধর্মরাজের পুজোয় বা ষষ্ঠীতলায়, বটতলায়, ওরা বিবির মন্দিরে এরকম বেশ কিছু ঘোড়া প'ড়ে থাকতে দেখেছেন আপনিও হয়তো।
কিন্তু লক্ষনীয় বিষয় হলো কৃষ্ণনগরের এই পীরতলায়  এক বিশেষ ধরণের একজোড়া ঘোড়া পীরকে উৎসর্গ ক'রে নানা প্রার্থনা করা হয় স্থানীয় হিন্দু ও মুসলিম বাসিন্দাদের মধ্যে। আপনি বলবেন  এই ঘোড়া 'ছলনের ঘোড়া'-র সাথে মেলেনা।  কারণ মুখ চৌকো আর চ্যাপ্টা এবং আর এতে দুটো রঙয়ের ব্যবহার থাকে। সাদা রং ভ'রে লাল দিয়ে দাগ কাটা বা ডোরাকাটা করা হয়। একেবারে চোখ, মুখ, কানকে যে লাল রং দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয় তা নয়; শুধু প্রতীকের ম'ত একটা ধারণা দেওয়া হয়। এই ঘোড়া দু রকমের আকারের পাওয়া যায়। যেটা একটু বড়, তার পিঠে বাঘের ম'ত ডোরাকাটা তিন-চারটে দাগ দেওয়া থাকে আর যেগুলো একটু ছোট আকারের, তাতে লম্বালম্বি, আড়াআড়ি কিছু দাগ দিয়ে দেওয়া থাকে।  সাধারণত যাদের সন্তানেরা বিকলাঙ্গ বা ঠিকম'ত কথা বলতে পারছে না ; সেইসব মায়েরা এই জোড়া ঘোড়া, ; মোমবাতি, ধূপ এসব দিয়ে আসে অশ্বত্থ গাছের তলায়।
আরো একটি ছলনের পুতুল  বাঘরাই এর বীরভূমের রাজনগরের পুতুল।এটি ছলনের পুতুল পোড়ামাটির লাল আর কালো রঙের হয়।শিল্পী  মনের মাধুরী মিশিয়ে  এই রঙ  করা ছবি দেখে আমার মনে হয় ছিলো প্রথম । নবগ্রামের প্যাঁচা যদি কিংবা ধর্ম রাজের ঘোড়া যদি শিল্প হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। একটু তত্ত্বাবধান করলে এটিও সংগ্রহ যোগ্য হতে পারে।

এ বিষয়ে দক্ষিণ পরগনার সঞ্জয় ঘোষ লিখেছিলেন"এর সাংস্কৃতিক নৃতাত্বিক মূল্য অসীম।আমার মনে হয় সেটা এই লেখায় এসেও আসেনি।কারন নৃতাত্বিক মূল্যায়ন না করা ।আদিবাসী অধ্যুষিত পুরুলিয়া,বাঁকুড়া,দুই মেদিনীপুর,বীরভুম ,হয়তো ঝাড়খনন্ড ও উড়িষ্যায় খোলা আকাশ্র নিচে বা গাছের নিচে লৌকিক দেব দেবীর থানে হাতি ও ঘোঁড়া অবশ্যই থাকবে ছলন হিসেবে।এবং এই আদিবাসীগন যেহেতু ক্রমান্বয়ে জৈন,বৌদ্ধ,হিন্দু ,মুসলিম ধর্ম গ্রহন করেছেন তাই সেই ধর্মেও এগুলি কোনো না কোনো ভাবে থেকেছে।বিশেষ করে সুফি ইস্লামের সমন্বয়ধর্মী ধর্মে পীর গাজী বিবি র ধারায়,ধর্মরাজ ,দক্ষিণ রায়ের পূজ়ায়।এমনকি সাগরে বিশালাক্ষী থানেও দু একটি ঘোড়া ছলন দেখেছি। "

🙏 Manab Mondal 🙏

1 comment: