Tuesday, 30 November 2021

দারু বিগ্রহ

সোমা মুখোপাধ্যায় যিনি বাংলার নানা ঐতিহাসিক ঐতিহ্য এর কথা তাঁর লেখা গ্রন্থের মাধ্যমে তুলে ধরেন তাঁর একটি পোস্ট দেখে , আমার এই লেখাটা লেখার  ইচ্ছে হলো। যদিও সায়ন রায়ের তৈরি তথ্য চিত্র গুলো য় অনেক গুলো দারুন বিগ্রহের কথা আমরা জানতে পারি। তার মধ্যে  ফরতাবাদ এর কাঠের কালি বিশেষ উল্লেখযোগ্য কারণ এই মন্দিরের পথ খুঁজে পাওয়া ই অনেক টা কঠীন কাজ অন্তত কোলকাতায় থাকাকালীন দুইবার তিনবার চেষ্টা করে আমি ব্যার্থ হয়েছিলাম, এবং তারাপদ সাঁতারার‌ লেখায় যদিও বহু দারু বিগ্রহের কথা আমরা জানতে পারি। শালকিয়ায় রমণী মোহন চ্যাটার্জীর বাড়িতে এক দারুময়ী জগদ্ধাত্রী আছেন তার রূপ সত্যি অসাধারণ। সোমা দেবীর কথা অনুযায়ী  রমণী বাবু একজন উদ্যোগপতি ছিলেন।তাঁর কাস্ট আয়রণের ব্যবসা ছিল।   হুগলির সঙ্গে হাওড়ার যোগসূত্রের কারণে বিগ্ৰহে তার অনেক প্রভাব আছে।
আমি আমার বিভিন্ন লেখায় তিনটি চারটি দারু বিগ্রহের কথা আপনাদের বলেছিলাম। বারুইপুর অঞ্চলের রামনগর থানার আদি মহামায়া, গড়িয়ার মহামায়া, বোড়ালের ত্রিপুরার সুন্দরী  , বনহুগলির চক্রবর্তী দের জগন্নাথ দেব কথা।  দারুন বিগ্রহ আসলে কি? সাদামাটা ভাষায় বললে কাঠের মূর্তি। কাঠের মূর্তি মানেই মনে পরে জগন্নাথের কথা, জগন্নাথের মূর্তি সাধারণত কাঠে তৈরি করা হয়। জগন্নাথকে মূলত আদিবাসী দেবতা মনে করেন। ওড়িশার আদিম আদিবাসী সরভরা ছিল বৃক্ষ-উপাসক। তারা তাদের দেবতাকে বলত "জগনাত"। সম্ভবত, এই শব্দটি থেকে "জগন্নাথ" শব্দটি এসেছে। নিম গাছের কাঠ দিয়ে জগন্নাথদেবের প্রধাণ বিগ্রহটি(জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা) নির্মিত। এই মূর্তির চোখদুটি বড়ো বড়ো ও গোলাকার। হাত অসম্পূর্ণ। মূর্তিতে কোনো পা দেখা যায় না। যদিও বিগ্রহে অসম্পূর্ণ হাত ও পায়ের অনুপস্থিতি নিয়ে নানা ধরনের মতবাদ এবং পবিত্র বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার কাঠের মূর্তি গুলো আসলে চৈতন্য মহাপ্রভুর দ্বারা প্রভাবিত। আপনারা সকলেই জানে বর্তমান দক্ষিণ কলকাতার কালিঘাট, কুঁদঘাট , গড়িয়া অঞ্চলের উপর দিয়ে বেয়ে গেছে টালির নালা, তাই আসলে আদি গঙ্গা। বানিজ্য এর স্বার্থে টলি সাহেব এই গঙ্গার সংঙ্কার করে বলে এরনাম টালির নালা। কুঁদঘাঘাট আসলে কুঁত - ঘাট , কুঁত আসলে আজকের দিনে র টোল ট্যাক্সের মতো জলপথ ব্যবহার কর আদায়ের স্থান।
এই আদি গঙ্গা পথ ধরে গড়িয়া , বারাইপুর, জয় নগর, ছত্র ভোগ হয়ে চৈতন্য মহাপ্রভু পুরি গিয়েছিলেন। তাই এই অঞ্চলে বৈষ্ণব ঘাটা, কীর্তনখোলা মতো জনপদের নাম শোনা যায়। এবং মন্দির গুলোতে বৈষ্ণব প্রভাবে কাঠের মূর্তি দেখা যায়। আমি যতোদূর জানি মহামায়া ও বৈষ্ণব প্রভাবিত দেবী।
কিন্তু অবাক লাগলো শালকিয়ায় কাঠের জগদ্ধাত্রী মূর্তি দেখে। সালকিয়া হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হাওড়া শহরের একটি অঞ্চল। এই জন পদের পুরাতন নাম ছিলো শালিখাঁ , ১৯শ শতক থেকে জনবসতিপূর্ণ হতে শুরু করে হুগলি নদীর তীরে মালি পাঁচঘড়া ও ঘুষুড়ি অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত এই অঞ্চল। বাংলায় জগদ্ধাত্রী পূজা বিখ্যাত চন্দন নগরে। অর্থনৈতিক কারণে এটি ঘটেছিলো। দূর্গা পূজার সময় এরা ব্যাস্ত থাকতো। তাই জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন করে এই বনিক মহল। তবে শালকিয়়াার সীতা রাম ঘোষ লেন এই বিগ্রহের বয়স একশ বছরের পুরনো নয়।
 আমার প্রশ্ন হলো বাংলায় কাঠের মূর্তি তৈরি হয়েছিল , সম্ভবতঃ পাথর ও ধাতুর বিকল্প হিসেবে মূর্তি র স্থায়ীত্ব বাড়ানোর জন্য । কিন্তু ঠিক পাঁচশত বছর পূর্বে চালু হলো কেন এই কাঠের মূর্তি  তৈরি ?
কারণ আমার চোখে দেখা প্রাচীন কাঠের মূর্তি বোধহয় চৈতন্য মহাপ্রভুর মূর্তি।চৈতন্যদেব ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তিন বছর পরে, ১৫১৩ সালে নির্মিত হয় ওই মূর্তি। বলা হয়, যে নিম গাছের তলায় তাঁর জন্ম হয়েছিল, সেই গাছের কাঠ দিয়েই তৈরি হয়েছিল চৈতন্যদেবের দারু বিগ্রহটি।
অন্যটিও নদীয়ার চাকদহ যশরায় চৈতন্যদেবের অন্তরঙ্গ পার্ষদ জগদীশ পণ্ডিত প্রতিষ্ঠিত প্রায় পাঁচশ বৎসরের সুভদ্রা বলরাম বিহীন দারু নির্মিত জগন্নাথ বিগ্রহ যদিও খুব বিখ্যাত। জগন্নাথ নামের অর্থ চলমান। কিন্তু ইনি রথে চড়েন না। এ নিয়ে একদিন গল্প হবে নাড়ায়।
আমার এক কবি বন্ধু বলেছিলো। কাঠের মূর্তি তৈরি সাথে অর্থনীতি অবস্থার একটা যোগাযোগ আছে। কাঠ সহজ লভ্য বলেই কাঠের মূর্তি তৈরি করা হতো বাংলায়।সে চৈতন্য মহাপ্রভু কে দেবতা অবতার হিসাবে দেখেনি কখনো। সে সমাজ সংস্কারক হিসেবে দেখতো। তিনি ব্রাম্ভণদের জাতপাত বিরুদ্ধে, পূজা র নামে সম্পদ বৃদ্ধির বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ ছিলেন। নদীয়ার চাকদহ যশরায় জগন্নাথ গল্প দেখুন, পান্ডাদের অত্যাচারে জগন্নাথ ছাড়লেন পুরীর মন্দির। আবার নগর কীর্তন শাসকদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ এক প্রচেষ্টা যা রাষ্ট্রের কাছে , নিজের ধর্ম পালনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। তবে বাংলা বৈষ্ণব রা দেবদেবীকে ঘরে সাধারণ সদস্যদের মতো ধরে নিয়ে ছিলো। গোপাল কখনো তাদের সন্তান, কৃষ্ণ তাদের সংখ্যা। ঘর সংসার সব কিছু এদের ঈশ্বরকে নিয়ে। এদিকে বৃন্দাবন অঞ্চলে এই সময়ে মন্দির গুলো ভাঙা পরেছে শাসকদের দ্বারা। সেই শাসকদের হাতে তখন বাংলার শাসন। ধর্মীয় দিক থেকে তাঁরা মূর্তি পূজা বিরোধী। তাই এই কাঠের মূর্তি যা নিয়ে সহজেই প্রদান পরিবর্তন করা যায়। এই মতকে আমি সমর্থন করি না, তবে যদি এটা সত্য হয়ে থাকে তবে বলতে হয়। তবে বলতে হবে ভয় ও সভ্যতাকে সুন্দর নিদর্শন গরতে সাহায্য করেছে। আর শিল্প মন কখনো হয়তো সামাজিক ঘটনায় অতটা প্রভাবিত হয়না, তাই তাঁরা অনেক দিন বেঁচে থাকে তাদের শিল্প কলার মধ্যে দিয়ে।

Monday, 29 November 2021

চীনা মাটির পুতুল

পরিব্রাজক গবেষক সায়ন রায়ের সংগ্রহ এর চীনা মাটির প্রদীপ, রুই মাছ দেখে মনে পরে গেলো , বাংলায় একসময় চীনামাটির পুতুল  তৈরি হতো খুব। পুতুল আসলে কি পরিস্কার করে বলে নেওয়া উচিত।পুতুল কখনও মানুষের চেহারার কাছাকাছি আবার কখন কোনো পশুর চেহারার অনুকরণে হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে বৃহত্তর দৃষ্টিতে মাটি, কাঠ, মোম, প্লাস্টিকের বানানো পশুপাখি থেকে ফল, গাছ সব কিছুকেই পুতুলের শ্রেণিভুক্ত করা যায়। 
এবার চীনা মাটির পুতুল এর কথা য় আসা যাক। চীনা মাটির নাম থেকে ই বোধহয় বুঝতে পরেন এটি বাংলার মাটি নয়। চীনামাটির সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয়।চীনারা সর্বপ্রথম মাটি দিয়ে পাত্র তৈরি করে।  এটি একটি সাদা মাটি  আর এ কারণেই এ মাটিকে চীনামাটি নামে নামকরণ করা হয়। তবে ক্যাওলিং টিলা থেকে সংগ্রহ করার জন্য কোথাও কোথাও এটি ক্যাওলিন বলা হয় । চীনামাটি হচ্ছে বিশেষ ধরনের মাটি, যা বিভিন্ন দ্রব্য তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়। এই মাটিতে আছে ৪৬ শতাংশ বালু, ৪০ শতাংশ অ্যালুমিনা ও ১৪ শতাংশ জল থেকে।
উচ্চ তাপে আগুনে পোড়ালে চীনামাটি সাদা, মসৃণ ও চকচকে হয়। এ বৈশিষ্ট্যের জন্যই এ মাটি দিয়ে কাপ, প্লেট, বাটি ইত্যাদি তৈরি করা হয়।
এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং দক্ষিণ আমেরিকার খনি থেকে প্রচুর পরিমাণে চীনামাটি সংগ্রহ করা হয়। পশ্চিম ইংল্যান্ডে কর্নওয়ালে ও পশ্চিম ডেভনে চীনামাটির পলি তলানি পাওয়া যায়। এ জন্য এসব এলাকায় নানা ধরনের মৃৎশিল্প গড়ে উঠেছে। মৃৎশিল্প বা মাটির তৈরি শিল্পের পাশাপাশি চীনামাটি কাগজ, রাবার, রঙ, প্রসাধনসামগ্রী ইত্যাদি তৈরিতেও ব্যবহার করা যায়।
তবে এই মাটির ও একটা ইতিহাস আছে। মনে হয় সুকুমার রায়ের কোন প্রবন্ধে পড়ে ছিলাম।দশ হাজার বৎসর আগে মিশরে  মাটির বাসন তৈরি হত, তাহ্ সুন্দর সুন্দর দেখতে ছিলো। বাসনগুলি সমস্তই হাতে গড়া, কারণ, কুমারের চাকে মাটি গড়িবার কায়দা সে সময়ে   জানা ছিল না। কিন্তু এ কাজে তাহাদের হাত এমন সাফাই ছিল যে, বড় বড় জালার মতো পাত্রগুলির গড়নেও কোথাও খুঁত ধরিবার যো ছিলো। বড় বড় জাহাজী নৌকা করিয়া এক সকল বাসন দেশ-বিদেশে রপ্তানি ও হতো । বাসনগুলির উপর চকচকে কালো পালিশ থাকিত, তার গায়ে সাদা রঙের কারুকার্য করা থাকতো।

মাটির বাসন নানারকমের। আমাদের দেশে সাধারণ 'মেটে বাসন' যা অল্প আঁচে পুড়িয়ে তৈরি হতো। গেলাস, ভাঁড়, সরা, মালসা  আরম্ভ করে কুঁজা, জালা পর্যন্ত ভারতবর্ষের প্রায় সর্বত্রই পাওয়া যায় এখনো। কিন্তু 'সাধারণ মাটির' জিনিসও যে কত সুন্দর হইতে পারে, তাই নিয়ে ই আমাদের চর্চা।

আর একরকম মাটির জিনিস হয় ভারতে, তাহাকে পাথুরে মাটি বলা যায়। এগুলোকে কড়া আগুনে পোড়ালে পাথরের মতো মজবুত হয় এবং তাহাকে অসংখ্য প্রকার দরকারী কাজে লাগান যায়। বাড়ি বানাইবার টালি, ড্রেনের পাইপ, নানারূপ খেলনা প্রভৃতি কত জিনিস তৈয়ারি হয়। তাহাতে আবার নানারকম রং দেওয়া ও ইচ্ছামত পালিশ ধরান চলে।

সাদা মাটির বাসন কথায় আসি এবার চীনে মাটির বাসন এক সময়ে কেবল চীন দেশেই ত পাওয়া যেতো। প্রায় সাত শত বৎসর আগে মুসলমান সম্রাট সালাদিনের কাছে চীন সম্রাট কতগুলো উপহার পাঠিয়েছিলেন, তাহার মধ্যে কতগুলা চীনা মাটির বাসন ছিল। তেমন বাসন কেউ চোখে দেখেননি। পাতলা ঝিনুকের মতো স্বচ্ছ, ডিমের খোলার মতো হালকা, সে আশ্চর্য বাসনের কথা চারিদিকে রটে গেল।

গ্রীস প্রভৃতি দেশে এক সময়ে অতি সুন্দর মাটির ঘড়া ও ফুলদানি তৈয়ারি হইত কিন্তু গ্রীক ও রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংস হইবার পর এই শিল্প নষ্ট হইয়া যায়। এই সময় আবার দক্ষিণ ইউরোপে, বিশেষত ইটালিতে নানারূপ শিল্পের বাসন তৈরি আগ্রহ দেখা দিতে থাকলো। তখনও তাহারা চীনা মাটি গড়িতে পারে নি কিন্তু মাটির উপর সাদা পালিশ চড়াইয়া তাহার চমৎকার নকল করেছিলেন। বহুদিন পর্যন্ত এই ব্যবসায় ইটালির একচেটিয়া ছিল। যাহাদের চেষ্টায় ও যত্নে এই শিল্পের ব্যবসা ইউরোপের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তাদের মধ্যে প্যালিসির নাম বিশেষভাবে করা যায়। 
তাই সাত কান্ড রামায়ণ বলে যেটা প্রমান করতে চাইছিলাম, বাংলার হস্তশিল্প ও সংস্কৃতি  কৃতিত্ব এটাই যে এই চীনা মাটি দিয়ে বাংলার শিল্পী রাত কিন্তু গেয়ে তুললো নানা ধরনের পুতুল। যা একটি শৈল্পিক নিদর্শন। সবচেয়ে বড় কথা যা আবার বাংলার সংস্কৃতি প্রতীক, যেমন বাঙালি র প্রিয় মাছ রুই, ভুড়িওয়ালা বৈষ্ণব, না খেতে পাওয়া রাগা শিব ঠাকুর।
চীনামাটির পাত্র বা পতুল তৈরি সহ কাজ নয়। চীনামাটির পুতুল তৈরির জন্য প্রথমে কোয়ার্টজ ও ফেলসপার চূর্ণ চীনামাটির সাথে মেশাতে হয়। পরে জল দিয়ে মণ্ড তৈরি করা হয়। সে মণ্ড থেকে তৈরি হয় নানা ধরনের মৃৎপাত্র বা পুতুল এর আকার দিতে হয়। এরপর পাত্রগুলো শুকানোর পর ১৩০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায়  পোড়ানো হয়। এরপর সেগুলোতে দেয়া হয় কাচের প্রলেপ; সেই সাথে বিভিন্ন ধরনের রঙ ব্যবহার করে নকশাও করা হয়। এভাবেই চীনামাটি থেকে পাওয়া যায় বিভিন্ন দ্রব্য মানে পুতুল বাসন পত্র। এগুলো বেশ জনপ্রিয় এখনো।
Manab Mondal

মাটির বাঁশি পুতুল


বিতর্ক উঠবে বলে পিছনে হটে যাবো এমনটি নয়। আমি বলবো, শ্রীকৃষ্ণ এর  যে মূর্তি আপনারা দেখতে পান, তা আসলে বাঙালীদের সৃষ্টি। কারণ যে ব্রজভুমিতে শ্রীকৃষ্ণ এর জন্ম সেখানকার ব্রজবাসীরা, শ্রীনাথ জি, দাউজি, গোবর্ধন পূজা করতে বেশি পছন্দ করেন এখনো। সে হিসেবে বাঁশি বাজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রাধাকৃষ্ণ এর মূর্তি বাঙালি দের রোমান্টিক মন, এবং যন্ত্রসঙ্গীত প্রেমের প্রমান। তাছাড়া একটু চিন্তা করে দেখুন । রাধা মাখন বেচতে মথুরা যেতেন। অর্থাৎ অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন ছিলেন। আজো গো বলয়ের মেয়েরা অতোটা স্বাধীনতা পায় না।

এবার আসি আসল কথায়। কৃষ্ণ হাতে র বাঁশি আজকের আলোচনা বিষয়। যদিও আমার মূল বিষয় হলো  মাটির বাঁশি পুতুল । শিল্প ও সংগীত বিষয়ক সংস্কৃত গ্রন্থ নাট্যশাস্ত্রে (~২০০ খ্রিঃপূঃ থেকে ২০০ খ্রিস্টাব্দ) উল্লিখিত হয়েছে, বাঁশি সে সময়ের এক গুরুত্বপূর্ণ বাদ্যযন্ত্র ছিল। অনেক হিন্দু গ্রন্থে বাঁশি বা বেণুকে সংগীতকলায় ব্যবহার করার জন্য মানুষের গলার স্বর ও বীণার পরিপূরক হিসেবে দেখানো হয়েছে (বাণী-বীণা-বেণু)। ঋগ্বেদের (১৫০০-১২০০ খ্রিঃপূঃ) মতো প্রাক্‌বৈদিক ও বৈদিক গ্রন্থে একে নাদী আর তূণর এবং পরবর্তী বৈদিক যুগের হিন্দু গ্রন্থে বাঁশিকে বেণু হিসেবে, উপনিষদ ও যোগেও বাঁশি  উল্লেখ আছে।
ভারতের সমস্ত প্রাচীন পুরাতাত্ত্বিক ভাস্কর্য ও চিত্রকলায় বাঁশিকে অনুভূমিকভাবে (একটু নিচু করে) বাজানোর রীতি পাওয়া যায়।  একটাও লক্ষণীয় বিষয় সেকালে বাদ্যযন্ত্র বাজানোতে কোনো লিঙ্গভেদ ছিল না― নিদর্শনগুলোতে প্রচুর নারীশিল্পীর ছবিও পাওয়া যায়। কিন্তু পঞ্চদশ শতাব্দী শুরু হতেই বাঁশি বাজানোর অধিকার ক্রমে ক্রমে পুরুষদের দখলে চলে যায় আর বাজানোতে আড়াআড়ি পদ্ধতির শুরু হয়। সম্ভবত ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের আগমন ও হিন্দুস্তানি সংগীতের উপর পশ্চিম এশীয় প্রভাব এই পরিবর্তনের জন্য দায়ী।
বাঁশিকে ভারতীয় সঙ্গীত জগত ভুলে গেছেন কিছুটা হলেও। বাংলার সংস্কৃতি  জগত একে ভোলে নি।বাংলায় বাঁশিকে মুরালি, মোহন বাঁশি, বংশী অথবা বাঁশরিও বলা হয় ।  ভারতীয় বাঁশি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাঁশি তৈরিতে তরলা বাঁশ ব্যবহার করা হয়। কেউ কেউ শখের বশে ষ্টিলের, তামার, পিতলের, রূপার এমনকি সোনার পাইপ দিয়েও বাঁশি তৈরী করিয়ে থাকেন। বাংলার মৃৎ শিল্পীরা নতুন করে যোগ করেছে মাটির বাঁশি। তাও আবার পুতুল এর আকারে।
 এই প্রাচীন এবং মনহরানো বাদ্যযন্ত্রের গায়ে সাতটি ছিদ্র (মাঝে মাঝে আটটিও করতে দেখা যায়) থাকে । যে নল বা পাইপটি দিয়ে বাঁশি তৈরী করা হয় তার একপাশ সম্পূর্ণ আটকে বায়ুরোধী করে দেওয়া হয়। বাঁশের তৈরী বাঁশিতে গিট বা গিরা একপাশকে বায়ুরোধী করার কাজে ব্যবহার করা হয়। বন্ধ এবং খোলা প্রান্তের মাঝামাঝিতে ছিদ্রগুলো করা হয়। যে ছিদ্রটি বন্ধ প্রান্তের ঠিক কাছাকাছি থাকে সেটা দিয়ে কৌশলে ফু দিতে হয় এবং বাকি ছ'টি ছিদ্র ডান হাতের মধ্যবর্তী তিনটি এবং বাম হাতের মধ্যবর্তী তিনটি আঙ্গুল দিয়ে কখনো আটকে কখনো ছেড়ে দিয়ে সুর তুলতে হয়। অতো জটিল গঠনতন্ত্র নেই এই মাটির বাঁশি তে। তবে নান্দনিক সৌন্দর্য এর আকর্ষণীয়।
 কোনটি কাঠালিয়া পুতুল, কোনটি ছলনের পুতুল, কোনো টি জো পুতুল মতো দেখতে।  বাংলাদেশ এক শতাব্দী পূর্বে এই বাঁশি  তৈরি করা শুরু হয়েছিল। তবে অনেক সৃজনশীল পশ্চিমবঙ্গের মাটির গহনা শিল্পী  হাওড়া বাসী রাজকুমার দেবনাথ।তার কাছে পেয়ে যাবেন ঘোড়া,হাঁস, বিড়াল হাতি আরো অনেক কিছু, তবে মাটির গহনা শিল্পী হিসেবে উনার সুনাম অনেক বেশি, সে নিয়ে পরর্বতী পর্বে আলোচনা করবো। শিল্পী হিসেবে উনি সরকারী বেসরকারী উদ্যোগে একটি পূরস্কারের তো দাবি রাখেন ই।
Manab Mondal

Sunday, 28 November 2021

ফেনি

গোয়া নামটি অস্তিত্বের মধ্যে এসেছিল তা স্পষ্ট নয়। এটি ইউরোপীয় বা পর্তুগিজ ভাষা থেকে উৎপন্ন হতে পারে। এটিও বিশ্বাস করা হয় যে, গোয়ার নামটি বৈদিক সংস্কৃত শব্দ 'go' থেকে উদ্ভূত হতে পারে যার অর্থ 'গরু'। এখানে প্রচুর পরিমাণে কাজুবাদাম পাওয়া যায়।১৭০০ সালে ভারতে প্রথম ভারতে কাজু বাদাম গাছ নিয়ে এসেছিলেন পর্তুগিজরা। ব্রাজিল থেকে তাঁরা কাজুবাদামের গাছ নিয় এসে গোয়ায় লাগিয়েছিলেন। গোয়ার পরিবেশের সঙ্গে খাপ খেয়ে গিয়েছিল কাজুবাদামের গাছ। এই কাজু বাদামের গাছ থেকেই ফেনির উৎপত্তি। কাঁচা কাজু পচিয়ে সেখান থেকে ফেনি তৈরি করা হয়। ফেনি তৈরির জন্য কাজু গাছ রীতিমত চাষ করে থাকে গোয়ার চাষীরা। গোয়ার অর্থকরী ফসল এই কাজু। পর্যটকদের কাছে আকর্ষনীয় করে তুলতে মশালা ফেনিও তৈরি করা হয়। তাতে মেশান হয় এলাচ, গোলমরিচল, লবঙ্গ, দারচিনি। তারপরে সেটিকে পর্যটকদের দেওয়া হয়। গোয়ায় এই মশালা ফেনি বেশ জনপ্রিয় পর্যটকদের কাছে।

Tuesday, 23 November 2021

হিঙ্গুল পুতুল

ছোট্ট আও আও নালিশের সুরে বলল" আমাকে একটা বার্বি ডল কিনে দিলে না তুমি।"মা জিজ্ঞেস করলো "সেটা আবার কি? "আমি বললাম "পুতুল। "মা ছোট বেলায় উনুনে পুড়িয়ে মাটির পুতুল বানিয়ে দিতো । সেই স্মৃতি টা উস্কে দিলো। আমি আমার অনেক কটি পোস্ট বলার চেষ্টা করছি বাংলার বিভিন্ন স্থানে যে পুতুল পাওয়া যায় , তা তৈরিতে আমাদের ধর্মীয় সংস্কৃতি অনেক অবদান আছে। অথচো আধুনিকতার  চাপে বাংলার ঘরে থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার পুতুল। অথচো পুতুল কেনা বন্ধ করে নি কিন্তু বাঙালী। বাঙালি র ঘরে আসছে,জাপানের তথা বৌদ্ধ ধর্মে দারুমা।দারুমা পুতুল ঐতিহ্যবাহী জাপানি খেলনা পুতুল। এটি ছোট, বৃত্তাকার/গোলাকার, দাড়িওয়ালা মানুষ চিত্রিত, ফাঁপা ও লাল রঙের হয়। তবে অঞ্চল ভেদে দারুমা পুতুলের নকশা, ডিজাইন ভিন্ন হয়।  এই পুতুল নাকি সৌভাগ্যে ফেরাবে বাঙালি র।
যাইহোক সোস্যাল মিডিয়ায় বিশিষ্ট পরিচিত নাম সায়ন রায় । সৌভাগ্য ক্রমে আমার ফোন বুকে তাঁর নাম্বার টি সেভ করা। তাঁর status দেখতে পেলাম একটা হারিয়ে যাওয়া পুতুল এর ছবি। এটা বীরভূমের পুতুল, মনে পরে গেলো,সাঁওতালি ঘরনা চাদর বাঁধনী পুতুল,বাঘরাইপুতুল , কিংবা হিঙ্গুলা পুতুল , আজ হারিয়ে যাওয়া র পথে। হিঙ্গুলা পুতুল এর কথা তাই বলতে ইচ্ছে করলো আপনাদের কাছে।পুতুলের নানা ভাগ,  কি দিয়ে তৈরি হচ্ছে সেটা দিয়ে বলি সাধারণত আমরা মাটির পুতুল, কাপড়ের পুতুল,কাঠের পুতুল,পাটের পুতুল,তালপাতার পুতুল,গালার পুতুল,ধাতুর পুতুল,কাগজের পুতুল,শোলার পুতুল। এদের মধ্যে একটি বাংলার প্রবাদ প্রবচনে থাকে গেলেও হারিয়ে গেছে বোধহয় আমাদের জীবন থেকে। তালপাতার সিপাই, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায়এই খেলনা উদ্ভাব। আজও আর দেখা যায় না। তবে আদিবাসী সাঁওতাল দেবতা সিং বোঙ্গার উদ্দেশ্যে তৈরি এই পুতুলের মুখ হয় হাতির মতো।এছাড়াও তালপাতার সেপাই তৈরি হতো তালপাতা দিয়ে। এতে থাকে যোদ্ধার অবয়ব। সেখান থেকে আসতে পারে তাল পাতার সেপাই বানানোর রীতি।
এছাড়া আগেই বলেছি বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে তৈরি শুরু হয় পুতুল বানানোর রীতি।

সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে পুতুলের নানা ভাগ আছে যেমন,:টুসু পুতুল,ভাদু পুতুল,রাণী পুতুল,আহ্লাদী পুতুল,বৌ পুতুল,ষষ্ঠী পুতুল,লক্ষ্মী পুতুল,হিঙ্গুল পুতুল,ঘাড় নাড়া পুতুল,জৌ পুতুল,যাদু পুতুল বা কালো পুতুল,পুতুল,আশ্চর্য প্রদীপ,বোঙ্গা হাতি পুতুল। আধুনিক বাংলা তৈরি হচ্ছে দেওয়ালী পুতুল।


হিঙ্গুলা পুতুলের কথায় আসি এবার । কারণ সায়ণ রায়ের  স্ট্যাটাসে হিঙ্গুলা পুতুল ছবিই আমি দেখেছি।বাঁকুড়ায় তৈরি হয় হিঙ্গুল রঙের হিঙ্গুলা পুতুল। কাঁচা মাটি দিয়ে তৈরি এইসব পুতুল দুর্গাপুজো, জন্মাষ্টমী ও টুসু পুজোর সময় বিক্রি হয়।ষষ্ঠীপুজো ও জিতাষ্ঠমীর ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে হিঙ্গুল পুতুল কাজে লাগে। কেউ কেউ মানত করার জন্য হিঙ্গুল পুতুল ব্যবহার করে থাকেন। ঘর সাজানোর জন্য অনেকেই কেনেন। হলুদ (হরিতালি), লাল ( হিঙ্গুলা), নীল .ওপর সূক্ষ্ম কাজ, রংবেরঙের কাঠের পুতুল, চমক এর আসল আকর্ষণ। হিঙ্গুল বা হিম এক ধরনের খনিজ পদার্থ। এক সময়ে বিখ্যাত হয় বিষ্ণুপুরের হিঙ্গুল পুতুলগুলো । পুতুল গুলো  রাঙিয়ে তুলতে লালচে রঙে এই হিঙ্গুল ।এই রং দিলে বেশ চকচকে হত পুতুলগুলো। এই কারণেই পুতুলগুলোর এমন নাম। কাঁচা মাটিকে হাতে টিপে পুতুলের রূপ দিয়ে রোদে শুকোনো হয়। তাতে পরে ভেষজ রঙের প্রলেপ। পুতুলের উচ্চতা হয় মোটামুটি এক আঙুলের মতো। বাচ্চাদের খেলনা হিসেবেই এই পুতুল জনপ্রিয়। পাশাপাশি,  তবে এখন খানিকটা ইউরোপীয় প্রভাব এসে মিশেছে এই পুতুলের সাজসজ্জায়। হিঙ্গুল পুতুলের পরনে থাকে ফ্রক, মাথায় পাশ্চাত্য রীতির টুপিও দেখা যায়।

.এই পুতুল তৈরি শুরু হ‍ওয়ার একটি গল্প শোনা যায় যে- যখন রাজবাড়িতে শিল্পী রা রাজাদের জন্য হাতে বানানো তাস নিয়ে যেতেন, তখন রাজবাড়ির শিশু রা তাঁদের কাছে বায়না করে বলতো ‛ আমাদের জন্য কি এনেছো? আমাদের-ও পুতুল দিতে হবে।’... তখন শিল্পীদের স্ত্রী রা মাটির ছোটো ছোটো পুতুল বানিয়ে রাজবাড়ির শিশুদের জন্য নিয়েযেতো।.... 

যাইহোক এর পরে  চাদর বাঁধনী পুতুলের কথা বলবো কারণ এর সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস ‌।
🙏🙏🙏🙏🙏🙏🙏🙏🙏🙏
কৃতজ্ঞতা জানাই - সায়ন রায় কে , ছোট্ট বয়সে  ও  অনেক কাজ করেছেন , ওর উৎসাহে পুতুল নিয়ে এই লেখা শুরু করলাম। 

হরিনাভি

আদি গঙ্গা নিয়ে কথা বলতে গেলে  দেখবেন  ষোলো শতাব্দী পর্যন্ত এর গর্ব বজায় ছিলো ধরে নেওয়া যেতে পারে। কালিঘাট বোড়াল, রাজপুর, হরিণাভি, মাহীনগর, বারুইপুর, বাহারু, জয়নগর, মজিলপুর, ছত্রভোগ ইত্যাদি পাঁচ শত বছরের পুরনো জনপদ এদাবিও করতে পারি। বিপ্রদাস পিপিলাইএর মনসবিজয়, 1495 সালে রচিত, এই অঞ্চলে অনেক জায়গার উল্লেখ করেছে। “চাঁদ সদাগর, এর বণিক চরিত্র মনসবিজয়পুরাতন ভাগীরথী এই শাখা  হয়ে কালীঘাট থেকে বারুইপুর পৌঁছেছিল। সেখান থেকে তিনি ছত্রভোগের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং তারপরে হাতিগড় পরগনা হয়ে খোলা সমুদ্রে পৌঁছে গেলেন। ” চৈতন্যদেব (1486-1534) এই পথ দিয়ে গেছে। নৌকায় ভ্রমণ পুরী তিনি বারুইপুরের নিকটবর্তী আতিসারা গ্রামে থামেন। "তার শেষ স্টপেজ 24 পরগনা ছত্রভোগে ছিল, এখন এই শহরটির অধীনে একটি গ্রাম মথুরাপুর থানা পুরানো ভাগীরথী নদীর তীরে ছত্রভোগ একটি গুরুত্বপূর্ণ নদ-বন্দর ছিল বলে মনে হয়। "রমা চন্দ্র খান, দ্য জমিদার ছত্রভোগের চৈতন্যদেবকে তাঁর যাত্রা চালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন।

কলকাতার দক্ষিণে ২৪ পরগণার অন্তর্গত হরিনাভী গ্রামে অবস্থিত ঘোষেদের জমিদার বাড়ী। ষ
হরিনাভী অঞ্চলটি সেইসময়ের "মদন মল্ল" পরগণার অন্তর্গত ছিল। মদন রায় ছিলেন মহারাজ প্রতাপাদিত্যর ঢালি ও সেনানায়ক।  মহারাজ প্রতাপাদিত্যর মোঘলদের কাছে পরাজয়ের পরে মদন রায় এই গ্রাম গড়ে তোলেন। নাভি পর্যন্ত প্রোথিত কষ্টি পাথরের বিষ্ণু মূর্তি পাওয়া যায় এই গ্রাম থেকে তাই এই গ্রামের নাম হয় হরিনাভী।    

১৭৫২ সালে শ্রী রামচন্দ্র ঘোষ হরিনাভী গ্রামের কিছু জায়গা কিনে নেন কলকাতার সিংহ পরিবারের কাছ থেকে। তাঁর পুত্র হরমোহন ঘোষ বর্তমান দূর্গামন্ডপ সহ বসতবাড়ি তৈরি করেন এবং পৌত্র নবীনচন্দ্র ঘোষ ১৬টি স্তম্ভ সহ নাটমন্দির তৈরি করেন। এরপরেই শুরু হয় রাসের মেলা, তাই লোকমুখে এটি রাসবাড়ি নামে পরিচিতি পায়। এই রাসবাড়ির নিকটেই অবস্থিত দূর্গাদালান। তবে আজ তার শোচনীয় অবস্থা দেখে সত্যিই কষ্ট হয়। নবীন ঘোষের আমলে গৃহদেবতা গোপীনাথ জিউ ও রাধাকে বসিয়ে রথ যাত্রার সূচনা হয়। পরবর্তীকালে ১৯৩৭ সালে একটি লোহার রথ তৈরি করেন হীরালাল ঘোষ ও সেই রথ টানার জন্য ৩০ জন লোকের প্রয়োজন হত। তবে বর্তমানে সেই রথ রাসবাড়ির সামনেই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।         
      
 বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের হরিনাভীর সাথে বেশ স্মৃতি জড়িয়ে আছে। হরিনাভী স্কুলে তিনি ১৯২০ সালে মাত্র ২৬ বছর বয়সে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। এখানে তিনি মাত্র ২ বছর শিক্ষকতা করেন। এখানে থাকাকালীন তাঁর সাহিত্যিক প্রতিভার বিকাশ ঘটে। প্রথমদিকে তিনি হরিনাভীর কাছেই রাজপুরে থাকতেন। তাঁর বাড়ির কাছেই ছিল একটি বকুল গাছ। মাঝে মাঝেই এই গাছের তলায় তাঁর সময় কেটেছে। "পথের পাঁচালি" থেকে "চাঁদের পাহাড়" অনেক গল্পের পটভূমিই  এই হরিনাভী গ্রাম। 

Monday, 22 November 2021

বাবু পুতুল

রানি পুতুল থেকে সাহেব মেম পুতুল  এর কথা যখন বলেছি  তখন বাবু পুতুল এর কথা বাদ যায় কেন? তবে তার আগে বলে নিতে হবে একটি অন্য গল্প। 
কলকাতা গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্য কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।  এদেশে তখন ইউরোপীয় ধারার চিত্রকলার সূচনা হয়েছে। দেখা গেল  যে কালীঘাট পটচিত্রের ধারা আদরনীয় হয়ে উঠেছে তখন। বাংলা শিল্পকলা ধারায় কালীঘাট পট চিত্ররীতি শুধু জনপ্রিয়ই নয়, তার রয়েছে এমন এক নিজস্ব শৈলীকলা।
তীর্থযাত্রীরা কালীঘাটে এলে তীর্থের স্মারক হিসেবে এই পট কিনে নিয়ে যেতেন সে সব দিনে। সেই চাহিদা অনুসারে আঁকা হত  শিব, কালী, রাম-সীতা, ইত্যাদিই ছবি । বালির মিলে তৈরি চৌকো আকৃতির কাগজে  আঁকা হত এই পট। তাই এই পটকে বলা হত ‘চৌকশ’।  বাংলার জড়ানো পটের থেকে আলাদা হয়ে যায় এই পট।
তীর্থযাত্রীদের জন্য তৈরি বলে গোড়ায় ছবির বিষয় দেবদেবী হলেও পরবর্তীকালে সমাজ সমালোচনায় মনোনিবেশ করেন শিল্পীরা। তাই  শিব, দুর্গা, কালী-র বিষয় থেকে বেড়িয়ে গিয়ে শিল্পীরা আঁকলেন ‘আলালের ঘরের দুলাল’, ‘বাবু ও বেশ্যা’, ‘ঘরে ছুঁচোর কেত্তন আর বছরে কেঁচোর পত্তন’ জাতীয় ছবিগুলি। পাশাপাশি দেখা গেল শুধু মাত্র আঙ্গিকে নয়, রূপের আদর্শেও  কালীঘাট বিশিষ্টতা অর্জন করল।পুরুষের  পটলচেরা চোখ, ধনুকাকৃতি ভ্রু, বাবরি করা চুল, নধর বাবু । নারীরা হল সুপুষ্ট দেহ আর লীলায়িত ভঙ্গিমা। চব্বিশ পরগনার মাটির পুতুল হয়ে উঠল কালীঘাট পটচিত্র শৈলীর অনুপ্রেরণা।
এবার আসি দঃ ২৪ পরগনার কথায়। এখনকার মজিলপুর শহরের পশ্চিমাংশের বিস্তৃত ধানক্ষেত 'গঙ্গার বাদা'র উপর দিয়েই আদিগঙ্গার প্রবাহ বইত। আদিগঙ্গার মজাগর্ভে নতুন বসতির উৎপত্তি হয়েছিল বলেই এই শহরের নাম 'মজিলপুর' হয়েছে। সপ্তদশ শতকের গোড়ার দিকে ভাগ্যবিপর্যয়ের ফলে যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের আমলা-অমাত্য, ব্রাহ্মণ-কায়স্থ, পণ্ডিত-পুরোহিতরা সুন্দরবনের এই জঙ্গলাকীর্ণ জনবিরল স্থানে বসবাস শুরু করেন।
প্রায় ২৫০ বছর আগে দত্ত-জমিদাররা কালীচরণ পেয়াদাকে যশোহর থেকে জয়নগরে এনেছিলেন। শোনা যায় কালীচরণ নাকি মাটি দিয়ে ‘টেপা পুতুল’ তৈরি করতেন। তাঁর ছেলে জানকীনাথ দাস জয়নগরে পুতুল তৈরি শুরু করেন। তাঁরই উত্তর পুরুষ শম্ভুবাবুর ঠাকুরদা মন্মথনাথ  জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। মন্মথের কাজ আজও দেখা যায় দেশ বিদেশের বিভিন্ন সংগ্রহালয়ে। এ ছাড়াও শম্ভুবাবুর বাবা পাঁচুগোপাল দাসও ছিলেন নাম করা শিল্পী। আজ নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও শম্ভু আঁকড়ে ধরে রেখেছেন এই শিল্পকে।
জয়নগর মজিলপুরের পুতুল দু’প্রকার। হাতে তৈরি এবং ছাঁচের। প্রচলিত দেবদেবীর পাশাপাশি তৈরি হয় নানা লৌকিক দেবদেবীর মূর্তি। হাতে তৈরি পুতুলের মধ্যে নারায়ণী, শীতলা, বনবিবি, দক্ষিণরায়, পঞ্চানন, মানিকপীর, আটেশ্বর, দক্ষিণেশ্বর উল্লেখযোগ্য। আর ছাঁচের পুতুলের মধ্যে রয়েছে গণেশজননী, জগদ্ধাত্রী, রাধাকৃষ্ণ, কালিয়দমন, ষড়ভূজচৈতন্য, কলকাতার বাবু, গয়লা-বৌ, কৃষক ইত্যাদি। এ ছাড়াও রথের সময় জগন্নাথ, ঝুলন-জন্মাষ্টমীর সময় রাধা-কৃষ্ণ, গোপাল, নববর্ষে লক্ষ্মী-গণেশের মূর্তির তৈরি করা হয়।আট পুরুষ ধরে, তৈরি করছে এরা পুতুল। বাংলার বাবুদের কৃত্রিমতা, ঔদ্ধত্যকে কটাক্ষ করে মজিলপুরে বাবু পুতুল বানানো শুরু হয়েছিল, সেগুলো এখনও জনপ্রিয়। তবে এই পুতুল গুলো তে কালিঘাট এর পটের  প্রভাব রয়েছে।
Manab Mondal

ছলনের পুতুল

ছলনের পুতুল এর শৈল্পিক মূল্য নেই তেমন, দৃষ্টি নন্দন এর গুন নেই এর মধ্যে। আমার লেখা ছোট গল্প " ছলনের পুতুল" যাঁরা পড়েছেন। তার বোধহয় সেটা আগে ভাগেই বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু গল্পে মধ্যে সেই ভাবে এর গুরুত্ব এর পরিচয় ঘটানোর সুযোগ ছিলোনা, লেখক হিসেবে সে হিসেবে আমি ব্যার্থ। 
যাইহোক দক্ষিণ ২৪ পরগনার নূরপুর ঘুরতে গিয়ে, দেওয়ানা তলার  এক মেলায় প্রথম ছলনের গুরুত্ব সম্পর্কে আমি পরিচিত হই। অথচ আমার বসত বাড়ি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্ব টালিগঞ্জ অঞ্চল তথা দক্ষিণ কলিকাতার এক মাত্র বনবিবির মন্দির, সেখানে এই ছলনের পুতুল বা ঘোড়া গুলো বিক্রি হলেও এ প্রতি আমি কখনো আগ্রহ দেখায় নি। কিন্তু এর গুরুত্ব আছে আমাদের কাছে অনেক খানি। কারণ ধর্ম ঠাকুর এর কাছে মানত করা ঘোড়া গুলো ই আজ বিশ্ব দরবারে তাদের শৈল্পিক সুন্দর জন্য, একটা জায়গা করে নিয়েছে। তেমনি এই পুতুল গুলো একটু শৈল্পিক ভাবনা রাঙিয়ে উঠলে, এগুলো ও সংগ্রহ যোগ্য হতে পারে।


তবে এর ধর্মী গুরুত্ব কথাই আসি। ভারত উপমহাদেশে মিশ্র ধর্মীয় সংস্কৃতিতে, কখনো কখনো , মানুষ জন  হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের পুতুল এর পূজারী বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। তাদের বলি,পাঁচ ভুত কথা জানেন আপনি। শাস্ত্র মতের পঞ্চভুত হল ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। বিজ্ঞান মানলে, এ বিশ্ব ব্রম্ভান্ডের বাস্তুতন্ত্র এদের ওপর নির্ভর করছে।
এবার একটু খুলে বলি। ক্ষিতি মানে হল- পৃথিবী, অপ কথার মানে হল- জল। তেজ কথার অর্থ হল- আগুন, আর মরুৎ মানে হল বাতাস। এবং ব্যোম বলতে বোঝায় শূন্যতা অর্থাৎ আকাশকে।  পুতুল কারিগর ক্ষিতি মানে পৃথিবী থেকেই মাটি নিয়ে আসে। তার পর অপ অর্থাৎ জল দিয়ে শিল্পী সেই মাটিকেই মাখে। সেই নরম মাটিকে সে পরিণত করে মনের মতন আঁকারে। এর পর শিল্পী ভাবেন কাঁচা মাটিকে পুড়িয়ে শক্ত করার কথা। আর তখনই তাঁর দরকার হয় আগুনের, অর্থাৎ তাঁর লাগে তেজ। এবার তো পুতুলকে ঠাণ্ডা করতে হবে। তাই সেই পোড়া উত্তপ্ত পুতুল সে দেয় বাতাসের কাছে। সুতরাং তাঁর লাগলো মরুৎ কে। এবার ব্যোম কে কাজে লাগাতে হবে শিল্পীর। কিন্তু শূন্যতাকে কি ভাবে পুতুলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে? এর উত্তর লোকো শিল্পী বের করে নেয় অবলীলায়। সে সমস্ত পুতুলগুলি বানাতে থাকে ফাঁপা করে। আর ফাঁপা মানেই হল শূন্যতা অথবা অসংখ্য ছিদ্র করা হয় পুতুলের গায়ে। 


পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমের জেলা গুলিতে মনসকামনা পুর্ন করতে ছলনের হাতি  পুতুল দেওয়া হয়। পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রাম থানা, জঙ্গলমহলের পবিত্র গড়াম স্থান, আদিবাসীদের জাগ্রত দেবতা কালুয়া  কাছে উৎসর্গের জন্য মাটির হাতি।কিন্তু মোটামুটি আমরা সবাই-ই 'ছলনের ঘোড়া'-র সাথে পরিচিত। পোড়ামাটির তৈরি চার পায়ের কৃত্রিম রং ছাড়া এক ধরণের পুতুল। তবে খেলনার জন্য কিন্তু এই ঘোড়ার কোনও ব্যবহার নেই। ধর্মরাজের পুজোয় বা ষষ্ঠীতলায়, বটতলায়, ওরা বিবির মন্দিরে এরকম বেশ কিছু ঘোড়া প'ড়ে থাকতে দেখেছেন আপনিও হয়তো।
কিন্তু লক্ষনীয় বিষয় হলো কৃষ্ণনগরের এই পীরতলায়  এক বিশেষ ধরণের একজোড়া ঘোড়া পীরকে উৎসর্গ ক'রে নানা প্রার্থনা করা হয় স্থানীয় হিন্দু ও মুসলিম বাসিন্দাদের মধ্যে। আপনি বলবেন  এই ঘোড়া 'ছলনের ঘোড়া'-র সাথে মেলেনা।  কারণ মুখ চৌকো আর চ্যাপ্টা এবং আর এতে দুটো রঙয়ের ব্যবহার থাকে। সাদা রং ভ'রে লাল দিয়ে দাগ কাটা বা ডোরাকাটা করা হয়। একেবারে চোখ, মুখ, কানকে যে লাল রং দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয় তা নয়; শুধু প্রতীকের ম'ত একটা ধারণা দেওয়া হয়। এই ঘোড়া দু রকমের আকারের পাওয়া যায়। যেটা একটু বড়, তার পিঠে বাঘের ম'ত ডোরাকাটা তিন-চারটে দাগ দেওয়া থাকে আর যেগুলো একটু ছোট আকারের, তাতে লম্বালম্বি, আড়াআড়ি কিছু দাগ দিয়ে দেওয়া থাকে।  সাধারণত যাদের সন্তানেরা বিকলাঙ্গ বা ঠিকম'ত কথা বলতে পারছে না ; সেইসব মায়েরা এই জোড়া ঘোড়া, ; মোমবাতি, ধূপ এসব দিয়ে আসে অশ্বত্থ গাছের তলায়।
আরো একটি ছলনের পুতুল  বাঘরাই এর বীরভূমের রাজনগরের পুতুল।এটি ছলনের পুতুল পোড়ামাটির লাল আর কালো রঙের হয়।শিল্পী  মনের মাধুরী মিশিয়ে  এই রঙ  করা ছবি দেখে আমার মনে হয় ছিলো প্রথম । নবগ্রামের প্যাঁচা যদি কিংবা ধর্ম রাজের ঘোড়া যদি শিল্প হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। একটু তত্ত্বাবধান করলে এটিও সংগ্রহ যোগ্য হতে পারে।

এ বিষয়ে দক্ষিণ পরগনার সঞ্জয় ঘোষ লিখেছিলেন"এর সাংস্কৃতিক নৃতাত্বিক মূল্য অসীম।আমার মনে হয় সেটা এই লেখায় এসেও আসেনি।কারন নৃতাত্বিক মূল্যায়ন না করা ।আদিবাসী অধ্যুষিত পুরুলিয়া,বাঁকুড়া,দুই মেদিনীপুর,বীরভুম ,হয়তো ঝাড়খনন্ড ও উড়িষ্যায় খোলা আকাশ্র নিচে বা গাছের নিচে লৌকিক দেব দেবীর থানে হাতি ও ঘোঁড়া অবশ্যই থাকবে ছলন হিসেবে।এবং এই আদিবাসীগন যেহেতু ক্রমান্বয়ে জৈন,বৌদ্ধ,হিন্দু ,মুসলিম ধর্ম গ্রহন করেছেন তাই সেই ধর্মেও এগুলি কোনো না কোনো ভাবে থেকেছে।বিশেষ করে সুফি ইস্লামের সমন্বয়ধর্মী ধর্মে পীর গাজী বিবি র ধারায়,ধর্মরাজ ,দক্ষিণ রায়ের পূজ়ায়।এমনকি সাগরে বিশালাক্ষী থানেও দু একটি ঘোড়া ছলন দেখেছি। "

🙏 Manab Mondal 🙏

Sunday, 21 November 2021

চদর বদর পুতুল

একসময় বাংলার বিনোদন জগতের গুরুত্বপূর্ণ জনপ্রিয় পুতুল নাচ ছিলো চদর বদর। পরাধীন ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের হাতিয়ার ছিলো এই নাচ।একসময় ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রচার করা হতো এই নাচ গুলো। অনেকের মতে চদরবদর হল পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন পুতুল নাচ৷ কিন্তু এর ইতিকথা খুব একটা জানা যায় না৷ কবে ঠিক কোন জায়গায় কোন ভূখণ্ড জনপদে এর জন্ম তার ঠিক নেই, নেই কোনও লিখিত ইতিহাস৷ কেউ কেউ বলেন ‘চদর’ কথাটা এসেছে চাদর থেকে৷ চাদরের তলায় এই নাচ দেখানো হয় বলে নাম হয়েছে চদরবদর৷ 
গ্রাম বাংলার এই পুতুলনাচ আজ লুপ্তপ্রায়। পুতুলনাচের তেমনই এক ধারা অন্তত ৩০ বছর আগেও বীরভূম, বর্ধমান, বাঁকুড়া-সহ কিছু জেলায় ভাল ভাবেই টিকে ছিল। 
 এই পুতুলনাচের পোশাকি নাম ‘চাদর বাঁধনি’। গ্রাম্য ভাষায় এরই নাম ‘চদর বদর’। এটি সাঁওতালি শব্দ। ‘চদর বদর’ নাচানো সাঁওতালি সংস্কৃতির অন্যতম নিদর্শন। ‘চদর বদর’ আদিবাসী নিজস্ব ঘরানার পুতুলনাচ, যা কোনও পশ্চিমী দেশ থেকে নকল করা নয়। নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ধরে রাখার প্রয়াস, আদিবাসীদের সারল্য, প্রযুক্তি এই পুতুলনাচের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। বাংলার মৃতপ্রায়, সুপ্রাচীন অথচ আলোচনা-গবেষণার আড়ালে থেকে গিয়েছে সাঁত্ততালি লোকাশিলোকাশিল্পটি।
চদর বদরের পুতুলগুলি সাধারণত ৭ থেকে ৯ ইঞ্চি লম্বা হয়। পুতুলগুলি গড়তে প্রয়োজন হয় কারিগরি দক্ষতা। শিরিষ, জাম, বট, ডুমুর ইত্যাদি হাল্কা কাঠ খোদাই করে পুতুল তৈরি করা হয়ে থাকে। কাঠের তৈরি পুতুলে তার পরে চলে রংয়ের কাজ। শেষে পুতুলকে কাপড় পরানো হয়। এই পুতুল নাচের কাঠি এবং সুতো দুটোরই ভূমিকা আছে৷ ছোটো ছোটো ধূসর বা কালো কাঠের টুকরো আর বাঁশ দিয়ে একদম নির্ভেজাল দেশি পদ্ধতিতে তৈরি এই পুতুল৷ এই কারিগরি অন্য কোনও পুতুল নাচে নেই৷ তা হল মূল একটা লাঠির সঙ্গে বিভিন্ন কাঠি এবং সুতোতে যুক্ত থাকে পুতুলগুলির বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, মূল লাঠিটি নাড়লেই সেগুলি একসঙ্গে নানা ভঙ্গিতে নড়তে থাকে৷ যে কোনও পুতুল নাচই হয় পথে অথবা খোলা জায়গায়৷ চদরবদর-এ পুতুল নাচে স্ট্যান্ডের ওপরে বসানো গোল অথবা চৌকো বাক্সের মতো চারদিক খোলা মঞ্চে৷ কোথাও বা স্ট্যান্ডের বদলে থাকে একটা গোল লাঠি৷ একপায়া কাঠের স্ট্যান্ডের ওপর ভর করে থাকে একটি বাক্স। সেটারই তিন দিক ঘিরে থাকে চাদরে। শাড়ি দিয়ে মোড়া থাকে বাক্সের নিচের অংশ। আর সেই বাক্সেই ধামসা মাদল সহযোগে নাচতে থাকে সাঁওতালি নারী-পুরুষের প্রতিরূপ সরূপ সারিবদ্ধ পুতুলগুলি।এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় চদরবদরের পুতুল নাচের মঞ্চটির একটু আধটু তফাত্‍ হয়৷ যেমন, বীরভূমের চদরবদরে মঞ্চটি গোল আবার উত্তর দিনাজপুরে চৌকো৷ কোথাও বা ছাদটা কাপড় দিয়ে ঢাকা৷ কোথাও বা ছাদটা হয় কাঠের৷ সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত চদরবদর পুতুলগুলিতে দেখেছি মঞ্চটি উন্মুক্ত৷ শুধু এ দিক থেকে ও দিক কয়েকটি লাঠি চলে গেছে৷ নাচের সব চরিত্রই আদিবাসী নারী-পুরুষ-শিশু৷ পুতুল থেকে নাচ দেখানোর স্ট্যান্ড লাগানো বাক্স তৈরি করেন শিল্পী নিজেই৷ গানও বাঁধেন নিজেরাই৷


ডাং পুতুলনাচের মতো ‘চদর বদর’ও দেখানো হয়ে থাকে ডাং বা লাঠির সাহয্যে। কিন্তু ডাং পুতুলনাচের শিল্পীরা নিজের কোমরে একটি ছোট চোঙ বেঁধে খাপে ডাংটিকে পুরে হাত দিয়ে সেই ডাংটিকে উপর নীচে তুলে ও ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুতুলনাচ দেখান। চদর বদরের ক্ষেত্রে ডাংটিকে দুইয়ের মধ্যবর্তী স্থানে ভারসাম্য এনে পুতুলনাচ দেখানো হয়। বেণী পুতুলের মতো চদর বদরের পুতুলগুলি ছোট হয়ে থাকে।

মঞ্চ সাজানো হলে। শিল্পীরা প্রত্যেকে বাজান। লাগড়া, মাদল, বাঁশি। আর পুতুলেরা বাজনার তালে তাল মিলিয়ে নাচছে। মজার বিষয় এদের পুতুল দের নাম থাকে।

চাদর বদর প্রদর্শনের সময় শিল্পীদের পোশাকেও থাকে বৈচিত্র। শিল্পীরা পাঞ্চি পরেন নিম্নাংশে। মাথায় গামছা ও হাঁসের পালক। চিরাচরিত উপজাতি বাদ্যযন্ত্রে অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখা যায় পুতুল নাচের সময়। বাজে বানাম, তুংদা (মাদল), লাগড়া, তিরেঞয়া( বাঁশি)। পুতুলনাচের সময় মোটমুটি নির্ভর করে দর্শকের উপরে। দর্শক চাইলে পুতুলনাচের সময় বাড়তেই পারে।


একটা পুতুল নাচ চলতে চলতেই বাঁধা হতে থাকে নতুন গান নতুন পালা৷ পুতুল তৈরি হয় সেই গানের গল্পাংশের ওপর ভিত্তি করে৷ এই জায়গাতে চদরবদরের সঙ্গে পটের একটা বড়ো মিল৷ পট আঁকার আগে গান বেঁধে নেন পটুয়ারাও৷ দমন এখন নতুন গান বাঁধছেন৷ সেই গানের বিষয় হবে গ্রামের ‘মাঝি হারাম’ মানে মোড়লের কাজকর্ম৷ পুতুল তৈরির উপকরণও হাতের কাছের বাঁশ আর কাঠকুটো থেকে থেকে পেয়ে যান শিল্পী৷ তাকে বলি, ওপরে যে পুতুলটা দুলতে দুলতে নানা কসরত্ দেখাচ্ছে তার সঙ্গে তো তোমার বলা কাহিনির কোনও যোগাযোগ নেই৷ ওটা কেন? ‘ইচ্ছে করেই করা, লোকের নজর কাড়ার জন্য৷ বাক্সের ভিতরের পুতুলগুলি দূর থেকে অনেকেই দেখতে পান না৷ সেটা দেখতে হলে কাছে এসে ভিতরের নজর দিতে হয়৷ কিন্তু ওপরের এই পুতুল নাচ দেখে আর গান শুনে লোকে ভিড় জমাবেই৷

Saturday, 20 November 2021

শিবের মুখোশ

বাংলার হস্ত শিল্প নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আগেই দেখিয়ে ছিলাম, আসলে আমাদের হিন্দু ধর্ম বিভিন্ন সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তাগিদায় তৈরি , পুতুল মুর্তি, মুখোশ , পরে ঐতিহ্য বাহী শিল্প নির্দেশন হিসেবে পরিচিত হয়েছে। শিবের মুখোশ ক্ষেত্রে ও এরচেয়ে আলাদা কিছু ই নয়।
শিবের মুখোশ নবদ্বীপের লৌকিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অংশ।চৈত্র মাসে শিবপার্বতীর বিয়ের সময় এই মুখোস তৈরি করা হয়। লৌকিক শৈব সংস্কৃতির সাথে এই মুখোশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটিকে মুখোশ বলা হলেও আসলে এটি মাটি দিয়ে তৈরি মূর্তি। বহুবর্ণশোভিত এই মুখোসটি লৌকিক শিল্পের অন্যতম নিদর্শন।
কাঁচা মাটি দিয়ে ছাঁচে ফেলে এটি তৈরি করা হয়। এরপর এটিকে রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়। রোদে শুকিয়ে গেলে সাদা রং করা হয় এবং চোখ নাক কান আঁকা হয়। মাথায় সোনালী রঙের টোপর পরানো হয়। টোপর বা মুকুটের উপরে ফনাযুক্ত সাপ থাকে।
চৈত্র মাসে শিবের বিয়ে উপলক্ষ্যে  এই মুখোশকে চতুর্দলায় সাজিয়ে নিয়ে বাড়ি বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। বাড়ি বাড়ি থেকে ভিক্ষা করে সেই টাকা দিয়ে শিবের বিয়ের আয়োজন করা হয়। মূলত ছোট ছোট ছেলেরা শিবের বিয়ের আয়োজন করে। 
তবে নবদ্বীপ শহরের কথা আলাদা। শিবের বিয়ে নবদ্বীপের একটি আঞ্চলিক ঐতিহ্য বাহী উৎসব। বাংলার শৈব সংস্কৃতি উৎসব এটি। তাদের মধ্যে নবদ্বীপে চৈত্র মাসে বাসন্তী পুজোর শেষ দিন অর্থাৎ দশমীর পরদিন ভোররাতে শিবের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। চোখ ধাঁধানো শোভাযাত্রার মাধ্যমে নানা রাস্তা ঘুরে শিব ও পার্বতীকে চতুর্দলায় সাজিয়ে পোড়ামাতলায় নিয়ে আসা হয়। এই অনুষ্ঠানটিকে সমাজের বিজ্ঞান এর চোখে দেখলে বলা যাবে সমাজের উচ্চ শ্রেণী ও নিম্ন শ্রেণীর মিলন বলা যেতে পারে। শিব এখানে নিম্ন শ্রেণী ও পার্বতী উচ্চ বংশীয় কন্যা, তাইএই বিয়ে সামাজিক মিলনের বহিঃপ্রকাশ।
শিবের বিয়ে নিয়ে নবদ্বীপের উন্মাদনা দেখার মতো। এখনে বুড়োশিবতলার,বুড়োশিব, যোগনাথ তলার যোগনাথ ,চারিচারা পাড়ার বালকনাথ এবং বউ বাজারের মালোদের শিবের  বিয়ে হয় জাঁকজমকের সঙ্গে নিজের নিজের মন্দিরের এলাকায়। মন্দিরের পাশে বিশাল মঞ্চ বাঁধা হয়। একবার আর পাঁচ টা সাধারণ বিয়ের সাথে এর কোন পার্থক্য থাকে না, এই মঞ্চ গুলো য় ,সাজানো হয় শহরের বড় বড় দোকানের থেকে উপহার হিসেবে আসা,পোশাক , আসবাব, সাইকেল , কাঁসা-পিতলের বাসনপত্র, বাইক , ফ্রিজ, এসি কিছুই বাদ থাকে না যাকিছু লাগে নতুন সংসার করতে সবই আসে। শহরের বড় বড় দোকান থেকে ব্যবসায়ীরা আনন্দের সঙ্গে ওই সব জিনিস বিয়ের বাসর সাজাতে দিয়ে থাকেন।
শুধু শিবের বিয়ে নিয়ে মাতেন না  নবদ্বীপ। খর চৈত্রের দিনগুলাে, গাজন, নীল, চড়কের মতাে উৎসব সাড়ম্বরে পালিত হয়। সংক্রান্তির পাঁচ দিন আগে থেকে শুরু হয়ে যায়,শিবের গাজন উৎসব। শহরের কেন্দ্র স্থলে রয়েছে বিশালাকার শিব লিঙ্গ। ১৬৬৯ সালে প্রথমবার নদিয়ারাজ রাঘব মন্দির গড়ে এই শিব প্রতিষ্ঠা করেন। তবে গঙ্গার ভাঙনের ফলে সে মন্দির বিনষ্ট হয়। ১৮২৫ সালে তা আবার প্রতিষ্ঠা করা হয়। নবদ্বীপের শিবের বিয়ে উৎসব অন্তত ৫০০ থেকে ৬০০ বছরের প্রাচীন উৎসব বলে মনে করা হয়। তর্কের খাতিরে তিনশ বছরের কম এর বয়স নয়।
বাংলা সব জায়গায় চৈত্র মাসের শুক্ল ষষ্ঠি,সপ্তমী,অষ্টমী, নবমী ও বিজয়া দশমী তিথি মেনে পাঁচদিন বাসন্তী দুর্গা পুজো  হয়। নবদ্বীপের বাসন্তী পুজোয় অতিরিক্ত সংযোজন হলো এই শিবের বিয়ের অনুষ্ঠান। বাসন্তী পুজোর শেষ দিনে অনুষ্ঠিত হয় শিবের বিয়ের । বাসন্তী পুজোর ভোরে শিবের মুখোশ তৈরি করে সেটিকে চতুর্দলায় সাজিয়ে নিয়ে বর সাজানো হয়। অন্যদিকে দুর্গা ঠাকুরকে (বাসন্তী ঠাকুরকে) দোলায় সাজিয়ে শহরের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে অবশেষে পোড়ামা তলায় নিয়ে আসা হয়। সেখানে বাঙালি হিন্দু বিবাহ রীতি মেনে শিব ও মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার বিয়ে দেওয়া হয়। সাতপাকে ঘোরা থেকে শুরু করে মালা বদল জলসাজ সবই হয়। এর পর আতশবাজির বাজির পোড়ানো হয়।
চৈতন্যদেবের জন্মস্থান হলেও নবদ্বীপে শিবের উপাসনা প্রাক্ চৈতন্য যুগের। একমাত্র বৈষ্ণব প্রভাবিত কিছু কিছু অঞ্চলের কথা বাদ দিলে বাঙালি সমাজ এবং সংস্কৃতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুরুষ দেবতা হলেন শিব।তাছাড়া বৈষ্ণব মতে শিব হলেন পরম বৈষ্ণব।তবে নবদ্বীপের শিব উপাসনার পিছনে হয়তো বৌদ্ধ প্রভাব থাকতে পারে। তাই চৈতন্যধাম জুড়ে রয়েছে বহু শিব মন্দির। নবদ্বীপের চার দিকে রয়েছেন চার শিব। উত্তরে যুগনাথ বা যোগনাথ, দক্ষিণে আলোকনাথ, পুবে হংসবাহন এবং পশ্চিমে বুড়োশিব। তাছাড়া বালকনাথ, বাণেশ্বর, দণ্ডপাণি ও পলেশ্বর।নবদ্বীপে যে শিবের গাজন হয়, পণ্ডিতদের মতে তা গাজন আসলে বৌদ্ধদের ধর্মগর্জন থেকে এসেছে। নবদ্বীপ এক সময়ে বৌদ্ধ প্রভাবিত অঞ্চল ছিল।  সেন রাজবংশের সময় থেকেই নবদ্বীপে তন্ত্রের প্রভাব বাড়তে শুরু করে। সেই সময়ে তন্ত্র বা শক্তি সাধনার অঙ্গ হিসাবে ভৈরবী এবং ভৈরব বা শিবের আরাধনা শুরু হয়। বৌদ্ধ মূর্তিগুলিতে চোখ মুখ একে  শিবে রূপ দেওয়া হয়।
🙏বাঁকুড়ার ঘোড়ার সম্পর্কে কিছু তথ্য জানতে এই linkটা দেখতে পারেন 🙏
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=4087420051274256&id=249406185075681

কাঠালিয়া পুতুল

মুর্শিদাবাদের কাঠালিয়াতে পুতুলের মুখ তৈরি হয় ছাঁচে, দেহ তৈরি হয় কুমোরের চাকে। খড়ির সঙ্গে অভ্র মিশিয়ে চকচকে করা হয় পুতুলগুলি। তারপর রোদে শুকিয়ে লাল-কালো ডোরাকাটা রঙ করা হয়। চোখ মুখ আঁকা হয়।কাঁঠালিয়ার কুমোরেরা তৈরি করেন গ্রাম জীবনের অন্দরমহলের নানা দৃশ্য,যেমন-জাঁতা পেশাইরত মহিলা,গয়লানি,খোঁপা বাঁধা ইত্যাদি। এই সব পুতুলের দেহটা নির্মিত হয় চাকে, মুখটা তৈরি হয় ছাঁচে,হাত-পা ও অন্যান্য অংশ তৈরি হয় হাতে।



বাংলা র শৈশব একটা নিজেস্য বৈশিষ্ট্য ছিলো আগে , খেলানাতেও ছিলো শিল্পের ছোয়া । যেমন টেপা পুতুল।মাটি দিয়ে কুমোরর তৈরি একটি উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্ম হলো টেপা পুতুল। নরম এঁটেল মাটি দিয়ে হাতের নৈপুণ্য হাত দিয়ে টিপে তৈরি করে বলে এ পুতুলকে টেপা পুতুল বলে।  মাটির বুটি দিয়ে বা কাঠির রেখা টেনে এ পুতুলের অলংকার ও পোশাকের আভাস ফুটিয়ে তোলা হয়। পরে রোদে শুকাতে দেওয়া হয়। শুকানো হয়ে গেলে পোড়ানো হয় আগুনে।


সাধারণত বাচ্চাদের খেলনাসামগ্রী হিসেবে টেপা পুতুল বানানো হয়। উল্লেখযোগ্য কিছু খেলনা পুতুল হলো বউ-জামাই, কৃষক, নথ পরা বউ। শৌখিন ব্যক্তিরা গৃহসজ্জার জন্য এ পুতুল সাজিয়ে রাখেন। গ্রামবাংলার মেলায় টেপা পুতুলের দেখা মেলে এখনো। বর্তমানে শহুরে মেলায়ও এ পুতুল দেখা যায়।পুতুল। ছাঁচে ফেলে পুতুল সাথে এর পার্থক্য আছে হাতের নৈপুণ্য ও কারিগরি জ্ঞানের মাধ্যমে টিপে টিপে এই পুতুল তৈরি হয় এটি।টেপা পুতুল বাংলার ঐতিহ্যের একটি অংশ। কবে, কোথায় এ পুতুল বানানাে শুরু হয়েছে সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে মূলত মেয়েরাই টেপা পুতুল তৈরি করতো প্রথম দিকে। পুতুলের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ হাতের সাহায্যেই গড়ে তােলা হয় মাটি দিয়ে।


এখন এই ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে? একটা কারণ, চাহিদা কমেছে। শৌখিন পুতুলের সঙ্গে লড়াইয়ে অনেক দিন ধরে হারছে মাটির পুতুল। মেলা, হাটে রমরমা কমেছে। সেখানে মাটির পুতুলের চাহিদা প্রায় নেই বললেই চলে। মাটিরও অভাব। এখন মাটি কিনতে হয়। দাম বেশি পড়ে। শুধু পুতুল নয়, মাটির তৈরি অন্য জিনিসপত্রের চাহিদা কমেছে। মুর্শিদাবাদের হাতে টেপা পুতুল বেশ জনপ্রিয়৷ প্রথমে পুতুল তৈরির মাটিটা তৈরি করে তাকে হাত দিয়ে প্রয়োজনমতো নানান আকার দেওয়া হয়৷ আঙ্গুলের সাহায্যে লম্বা গোল নানান শেপ তৈরি করা হয়৷ মুর্শিদাবাদের কাঁঠালিয়া, পাঁচমোরাতে এই হাতে টেপা পুতুল তৈরি করা হয়৷ এইসব পুতুলে উঠে আসে গ্রামীণ সমাজ জীবনের চিত্র৷
এটি বাংলার সব থেকে প্রাচীন পুতুল বলে দাবি করতে পারেন। রাজা শশাঙ্ক এর সময় থেকে তৈরি হতো এই পুতুল। কারণ কর্নসুবর্ণথেকে এরকম পুতুল পাওয়া গেছিলো। তাইরাজা শশাঙ্কের আমল থেকেই এই পুতুলের আবির্ভাব বলে অনেকে মনে করেন । তবে  রাজা শশাঙ্কও পোড়া মাটির পুতুল কে সংস্কৃতির একটি অঙ্গ হিসেবে মনে করেছিলেন কারণ শুধু মাটির পুতুল নয় , মাটির বাসন , এছাড়াও সেই সময়ে অনেক বড় বড় প্রসাদ , মন্দির গাত্রেও পোড়ামাটির কাজ দেখতে পাওয়া যায় । তিনি মৃৎ শিল্পকে গুরুত্ব দিয়ে ছিলেন।
তাই এই পুতুলকে প্রাচীন কালের ঘরানা বলে মনে করা যেতেই পারে।


    কাঠালিয়া পুতুলে সমজের বিভিন্ন চরিত্রকে খুঁজে পাওয়া যায় । যেমন গোয়ালিনী , সন্তান কোলে এক মা , মেয়েদের একে ওপরের মাথার উকুন বাছা, বাচ্চাকে পায়ে শুইয়ে তেল মাখানো , দারোগা বাবু ,আরো বিভিন্ন রকমের ।

   


রাজপুর বিপত্তারিনী চন্ডী

দুর্গা তিনিই বিপদতারিনী,যিঁনি সমগ্র বিপদ থেকে রক্ষা করেন বা যিঁনি বিপদ সমূহ নাশ ।  তিনি দেবী সঙ্কটনাশিনী এবং দেবী দুর্গা(পার্বতী)-এর ১০৮ অবতারের অন্যতম। হিন্দুরা মূলত বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য এই দেবীর পূজা করেন।আষাঢ় মাসের রথ থেকে উল্টোরথের মধ্যে মঙ্গলবার ও শনিবার-এ হিন্দু মহিলারা বিপত্তারিণী ব্রত পালন করেন।আষাঢ়ে বাংলার অন্যতম উৎসব বিপত্তরিণী পুজো। তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, এই উৎসবটির মতো জনপ্রিয়তা খুব কম উৎসবের রয়েছে। বিপত্তারিণী পুজোর দিন থেকে লক্ষ করুন, কত জন মানুষ হাতে লাল ডোরে দুব্বোঘাস বেঁধে তাগা ধারণ করেছেন। স্পষ্ট বুঝতে পারবেন, বাংলার সংস্কৃতির অন্তঃস্থলে ঠিক কতটা জায়গা অধিকার করে রয়েছেন এই দেবী।
বিপদ তারিণী পুরাণে কৌশিকীদেবী নামে খ্যাতা।  তিনিই জয়দুর্গা,দেবীর উৎপত্তি হয়েছিলো  শিবের অর্ধাঙ্গিনী হিসাবে। দেবী পার্বতীর কৃষ্ণ কোশ থেকে- তাই তিনি কৌশিকী। কথিত আছে, শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক দুই অসুরের হাতে দেবতারা পরাজিত হয়ে হিমালয়ে গিয়ে মহামায়ার স্তব করতে লাগলেন। সেই সময় পরমেশ্বরী ভগবতী পার্বতী সেই স্থান দিয়ে যাচ্ছিলেন। দেবী তাদের স্তব শুনে বললেন –"আপনারা এখানে কার স্তব করিতেছেন?” সেই সময় ভগবতী পার্বতীর শরীর থেকে তার মতন দেখতে আর এক জন দেবী বের হয়ে আসলেন। সেই নব আবির্ভূতা দেবী জানালেন – “ইহারা আমারই স্তব করিতেছেন।” এই দেবী যুদ্ধে শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক অসুরের বধ করেছিলেন । এই দেবী মোহাচ্ছন্ন শুম্ভাসুরকে অদ্বৈত জ্ঞান দান করে বলেছিলেন-"এই জগতে এক আমিই আছি। আমি ছাড়া আমার সাহায্যকারিনী আর কে আছে? ওরে দুষ্ট ভাল করে দেখ , ব্রহ্মাণী প্রভৃতি শক্তি আমারই অভিন্না বিভুতি বা শক্তি। এই দেখ তারা আমার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।”আবার আরোএকটি গাঁথানুসারে ভগবান মহাদেব দেবী পার্বতীকে ‘কালী’ বলে উপহাস করেন। এতে দেবী ক্রুদ্ধ হয়ে তপস্যার মাধ্যমে নিজের “কৃষ্ণবর্ণা” রূপ পরিত্যাগ করলেন। সেই কৃষ্ণবর্ণা স্বরূপ দেবীই হলেন , দেবীর পার্বতীর অঙ্গ থেকে সৃষ্টা জয়দুর্গা, কৌশিকীদেবী ও বিপদতারিনীদুর্গা।
বিপত্তারিণী মা চণ্ডী দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার,  রাজপুরে অবস্থিত প্রাচীন এক দেবী প্রতিমা। কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গে এই মন্দির চণ্ডীর বাড়ি হিসাবে পরিচিত। মন্দিরে প্রতিদিন নিষ্ঠা সহকারে পুজো হয় এবং মন্দিরের সাথেই জড়িয়ে রয়েছে বহু মাহাত্ম্যপূর্ণ কাহিনী। আষাঢ় মাসের বিপত্তারিণী পুজোকে কেন্দ্র করে মন্দির চত্বরে ভক্তদের ভীড় দেখার মতন। শিয়ালদহ সাউথ স্টেশন থেকে ট্রেন পথে সােনারপুরে নেমে রাজপুর আসা যায়। এই রাজপুরেই অধিষ্ঠাতা হয়ে রয়েছেন মা বিপত্তারিণী।
বাবা দুলাল তাঁর প্রথম ইচ্ছায় দক্ষিণাকালীর মূর্তি তৈরি করতে দিয়েছিলেন। কিন্তু দেবী তাঁকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে বলেন দক্ষিণাকালী নয়, বিপত্তারিণী চণ্ডীর মূর্তি গড়তে। দেবী তাঁর রূপও বলে দেন, অর্থাৎ এখানে দেবী সিংহবাহিনী, তাঁর চার হাত, এক হাতে মহাশূল, এক হাতে খড়গ ও অন্য দুই হাতে বরাভয় ও অভয় দান করছেন তিনি। তিনি আরও জানিয়ে দেন, সকল ভক্তকে বিপদে উদ্ধার করতেই তিনি বাবা দুলালকে দিয়ে তাঁর প্রচার করাতে চান। শুধুমাত্র মূর্তিরই বর্ণনা নয়, তিনি পুজোর পদ্ধতিও শিখিয়ে গিয়েছিলেন দুলাল বাবাকে। সেই থেকে রাজপুরে মা বিপত্তারিণী চণ্ডী রয়েছেন।

নিয়ম অনুসারে এখানে সোজা রথ ও উলটোরথের মাঝের মঙ্গলবারে বিপত্তারিণীর পুজো হয়। পুজোর দিন একেবারে ভোর থেকেই এখানে ভক্ত সমাগম শুরু হয়ে যায়। সবাই মাকে তেরো রকমের ফল, মিষ্টান্ন দিয়ে পুজো দেন।
এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা বাবা দুলাল(দুলাল চন্দ্র দাস) নিয়ে কাহিনী প্রচলিত আছে । ১৩২৩ সনের কার্তিক মাসে কার্তিক পুজোর দিন ভোরে জন্ম নেন। ইনি জন্মানোর কিছুক্ষন পরেই ঐ ভোরের বেলায় কযেকজন অপরিচিত কীর্তনীয়া রাজপুর গ্রামের রাস্তা দিয়ে কীর্তন গেযে যেতে,যেতেই তাঁরা হঠাৎ করে শ্রী সাধন চন্দ্র দাসের বাড়ির ভিতরে ঢুকে বাবা দুলাল যে ঘরে জন্মান সেই ঘরের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কীর্তন গাইতে লাগলেন, ” যশোদা নন্দন,নন্দের দুলাল এলো রে, রাজপুর ধামেতে বাবা দুলাল এলো রে ” । শোনা যায় শিশু দুলাল একদিন পাঠশালায় পডার শেষে বাকিন্তু সাধনবাবু ছেলেকে বললেন,আমরা বংশগত বিচারে ব্রাহ্মণ নয,আমরা নীচ জাতির, মাহিষ সম্প্রদায়ের, তাই আমাদের ঐ পূজা দেখা ঠিক নয়।" বাবা সাধনবাবু ছেলের বাযনার কাছে হেরে গিয়ে বললেন, “ঠিক আছে,নিয়ে যেতেই পারি,কিন্তু তোমাকে প্রচুর শীত বস্ত্র পডতে হবে, নাহলে শীতের রাতে ঠান্ডা লেগে যাবে।শিশু দুলাল বাবার বায়না মেনে তাতেই রাজি হয়ে গেল ।সেখানে পৌঁছিয়ে দেখা গেলো মা চন্ডী যেন তাকে দেখে হাসছেন,যেন চেনা লোকের সঙ্গে মা চন্ডীর হঠাত দেখা হয়ে গিয়েছে,তাই তিনি হাসেছেন। এপর থেকে তার মনের আয়নায় মা চন্ডীর ত্রিনয়নী মুখ বারংবার ভেসে উঠতে লাগল। এর কিছুদিন পরে ঠাকুরদার পিঠ চুলকিযে পাওয়া টাকানিয়ে পটুয়াপাড়ায গিয়ে মা চন্ডীর ছোট মূর্তি তৈরির বায়না করলেন । মূর্তি তৈরি হলে সেই শিশু দুলাল নিজে মাতৃমূর্তি চন্ডী মায়ের মূর্তি মাথায় নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিলে পটুয়া তাঁকে বাধা দেয় , শিশু মৃন্ময়ী মাতৃমূর্তি মাথায় নিয়ে বাড়ি যেতে পারবে না । সবাইকে অবাক করে শিশু দুলালের মাথায় মা চন্ডীর মাতৃমূর্তি উঠিয়ে নিলেন অনায়াসে।এসব কান্ডর কথা সবার অজানা। পাঠশালা থেকে ছেলে কোথায় গেলো সেই নিয়ে সবাই চিন্তিত।শিশু দুলাল একটা মৃন্ময়ী চন্ডী মাতৃমূর্তি মাথায় নিয়ে বাড়ির দিকে আসছে।এই দৃশ্য দেখেই তিনি প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পড়লেন তাঁর বাবা।  তিনি দুলালকে বললেন,”তুমি এই চন্ডী মূর্তি নিয়ে ঘরে ঢুকবে না।ঐ মূর্তি সদর দরজার বাহিরে রাস্তায় রেখে ঘরে ঢুকবে কারন আমরা নিম্ন বর্নের মানুষ,তাই আমাদের ঐ মূর্তি ঘরে ঢোকানোর অধিকার নেই।তুমি ঐ মূর্তি দরজার বাহিরে রেখে ঘরে ঢুকবে “।এই কথা তিনি বললেও শিশু দুলাল কোন উওর না দিয়ে মাতৃমূর্তি মাথায় নিয়ে বাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকলেন। দুলাল জননী তখন দুলালের এই রকম অবাধ্যতা দেখে খুব রেগে গিয়ে বাড়ির উঠোনে একটু ঝোপঝাড়ে রাখা একটা বেতের ডাল নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শিশু দুলালকে মারতে শুরু করলেন কিন্তু শিশু দুলাল নির্বিকার।তখন শিশু দুলালেকে ঠাকুরদা রক্ষা করলেন এই মার খাওয়া র হাত থেকে । রাতে দুলাল এর  মা  স্বপ্নে দেখলেন,যেন একটা শ্যামবর্না অপরুপা সুন্দরী কিশোরী কন্যা লাল বেনারসি শাডি পরে যেন,আডাল থেকেই তাঁকে বলছে,”তুই আমার পিঠের দিকে তাকিয়ে দেখ,আমার পিঠে কিরকম কালশিটে দাগ পডেছে।তুই দুলালকে মারলি, বেত দিয়ে। ঐটুকু বাচচা ছেলে কি ঐরকম মার সহ্য করতে পারে?সেইজন্যই দুলালের পিঠের উপরে আমার পিঠ দিয়ে ওকে রক্ষা করতে চেষ্টা করেছি বলে,আমার পিঠে কালশিটে দাগ পড়েছে।"এইকথা বলে সেই শ্যামবর্না অপরুপা সুন্দরী কিশোরী কন্যা অদৃশ্য হয়ে গেলেন, স্বপ্নে। তখনই দুলাল জননীর ঘুম ভেঙে গেলে তিনি বুঝতে পারলেন,এই শ্যাম বর্না কিশোরী কন্যা স্বয়ং মা চন্ডী।তিনি ছাড়া অন্য কেউ নন। দুলাল জননী তারপর চন্ডী প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করলেন‌।সেই থেকেই আজও মাযের মৃন্ময়ী মূর্তি শিশু দুলালের বাড়িতে পূজিতা হয়ে আসছেন,দুলালের অবর্তমানেও।এইভাবে মা চন্ডী বাবা দুলালের গৃহে মৃন্ময়ী মাতৃমূর্তিতে প্রতিষ্ঠিত হলেন। এরপরের পর্যায়গুলিতে মা চন্ডী বাবা দুলালের সাথে কিভাবে লীলা করেছিলেন তা ধীরে ধীরে প্রচারিত হতে থাকে।

লোকজন বিশ্বাস করেন রাজপুর বিপত্তারিনী চন্ডী বাড়িতে মায়ের আরতির সময় মাকে আপনার সমস্যা জানান,মা ঠিক সমাধান করে দেবেন। এখানে মা চন্ডীকে ভগবান ভেবে নয়,নিজের মা ভেবে সব কিছু মনে মনে জানান,মা নায্য বিচার করে সমাধান করে দেবেন।

Friday, 19 November 2021

ইতু পূজা

ছট পূজা নিয়ে পোস্ট করতে গিয়ে মনে পরলো। বাঙালি মেয়েরাও সূর্য পূজা করেন। ইতু পূজা।ইতু শব্দটি মিতু অর্থাৎ মিত্র থেকে এসেছে। সুতরাং মিত্র>মিতু>ইতু। মিত্র শব্দের অর্থ সূর্য। অগ্রহায়ণ মাসে সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে অবস্থান করে এবং এই অবস্থানে সূর্যের নাম মিত্র। এই থেকেই বাংলার ঘরে ঘরে ইতু পুজো শুরু হয়। সুতরাং ইতু পূজা মানে সূর্য পূজা।তবে, আচার্য সুকুমার সেন ইতু পুজোর ইতিহাসকে অন্য আঙ্গিকে তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, ইতু হলেন প্রাচীন ইন্দ্রপূজার দৃষ্টান্ত। ঋকবেদীয় সূক্তগুলোর নাম ইন্দ্রস্তূপ, সেখান থেকে ইন্দথথু>ইতু। তাঁর মতে, মেয়েরা ইন্দ্রের মতো বর পাওয়ার বাসনায় ইন্দ্রদ্বাদশীর দিন ইতু পূজা করে।তবে বাংলার মেয়েরা ইতুকে শস্যের দেবী হিসেবেই পূজা করে থাকে। ইতু পূজা বাংলার একটি লোকউৎসব। অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি রবিবার করে এ ব্রত রাখেন মেয়েরা‌।বাংলার মেয়েরা যে ব্রত গুলো করেন তার অনেক গুলো ই কৃষি সংক্রান্ত।  যেমন ,পুণ্যিপুকুর ব্রত বাংলার হিন্দুসমাজের অশাস্ত্রীয় বা মেয়েলি ব্রতগুলির অন্তর্গত একটি কুমারীব্রত। গ্রামীণ বাংলার বাঙালি হিন্দুঘরের পাঁচ থেকে নয় বছর বয়সী কুমারী মেয়েরা চৈত্র মাসের সংক্রান্তি থেকে বৈশাখ মাসের শেষদিন (সংক্রান্তি) পর্যন্ত একমাসব্যাপী এই ব্রত পালন করে। ব্রতের উদ্দেশ্য হল বৈশাখ মাসের খরায় যাতে পুকুর জলশূন্য না হয় অথবা গ্রীষ্মঋতুতে যেন গাছ না মরে এবং ফসল যেন ভাল হয়। 
যাইহোক।প্রাচীনকালে কুমারী মেয়ের ভালো স্বামী সবার আশায়  সূর্যের পুজো করতো।
 যেমন,মহাভারতে কুন্তীর সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন সূর্যদেব।সূর্যের অপর নাম আদিত্য। এই আদিত্য থেক ইতু শব্দটি এসেছে। শাক্তধর্মের প্রভাবে ইতু ক্রমশ দেবীতে পরিণত হয়েছেন। সূর্যদেবতা থেকে ইতু শষ্যদেবী লক্ষ্মীতে রূপান্তরিত হয়েছেন। এইকারণে তিনি ইতুলক্ষ্মী নামে রাঢ়বাংলায় পূজিত।
তবে আগে অগ্রহায়ণ মাসে নতুন বছর শুরু হতো। এই সময়ে রবিশস্য বিশেষ করে গম যব সরিষা ইত্যাদি ফসল লাগানো হতো। কৃষির সঙ্গে প্রজনন সমার্থক। সুতরাং বোঝাই যায় ইতু আসলে সেই রবিশস্যের অঙ্কুরোদ্গমের কৃষি উৎসব।কার্তিকসংক্রান্তির দিন ইতু-উৎসবের সূচনা। সমাপ্ত হয় অগ্রহায়ণ সংক্রান্তিতে। প্রতি রবিবারে মেয়েরা ইতুর ঘট এনে পুজো করে। ইতু পুজোয় লাগে চাল-কলাইয়ের নৈবেদ্য। আর ভোগে লাগে ভাজাপোড়া অর্থাৎ চাল-কলাই ভাজা। সংক্রান্তির দিনে ইতুলক্ষ্মীর বিশেষ ভোগে থাকে সরুচাকলির পদ। সেদিন পুজোর ফুল বলতে হলুদ সরিষার ফুল। পুজোর পর ইতুকে নদীতে বা পুকুরে বিসর্জন দেওয়ার রীতি।বাংলা মেয়েরা নিজেরাই এই পুজো করে থাকেন। ইতুকে সাধভক্ষণের প্রথাও রয়েছে কোথাও কোথাও। সেদিন নতুন গুড় ও চাল দুধ দিয়ে পরমান্ন তৈরি করে নিবেদন করা হয়।প্রধানতঃ রবিবার পুজো করা হয় বলে সূর্যের পুজো বলা হয়। অবশ্য ইতু পুজোকে সূর্য উপাসনা বলা হলেও এই পুজোর রীতিও উপাচার বিশ্লেষণ করে ইতুকে মাতৃকাদেবী রূপেই গণ্য করে অনেকে। আসলে ইতুর ঘটের গায়ে পুতুলি আঁকা এবং ভেতরে শস্যদানা ও তৃণগুচ্ছ রাখা আর প্রতীকী শষ্যক্ষেত্র মাতৃপ্রতীক বলেই মনে হয়।
ছবি, সঞয় ঘোষ
🙏চন্ডী পূজা নিয়ে কিছু কথা জানতে এই linkটা দেখতে পারেন 🙏
https://www.facebook.com/249406185075681/posts/4230456863637240/

Thursday, 18 November 2021

বাবু পুতুল

রানি পুতুল থেকে সাহেব মেম পুতুল  এর কথা যখন বলেছি  তখন বাবু পুতুল এর কথা বাদ যায় কেন? তবে তার আগে বলে নিতে হবে একটি অন্য গল্প। 
কলকাতা গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্য কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।  এদেশে তখন ইউরোপীয় ধারার চিত্রকলার সূচনা হয়েছে। দেখা গেল  যে কালীঘাট পটচিত্রের ধারা আদরনীয় হয়ে উঠেছে তখন। বাংলা শিল্পকলা ধারায় কালীঘাট পট চিত্ররীতি শুধু জনপ্রিয়ই নয়, তার রয়েছে এমন এক নিজস্ব শৈলীকলা।
তীর্থযাত্রীরা কালীঘাটে এলে তীর্থের স্মারক হিসেবে এই পট কিনে নিয়ে যেতেন সে সব দিনে। সেই চাহিদা অনুসারে আঁকা হত  শিব, কালী, রাম-সীতা, ইত্যাদিই ছবি । বালির মিলে তৈরি চৌকো আকৃতির কাগজে  আঁকা হত এই পট। তাই এই পটকে বলা হত ‘চৌকশ’।  বাংলার জড়ানো পটের থেকে আলাদা হয়ে যায় এই পট।
তীর্থযাত্রীদের জন্য তৈরি বলে গোড়ায় ছবির বিষয় দেবদেবী হলেও পরবর্তীকালে সমাজ সমালোচনায় মনোনিবেশ করেন শিল্পীরা। তাই  শিব, দুর্গা, কালী-র বিষয় থেকে বেড়িয়ে গিয়ে শিল্পীরা আঁকলেন ‘আলালের ঘরের দুলাল’, ‘বাবু ও বেশ্যা’, ‘ঘরে ছুঁচোর কেত্তন আর বছরে কেঁচোর পত্তন’ জাতীয় ছবিগুলি। পাশাপাশি দেখা গেল শুধু মাত্র আঙ্গিকে নয়, রূপের আদর্শেও  কালীঘাট বিশিষ্টতা অর্জন করল।পুরুষের  পটলচেরা চোখ, ধনুকাকৃতি ভ্রু, বাবরি করা চুল, নধর বাবু । নারীরা হল সুপুষ্ট দেহ আর লীলায়িত ভঙ্গিমা। চব্বিশ পরগনার মাটির পুতুল হয়ে উঠল কালীঘাট পটচিত্র শৈলীর অনুপ্রেরণা।
এবার আসি দঃ ২৪ পরগনার কথায়। এখনকার মজিলপুর শহরের পশ্চিমাংশের বিস্তৃত ধানক্ষেত 'গঙ্গার বাদা'র উপর দিয়েই আদিগঙ্গার প্রবাহ বইত। আদিগঙ্গার মজাগর্ভে নতুন বসতির উৎপত্তি হয়েছিল বলেই এই শহরের নাম 'মজিলপুর' হয়েছে। সপ্তদশ শতকের গোড়ার দিকে ভাগ্যবিপর্যয়ের ফলে যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের আমলা-অমাত্য, ব্রাহ্মণ-কায়স্থ, পণ্ডিত-পুরোহিতরা সুন্দরবনের এই জঙ্গলাকীর্ণ জনবিরল স্থানে বসবাস শুরু করেন।
প্রায় ২৫০ বছর আগে দত্ত-জমিদাররা কালীচরণ পেয়াদাকে যশোহর থেকে জয়নগরে এনেছিলেন। শোনা যায় কালীচরণ নাকি মাটি দিয়ে ‘টেপা পুতুল’ তৈরি করতেন। তাঁর ছেলে জানকীনাথ দাস জয়নগরে পুতুল তৈরি শুরু করেন। তাঁরই উত্তর পুরুষ শম্ভুবাবুর ঠাকুরদা মন্মথনাথ  জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। মন্মথের কাজ আজও দেখা যায় দেশ বিদেশের বিভিন্ন সংগ্রহালয়ে। এ ছাড়াও শম্ভুবাবুর বাবা পাঁচুগোপাল দাসও ছিলেন নাম করা শিল্পী। আজ নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও শম্ভু আঁকড়ে ধরে রেখেছেন এই শিল্পকে।
জয়নগর মজিলপুরের পুতুল দু’প্রকার। হাতে তৈরি এবং ছাঁচের। প্রচলিত দেবদেবীর পাশাপাশি তৈরি হয় নানা লৌকিক দেবদেবীর মূর্তি। হাতে তৈরি পুতুলের মধ্যে নারায়ণী, শীতলা, বনবিবি, দক্ষিণরায়, পঞ্চানন, মানিকপীর, আটেশ্বর, দক্ষিণেশ্বর উল্লেখযোগ্য। আর ছাঁচের পুতুলের মধ্যে রয়েছে গণেশজননী, জগদ্ধাত্রী, রাধাকৃষ্ণ, কালিয়দমন, ষড়ভূজচৈতন্য, কলকাতার বাবু, গয়লা-বৌ, কৃষক ইত্যাদি। এ ছাড়াও রথের সময় জগন্নাথ, ঝুলন-জন্মাষ্টমীর সময় রাধা-কৃষ্ণ, গোপাল, নববর্ষে লক্ষ্মী-গণেশের মূর্তির তৈরি করা হয়।আট পুরুষ ধরে, তৈরি করছে এরা পুতুল। বাংলার বাবুদের কৃত্রিমতা, ঔদ্ধত্যকে কটাক্ষ করে মজিলপুরে বাবু পুতুল বানানো শুরু হয়েছিল, সেগুলো এখনও জনপ্রিয়। তবে এই পুতুল গুলো তে কালিঘাট এর পটের  প্রভাব রয়েছে।
Manab Mondal

নেংটা কার্তিক

ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় দক্ষিণ ভারতে কার্তিকের পূজা অধিক জনপ্রিয়।কার্তিকেয় বা কার্তিক হিন্দু যুদ্ধদেবতা। তিনি শিব ও পার্বতীর সন্তান।  তিনি পৌরাণিক দেবতা। প্রাচীন ভারতে সব জয়গায় কার্তিক পূজা প্রচলিত ছিল। কার্তিক কিন্তু কুমার নয়।ভগবান কার্তিকের স্ত্রী হলেন দেবসেনা ও বালি(বল্লী)। সুরাপদ্মনকে বধ করার পর দেবরাজ ইন্দ্র নিজ কন‍্যা দেবসেনার সঙ্গে কার্তিকের বিয়ে দেন। পরে নম্বিরাজের কন্যা বালি-র সঙ্গে কার্তিকের বিয়ে হয়।
বাংলা য় ধারণা আছে,কার্তিক ঠাকুরের তার কৃপা পেলে পুত্রলাভ , ধনলাভ হয় ৷সেজন্য বিয়ে হয়েছে কিন্তুু এখনও সন্তান হয় নি এমন দম্পতির বাড়ির সামনে কার্তিক ঠাকুরের মূর্তি ফেলা হয় ।সুঠাম গড়নের ল্যাংটো কাটোয়ার কার্তিক লড়াই খুব বিখ্যাত। কাটোয়ার কার্তিক পুজো বিখ্যাত , এখানে এক পুজোর সঙ্গে অন্য পুজোর প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে কার্তিক লড়াই বলে।
বাংলা মাসগুলির মধ্যে একমাত্র কার্তিক মাস বাদ দিয়ে আরও কোনও মাসের নাম কোনও দেবতার নামে উৎসর্গ করা হয়নি। হেমন্তকালের মাস কার্তিকই ছিল প্রাচীনবাংলার সমাজে বছরের প্রথম মাস এবং লক্ষ্মীর পাশাপাশি কার্তিকই ছিলেন প্রধান দেবতা। এই কার্তিক কিন্তু মা দুর্গার সন্তানরূপে পূজিত কার্তিক নন, বরং প্রজনন ও কৃষির দেবতা তথা রাঢ়দেশীয় কৃষিসংস্কৃতির প্রধান প্রতিভূ। তাই রাঢ়বঙ্গে অঘ্রান মাসে নবান্নের প্রধান দেবতাও কার্তিক ।

অঘ্রান মাসেই বাঙালি চাষির ঘরে থাকত ফসলের প্রাচুর্য, তাই মুঘল আমলে পয়লা অঘ্রান ছিল বাঙালি নববর্ষ।  মূলত কৃষিপ্রধান ও নদীতীরবর্তী অঞ্চল শস্য উৎপাদনে শ্রেষ্ঠ হয় বলেই গঙ্গা তীরবর্তী কাটোয়া, পূর্বস্থলী ও বাঁশবেড়িয়া অঞ্চলে আদিকাল থেকে কার্তিক পূজার খ্যাতি দেখা যায়। 
কাটোয়া মহকুমার গ্রামাঞ্চলে কৃষিদেবতা রূপে পূজিত হলেও শহর কাটোয়ার সঙ্গে কার্তিক জড়িয়ে আছেন বণিক ও বারবনিতাদের সম্মিলিত প্রয়াসের সঙ্গে।  এক সময় কাটোয়া একটা  সমৃদ্ধ শহর ছিলো।ফুর্তির জন্যও প্রচুর রক্ষিতা থাকত। আর তৎকালীন কাটোয়া  ছিল কিছু অঞ্চল বন আর কিছু অংশ কৃষিক্ষেত অঞ্চল। তাই ভাগীরথী তীরে সেই বারবণিতাদের অন্ধকার জীবনে একটা আশ্রয় খুঁজতে তারা তাদের প্রিয় বাবুদের কাছে বায়না করে সন্তানলাভের জন্য। যদিও সমাজব্যবস্থায় গণিকার সন্তানকে কেউ মেনে নেয় না।  বাবুরা নিষিদ্ধপল্লিতে কার্তিক পুজোর আয়োজন করে। কার্তিক এমনিতেই প্রজননের দেবতা, প্রাচীনকালে নিষিদ্ধপল্লিতে তাঁর পুজোও হত।  কাটোয়ার নিষিদ্ধপল্লির সেই গণিকাদের বাসনার ঠাকুর নেংটো কার্তিক বা অনেকে বলেন খোকা কার্তিক ক্রমেই জনপ্রিয়তা লাভ করে।
কাটোয়া মহকুমার কার্তিক মূলত ন্যাংটা কার্তিক বা খোকা কার্তিক,।  একজন শিশুকে ভুলিয়ে রাখার মতো এই কার্তিককে পূজায় দিতে হয় বিভিন্ন ধরণের খেলনা, বেলুন, মোয়া, কদমা, লাড্ডু। মানতকারী মানুষের শিশুলাভের কামনা থেকেই এই উপকরণগুলিকে পূজায় উঠে এসেছে বলে মনে করা হয়।
সাবেক কার্তিক লড়াই ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে থিমের লড়াইয়ের। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে শহর ও শহরতলি জুড়ে তৈরি হচ্ছে দেবসেনাপতির মণ্ডপ। প্রতি বছরই বাজেট বাড়ছে পুজো কমিটিগুলির, বাড়ছে আড়ম্বর।
কে কত ভালো থিম করতে পারে তা নিয়ে রীতিমত যুদ্ধ চলছে। আর তাতেই উঠে আসছে নিত্যনতুন বিষয় ভাবনা। বড় পুজোগুলি যেখানে বাইরে থেকে থিমের মণ্ডপ আনছে, ছোট পুজো স্বল্প খরচে বানিয়ে ফেলছে নিজেদের থিম। কেউ কাউকে জায়গা ছাড়তে রাজি নয় ।
সব মিলিয়ে কার্তিক পুজো ঘিরে জমে উঠেছে আয়োজকদের লড়াই।

Wednesday, 17 November 2021

করগঙ্গার শিব মন্দির

আজ এমন একটি অপরিচিত শিব মন্দিরে কথা বলতে চাই,  যেটি মনসা মঙ্গল কাব্য সাথে জড়িত। মঙ্গল কাব্য হলো বাংলার নিজের। মহাভারত রামায়ণ এর চেয়ে এটা আলদা। মঙ্গলকাব্য বিশারদ আশুতোষ ভট্টাচার্য মনসামঙ্গল কাব্যের সম্পর্কে এরকম বলেছেন “রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ-নিরপেক্ষ একটি স্বাধীন লৌকিক কাহিনী” ।খ্রিষ্টীয় দশম-একাদশ শতাব্দী থেকে বাংলায় মনসার মূর্তিনির্মাণ শুরু হয়। মনসামঙ্গল কাব্যের মূল লৌকিক কাহিনিটি তারও আগে থেকে পল্লিগীতি ও ছড়ার আকারে বাংলার লোকসমাজে প্রচলিত ছিল বলে অনুমান করা হয়। খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে এক লোককথাটি শক্তিশালী কবিদের নিপুণ হাতে পড়ে কাব্যকৃতির রূপ নেয়। ক্রমে তার মধ্যে নানা উপকাহিনি ও পৌরাণিক উপাখ্যানের সমাবেশ ঘটে।বৈদ্যপুর, উদয়পুর, হাসনহাটি প্রভৃতি গ্রামের নামকরণ হয়েছে এই কাব্য অনুসারে৷লৌকিক দেবী হলেও কালক্রমে মনসা ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক হিন্দুসমাজেও প্রতিপত্তি অর্জন করে; এমনকি চৈতন্যদেবের সমসাময়িক কালে শিক্ষিত বাঙালি সমাজেও মনসার পূজা প্রচলিত হয়।
এই কাব্যে সেযুগের হিন্দু বাঙালি সমাজের সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি সম্পর্কে নানা অনুপূঙ্খ বর্ণনা পাওয়া যায়। চাঁদ সদাগর শুধুমাত্র এই কাব্যেরই নয়, বরং সমগ্র বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বলিষ্ঠ চরিত্র; বেহুলা-লখিন্দরের করুণ উপাখ্যানটিও তার মানবিক আবেদনের কারণে আজও বাঙালি সমাজে জনপ্রিয়।

চাঁদ সদাগর মনসামঙ্গল কাব্যধারার একটি কিংবদন্তি চরিত্র। তিনি ছিলেন প্রাচীন ভারতের চম্পক নগরের একজন ধনী ও ক্ষমতাশালী বণিক। যদিও বিপ্রদাস পিপলাই তার মনসামঙ্গল কাব্যে উল্লেখ করেছেন যে, চাঁদ সদাগরের বাণিজ্যতরী সপ্তগ্রাম ও গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত ত্রিবেণী হয়ে সমুদ্রের পথে যাত্রা করত।তবে আদি গঙ্গাকে তাঁর বানিজ্য পথ বলেই ধরে নেওয়া হয়। লোকজন দাবি চাঁদ সওদাগর এই আদি গঙ্গার তীরে অনেক গুলো শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গড়িয়া মহামায়া তলা অঞ্চলের তেঁতুলতলা করগঙ্গা শিব জোড়ামন্দির ও নাকি চাঁদ সওদাগর প্রতিষ্ঠিত।
ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতার বিশিষ্ট ধনী ভোলা দত্ত নিজেকে চাঁদ সদাগরের বংশধর বলে দাবি করতেন। তিনি মনসামঙ্গলে বর্ণিত ‘শঙ্কর ভবানী’ মূর্তি পূজা করতেন। তার বংশধরেরা আজও সেই শিবদুর্গা মূর্তিরই পূজা করে পাশে বসে থাকে কার্তিক গণেশ ও লক্ষ্মী ও সরস্বতী মায়ের ছেলে মেয়েরা আসছেন। এই মূর্তিতে দুর্গা শিবের কোলে বসে থাকেন; দেবী সপরিবারে থাকলেও মহিষাসুর থাকে না; দেবীও সিংহের পরিবর্তে শিবের বৃষস্কন্ধে বসে থাকেন।পায়ের তলায় নিজে বসে দেবীর বাহন বীর কেশর সিংহ।
অতিতে  ভাগীরথী খাতে প্রবাহিত গঙ্গা নদীর নিম্ন প্রবাহটি একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে যেমন ছিল, তেমনটি আগে ছিল না। ব্যান্ডেলের কাছে ত্রিবেণীতে এটি তিনটি শাখায় ভাগ হয়ে যেত। দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে সপ্তগ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যেত সরস্বতী নদী। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বয়ে যেত যমুনা নদী মাঝখান দিয়ে বইত হুগলি নদী। এখন যেখানে কলকাতা শহর সেখানে হুগলি বাঁক নিত এবং কালীঘাট, বারুইপুর ও মগরা হয়ে সমুদ্রে গিয়ে মিশত। এই আদি খাতটিকেই বলা হয় আদিগঙ্গা।
এখন টালিগঞ্জ, আজাদগড়, রানিকুঠি, নেতাজিনগর, আলিপুর, বাঁশদ্রোণী, নাকতলা, রথতলা, বৈষ্ণবঘাটা, গড়িয়া, বোড়াল, মহামায়াতলা, নরেন্দ্রপুর, রাজপুর, হরিনাভি, কোদালিয়া, চাঙারিপোতার (অধুনা সুভাষগ্রাম) মধ্যে দিয়ে আদিগঙ্গা প্রবাহিত। এই পর্যন্ত আদিগঙ্গা "টালির নালা" নামেও পরিচিত। এর পর মাহিনগর ও বারুইপুর (আগে অতিসারা গ্রাম) হয়ে এটি পৌঁছেছে জয়নগর ও মজিলপুরে। শেষপর্যন্ত আদিগঙ্গা মিশেছে বঙ্গোপসাগরে।নগরায়ণের ফলে আদিগঙ্গার অধিকাংশ অংশ শুকিয়ে গেছে। বিশেষ করে  বর্তমানে  নরেন্দ্রপুর থেকে রাজপুর-সোনাপুর পর্যন্ত তিন কিলোমিটার এলকায় বস্তুত কোনো নদীর নাম নিশানা নেই। এসব স্থানে নির্মান করা হয়েছে কংক্রিটের দালান, কমিউনিটি হল আর রাস্তাঘাট। খুব কাছেই দেখা যায় দীর্ঘায়িত কিছু জলাধার বা পুকুর যেগুলো আবার নামকরণও করা হয়েছে, যেমন ‘করের গঙ্গা’, ‘ঘোষের গঙ্গা’ বোসের গঙ্গা' প্রভৃতি। নানা নামে অভিহিত হয়ে বৃহৎ পুষ্করিণী আকারে পূর্ণ গঙ্গা মর্যাদায় অস্তিত্ব রক্ষা করে চলেছে। এর তীরে তীরে এখনও বহু শশ্মানঘাট বিদ্যমান। আর এই আদি গঙ্গার মন্দির গুলো প্রমাণ করে, বানিজ্য করতে যাবার জন্য বনিক সম্প্রদায় তাদের ইষ্ট দেবতার পূজা র জন্য এইসব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাই করগঙ্গা শিব মন্দির টি যত জীর্ণ হোক এটি বাঙালির ঐতিহ্য।