Saturday, 20 November 2021

শিবের মুখোশ

বাংলার হস্ত শিল্প নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আগেই দেখিয়ে ছিলাম, আসলে আমাদের হিন্দু ধর্ম বিভিন্ন সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তাগিদায় তৈরি , পুতুল মুর্তি, মুখোশ , পরে ঐতিহ্য বাহী শিল্প নির্দেশন হিসেবে পরিচিত হয়েছে। শিবের মুখোশ ক্ষেত্রে ও এরচেয়ে আলাদা কিছু ই নয়।
শিবের মুখোশ নবদ্বীপের লৌকিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অংশ।চৈত্র মাসে শিবপার্বতীর বিয়ের সময় এই মুখোস তৈরি করা হয়। লৌকিক শৈব সংস্কৃতির সাথে এই মুখোশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটিকে মুখোশ বলা হলেও আসলে এটি মাটি দিয়ে তৈরি মূর্তি। বহুবর্ণশোভিত এই মুখোসটি লৌকিক শিল্পের অন্যতম নিদর্শন।
কাঁচা মাটি দিয়ে ছাঁচে ফেলে এটি তৈরি করা হয়। এরপর এটিকে রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়। রোদে শুকিয়ে গেলে সাদা রং করা হয় এবং চোখ নাক কান আঁকা হয়। মাথায় সোনালী রঙের টোপর পরানো হয়। টোপর বা মুকুটের উপরে ফনাযুক্ত সাপ থাকে।
চৈত্র মাসে শিবের বিয়ে উপলক্ষ্যে  এই মুখোশকে চতুর্দলায় সাজিয়ে নিয়ে বাড়ি বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। বাড়ি বাড়ি থেকে ভিক্ষা করে সেই টাকা দিয়ে শিবের বিয়ের আয়োজন করা হয়। মূলত ছোট ছোট ছেলেরা শিবের বিয়ের আয়োজন করে। 
তবে নবদ্বীপ শহরের কথা আলাদা। শিবের বিয়ে নবদ্বীপের একটি আঞ্চলিক ঐতিহ্য বাহী উৎসব। বাংলার শৈব সংস্কৃতি উৎসব এটি। তাদের মধ্যে নবদ্বীপে চৈত্র মাসে বাসন্তী পুজোর শেষ দিন অর্থাৎ দশমীর পরদিন ভোররাতে শিবের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। চোখ ধাঁধানো শোভাযাত্রার মাধ্যমে নানা রাস্তা ঘুরে শিব ও পার্বতীকে চতুর্দলায় সাজিয়ে পোড়ামাতলায় নিয়ে আসা হয়। এই অনুষ্ঠানটিকে সমাজের বিজ্ঞান এর চোখে দেখলে বলা যাবে সমাজের উচ্চ শ্রেণী ও নিম্ন শ্রেণীর মিলন বলা যেতে পারে। শিব এখানে নিম্ন শ্রেণী ও পার্বতী উচ্চ বংশীয় কন্যা, তাইএই বিয়ে সামাজিক মিলনের বহিঃপ্রকাশ।
শিবের বিয়ে নিয়ে নবদ্বীপের উন্মাদনা দেখার মতো। এখনে বুড়োশিবতলার,বুড়োশিব, যোগনাথ তলার যোগনাথ ,চারিচারা পাড়ার বালকনাথ এবং বউ বাজারের মালোদের শিবের  বিয়ে হয় জাঁকজমকের সঙ্গে নিজের নিজের মন্দিরের এলাকায়। মন্দিরের পাশে বিশাল মঞ্চ বাঁধা হয়। একবার আর পাঁচ টা সাধারণ বিয়ের সাথে এর কোন পার্থক্য থাকে না, এই মঞ্চ গুলো য় ,সাজানো হয় শহরের বড় বড় দোকানের থেকে উপহার হিসেবে আসা,পোশাক , আসবাব, সাইকেল , কাঁসা-পিতলের বাসনপত্র, বাইক , ফ্রিজ, এসি কিছুই বাদ থাকে না যাকিছু লাগে নতুন সংসার করতে সবই আসে। শহরের বড় বড় দোকান থেকে ব্যবসায়ীরা আনন্দের সঙ্গে ওই সব জিনিস বিয়ের বাসর সাজাতে দিয়ে থাকেন।
শুধু শিবের বিয়ে নিয়ে মাতেন না  নবদ্বীপ। খর চৈত্রের দিনগুলাে, গাজন, নীল, চড়কের মতাে উৎসব সাড়ম্বরে পালিত হয়। সংক্রান্তির পাঁচ দিন আগে থেকে শুরু হয়ে যায়,শিবের গাজন উৎসব। শহরের কেন্দ্র স্থলে রয়েছে বিশালাকার শিব লিঙ্গ। ১৬৬৯ সালে প্রথমবার নদিয়ারাজ রাঘব মন্দির গড়ে এই শিব প্রতিষ্ঠা করেন। তবে গঙ্গার ভাঙনের ফলে সে মন্দির বিনষ্ট হয়। ১৮২৫ সালে তা আবার প্রতিষ্ঠা করা হয়। নবদ্বীপের শিবের বিয়ে উৎসব অন্তত ৫০০ থেকে ৬০০ বছরের প্রাচীন উৎসব বলে মনে করা হয়। তর্কের খাতিরে তিনশ বছরের কম এর বয়স নয়।
বাংলা সব জায়গায় চৈত্র মাসের শুক্ল ষষ্ঠি,সপ্তমী,অষ্টমী, নবমী ও বিজয়া দশমী তিথি মেনে পাঁচদিন বাসন্তী দুর্গা পুজো  হয়। নবদ্বীপের বাসন্তী পুজোয় অতিরিক্ত সংযোজন হলো এই শিবের বিয়ের অনুষ্ঠান। বাসন্তী পুজোর শেষ দিনে অনুষ্ঠিত হয় শিবের বিয়ের । বাসন্তী পুজোর ভোরে শিবের মুখোশ তৈরি করে সেটিকে চতুর্দলায় সাজিয়ে নিয়ে বর সাজানো হয়। অন্যদিকে দুর্গা ঠাকুরকে (বাসন্তী ঠাকুরকে) দোলায় সাজিয়ে শহরের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে অবশেষে পোড়ামা তলায় নিয়ে আসা হয়। সেখানে বাঙালি হিন্দু বিবাহ রীতি মেনে শিব ও মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার বিয়ে দেওয়া হয়। সাতপাকে ঘোরা থেকে শুরু করে মালা বদল জলসাজ সবই হয়। এর পর আতশবাজির বাজির পোড়ানো হয়।
চৈতন্যদেবের জন্মস্থান হলেও নবদ্বীপে শিবের উপাসনা প্রাক্ চৈতন্য যুগের। একমাত্র বৈষ্ণব প্রভাবিত কিছু কিছু অঞ্চলের কথা বাদ দিলে বাঙালি সমাজ এবং সংস্কৃতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুরুষ দেবতা হলেন শিব।তাছাড়া বৈষ্ণব মতে শিব হলেন পরম বৈষ্ণব।তবে নবদ্বীপের শিব উপাসনার পিছনে হয়তো বৌদ্ধ প্রভাব থাকতে পারে। তাই চৈতন্যধাম জুড়ে রয়েছে বহু শিব মন্দির। নবদ্বীপের চার দিকে রয়েছেন চার শিব। উত্তরে যুগনাথ বা যোগনাথ, দক্ষিণে আলোকনাথ, পুবে হংসবাহন এবং পশ্চিমে বুড়োশিব। তাছাড়া বালকনাথ, বাণেশ্বর, দণ্ডপাণি ও পলেশ্বর।নবদ্বীপে যে শিবের গাজন হয়, পণ্ডিতদের মতে তা গাজন আসলে বৌদ্ধদের ধর্মগর্জন থেকে এসেছে। নবদ্বীপ এক সময়ে বৌদ্ধ প্রভাবিত অঞ্চল ছিল।  সেন রাজবংশের সময় থেকেই নবদ্বীপে তন্ত্রের প্রভাব বাড়তে শুরু করে। সেই সময়ে তন্ত্র বা শক্তি সাধনার অঙ্গ হিসাবে ভৈরবী এবং ভৈরব বা শিবের আরাধনা শুরু হয়। বৌদ্ধ মূর্তিগুলিতে চোখ মুখ একে  শিবে রূপ দেওয়া হয়।
🙏বাঁকুড়ার ঘোড়ার সম্পর্কে কিছু তথ্য জানতে এই linkটা দেখতে পারেন 🙏
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=4087420051274256&id=249406185075681

No comments:

Post a Comment