রানি পুতুল থেকে সাহেব মেম পুতুল এর কথা যখন বলেছি তখন বাবু পুতুল এর কথা বাদ যায় কেন? তবে তার আগে বলে নিতে হবে একটি অন্য গল্প।
কলকাতা গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্য কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এদেশে তখন ইউরোপীয় ধারার চিত্রকলার সূচনা হয়েছে। দেখা গেল যে কালীঘাট পটচিত্রের ধারা আদরনীয় হয়ে উঠেছে তখন। বাংলা শিল্পকলা ধারায় কালীঘাট পট চিত্ররীতি শুধু জনপ্রিয়ই নয়, তার রয়েছে এমন এক নিজস্ব শৈলীকলা।
তীর্থযাত্রীরা কালীঘাটে এলে তীর্থের স্মারক হিসেবে এই পট কিনে নিয়ে যেতেন সে সব দিনে। সেই চাহিদা অনুসারে আঁকা হত শিব, কালী, রাম-সীতা, ইত্যাদিই ছবি । বালির মিলে তৈরি চৌকো আকৃতির কাগজে আঁকা হত এই পট। তাই এই পটকে বলা হত ‘চৌকশ’। বাংলার জড়ানো পটের থেকে আলাদা হয়ে যায় এই পট।
তীর্থযাত্রীদের জন্য তৈরি বলে গোড়ায় ছবির বিষয় দেবদেবী হলেও পরবর্তীকালে সমাজ সমালোচনায় মনোনিবেশ করেন শিল্পীরা। তাই শিব, দুর্গা, কালী-র বিষয় থেকে বেড়িয়ে গিয়ে শিল্পীরা আঁকলেন ‘আলালের ঘরের দুলাল’, ‘বাবু ও বেশ্যা’, ‘ঘরে ছুঁচোর কেত্তন আর বছরে কেঁচোর পত্তন’ জাতীয় ছবিগুলি। পাশাপাশি দেখা গেল শুধু মাত্র আঙ্গিকে নয়, রূপের আদর্শেও কালীঘাট বিশিষ্টতা অর্জন করল।পুরুষের পটলচেরা চোখ, ধনুকাকৃতি ভ্রু, বাবরি করা চুল, নধর বাবু । নারীরা হল সুপুষ্ট দেহ আর লীলায়িত ভঙ্গিমা। চব্বিশ পরগনার মাটির পুতুল হয়ে উঠল কালীঘাট পটচিত্র শৈলীর অনুপ্রেরণা।
এবার আসি দঃ ২৪ পরগনার কথায়। এখনকার মজিলপুর শহরের পশ্চিমাংশের বিস্তৃত ধানক্ষেত 'গঙ্গার বাদা'র উপর দিয়েই আদিগঙ্গার প্রবাহ বইত। আদিগঙ্গার মজাগর্ভে নতুন বসতির উৎপত্তি হয়েছিল বলেই এই শহরের নাম 'মজিলপুর' হয়েছে। সপ্তদশ শতকের গোড়ার দিকে ভাগ্যবিপর্যয়ের ফলে যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের আমলা-অমাত্য, ব্রাহ্মণ-কায়স্থ, পণ্ডিত-পুরোহিতরা সুন্দরবনের এই জঙ্গলাকীর্ণ জনবিরল স্থানে বসবাস শুরু করেন।
প্রায় ২৫০ বছর আগে দত্ত-জমিদাররা কালীচরণ পেয়াদাকে যশোহর থেকে জয়নগরে এনেছিলেন। শোনা যায় কালীচরণ নাকি মাটি দিয়ে ‘টেপা পুতুল’ তৈরি করতেন। তাঁর ছেলে জানকীনাথ দাস জয়নগরে পুতুল তৈরি শুরু করেন। তাঁরই উত্তর পুরুষ শম্ভুবাবুর ঠাকুরদা মন্মথনাথ জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। মন্মথের কাজ আজও দেখা যায় দেশ বিদেশের বিভিন্ন সংগ্রহালয়ে। এ ছাড়াও শম্ভুবাবুর বাবা পাঁচুগোপাল দাসও ছিলেন নাম করা শিল্পী। আজ নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও শম্ভু আঁকড়ে ধরে রেখেছেন এই শিল্পকে।
জয়নগর মজিলপুরের পুতুল দু’প্রকার। হাতে তৈরি এবং ছাঁচের। প্রচলিত দেবদেবীর পাশাপাশি তৈরি হয় নানা লৌকিক দেবদেবীর মূর্তি। হাতে তৈরি পুতুলের মধ্যে নারায়ণী, শীতলা, বনবিবি, দক্ষিণরায়, পঞ্চানন, মানিকপীর, আটেশ্বর, দক্ষিণেশ্বর উল্লেখযোগ্য। আর ছাঁচের পুতুলের মধ্যে রয়েছে গণেশজননী, জগদ্ধাত্রী, রাধাকৃষ্ণ, কালিয়দমন, ষড়ভূজচৈতন্য, কলকাতার বাবু, গয়লা-বৌ, কৃষক ইত্যাদি। এ ছাড়াও রথের সময় জগন্নাথ, ঝুলন-জন্মাষ্টমীর সময় রাধা-কৃষ্ণ, গোপাল, নববর্ষে লক্ষ্মী-গণেশের মূর্তির তৈরি করা হয়।আট পুরুষ ধরে, তৈরি করছে এরা পুতুল। বাংলার বাবুদের কৃত্রিমতা, ঔদ্ধত্যকে কটাক্ষ করে মজিলপুরে বাবু পুতুল বানানো শুরু হয়েছিল, সেগুলো এখনও জনপ্রিয়। তবে এই পুতুল গুলো তে কালিঘাট এর পটের প্রভাব রয়েছে।
Manab Mondal
দারুন লাগলো।
ReplyDelete