Friday, 8 December 2023

গণপুর গ্রাম রামেশ্বর শিব মন্দির

গণপুর গ্রাম রামেশ্বর শিব মন্দির কমপ্লেক্স কথা জানান কি আপনি?

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বীরভূম জেলার সিউড়ি সদর মহকুমা মহম্মদ বাজার সি ডি ব্লকের একটি পুরানো গ্রাম গণপুর ।

গণপুর গ্রাম রামেশ্বর শিব মন্দির কমপ্লেক্স কথা অনেকটাই প্রচারে আড়ালে। বীরভূমের সিউড়ি রামপুরহাট রাস্তার ধারে গণপুর পৌঁছে যেতে পারেন আপনি। চারিদিকে শাল জঙ্গলে ঘেরা গণপুর। ডেভিড জে ম্যাককাশন তাঁর Temples of Bengal, (1972), বই লিখেছেন গণপুরে অনেকগুলি ছোট ছোট চার চালা মন্দির আছে ।যেগুলি ইঁটের তৈরি এবং তাদের সম্মুখভাগ সমৃদ্ধভাবে খোদাই করা ভাস্কর্যে। তিনি ১৭৬৯ সাল নাগাদ প্রতিষ্ঠিত একটি বিষ্ণু মন্দিরেরও উল্লেখ করেছেন ।এটি মণ্ডল পরিবারের দ্বারা নির্মিত একটি আট চালা মন্দির, এবং ইঁট দিয়ে নির্মিত।

কয়েকটি পাথর দ্বারা নির্মিত মন্দির ছাড়া বীরভূম জেলার অধিকাংশ মন্দিরই ইট দ্বারা নির্মিত। যে ঐতিহাসিক পটভূমিকায় এই সমস্ত মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় সেইসময় এইগুলির নির্মাণে আশানুরূপ অর্থ সাহায্য রাজকোষ থেকে পাওয়া যায়নি। সাধারণ জমির অধিকারী, পণ্ডিত, ব্যবসায়ীদের দ্বারা অধিকাংশ মন্দিরই প্রতিষ্ঠিত হয়।

আগে বীরভূম ছিলো নানা শিল্পে উন্নত। গণপুর, মল্লারপুর, মহম্মদবাজার, এইসব এলাকা লোহা নিষ্কাশনের জন্য বিখ্যাত ছিলো। সেই সুবাদে তখন থেকেই গণপুর একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম।

সেকালে দেশীয় প্রক্রিয়ায় আকরিক লোহা থেকে লোহা নিষ্কাশনের কেন্দ্র ছিল বীরভূম ।এই গ্রামের চৌধুরী বংশ লোহার কারবার করেই বিত্তশালী হয়েছিল। তাঁদের প্রাচুর্যের প্রমাণ গণপুর গ্রামে অবস্থিত ১৪ টি চারচালা মন্দির। একটি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা আয়তকার জমির মধ্যে তিন দিকে অবস্থিত ও সামান্য উঁচু ভিত্তিবেদির উপর স্থাপিত চারচালা ১৪ টি শিব মন্দিরের। মন্দিরগুলির ৭টি পশ্চিমমুখী ৪টি পূর্বমুখী এবং ৩টি দক্ষিণমুখী । ১৭৬৭ সাল নাগাদ বীরভূমে দারুণ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। লোহার ব্যবসা করে যথেষ্ট চৌধুরী পরিবার তখন বড়োলোক হয়ে ওঠেছিল। গ্রামের প্রজাদের খাদ্য বা অর্থের বিনিময়ে চৌধুরীরা এই মন্দিরগুলি নির্মাণ শুরু করেন। ১৭৭৯ সালে এই নির্মাণ শেষ হয়।

তবে গ্রামে। অন্যান্য পারিবারের বানানো কিছু মন্দিরও গ্রামে আছে। এখানে একটি একচালা শিব মন্দির আছে, যার দরজা শুধু শিবরাত্রির সময় খোলা হয়। গ্রামের একটা পুকুরে ডোবানো রাখা থাকে শিবলিঙ্গটি। শিবরাত্রির সময় দুদিনই শিবলিঙ্গ মন্দিরে আসে।

Saturday, 28 October 2023

লক্ষ্মীর বাহন কি শুধু মাত্র পেঁচা?

বাংলার সব পূজা উৎসবে কিছু ব্যাতিক্রম ঘটনা দেখা যায়।

যেমন রামকানালী, গঙ্গাজলঘাটিতে লক্ষী পূজাতে পূজা হয় গজলক্ষ্মীর। তবে এই পুজোর প্রচলন হয়েছিল প্রায় ১৪০ বছর আগে। তখন বাঁকুড়ার বেশ কিছু জায়গায় হাতি আক্রমণ করত প্রায়শই, প্রচুর শস্যহানি হতো। তখন তাই গ্রামবাসীরা গজলক্ষ্মীর পূজা করে। এখানে লক্ষ্মীর বাহন রূপে পেঁচা নয় হাতিকে রেখে পুজো করেন। সকলের কাছে তাই তিনি গজলক্ষ্মী।


এদিকে হিন্দু পৌরাণিক গল্প, গজলক্ষ্মী সমুদ্র মন্থনের সময় আবির্ভূত হয়েছিলেন । তিনি ইন্দ্রের হারানো সম্পদ এবং ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেছিলেন। তিনি দেবীর রূপ যিনি পশু সম্পদ এবং সম্পদের অন্যান্য প্রতীক যা শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে।
তবে সেক্ষেত্রে কিন্তু মূর্তি ফারাক আছে।
দেবীর পায়ের কাছে দুটি সিংহ আছে, আবার দুটি হাতি তাকে জীবনদানকারী জল দিয়ে স্নান করাছে এবং তার বাম এবং ডান পাশে দুটি মহিলা পরিচারক চামর ধরে আছে।

তবে গুপ্ত রাজা বৈষ্ণব ছিলেন এবং দেবী লক্ষ্মীকে সর্বোচ্চ সম্মান করতেন।তাদের শাসনামলে বেশিরভাগ মুদ্রায় দেবী লক্ষ্মী সিংহবাহিনী হিসাবে দেখা যায়।গুপ্ত শাসক প্রকাশ দিয়ার শাসনামলের মুদ্রায় গরুড়ধ্বজা এবং উল্টোদিকে লক্ষ্মী রয়েছে

Friday, 27 October 2023

কলিকাতার গয়না বাড়ি

কোলকাতার গহনা বাড়ি চেনেন??

বামাচরণ ভড় ঠাকুরবাড়ি গয়না বাড়ি হিসেবে পরিচিত।উত্তর কলকাতার নীলমণি সরকার লেনে বামাচরণ ভড়ের বসতবাড়িকে ব্রজকিশোর ঠাকুরবাড়ি বলে চেনে । সরু গলি, বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই, কী অপূর্ব স্থাপত্য কারুকার্য অপেক্ষা করছে এই বাড়ির ভেতরে।


ইংরেজ আমলে বামাচরণ ভড় এক সফল ব্যবসায়ী। বামাচরণের জন্ম ১৮৫১ সালে। তিনি কলকাতার বাসিন্দা ছিলেন না। ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতা তখন উদীয়মান নগরী, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের পীঠস্থান হয়ে যখন ওঠেছে। তখন এ শহরে বামাচরণ এসে ছিলেন এক ভাগ্যান্বেষী হিসেবে। দরিদ্র পরিবারের সন্তান, পেটের দায়ে এসেছিলেন কোলকাতায়। কলকাতায়, আর দশজন শ্রমিকের মতো তিনি কাজ শুরু করেছিলেন।

কলকাতায় এসে প্রথমে বামাচরণ এক পোশাক তৈরির কারখানায় শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন । এই সংস্থা মূলত ইওরোপীয় পোশাক তৈরি করত। অসম্ভব বুদ্ধিমান ও পরিশ্রমী বামাচরণ ছিলেন। তিনি ব্যবসার যাবতীয় বিষয় করায়ত্ত করলেন। পরে তিনি কলকাতার এক পোশাক প্রস্তুতকারক ইংরেজ কোম্পানির অংশীদার হয়ে বসলেন। আর এই কোম্পানীর মালিক বিলেতে ফিরে গেলেন, পুরো ব্যবসা মালিক হয়ে বসেন বামাচরণ।

দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে ইংরেজদের বোয়েরের প্রথম যুদ্ধ চলেছিল,২০শে ডিসেম্বর ১৮৮০ থেকে ২৩শে মার্চ ১৮৮১ পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় যুদ্ধ চলেছিল,১১ই অক্টোবর ১৮৯৯ থেকে ৩১শে মে ১৯০২ পর্যন্ত।এই যুদ্ধে জড়িয়ে গেল এক বাঙালির ব্যবসায়ী বামাচরণ ভড় নাম।বোয়েরের যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী ইংরেজ সৈন্যদের সামরিক পোশাক সাপ্লাই করেছিলেন তিনি।

তৎকালীন ঔপনিবেশিক কলকাতায় মতিলাল শীল,গোকুল মিত্র, নরসিংহ দাঁ-এর মতো কৃতি বাঙালি ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছিলেন,বামাচরণ ভড়। তিনি সামরিক পোশাকের ব্যাবসা নাম,যশ,খ্যাতি করেছিলেন।ব্যাবসা যখন মধ্যগগনে, বামাচরণ ভড় তার নীলমনি সরকার লেনের বসতবাড়িতে স্থাপন করলেন গৃহদেবতা রাধা মাধবের মন্দির। তাঁর মতে কৃপায় আজ এই তার এই বিশাল প্রতিপত্তি,তাঁকে তিনি কিভাবে অস্বীকার করেন।


যাইহোক ১৮৬৫ সালে তৈরি লাল ইটের বাড়িটি দোতলা। তৎকালীন প্রচলিত জমিদার রীতিতে ইট, কড়িবরগা, চুন-সুরকি নির্মিত বাড়িটি দেড়শ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় অবিকল।

দেড়শো বছর অতিক্রান্ত লাল রঙা বাড়িটার ভিতরে প্রবেশ করলেই বিস্মিত হতে হয় আজকে ও।বাইরে থেকে বিশেষত্বহীন বহিরঙ্গের বাড়িটির অন্দরের শোভা বর্ধন করেছে গথিক আর মুঘল স্থাপত্যরীতির সংমিশ্রণে তৈরি একাধিক আর্চ। বিম আর কলাম ধরে রেখেছে বাহারি পেনডেন্টিভ। খড়খড়িযুক্ত বারান্দা, তাতে লোহার রেলিং আর মাথায় আর্চ ছাদের পাঁচিলের কারুকার্যও অনবদ্য। ছাদের আর্চগুলিতে দেখা যায় আংটায় আটকানো পর্দার ঝালরের প্যাটার্ন। প্রাচীনত্বের স্পর্শ এখনো ধরে রেখেছে কাঠের রেলিং-যুক্ত মার্বেল পাথরের সিঁড়ি।।এক অসাধারণ স্থাপনা মুগ্ধ হতে বাধ্য করবে সবাইকে ।
এই বাড়ির বাহারি নাম গয়নাবাড়ি।সেই কোন কালে হয়তো বাড়ির দেওয়ালে,খোদিত নক্সার প্রাচুর্যতার কারণেই এহেন নাম ভালোবেসে রেখেছিল মানুষরা ।লোকমুখে গয়না বাড়ি নামটি পরিচিত হয় পরে।


অষ্টনায়িকা_দুর্গা"।

"অষ্টনায়িকা_দুর্গা"।

বাঁকুড়া জেলার অযোধ্যা গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত
আমরাল গ্রামের পদ্মাসনা চতুর্ভূজা দেবী দুর্গা অষ্টসখীর সাথে বাপের বাড়ি আসেন,কোনো সন্তানকেই  তিনি আনেন না। গ্রামের গোস্বামী পরিবার এই কুমারী দুর্গার পুজো শুরু করেন বহু বছর আগে।

অষ্টনায়িকা_দুর্গা  পদ্মের উপরে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য  কমলেকামিনী দুর্গা  নামে পরিচিত। 
পুজোর সময় কামান দাগা হয়। এখানে মা দুর্গা অসুরকে বধ করছেন না।

বিষ্ণুপুর থেকে দ্বারিকা-জয়কৃষ্ণপুরের রাস্তা ধরে পৌঁছে যাওয়া যায় এই গ্রামে ।
স্থান - আমরাল,বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া।

মা তাঁরা আবির্ভাব তিথি।।

শুক্লা চতুর্দশী তিথি মা তাঁরার আবির্ভাব তিথি। এইদিন মা ভক্তদের পুজো গ্রহণ করেন, তারাপীঠ মন্দিরের গর্ভগৃহের বাইরে এসে  ।এই তিথিতে তারা মা কে মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে বাইরে বের করে এনে মন্দির প্রবেশপথ সংলগ্ন “ বিরাম মঞ্চে বসানো হয়। এবং তাঁর ছোট বোন মলুটির মা মৌলিক্ষার মন্দির অভিমুখে পশ্চিম দিকে  মুখ করে বসিয়ে পুজো করা হয় ।  
লোক কথা অনুযায়ী মলুটি গ্রামের মা মৌলিক্ষা তারা মায়ের ছোট বোন । এই দিন দুই বোনে মুখ দেখাদেখি হয়। লোক কাহিনী অনুযায়ী এইদিন মা নাটোর খান , আর নানকার এর দিকে চান । অর্থাৎ মা তারা নাটোরের রাণীর তৈরী মন্দিরে বসে সারা বছর ভোগ গ্রহণ করেন । আর বছরের এই একটি দিন নানকার রাজপাটে অবস্থিত মৌলিক্ষা মন্দিরের দিকে চেয়ে থাকেন ।
লোকবিশ্বাস অনুযায়ী পাল রাজত্বের সময়ে জয়দত্ত সওদাগর মায়ের আদেশে দ্বারকা নদের ধারে মহাশশ্মানের শ্বেতশিমূল গাছের তলায় পঞ্চমুন্ডির আসনের নিচে মা তারার শিলামূর্তি উদ্ধার করে প্রতিষ্ঠা করেন এই ্শু্ক্লা চতুর্দশী তিথিতে।
এইদিন  ভক্তরা বিরাম মঞ্চে তারাকে শুধু স্পর্শ নয় একেবারে জড়িয়ে ধরে মনোবাঞ্ছা নিবেদন করতে পারে । বিরাম মঞ্চে কোন কবাট দেওয়া দরজা নেই ।চার দিকে খিলানের গাঁথনি । যে কেউ যখন খুশি যতবার ইচ্ছে তারা মাকে ছুঁতে পারে । এইদিন ভোরে সেবায়েতরা তারামাকে  চান করিয়ে  আরতি করে, গর্ভগৃহ থেকে  মাকে এনে বারান্দা সংলগ্ন  বিরাম মঞ্চে পশ্চিম দিকে মুখ করে স্থাপন করেন । মন্দিরের গর্ভ গৃহে মা তারা সারা বছর উত্তর মুখী হয়ে বিরাজ করেন । এদিন তারা মায়ের গর্ভগৃহ শুন্য থাকে । শুন্য বেদীর নিচে  মায়ের রূপোর চরণ দুটি  দর্শন করা যায় – যা অন্য সময়ে চোখের আড়ালে থাকে  ।মায়ের আবির্ভাব তিথিতে মায়ের কোন অন্ন ভোগ হয় না । মায়ের ছোট বোন মৌলিক্ষারও এই দিন অন্ন ভোগ হয় না । দুপুরে লুচি সুজি ও মিষ্টান্ন ভোগ নিবেদন করা হয় ।
 মায়ের পশ্চিম মুখী অবস্থান করার নিয়ে আরো একটি লোক কাহিনী প্রচলিত আছে।১১০৮ সালে বা ১৭০১ খ্রিস্টাব্দে মা তারার আবির্ভাব তিথিতে তান্ত্রিকেরা মায়ের পুজোর আয়োজন করছিলেন । এদিকে সেই সময়েই মলুটির নানকার রাজা রাখরচন্দ্র মায়ের সামনে বসে আরাধনা করছিলেন । তান্ত্রিকেরা রাখরচন্দ্রের পুজো বন্ধ করে দেয় । রাজা  মনের দুঃখে দ্বারকা নদীর পশ্চিমপাড়ে ঘট স্থাপন করে, মায়ের পুজো করে নিজের গ্রামে ফিরে যান ।রাতে তান্ত্রিকদের প্রধান আনন্দনাথকে মা স্বপ্নে জানান যে ,তাঁর ভক্ত রাখরচন্দ্র অভিমান করে ফিরে গেছেন । তাই প্রতি বছর আবির্ভাব তিথিতে মাকে যেন পশ্চিম দিকে মুখ করে বসিয়ে পুজার্চনা করা হয় । সেই থেকে এই শুক্লা চতুর্দশীর আবির্ভাব তিথিতে মা তারা সারা দিন পশ্চিম মুখী অবস্থান করে।
🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺

Thursday, 27 July 2023

অষ্টক গান

অষ্টক গান সম্পর্ক জানেন কি? লোক সংস্কৃতি এই ধারা কি সত্যি লুপ্তপ্রায়??

নীল ষষ্ঠী' বা নীল পুজো' বাংলার হিন্দুসমাজের
এক লৌকিক উৎসব, যেখানে শিবের বিয়ে দেওয়া হয়। চৈত্রসংক্রান্তির
চড়ক উৎসবের আগের দিন অনুষ্ঠিত হয় নীল ষষ্ঠী পুজো।
মহাদেব শিবের এক নীলকণ্ঠ । সেই নীল
বা শিবের সঙ্গে চণ্ডিকা
বিয়ে উপলক্ষ্যে লৌকিক আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয় এই পূজায়। পৌরাণিক কাহিনি অনুসায়ী দক্ষযজ্ঞে সতীর দেহত্যাগের পর সতী পুনরায় নীলধ্বজ রাজার বিল্ববনে সুন্দরী কন্যারূপে আবির্ভূত হন। রাজা তাঁকে নিজ
কন্যারূপে লালন-পালন করে শিবের সঙ্গে বিয়ে দেন। নীলপূজা শিব ও নীলাবতীরই বিবাহ-অনুষ্ঠানের
স্মারক।
নীল পুজোতে শিবকে নিয়ে ,নীলসন্ন্যাসীরা ও শিব-দুর্গার সঙেরা গান করতে করতে বাড়ি বাড়ি ঘােরান এবং ভিক্ষা সংগ্রহ করেন। এ সময় তাদের মুখে শােনা যায় যে বিশেষ ধরনের গান
তা ‘নীলের গান' বলেই লোক মুখে পরিচিত। তবে এই নীলের গান হল-অষ্টক গান'।


চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন সারাদিন উপােস করে সন্তানবতী হিন্দু মেয়েরা । বিকেলে তারা শিবের মাথায় জল ঢালেন । নীলের ব্রত’ শুনে সন্তানের
কল্যাণার্থে প্রদীপ জ্বালিয়ে শিবপুজো করে
উপবাস ভাঙ্গে তারা। তবে নিম বা বেল কাঠ দিয়
শিবের মূর্তি তৈরি হয়। চৈত্র সংক্রান্তির বেশ আগেই
নীল বা শিবকে মণ্ডপ থেকে নীচে নামানাে হয়। নীলপূজার আগের দিন অধিবাস; গভীর রাতে হয় হাজরা পূজা।হাজরা পূজায় শিবের চেলা বা ভূত-প্রেতের দেবতাকে পােড়া শােল মাছের ভােগ দেওয়া হয়। বিয়ে উপলক্ষে সকল দেবতাকে আমন্ত্রণ করা হয়।পরেরদিন
নীলপূজার সময় শিবকে গঙ্গাজলে স্নান করিয়ে নতুন
লালশালু কাপড় পরিয়ে অন্ততপক্ষে সাতটি বাড়িতে ঘােরাতে হয়।নীলসন্ন্যাসীরাও লাল কাপড় পরে পাগড়ি
মাথায়, গলায় রুদ্রাক্ষমালা ও হাতে ত্রিশূল নিয়ে
শিবের সঙ্গে করে এই মিছিল করে। এই মিছিলের
দলপতিকে ' নীল পাগোল' বা "বালা" বলা হয়। এদের সাথে থাকে ঢাক-ঢোল, বাঁশী বাজনদারের দল । সঙেরা শিব-দুর্গার সাজে । মহিলারা ঘরের উঠানে আল্পনা দিয়ে নীলকে আহ্বান করে বরাসনে বসিয়ে তার মাথায় তেলসিঁদুর পরিয়ে দেন। এরপর নীলের গান শুরু হয়:

যেমন
"শুন সবে মন দিয়ে হইবে শিবের বিয়ে
কৈলাসেতে হবে অধিবাস।
(ও) তাতে নারদ করে আনাগোনা কৈলাসে বিয়ার ঘটনা
বাজে কাঁসী বাঁশী, মোহন বাঁশরী।"
"(ও) নারদ চলল গিরি রাজের গৃহেতে।
আর একদিনেতে শূলপাণি, নারদকে বলেন বাণী
শুনো নারদ শুনো আমার সাধ,
আমি দুই পাশে দুই বালিশ দিয়ে, মধ্যিখানে থাকি শুয়ে
উশিপুসি করে কাটাই রাত।।
(ও) নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।
আর ওই শিব কয় কৈলাসে যেয়ে, দেখে এসেছি মেয়ে
শীঘ্র করো বিয়ের আয়োজন,
(ও) নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।
চলিলেন নারদ মুনি, চলিলেন নারদ ধনি
উপনীত গিরি পুরে যেয়ে।
কইলেন মেনকা রানী, আইলেন নারদ মুনি
দেখা পেয়ে এল মুনির ঠাঁই।।
(ও) নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।
শোনো ওগো গিরি রাজা, হইবা আমার আজা
জামাই তোমার হবে দিগম্বর।।"
বিয়ের ঘটক ভাগিনেয় নারদ মুনির কাছে শিব আর্তি জানান,
"ভাইগনা যদি উপকারী হও।
তবে বিয়া দিয়া আমার প্রাণ বাঁচাও।।"
বিয়ের পর নীলের গানে থাকে সংসারী হর-পার্বতীর কথা, শিবের কৃষিকাজ, গৌরীর শাঁখা পরা প্রভৃতি এবং ভিখারি শিবের সঙ্গে অন্নপূর্ণা শিবানীর দ্বান্দ্বিক সহাবস্থানের কাহিনি। গানের প্রথম অংশ দলপতি বালারা এবং পরবর্তী অংশ অন্য নীলসন্ন্যাসীরা গেয়ে থাকেন।
গানের শেষে সন্ন্যাসীদের চাল-পয়সা, ফল প্রভৃতি ভিক্ষা দিয়ে থাকেন বাড়ির মেয়েরা।।


বাংলার লোক সংস্কৃতির জনপ্রিয় এই অষ্টক গান হারিয়ে যাচ্ছে । না হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্রত গুলো সাথে এই সংস্কৃতি হয়তো এখন গুরুত্ব হারিয়েছে কিন্তু এখনো হারিয়ে যায় নি। একে সঠিক লালন পালন করার প্রয়োজন।


অষ্টক গান মূলত গ্রাম বাংলাতে চৈত্র সংক্রান্তি ও গাজনের সময় বিশেষ করে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এমনটা কি? মূলত নৃত্য ও গীত এর মাধ্যমে রচিত হয় অষ্টক গানে অনেক সময় ভগবান শ্রী কৃষ্ণ ও রাধারাণীর লীলা তুলে ধরা হয়।শিল্পীরা কেউ শ্রীকৃষ্ণ, রাধারানী,নিমাই, অষ্টসখী, মাতা যশোদা,সেজে তাদের নৃত্য ও গীতের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেন অষ্টক গান।
এই অষ্টক গানে নৌকাবিলাস, নিমাই সন্ন্যাস, কৃষ্ণ বেহুলা লখিন্দর ইত্যাদি পালা গুলি দেখানো হয় নৃত গীত সহকারে।
অষ্টক গীত শব্দটা এসেছে বোধহয় শ্রী কৃষ্ণের অষ্টপ্রহর এর লীলা থেকে । অথবা প্রতি দলে আট জন মিলে নৃত্য গীত করে বলে। কিংবা শ্রী কৃষ্ণে অষ্ট সখী নিয়ে লীলা করতেন সেই অনুযায়ী এই নৃত গীত পালা অষ্টক গান বলা হয়।
অষ্টক গান লোকসংস্কৃতি অঙ্গ তাই নৃত খুব সাদামাটা জৌলুস বিহীন । কিন্তু খুব আবেগপ্রবণ, মন মুগ্ধকর যা হৃদয় স্পর্শ করে যায়।অষ্টক গীত নৃত্যে ঢোল, করতাল, ঘুঙুর, হারমোনিয়াম,বাঁশি, ইত্যাদি ব্যাবহৃত হয়।

Wednesday, 26 July 2023

সাত ভাই কালি মন্দির।।

বনগাঁর সাত ভাই কালি মন্দির কেন বিখ্যাত??

উত্তর চব্বিশ পরগনায় বনগাঁর ইচ্ছামতি নদীর তীরে মনোরম পরিবেশে,বিরাট বট গাছের তলায় রাস্তার ধারে সাত ভাই কালী মন্দির অবস্থিত । এখানে মা প্রায় শত বছর ধরে পূজিত । মা এখানে খুব জাগ্রত। মায়ের কাছে এসে প্রার্থনা আর মনস্কামনা পূর্ণ হয় । পৌষ মাসের প্রতি শনি ও মঙ্গলবার সাত ভাই কালীমন্দিরে ধুমধাম করে বিশেষ পুজো হয় । পুজো উপলক্ষে এখানে মেলার আয়োজন হয় । এখানে প্রাচীন বটগাছে ভক্তরা লাল সুতো বাঁধে । কথিত আছে রেলওয়ে পথ তৈরি সময় গাছটি কাঁটার নির্দেশ এলেও গাছটি কাটাতে পারিনি কেউ।

লোক কথা অনুযায়ী, যশোরে একজমিদার বাড়িতে কালীচরণ, কালীপ্রসাদ, কালীকিংকর, কালীপ্রসন্ন-সহ মোট সাত ভাই ডাকাতি করতে গিয়েছিলো৷ সেই সময় নাকি মা কালীর তাদের জিজ্ঞাসা করে ধনসম্পদ সাথে তাঁকে নিয়ে যাচ্ছে না কেন? তারপর দেবীর নির্দেশ মতোই তারা মাকেও নিয়ে চলে আসে । শ্মশানের পাশে ইছামতীর পাড়ে বটগাছের তলায় কালী মূর্তিকে প্রতিষ্ঠা করে। এবং দেবীর নির্দেশে কৃষ্ণনগর থেকে চক্রবর্তী বামুনদের নিয়ে আসে নিত্য সেবার জন্য ৷ এক পৌষ মাসের রাত দেবীকে প্রতিষ্ঠা করা হয়।সেই অনুযায়ী আজও প্রতি বছর পৌষ মাসের শনি ও মঙ্গলবার সাতভাই কালীতলায় জাঁকজমক করে পুজো হয় ৷

Monday, 26 June 2023

পুরীর মহাপ্রসাদ

পুরী জগন্নাথ মন্দিরে প্রসাদকে মহাপ্রসাদ বলা হয় কেন?

বিভিন্ন পুরাণ যেমন পদ্মপুরাণ, স্কন্দ পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণে জগন্নাথের প্রসাদ বা জগন্নাথের ভোগ এর অপরিসীম মাহাত্ম্য কথা বলা হয়েছে।

ভগবান জগন্নাথ, দাদা বলরাম ও দেবী সুভদ্রা এই তিন মূর্তি দর্শন করলে এবং মহাপ্রসাদ গ্রহণ করলে আমাদের কলুষিত মন কলুষমুক্ত হয় আর আমাদের মনে ভক্তি ভাবের উদয় হয়।

আর এই ভক্তি থেকেই আসে প্রকৃত জ্ঞান। প্রকৃত জ্ঞান থেকেই আসে মুক্তি। তাই মুক্তি পেতে অবশ্যই ভক্তিভরে গ্রহণ করুন পুরীর জগন্নাথের প্রসাদ।

নিজের প্রসাদ সম্পর্কে প্রভু জগন্নাথ কি বলেছেন

এমনকি জগন্নাথ নিজে বলছেন যদি আমার নিবেদিত অন্ন কুকুরের মুখ থেকে পড়ে যায় এবং সেই অন্ন যদি ব্রহ্মাদি দেবগণ সৌভাগ্যবশত লাভ করেন তাহলে তাঁরা সেই অন্ন অনায়াসে ভক্ষণ করতে পারেন। কারণ এর মহত্ত্ব কখনো নষ্ট হয়না।

তাহলে কিএর মাহাত্ম্য কি কোনদিন বা কোনভাবে নষ্ট হয়?

না হয় না।

এই মহাপ্রসাদ শুকিয়ে যাক বা পর্য্যুষিত মানে বাসি হোক অথবা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া হোক বা অস্পৃশ্য জাতির স্পর্শ পেয়ে এই মহাপ্রসাদের মাহাত্ম্য নষ্ট হয় না।

প্রচলিত এক গল্প অনুযায়ী,একবার এক শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ব্রাহ্মণ এসেছিলেন পুরীর ধামে। তিনি জগন্নাথ দর্শন করলেন, কিন্তু জগন্নাথ দেবের মহাপ্রসাদ তিনি গ্রহণ করলেন না। ব্রাহ্মণের তাত্ত্বিক বিচার তাঁকে প্রসাদ গ্রহণে বাধা দিল।
যাইহোক পরে তাঁর কুষ্ঠ হল। তিনি মনে মনে ভাবলেন জ্ঞানত তিনি কোন পাপ করেন নাই তাহলে কি কারণে কুষ্ঠ হল ? অনেক ভেবে তিনি বুঝলেন তিনি জগন্নাথের মহাপ্রসাদ কে অস্বীকার করেছেন বলে তাঁর কুষ্ঠ হয়েছে।

তিনি পরে জগন্নাথের প্রসাদ গ্রহণ করলেন এবং তাঁর কুষ্ঠ রোগ সেরে গেল।

বিষ্ণুপুরাণে এবং স্কন্দপুরাণে ব্ৰহ্মা নারদের কথপোকথনে বলা হয়েছে। জগদীশ্বর বিষ্ণুকে একবার কোন অন্ন বা পানীয় নিবেদন করা হলে, সেই অন্ন এবং পানীয় সাক্ষাৎ নির্বিকার ব্রহ্মস্বরূপ বস্তুতে পরিণত হয়ে যায়। সেই জন্য বিষ্ণুর মহাপ্রসাদের নিয়ে ভক্ষ্যাভক্ষ্য বিচার করতে হয় না।
ব্রাহ্মণদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেদের জাতির শ্রেষ্ঠ বলে মনে মনে গর্ববোধ করে এবং কখনও কখনও প্রসাদ গ্রহণ করার আগে বিচার করেন। যদি এমন বিচার মনের মধ্যে উপস্থিত হয় তাহলে তাঁরা কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হন এবং দারাপুত্র রহিত অর্থাৎ নির্বংশ হয়ে নরকে যান। তাঁরা এমন নরকে গমন করেন যেখান থেকে তাঁদের আর উদ্ধারের কোনো উপায় থাকে না।

পদ্মপুরান অনুযায়ী লক্ষীদেবী স্বয়ং রান্না করেন ভগবান বিষ্ণুর জন্য তাই অন্ন খুব পবিত্র এবং দেবতাদেরও দুর্লভ।
বিষ্ণুপুরাণে পরিষ্কারভাবে বলা আছে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের ভোগ এর অন্ন যতক্ষণ পর্যন্ত জগন্নাথ দেবকে পরিবেশন না করা হয় তার আগে পর্যন্ত এটি মহাপ্রসাদ হয় না। নিবেদন করার পর এটি মহাপ্রসাদ হয় ।

জগন্নাথের প্রসাদের কোন সংস্পৃষ্ট দোষ নেই। একবার প্রসাদ গ্রহণ করলেই সমস্ত পাপ তৎক্ষণাৎ দূর হয়ে যায়।

বিষ্ণুপুরাণে এবং স্কন্দপুরাণে বলা আছে।অতিপাপ, মহাপাপ সমস্ত পাপ জগন্নাথ দেবের অন্নগ্রহণ করলে তৎক্ষণাৎ শেষ হয়ে যায়।

প্রভু জগন্নাথ দেবের নৈবেদ্য ভক্ষণে মহাপাতক নাশ হয় আর এই মহাপ্রসাদ গ্রহন এক কোটি গোদান এর পুণ্যফলের সমান ।
গরুড় পুরাণে স্পষ্ট বলা হয়েছে মহাপ্রসাদ গ্রহণের কোন নিয়ম নেই। একাদশী, আমাবস্যা,চান্দ্রায়ণ ব্রতেরও কোন নিয়ম কাল নিয়ম এখানে প্রভাব খাটাইতে পারে না।

যাঁরা মোক্ষলাভ করতে চান তাঁরা মহাপ্রসাদ পাওয়ামাত্রই কোন রকম বিচার না করে তৎক্ষণাৎ ভক্ষণ করে নেবেন।

Monday, 19 June 2023

চৈতন্য মহাপ্রভু প্রভাবে বাংলার জগন্নাথ

চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রভাবে বাংলার জগন্নাথ কি আলাদা হয়ে গেছেন পুরীর জগন্নাথদেবের থেকে??

বাংলার রথ উৎসব খুব খুব জনপ্রিয়।বাঙালির কাছে কেন এই ভুভারতে জগন্নাথ দেব এতো জনপ্রিয় হয়েছেন কারণ বোধহয় শ্রীচৈতন্যদেব।বাংলার জগন্নাথ সংস্কৃতির প্রাণ পুরুষ। যদিও চৈতন্যদেবের আগেই মাহেশে জগন্নাথ ছিলেন।কিন্তু বাঙালির নিজস্ব জগন্নাথ গড়ে উঠেছে শ্রীচৈতন্যদেবের প্রভাবে। তাঁর প্রভাবে লোকবিশ্বাস অনুসারে বীরভূম একচক্রে গ্রামে গড়ে উঠেছে পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দির ও। এছাড়া সারা বাংলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে জগন্নাথে মন্দির এবং রথ উৎসব। কিন্তু বাংলার জগন্নাথ রূপ কিছুটা পাল্টে গেছে , কোথায় কোথায় তাঁর আছে হাত সাথে আছে দিঘল চোখ।পূর্ব বর্ধমান জেলার আউরিয়া গ্ৰামের প্রতিষ্ঠিত হাত সহ আছে জগন্নাথ।

বাংলার সংস্কৃতি বাংলার দারুবিগ্ৰহ আলোচনা করলে দেখা যাবে জগন্নাথ দেবের আর তার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের।বাংলাতেও অনেক জায়গায় জগন্নাথ ও লক্ষ্মী দেবীকে নিয়ে রথযাত্রায় অনুষ্ঠান হয়। সুবর্ণ বণিক পরিবারে , বৌবাজার অঞ্চলে রথ যাত্রায় জগন্নাথ ও লক্ষ্মী একসাথে দেখা যায়। আবার রামকানাই অধিকারী পরিবারের জগন্নাথ দেবের পাশে আছেন ধাতুর লক্ষ্মী। যদিও সুবর্ণ বণিকদের পরিবারের পুরোহিত ছিলেন এরা। সুবর্ণবণিকদের প্রভাবেই জগন্নাথ দেবের পাশে লক্ষ্মীর বিগ্ৰহ তাঁরা প্রতিষ্ঠা করেন। আবার ময়দা জগন্নাথ দেব একা।বৈষ্ণব পরিবারে একক দধিবামন রূপেই জগন্নাথ বেশী পূজিত।

চুঁচড়ার বড়ো রথবাড়ির জগন্নাথ দেব আর শ্রীরামপুরের পাঁচু বাবুর বাজারের জগন্নাথ ত্রয়ী।কুলীন গ্ৰামের সত্যরাজ খান বা লক্ষ্মীকান্ত বসু প্রতিষ্ঠিত আবার জগন্নাথ ত্রয়ী।এই খানে বলরামের গোঁফের রেখা আছে।

গড়িয়া রথবাড়ি পরিবারের স্বপ্নাদিষ্ট জগন্নাথ দেব নীলচে সবুজ । বাংলার নোয়াখালির থেকে আসেন এই পরিবার । নোয়াখালির সবাই রামচন্দ্রের মতো জগন্নাথ দেবকে মনে করে নীলচে সবুজ রঙের করেন।চোখ দুটি টানা টানা।সবসময় উনি নীলমাধব বলেই যে নীল তা নয়।বাংলার রথ উৎসব খুব খুব জনপ্রিয়।বাঙালির কাছে কেন এই ভুভারতে জগন্নাথ দেব এতো জনপ্রিয় হয়েছেন কারণ বোধহয় শ্রীচৈতন্যদেব।বাংলার জগন্নাথ সংস্কৃতির প্রাণ পুরুষ। কিন্তু বাঙালির নিজস্ব জগন্নাথ গড়ে উঠেছে শ্রীচৈতন্যদেবের প্রভাবে। তাঁর প্রভাবে লোকবিশ্বাস অনুসারে বীরভূম একচক্রে গ্রামে গড়ে উঠেছে পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দির ও। এছাড়া সারা বাংলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে জগন্নাথে মন্দির এবং রথ উৎসব। কিন্তু বাংলার জগন্নাথ রূপ কিছুটা পাল্টে গেছে , কোথায় কোথায় তাঁর আছে হাত সাথে আছে দিঘল চোখ।বাংলার সংস্কৃতি বাংলার দারুবিগ্ৰহ আলোচনা করলে দেখা যাবে জগন্নাথ দেবের আর তার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের।

বাংলাতেও অনেক জায়গায় জগন্নাথ ও লক্ষ্মী দেবীকে নিয়ে রথযাত্রায় অনুষ্ঠান হয়। সুবর্ণ বণিক পরিবারে , বৌবাজার অঞ্চলে রথ যাত্রায় জগন্নাথ ও লক্ষ্মী একসাথে দেখা যায়। আবার রামকানাই অধিকারী পরিবারের জগন্নাথ দেবের পাশে আছেন ধাতুর লক্ষ্মী। যদিও সুবর্ণ বণিকদের পরিবারের পুরোহিত ছিলেন এরা। সুবর্ণবণিকদের প্রভাবেই জগন্নাথ দেবের পাশে লক্ষ্মীর বিগ্ৰহ তাঁরা প্রতিষ্ঠা করেন। আবার ময়দা জগন্নাথ দেবেএকা।

গড়িয়া রথবাড়ি পরিবারের স্বপ্নাদিষ্ট জগন্নাথ দেব নীলচে সবুজ । বাংলার নোয়াখালির থেকে আসেন এই পরিবার । নোয়াখালির সবাই রামচন্দ্রের মতো জগন্নাথ দেবকে মনে করে নীলচে সবুজ রঙের করেন।চোখ দুটি টানা টানা। উনি নীলমাধব বলে উনার রঙ হয়তো নীল। তবে জগন্নাথ রূপ বৈচিত্র্য বাংলার জগন্নাথকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনার বিষয় বস্তু করে তুলেছে।

ছবি - সুশ্যামল ঘোষ, নিজস্ব, কিছু সংগৃহীত

Sunday, 18 June 2023

অম্ববাচী কি ? কামাখ্যার ইতিহাস

মা কামাখ্যা দেবীর ইতিহাস কি....????

অম্ববাচী মেলা কেন পালন করা হয়.......????

যদি না জানেন তো জেনে নিন...পুরান মতে-স্বামীর অপমান সইতে না পেরে সতী দেহত্যাগ করলেন। প্রিয় স্ত্রীকে হারিয়ে, তাঁর দেহ নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য করলেন মহাদেব। চারিদিক তখন তোলপাড়। শিবের নৃত্যে সব ভেঙে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। এই জগতকে রক্ষা করতে দেবতাদের অনুরোধে ভগবান বিষ্ণু ভগবান শিবের ক্রোধ দমন করার পন্থা বেছে নেন। বিষ্ণুর চক্রে সতীর দেহ খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায়। ৫১টি জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে শরীরের এক একটি অঙ্গ। যা আজ ৫১টি পীঠস্থান। কামাখ্যা মন্দির সেই ৫১টি পীঠস্থানের একটি। সেখানে নাকি ছিটকে পড়েছিল সতীর যৌনাঙ্গ। তাই সেখানে দেবীর মূর্তি পুজিত হয় না।অসমের কামাখ্যা মন্দির, ধার্মিক কারণে তো বটেই, সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণেও জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। প্রত্যেক বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ ভিড় করে এই মন্দিরে। বিশেষকরে অম্বুবাচী মেলার সময় ভিড় হয় চোখে পড়ার মতো। সেই সময় পুজিত ভূগর্ভস্থ এলাকা লাল হয়ে থাকে। মন্দিরের নালা দিয়ে বেয়ে যায় লাল জল। এই ঘটনাকে মায়ের ঋতুস্রাব বলে অনেকেই মনে করেন। এই সময় নাকি দেবী ঋতুমতী হন। তিনদিন ধরে এমনটা চলতে থাকে। মন্দিরের মূল কক্ষে তখন কারও প্রবেশে অনুমতি থাকে না। মা নাকি এই সময় কারোর সঙ্গে দেখা করেন না, এমনটাই বিশ্বাস অনেকের। এসবকেই মায়ের লীলা বলে মনে করা হয়। যদিও বিজ্ঞান অন্য কথা বলছে। ওই এলাকায় আয়রন অক্সাইডের প্রভাবের কারণেই ভূগর্ভস্থ এলাকা লাল হয়ে থাকে।মাটি থেকে ৮০০ মিটার উঁচুতে রয়েছে এই মন্দিরটি। নিলাচল পর্বতের পশ্চিমাংশে গুয়াহাটি শহরে এই মন্দিরটি। এই মন্দিরটির প্রতিষ্ঠা নিয়ে জড়িয়ে রয়েছে নানা ইতিহাস। ইতিহাস বলছে ১১০০ খ্রিষ্টাব্দে এই মন্দিরটির প্রতিষ্ঠা হয়। পাল বংশের রাজারাই নাকি ছিলেন কামাখ্যা মায়ের আদি ভক্ত। পরবর্তীকালে পালবংশের রাজত্ব শেষ হওয়ার পর মন্দিরটিরও বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কথা শোনা যায়। কামরূপের শাসন ভার আসে কোচবিহারের রাজ পরিবারের হাতে। বিশ্বসিংহ নামে কোচ বংশীয় রাজা পুনরায় ওই মন্দিরটির পুনর্নিমাণ করেন। এমনই বহু ইতিহাস রয়েছে এই মন্দিরের স্থাপত্যকে ঘিরে।এই মন্দিরে রয়েছে চারটি কক্ষ। একটি গর্ভগৃহ ও তিনটিমন্দির। গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে সরু সিঁড়ি দিয়ে কক্ষের নীচে নেমে যেতে হয়। পৌরাণিক কাহিনি আজও মানুষকে ডেকে আনে এই মন্দিরের দর্শন করতে....

"

"অম্বুবাচী " শব্দটি ভাঙলে অর্থ দাঁড়ায় জল বৃদ্ধি " অম্বু" বা জল আর "বাচী" মানে বৃদ্ধি ৷ একে বলে " রজোযুকক্ষ্মাম্বুবাচীয ৷ অম্বুবাচীর আগের দিনকে বলে " অম্বুবাচী প্রবৃত্তি " আর তিন দিন পরে হয় "অম্বুবাচী নিবৃত্তি " ৷অম্বুবাচী সমাপ্ত থেকে বীজবপন ও ধান্যরোপন করা হয় ৷ আমরা পৃথিবীকে মাতৃসমা দেবী মনে করি ৷ দক্ষিণায়নের দিন থেকে তিনদিন সূর্য যে বারের যে সময়ে মিথুন রাশিতে গমন করে পরবর্তী সময়টিতে হয় অম্বুবাচী ৷ সময়কালে ধরিত্রী মা ঋতুমতী হন ৷অর্থাৎ মনে করা হয় গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহের পর বর্ষার আগমনে একজন মহিলার মত এই সময় ভূদেবী বা ধরিত্রী মা বা পৃথিবী রজঃস্বলা হন ৷ কামাখ্যা মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে একরকম লাল রংয়ের তরল ( ভক্তরা একে বলে মায়ের রজঃস্রাবের রক্ত ) বের হয় ৷ মন্দিরে চলতে থাকে কীর্তন ৷ মন্দিরের দরজা বন্ধ থাকে ৷বিভিন্ন মন্দির ও গৃহদেবীর প্রতিমা ঢেকে রাখা হয় ৷" আষাঢ়ে প্রথমে দেবী অম্বুবাচী দিনত্রয়ং ৷ সংগোপনে গৃহে দেবিং স্থাপয়েদ্বস্তু বেষ্টনে "৷ বাহিরে প্রদীপ ও ধূপ জ্বালিয়ে মাকে প্রণাম করা হয় ৷ চতুর্থ দিন দেবীর স্নান ও পূজা সম্পন্ন হলে ভক্তরা মন্দিরে ঢুকে মাতৃদর্শনের অনুমতি পায় ৷ অম্বুবাচীর দিন গুলিতে সব দেবীর পূজা বন্ধ থাকে ৷তবে , নারায়ণ , কৃষ্ণ , শিবের মত দেব পূজা করা যায় ৷ ঐসময় ভূমি কর্ষণ , বীজ বপন , পিতৃ -তর্পণ , ঢাক -ঢোল বাজানো , , ঘন্টা কাঁসরের আওয়াজ , গৃহ প্রবেশ , গৃহারম্ভ , ক্ষৌরকর্ম করা যায় না ৷ জপ - ধ্যান , হরিনাম করতে হয় ৷

এ সময় সাধু -সন্ন্যাসী , বিধবা মহিলারা এই তিনদিন গরম খাবার খান না ৷ আগে রান্না করা খাবার বা ফল মূল খান ৷ তিনদিন পরে জামাকাপড় , বিছানা ধুয়ে নিজেরা সাবান শ্যাম্পু মেখে স্নান করে সবকিছুতে হাত দেন ৷ পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে জগন্নাথের পাশে ভূদেবীর মূর্তি রয়েছে ৷ সেখানে অম্বুবাচীর প্রথম দিনটি "পহিলি রজো" এবং তৃতীয় দিন "ভূ-দহ" বা বাসি রজো হিসাবে পালিত হয় ৷ অম্বুবাচীর পর পৃথিবী হলকর্ষণের উপযোগী হয়ে ওঠে ৷ মাটি হয়ে ওঠে উর্বর ৷ ধরিত্রী হয়ে ওঠে শস্য শ্যামলা ৷

"

৫১ টি সতীপীঠের অন্যতম এখানে মাতৃ যোনি

পরায় পাহাড়টি নীল রংয়ের হয়ে যায় ৷ নাম হয় নীলকন্ঠ বা নীলাচল পর্বত ৷ একে তাই বলে সৃষ্টি তীর্থ ৷ অসমের গুয়াহাটি শহর সংলগ্ন ৷একে বলা হয় " তীর্থ চূড়ামনি "৷ প্রাচীন কাল থেকে একে জাদু টোনা , তন্ত্র মন্ত্রের

জায়গা বলা হয় ৷ এখানে নাকি ভূত , পেত্নি , ডাকিনী ও যোগিনীদের রাজত্ব ৷ পুরুষদের নাকি এখানকার নারীরা "ভেড়া " করে দেয় ৷ আসলে তন্ত্র সম্বন্ধে না জানার ফল এগুলো ৷ মা ,কৃপাময়ী ৷

কামাখ্যা মন্দিরের মূল উৎসব " অম্বুবাচী" বা অমাবতী ৷ বাংলা প্রবাদ " কিসের বার কিসের তিথি , আষাঢ়ের সাত তারিখ অম্বুবাচী" ৷হিন্দু বিশ্বাস এই সময় পৃথিবী ঋতুমতী হন ৷

পালিত হয় " অম্বুবাচী" উৎসব ৷ ওড়িশাতে একে বলে রজঃউৎসব ৷ এই সময় বিধবা মহিলা ও ব্রতীরা গরম খাবার খান না ৷ব্রত পালন করেন ৷ হল কর্ষন , গৃহ

প্রবেশ , ও বিবাহ বন্ধ থাকে ৷ সব মন্দিরের প্রবেশ দ্বার বন্ধ রাখা হয় ৷ শুধুমাত্র শ্রীকৃষ্ণের নিত্যসেবা যে কোন নারী রজঃস্বলা অবস্থায় বা অশৌচ অবস্থায় যেমন করতে পারেন । কামরূপ কামাখ্যা মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে

লাল রংয়ের তরল ( ভক্তদের মতে মায়ের রজস্রাব) বের হয় ৷ সারা ভারতবর্ষ থেকে লাখ লাখ ভক্ত এই সময় কামাখ্যা মন্দিরে উপস্থিত ৷ নাম গানে কীর্তনে এলাকা মুখর হয়ে ওঠে ৷ পান্ডারা ভক্তদের ওই রক্তভেজা কাপড়ের টুকরো দেন ৷যা পুরুষেরা ডান হাতে বা গলায় এবং মহিলারা বাঁ হাতে বা গলায় মাদুলি করে পরেন ৷ মনে করা হয়

মায়ের আর্শীবাদে এতে দুঃখ বিপদ দূর হয় ৷ এই রক্তবস্ত্র পরিধান করে শ্মশানে ও মৃতের ঘরে যেতে নেই ৷

কামদেবতাএখানে কামাখ্যা মন্দির স্থাপন করেন বলে নাম

"কামরূপ কামাখ্যা "৷স্বপ্ন পেয়ে কোচবিহারের রাজা বিশ্ব সিংহ প্রতি ইটে এক রতি করে সোনা দিয়ে সপ্ত রথ আকৃতির মৌচাকের আদলে তৈরী মন্দিরটি তৈরী করেন ৷সাতটি গম্বুজে রয়েছে তিনটি সোনার কলসী ৷মন্দিরের চারটি কক্ষ -গুহ্য গৃহ এবং চলন্ত , পঞ্চরত্ন ও নাটমন্দির নামের তিনটি মন্ডপ ৷ কালাপাহাড় মন্দিরের ক্ষতি করলে রাজা নরনারায়ণ তা পুনর্নিমাণ করেন ৷মন্দির চত্বরে আছেন দশ মহাবিদ্যা ও তাঁদের ভৈরব ৷ কামাখ্যার ভৈরব উমানন্দ আছেন সামনে দ্বীপে ৷ সবচেয়ে বড় উৎসব হয় "অম্বুবাচীতে" ৷ এসে গেল সেই অম্বুবাচীর দিনগুলো ৷আষাঢ় মাসের ঐ দিনগুলিতে মা স্বয়ং ঋতুমতী হন ৷ পাথরের গায়ে লাল জল দেখা যায় ৷ আর ঐ ভেজা কাপড়ের টুকরোকে ভাবা হয় খুব পবিত্র ৷অম্বুবাচীতে দর্শন বন্ধ থাকে ৷ ১৫ বছরে একবার মায়ের মুখ দেখা যায় ৷ বশীকরণ , বাণ মারার বুজরুকি করে জগৎজননী মাকে সন্তানদের থেকে দূরে রাখা বা ভয় পাওয়ানো অহেতুক ৷ তাই গিয়েছি গৌহাটি শহর থেকে চল্লিশ কিমি দূরে মায়াং গ্রামে ৷ চারটি আদিশক্তি ও ১৮- টি মহাশক্তি পীঠের অন্যতম ৷

জয় মা কামাখ্যা

জয়শ্রী কামেশ্বর

জয়শ্রী উমানন্দ ভৈরব

জয় ব্রহ্মপুত্র নদ,,,,

(মঙ্গলময় শুভ অম্ববাচী আগামী 22/6/2023বৃহস্পতিবার রাত্রী ২:৩২ থেকে শুরু,

ইঃ 26/6/2023 সোমবার বেলা,২:৫৬ সমাপ্ত। ,)

Friday, 16 June 2023

বিষ সংক্রান্তি

বিষ সংক্রান্তি কি জানেন??

#বিষসংক্রান্তি

জৈষ্ঠ মাসের শেষ দিন বিষ সংক্রান্তি নামে পরিচিত । বাংলা জৈষ্ঠ্য মাসের শেষ দিনটি হল জৈষ্ঠ্য সংক্রান্তি বা বিষ সংক্রান্তি বা এড়িবেড়ি ।এদিনে সর্পের দেবী মা মনসার পূজা উদ্দেশ্যে কিছু নিয়ম পালন করা হয়। নিরামিষ, তেতো ও কষা দ্রব্য খাওয়া হয়।সকালে ঘুম থেকে উঠেই , মুখ হাত পরিস্কার করে,দাঁত মেজে, একটি পাত্রে মুসুর ডাল, নিম পাতা, কেলে কাঁকড়া নামক ফল রাখা হয়। সকালে স্নানের পর সকলে ওগুলি সামান্য খেয়ে তারপর অন্য কিছু খেতে হয় ।দুপুরে ভাতের সাথে কেলে কাঁকড়ার ভাজা, করলা , নিম পাতার অথবা কোন তেঁতো সব্জির ভাজা, মুসুরের ডাল, মুসুরডালের বড়ার বিভিন্ন পদ, সজনে শাক ইত্যাদি পদ রান্না করতে হয় । এদিনে আমিষ দ্রব্য, পেঁয়াজ, রসুন, ঢ্যাঁড়স মতো সব্জি খাওয়া নিষিদ্ধ।এই নিয়ম পালনের পিছনে বৈজ্ঞানিক যুক্তিও আছে। আষাঢ় মাস হতে শুরু হয় বর্ষাকাল। বর্ষায় বিভিন্ন চর্মরোগ হয়। আর এই চর্মরোগ হতে বাঁচতে তেঁতো ও কষা সব্জি খাবার নিয়ম আয়ুর্বেদে অনুযায়ী। তাছাড়াও নিম-কেলে কাঁকড়ার মতো গাছের থেকে বিষ প্রভাবও কাটে। 1885 সালের 13ই জুন ( ৩২শে জৈষ্ঠ্য, ১২৯২ ) অর্থাৎ এই বিষ সংক্রান্তি দিনেই শ্রী ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের গলার অসুখের সূত্রপাত হয়।

এই দিন কিছু বাড়িতে মা মনসার পাঁচটি শাখা বিশিষ্ট ডাল পোঁতা হয়। শ্রাবণ মাসের শেষ অবধি প্রতি নাগ পঞ্চমী তে মা মনসার পূজো হয়।ভাসান হয় দুর্গা পূজোর দশমীর দিন । এইদিন সূর্য ওঠার আগে সারা ঘরে গোবরের বেড়ি দেওয়া হয় ।যাতে বিষধর সাপ ঘরে না ঢুকতে পারে তাই ঘর বন্ধন করা হয়।

Wednesday, 14 June 2023

গুড়শুটি মেলা

গুড়শুটি মেলা কোথায় হয় জানেন???

মেদিনীপুর গুড়সুটি মেলার খুব বিখ্যাত তবে সময় মাত্র কয়েক ঘন্টা।গুড়সুটির পসরা সাজিয়ে একদল বিক্রেতা হাজির হন এই মেলায় ।আসলে মেলায় ঘুরতে আসা শয়ে শয়ে ক্রেতা গুড়সুটি কেনে।

গুড় মাখানো কাঠিগজা - যাকে সবাই 'গুড়সুটি' বলে ডাকেন, তা এই মেলায় প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হয়। সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত গুড়সুটি কেনার জন্য লোকালয়ের মধ্যের এই ছোট্ট মেলায় ভীষণ ভিড় লেগে থাকে। এই জন্য সকলে এই মেলাকে 'গুড়সুটির মেলা' বলে চেনেন ও ডাকেন। দোলের দ্বিতীয় দিন শুধু মাত্র গুড়সুটির কারণে শহরের তো বটেই শহরের বাইরের দূর দূরান্ত থেকে লোকে এখানে হাজির হন সানন্দে। সবার হাতে ঝুলতে থাকে ব্যাগ। তাতে ভর্তি গুড়সুটি।

এক একজন তো এক দেড় কেজিও কেনেন। মেদিনীপুর শহরের পাটনাবাজার এলাকার সাহেবপুকুর চকে ঠিক দোল পূর্ণিমার দ্বিতীয় দিন এই মেলা বসে। । মেদিনীপুরে আসলে দু'দিন দোল খেলা হয়। আর সেই দ্বিতীয় দোলের দিনে বিকেল হলেই এই মেলা বসে। এই মেলাটি শুরু করেছিলেন সাহেব পুকুর চক এলাকার তৎকালীন বাসিন্দা এক অতি বৃদ্ধা উজ্জ্বলা সাহু। তাঁর পায়ের সমস্যার জন্য লোকে তাঁকে 'নেংড়ি বুড়ি' বলে ডাকতো। জীবনের শেষ বেলায় পৌঁছে তাঁর একমাত্র অবলম্বন ছোট্ট নাড়ুগোপালের জন্য দোলের সময় বিশেষ পুজো করতে গিয়ে এই মেলাটি বসিয়েছিলেন। অনেকে তাই এটিকে "নেংড়ি বুড়ির দোল" বলেও ডাকেন। কালক্রমে মেলাটি জনসাধারণেরস্থানীয়রা জানাচ্ছেন, বহু বছর ধরেই এই মেলা চলছে। আনুমানিক দুশবছর হবে এই মেলার বয়স।

তবে মেলায় আরো একটা আকর্ষণ আছে। পতিঙ্গা নামের খেলনা পাওয়া যায় এখানে।বাঁশের বাখরি চেঁছে এই খেলনাটি তৈরী করা হয়। 'পতঙ্গ' শব্দটি থেকে এসেছে 'পতিঙ্গা'। আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিলে ঘুরতে ঘুরতে মাটিতে নেমে আসে। ছোটদের অন্যতম পছন্দের এই খেলনাটি এই মেলাতেই পাওয়া যায় ।

বর্তমানে এই মেলাতে গুড়সুটির পাশাপাশি গুড় মাখানো ছোলা, মালপোয়া, মুগের জিলিপি এমনকি তেলেভাজা, পাঁপড়ভাজা, বারোভাজাও বিক্রি পাওয়া যায়। নানান মানুষের কলরবের সাথে সাথে সন্ধ্যায় দেবতার নামগানে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা মেলা।

Saturday, 27 May 2023

বাদাই গান

বাদাই গান শুনেছেন কখনো??

বাদাই গান সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রথমেই বলতে হয়।'বাদাই‘ শব্দটি এসেছে, বিবরণ বা বাদ–বিতণ্ডা। ব্যুৎপত্তিগত অর্থ[বি+ষ(সৎ)। আসলে বাদাই গানের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়।শ্রীকৃষ্ণের জন্মকাহিনি এবং মহাভারত থেকে বিভিন্ন কটূ প্রশ্ন এক পক্ষ গানের মাধ্যমে অন্যপক্ষে করে।অন্যপক্ষ সেই প্রশ্নের জবাব দিয়ে আবার নতুন প্রশ্নের করে।এভাবেই লড়াই চলতে থাকে যতক্ষণ না একপক্ষ হার স্বীকার করছে।

প্রাচীন লোকগানগুলির মধ্যে বাদাই গান অন্যতম । শ্রীকৃষ্ণের জন্ম কাহিনী নিয়ে বাদাই গান রচিত হত শুরুতে । এই গানের আসর বসত মূলত গ্রামের নাট মন্দিরে,বারোয়ারি তলায় বা কোনও অভিজাত গৃহস্থের বাড়ির উঠনে । আবার বিভিন্ন সাজে সজ্জিত হয়ে অভিনয়ের করে গান গেয়ে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়াতো শিল্পীরা।সাথে বাদ্যযন্ত্র হিসাবে থাকতো ঢোল,কাঁসি,বাঁশি,বাঁশরী, খঞ্জনি, নুপূর প্রভৃতি । কীর্তনের সুরে বাদাই গান গাওয়া হলেও পরবর্তী সময়ে টপ্পা, ঝুমুর, গাজনের সুরের গান গাইতে শুরু করেন শিল্পী রা । সময়ের সাথে সাথে বাদাই গানের ভাষা ও সুরে লাগে আধুনিকতার ছোঁওয়া লেগেছিল । তাই গানের উপস্থাপনা একই থাকলেও ভাষায় ধর্মীয় কাহিনীর পাশাপাশি জায়গা নিয়েছিল লোকশিক্ষা,সমাজচিত্র । বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এই বাদাই গান।

এই বাংলার বর্ধমান, হাওড়া প্রভৃতি জেলার গ্রামগুলিতে এই গানের জনপ্রিয় ছিল খুব একটা সময় । ধান রোয়া বা বোনার কাজ শেষ হলেই, গ্রামে শুরু হত বাদাই গান । তবে জন্মাষ্টমীর সময় থেকেই বাদাই গানের আসর চলতো বেশি বেশি । তবে জন্মাষ্টমী ছাড়াও বিভিন্ন পালা,পার্বনে এই গানের চল ছিল । একসময় হাওড়ার পানপুরের ঘোষ পরিবারের শ্যামসুন্দর জিউ এবং দত্ত পরিবারের রঘুনাথ জিউ–এর মন্দির প্রাঙ্গণে জন্মাষ্টমীর পরের দিন মেলা সহযোগে বাদাই গানের আসর বসে। সেটা বেশ জনপ্রিয় ছিলো। শ্রীকৃষ্ণের জন্মবৃত্তান্তমূলক ‘বাদাই গান‘-এ গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব সুস্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়।‘বাদাই গানে‘ কৃষ্ণজন্মকথা কীর্তনাঙ্গ সংকীর্তনে গ্রাম প্রদক্ষিণ করার প্রথা ছিল।কিন্তু আজ গ্রাম বাংলা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে প্রাচীন এই লোকসংগীত ।তবে ব্যতিক্রম শুধু পূর্ব বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বর থানার পিপলন গ্রাম । অর্দ্ধ শতাব্দী ধরে বাদাই গানকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর পিপলন গ্রামে উৎসব পালিত হয়ে আসছে এখনো।